Friday 31 December 2010

গ্যাসের নতুন সংযোগ বন্ধ। এলপিজির দাম বাড়ছে, সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই জ্বালানিসংকট সারা দেশে













সিলিন্ডারে এলপি গ্যাসের চাহিদা দিন দিন বাড়ছেই। কিন্তু এই গ্যাসের বাজারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই

ছবি: প্রথম আলো

অরুণ কর্মকার | তারিখ: ০১-০১-২০১১

দেশজুড়ে ঘনীভূত জ্বালানিসংকট ক্রমান্বয়ে তীব্রতর হচ্ছে। গ্যাসের স্বল্পতায় বিদ্যুৎ-সার-শিল্প উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। লাইনে চাপ কম থাকায় অনেক এলাকার বাসাবাড়িতে চুলা জ্বলে না। পাইপলাইনে গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়া সরকার বন্ধ রেখেছে। তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসও (এলপিজি) দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য। সিএনজি স্টেশনেও রেশনিং করা হচ্ছে চাহিদার তুলনায় উৎপাদনের স্বল্পতার কারণে। এই পরিস্থিতিতে দেশের শিল্প-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক কার্যক্রম যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনই দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে, ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা শহর পর্যন্ত দেশের সিংহভাগ মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির নিশ্চিত সংস্থান নেই। মানুষের হাতের কাছে কোনো কার্যকর বিকল্প জ্বালানিও নেই। সরকারি-বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, পাইপলাইনে সরবরাহ করা গ্যাসের সর্বমোট গ্রাহকসংখ্যা ২০ লাখের কম। আর জ্বালানির স্বল্পতার কারণে যে পরিমাণ উৎপাদন ব্যাহত হয়, তার আর্থিক মূল্য মোট দেশজ প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) প্রায় দুই শতাংশের সমান। এই সংকট থেকে উত্তরণে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অবহেলা, অদক্ষতা ও অপরিণামদর্শিতা জ্বালানি খাতকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে এসেছে। গৃহস্থালী কাজে ব্যবহারের জন্য এলপিজির ব্যবহার বাড়ানো এবং তা সহজলভ্য করার ব্যাপারে সরকার আলোচনা করছে। পেট্রোবাংলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডের (এলপিজিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কুদরত-ই-এলাহী বিষয়টি সম্পর্কে প্রথম আলোকে বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারি সম্প্রসারণ করে দেশে এলপিজির উৎপাদন বর্তমানের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বাড়ানোর পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। বেসরকারি খাতের অন্যতম প্রধান কোম্পানি ক্লিনহিটের মহাব্যবস্থাপক সাইদুল ইসলাম বলেন, সরকার এলপিজি, সিলিন্ডারসহ খুচরা যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর থেকে শুল্ক ও কর কমালে সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব। পাইপলাইনের গ্যাস: চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় পাইপলাইনের গ্যাস ব্যবহারকারী সব শ্রেণীর গ্রাহক সংকটে আছে। প্রয়োজনীয় গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে ৫০০ মেগাওয়াটেরও বেশি। বছরের অধিকাংশ সময়ে সার কারখানাগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদনে থাকে না। এ কারণে আমদানি করে সারের ঘাটতি পূরণ করতে হয়। গ্যাসের অভাবে শিল্প উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। তা ছাড়া, সরকারি-বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, গ্যাসের সংযোগ না পাওয়ায় প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন শুরু হতে পারছে না। গ্যাসের অভাবে সিএনজি স্টেশনগুলোতে রেশনিং করা হচ্ছে। এর পরও ঢাকা মহানগরসহ দেশের অধিকাংশ স্থানে বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাপ কম থাকায় চুলা জ্বলে না। বর্তমানে পাইপলাইনে সরবরাহ করা গ্যাসের ১২ শতাংশেরও কম (২৩ কোটি বা ২৩০ কোটি ঘনফুট) ব্যবহূত হয় গৃহস্থালী পর্যায়ে। এই শ্রেণীর অনেক গ্রাহক গ্যাসের নতুন সংযোগের জন্য আবেদন করে অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু গ্যাসের নতুন সংযোগ বন্ধ রাখা এবং প্রত্যন্ত এলাকায় গ্যাসের চাপ না থাকায় পুরোনো গ্রাহকদেরও অনেকে এলপিজি ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তা ছাড়া, দেশের যেসব শহরে পাইপলাইনের গ্যাস সরবরাহ নেই, সেখানেও জ্বালানি হিসেবে এলপিজিই জনপ্রিয়। কিন্তু এলপিজির উৎপাদন, আমদানি, সরবরাহ, বাজার সম্পূর্ণ অস্থিতিশীল। কার্যকর বিকল্প এলপিজি: পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও জ্বালানিসংকটের কার্যকর বিকল্প হতে পারে এলপিজি। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, এমনকি সৌদি আরবেও রান্নাসহ গৃহস্থালী কাজে এলপিজির ব্যবহার প্রায় শতভাগ। এ ছাড়া যানবাহন চালানোর কাজেও এই গ্যাস ব্যবহার করা যায় এবং বাংলাদেশেও সীমিত আকারে করা হচ্ছে। পাইপলাইনে সরবরাহ করা গ্যাসের পরই জ্বালানি হিসেবে এলপিজি মূল্যসাশ্রয়ী। কিন্তু এখানে এলপিজির উৎপাদন খুব কম। মূলত এই গ্যাসের সরবরাহ আমদানিনির্ভর। চাহিদা ও সরবরাহ: বাংলাদেশে এলপিজির চাহিদা সম্পর্কে সরকারি বা বেসরকারি খাতের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। তবে সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বছরে অন্তত এক লাখ টন (সাড়ে ১২ কেজির ৮০ লাখ বোতল বা কনটেইনার) এলপিজির চাহিদা দেশে রয়েছে। কিন্তু সরবরাহ এর অর্ধেকেরও কম। সরকারি খাতের ইস্টার্ন রিফাইনারি এলপিজি উৎপাদন করে আমদানি করা তেল থেকে এবং এলপিজিএল উৎপাদন করে সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানির গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাওয়া এনজিএল থেকে। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত এলপিজির পরিমাণ বছরে ১২ লাখ বোতলের বেশি নয়। চাহিদার বাকি অংশ বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বেসরকারি খাতের পাঁচটি কোম্পানি বছরে মাত্র ৪০ হাজার মেট্রিক টনের মতো (সাড়ে ১২ কেজির ৩২ লাখ বোতলের সমান) এলপিজি আমদানি করে। তাই চাহিদার তুলনায় দেশে এলপিজির ঘাটতি থাকে সারা বছর। ফলে অপরিহার্য এই পণ্য সাধারণ মানুষের কাছে বছরজুড়েই দুষ্প্রাপ্য হয়ে থাকে। খাঁড়ার ঘা: এমনিতেই চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অর্ধেকের কম, তার ওপর কৈলাশটিলার এলপিজি প্ল্যান্টে উৎপাদন হচ্ছে কম। কয়েক দিনের মধ্যে সেখানকার উৎপাদন অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ থাকবে। (এলপিজিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, কৈলাশটিলা প্ল্যান্টের কাঁচামাল (এনজিএল) আসে সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানির ক্ষেত্র থেকে। এই কোম্পানি বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ করা হয়েছে। এই কাজ শেষ হতে আরও প্রায় তিন সপ্তাহ লাগবে। এখন পর্যন্ত মজুদ করা এনজিএল দিয়ে প্ল্যান্টটি সীমিত আকারে চলছে। আরও কয়েক দিন চলবে। বাজারে সরকারি এলপিজির সরবরাহ কম হলেই বেসরকারি এলপিজির দাম বেড়ে যায় হু হু করে। দেশে উৎপাদন কমার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও গত নভেম্বর থেকে এলপিজির দাম বাড়তে বাড়তে বর্তমানে সর্বকালের সর্বোচ্চ হয়েছে বলে জানা গেছে। দেশের বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সূত্রে এবং ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা গেছে, ডিসম্বের মাসে এলপিজির উপাদান প্রোপেনের দাম উঠেছে প্রতি মেট্রিক টন ৯০৫ মার্কিন ডলার। বুটেনের দাম উঠেছে ৯৪৫ ডলার। বাংলাদেশে এলপিজির জন্য বুটেন ব্যবহার করা হয়। বড় অভিযোগ দামে: সরবরাহরে স্বল্পতার পাশাপাশি ঢাকাসহ সারা দেশে এলপিজি ব্যবহারকারীদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ, দামের অস্থিতিশীলতা। এ ক্ষেত্রে দেখার কেউ নেই। সরকারি খাতের এলপিজির দাম খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে নির্ধারণ করা আছে সাড়ে ১২ কেজির বোতল ৭০০ টাকা। কিন্তু গ্রাহক কখনোই এই দামে পান না। কিনতে হয় এক হাজার ২০০ টাকায়। বেসরকারি খাতের এলপিজিরও দাম নির্ধারিত আছে এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকার মধ্যে। কিন্তু তাও এই দামে পাওয়া যায় না। কখনো কখনো তা কিনতে হয় দেড় হাজার টাকা দিয়ে। সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানিগুলোর এলপিজি বিক্রি করার জন্য সারা দেশে নির্ধারিত ডিলার আছে। দেশের নানা স্থান থেকে পাওয়া গ্রাহকদের অভিযোগ হচ্ছে, এই ডিলার এবং তাঁদের নিয়োজিত খুচরা বিক্রেতারা কারসাজি করে দাম বাড়ান। অপরদিকে ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা বলেন, দাম বাড়ানো-কমানো সবই কোম্পানির হাতে। কোম্পানির নির্দেশে তা হয়ে থাকে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সরকারি এলপিজির দাম বাড়ার কথা নয়। কারণ ওই দাম সরকারের নির্ধারিত। কেউই এককভাবে নির্দেশ দিয়ে ওই দাম বাড়াতে পারে না। তার পরও সেটাই যখন ঘটে, তখন কারসাজি করা হয় বলে গ্রাহকেরা যে অভিযোগ করেন, তাই সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়। ঢাকার বাজার: মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক এলাকায় পাইপলাইনে গ্যাসের সরবরাহ থাকলেও প্রায় সারা দিনই গ্যাসের চাপ থাকে না। তাই রান্নার জন্য ওই এলাকার অনেকেই এখন এলপিজি ব্যবহার শুরু করেছেন। এ রকম একজন মাহমুদ আলী বলেন, নভেম্বরে যে সিলিন্ডার এক হাজার ২০০ টাকায় কিনেছিলেন, ডিসেম্বরে তা এক হাজার ৪৫০ টাকা। ঢাকা মহানগরের চারপাশে নতুন করে বাড়িঘর ওঠা এলাকাগুলোতে গৃহস্থালীর প্রয়োজনে এলপিজির ব্যবহার ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। কিন্তু এই গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়ায় এবং দেশের অন্যান্য শহরের তুলনায় ঢাকায় এলপিজির দাম বেশি হওয়ায় গ্রাহকেরা বিপদে আছেন। সারা দেশের অবস্থা: দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর এবং গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের বক্তব্য অনুযায়ী, সর্বত্রই এলপিজির সরবরাহ কম এবং দাম বেশি। রাজশাহী থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, গত চার মাসে সেখানে প্রতিটি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বেড়েছে ৩০০ টাকারও বেশি। একটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক অমলেন্দু পাল জানান, গত রমজানের আগে যে সিলিন্ডারের দাম ছিল ৯৮৫ টাকা, তা নভেম্বরে হয় এক হাজার ২৫ টাকা। ডিসেম্বরের শুরুতে হয় এক হাজার ৮৫ টাকা। এখন এক হাজার ২০০ টাকা। রংপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সেখানে সরকারি কোম্পানির এলপিজি পাওয়া যাচ্ছে না। বেসরকারি কোম্পানির সিলিন্ডার পাওয়া গেলেও দাম বেশি। কয়েক দিন আগেও যে সিলিন্ডারের দাম ছিল এক হাজার ২২০ টাকা, এখন তা এক হাজার ২৮০ টাকা। খুলনা থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, খুলনা অঞ্চলে প্রায় তিন লাখ সিলিন্ডারের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খাতের সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয় নয় হাজার। এখন বাজারে সরবরাহ যেমন কম, তেমনই ঘন ঘন দাম বাড়ার কারণে অনেকেই রান্নার কাজে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার শুরু করেছেন। বরিশাল অফিস জানায়, সাত দিন আগে যে সিলিন্ডার বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৭০ টাকায়, এখন তার দাম এক হাজার ২২০ টাকা। সরকারি কোম্পানির সিলিন্ডারের সরবরাহ গত কয়েক দিনে এক হাজার ৬০০ থেকে কমে ৪০০তে নেমেছে। ফরিদপুর অফিস জানায়, জেলার প্রায় ১০ হাজার এলপিজি গ্রাহক চরম বিপাকে পড়েছেন। গ্যাস সিলিন্ডারের দাম উঠেছে এক হাজার ২০০ টাকার ওপরে। শহরের স্টেশন রোডের বাসিন্দা দুই গৃহবধূ খাদিজা বেগম ও রাবেয়া ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে খড়ির দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়তে থাকলে আমাদের আর রান্না করে খাওয়ার উপায় থাকবে না। সরকার কি আমাদের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্তদের এই সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাবে না?’ যশোর অফিস জানায়, গ্যাস সিলিন্ডারের দাম উঠেছে এক হাজার ২৩০ টাকায়। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর বাজার তদারকি সেল থাকলেও দাম নিয়ন্ত্রণে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। শহরের রবীন্দ্রনাথ সড়কের খুচরা গ্যাস বিক্রেতা সাহাবুদ্দিন বলেন, তিনি ক্লিনহিটের প্রতিটি সিলিন্ডার এক হাজার ১৮০ টাকায় কিনে এক হাজার ২৩০ টাকায় বিক্রি করছেন। বগুড়া, কুমিল্লা, ফেনী ও সিরাজগঞ্জ থেকে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক এবং দিনাজপুর ও পাবনা অফিস থেকেও এলপিজি সম্পর্কে একই তথ্য জানানো হয়েছে।

No comments:

Post a Comment