Monday 31 October 2011

দুর্নীতির অভিযোগে চাপের মুখে সরকার



বশীর আহমেদ
দাতা সংস্থা এবং উন্নয়ন সহায়তাদানকারী দেশগুলোর পক্ষ থেকে দুর্নীতির প্রকাশ্য অভিযোগ ওঠায় রীতিমত চাপের মুখে পড়েছে সরকার। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ব্রিটেনের মতো উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর পক্ষ থেকে বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হচ্ছে। সর্বশেষ পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ এবং পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিত ঘোষণা করায় বেকায়দায় পড়েছে সরকার। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো দাতা সংস্থার দুর্নীতির এমন প্রকাশ্য অভিযোগ এর আগে কখনও আসেনি। বিষয়টি নিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, বিদ্যুত্ খাতসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারের সীমাহীন আর্থিক দুর্নীতির ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ তোলা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তা উপেক্ষা করা হয়েছে। যেসব মন্ত্রী ও উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি একজন সম্পাদকও টকশোতে বলেছেন, বিভিন্ন প্রকল্পের কমিশনের টাকা লন্ডন আমেরিকার কোন কোন জায়গায় ভাগ-বাটোয়ারা হয় সে কথাও আমরা জানি।
এখন বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে সরকারকে। শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে দুর্নীতির সনদ নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইন্দ্রাবতী মুলায়নীর সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বৈঠকের সময়ে তাকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতির সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক সব ধরনের সহায়তা স্থগিত রাখবে। বিশ্বব্যাংকের এ পদক্ষেপের কথা যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী নিউজ ওয়ার্ল্ডকে বলেছেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ব্যাপারে সুস্পষ্ট অভিযোগের কথা বলেছে। তারা বলেছে, এ দুর্নীতির ব্যাপারে তাদের কাছে ৭টি প্রমাণপত্র রয়েছে। তবে তারা এগুলো আমাকে দেখায়নি। তদন্ত কমিশনের কাছে এগুলো দেয়া হবে বলে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।
পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এ অভিযোগ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বিবিসিকে বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ দিতে দেরি করছে বিশ্বব্যাংক। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমরা বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তারা বলেছেন, বাংলাদেশে যে দুর্নীতি হচ্ছে তার অভিযোগ আমরা পাচ্ছি। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ দিতে দেরি করলে আমরা অর্থের বিকল্প উত্স খুঁজব। এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর কানাডা পুলিশ কানাডায় অবস্থিত এসএনসি-লাভালিন গ্রুপের একাধিক অফিসে অভিযান চালায়। দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র উদ্ধারের জন্য এ অভিযান চালানো হয়। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতিবিরোধী ইউনিটের অনুরোধেই কানাডা পুলিশ এ অভিযান চালায়। এসএনসি-লাভালিন (ঝঘঈ-খধাধষরহ) পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের পরামর্শক নিউজিল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মনসেল-এইকমের একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি।
পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার কথা। বিশ্বব্যাংকের এ দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করার কথা বলছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বিবিসিকে জানিয়েছেন, বিষয়টি তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং এ দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চেয়ে বিশ্বব্যাংকের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছেন ঢাকায় নিয়োগপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা। গত মাসে সিনেটের ফরেন রিলেশন কমিটিতে শুনানিতে নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এ মন্তব্য বিশেষ অর্থবহ। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের দুর্নীতির বিষয়টি যে এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত—এ মন্তব্য তারই প্রমাণ।
বাংলাদেশের দুর্নীতির বিষয়টি যে এখন সবার জানা, তা পরোক্ষভাবে জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত নতুন ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। গত ৩ তারিখ ঢাকায় তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটিশ হাইকমিশনার বলেন, ব্রিটেন বাংলাদেশকে যে উন্নয়ন সহায়তা দেয় তা ব্রিটিশ জনগণের ট্যাক্সের টাকা। সাধারণ মানুষের এ ট্যাক্সের টাকার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে দেয়া অর্থ কোথায়, কিভাবে ব্যয় করা হচ্ছে তা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মনিটরিং করা হবে।
সরকারের দুর্নীতির কারণেই জলবায়ু তহবিলের কোনো অর্থ পাচ্ছে না বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ১০ বিলিয়ন ডলারের যে তহবিল গঠন করা হয়েছে, সেই তহবিল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ পায়নি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বারবার অনুরোধ করার পরও দাতাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। দাতারা বলছেন, সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাদের প্রশ্ন রয়েছে। কোনো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে জলবায়ু তহবিলের তদারকির দায়িত্ব দিলে অর্থ ছাড় করবে দাতারা। সরকার এ প্রস্তাবে রাজি নয়। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল থেকে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে সরকার।

Sunday 2 October 2011

রাষ্ট্রের গোপন কাজ বিদেশির হাতে!


* বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক
* ভারতীয় সংস্থা বাছাই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে
* মধ্যস্থতা করছে আইএফসি
ফারুক মেহেদী
করের স্পর্শকাতর গোপন নথি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ, ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নাম্বার বা টিআইএন সনদ ইস্যুকরণ এবং এর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের তদারকির দায়িত্ব পাচ্ছে বিদেশি একটি সংস্থা। রাষ্ট্রীয় গোপন কাজের জন্য মনোনীত ভারতীয় সংস্থাটি পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য এনবিআরের এ ধরনের কাজ তদারকি করবে। পরে দরপত্রের মাধ্যমে আবারও সংস্থা মনোনয়ন করা হবে। কোনো ধরনের ঋণ সহায়তা না দিয়েই বাংলাদেশি করদাতাদের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জ নিয়ে পরিচালনার শর্তে ভারতীয় সংস্থা মনোনয়ন করছে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন বা আইএফসি। তাও বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে ভারতীয় সংস্থা মনোনয়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রে আইএফসির সদর দপ্তরে সংস্থাটি ভারতীয় চারটি মনোনীত কম্পানির মধ্য থেকে একটিকে নির্বাচন করে তা এ সপ্তাহেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরকে জানাবে। আগামী ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে বেসরকারি কম্পানিটির মাধ্যমে কাজ শুরু হবে। ভারতের কর বিভাগের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় ইনফোসিস সলিউশন নামের ভারতীয় সংস্থাটিই আইএফসির পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে বলে আইএফসি ও এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।
টিআইএন ও রিটার্ন জমা কার্যক্রম বেসরকারি খাতে দেওয়ার কথা স্বীকার করে এনবিআর চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দীন আহমেদ গত শনিবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বেসরকারি কম্পানি মনোনয়নের কাজ করছে আইএফসি। তারাই তা নির্বাচন করবে। আশা করছি, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচিত সংস্থাটি সারা দেশে কাজ শুরু করতে পারবে। প্রথমে তারা টিআইএন ব্যবস্থাপনার কাজ করবে। টিআইএনের তথ্যের সঙ্গে ন্যাশনাল আইডিকে সম্পৃক্ত করা হবে। কম্পানিটির মাধ্যমে পরে রিটার্ন জমার কাজও করা হবে। এটি পরীক্ষা করা হচ্ছে।'
রাজস্ব আহরণের মতো একটি স্পর্শকাতর কাজ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া গোপনীয়তার জন্য হুমকি কি না_এমন প্রশ্নে একমত হয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, 'সিক্রেসির ব্যাপার তো আছেই। তবে তা আমাদের লোকজনের নজরদারিতে থাকবে। তা ছাড়া এনবিআরের মূল কাজ তো শুধু টিআইএন দেওয়া বা রিটার্ন জমা নয়। এনবিআরের প্রধান কাজ অ্যাসেসমেন্ট ও কর আহরণ।'
তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে রাজস্ব খাতের মতো একটি সংবেদনশীল খাতে জড়িত করা বর্তমান আয়কর আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে বলে মন্তব্য করেছেন এনবিআরের সাবেক আয়কর নীতির সদস্য ও কর বিশেষজ্ঞ এস এ জহির মোহাম্মদ। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ব্যক্তির আয়কর রিটার্ন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যখন বেসরকারি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে যাবে, তখন অবশ্যই এর গোপনীয়তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। তা ছাড়া প্রচলিত আইনেই বলা আছে, ব্যক্তির করসংক্রান্ত কোনো তথ্য কোর্টের নির্দেশ বা সরকারি কোনো আইনগত সংস্থার অতিপ্রয়োজন ছাড়া কাউকে সরবরাহ করা যাবে না। এ রকম কর্মকাণ্ড করতে হলে প্রথমে প্রচলিত আইন পরিবর্তন করতে হবে। আইএফসিকে দিয়ে বিদেশি সংস্থা মনোনয়ন করানো হলেও বাস্তবে এর সঙ্গে এনবিআর জড়িত বলেও মন্তব্য করেছেন কর বিভাগের সাবেক এ শীর্ষ কর্মকর্তা।
বেসরকারি বিদেশি কম্পানির মাধ্যমে দেশের কর ব্যবস্থাপনার কাজ করানোর উদ্যোগের কঠোর সমালোচনা করেছেন সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি মোস্তাফা জব্বার। তিনি গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এটা একটা হীনমন্যতা। আমাদের ছেলেরা এখন বিদেশেও ব্যাপক প্রতিযোগিতা করে সফটওয়্যার
ও আইটি সেক্টরে কাজ করছে। সেখানে কেন একটি সাধারণ মানের সফটওয়্যার ও আইটি কাজে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের বদলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে মনোনয়ন করা হচ্ছে, তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। এর ফলে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হবে, তেমনি এ দেশের দক্ষ সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও তারা বঞ্চিত হবে।'
সূত্র জানায়, রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে আধুনিকায়ন করার কথা বলে টিআইএন ও রিটার্ন তদারকির কাজ বেসরকারি খাতে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ বরাবরই এ ব্যাপারে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে এসেছে। অবশেষে এ কাজে সফল হতে যাচ্ছে বিদেশি এই দুই দাতা সংস্থা। টিআইএন ও আয়কর রিটার্ন তদারকির জন্য মনোনীত বেসরকারি সংস্থাটি সারা দেশে ১০০টি ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র স্থাপন করবে। এর মধ্যে ৯৪টি স্থানীয় ব্যবস্থাপনা সেন্টার এবং ছয়টি আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনা সেন্টার। অবশ্য দুটি প্রধান কার্যালয়ও স্থাপন করা হবে এ কাজের সুবিধার জন্য। এসব স্থান থেকে টিআইএন ইস্যুকরণ ও রিটার্ন জমার যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হবে। প্রথমে সংস্থাটিকে টিআইএন সনদ ইস্যুকরণের কাজ দেওয়া হবে। পরে এক বছরের মধ্যে দেওয়া হবে রিটার্ন জমা নেওয়া ও এ-সংক্রান্ত অন্যান্য কাজ।
এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, বেসরকারি সংস্থা নির্বাচনে এনবিআরের সক্ষমতা থাকলেও তা পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার অজুহাতে আইএফসিকে এ কাজে নামানো হয়েছে, যার ফলে আইএফসির নিয়ন্ত্রণাধীন এ কাজে সাড়া দেওয়া সংস্থার বেশির ভাগই বিদেশি এবং বিদেশি সংস্থাগুলোর মধ্যে ভারতীয় সংস্থাই বেশি। প্রাথমিক বাছাইয়ে ২০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করা হয়। পরে আইএফসি মোট পাঁচটি বেসরকারি বিদেশি সংস্থাকে মনোনয়ন দেয়, যাদের মধ্য থেকে একটিকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দিয়ে কার্যাদেশ দেওয়া হবে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চারটিই ভারতীয় মালিকানাধীন। একটি বাংলাদেশি। কম্পানিগুলো হলো_ইনফোসিস সলিউশন, সিএমসি-টেকনোভিস্তা, ইনফো টেক গ্লোবাল বা আইটিজি, টেরা সফট এবং ই ডট জেন। এর মধ্যে ইনফোসিস সলিউশন, টেরা সফট সরাসরি ভারতীয়। সিএমসি-টেকনোভিস্তা ভারতীয় ও বাংলাদেশি যৌথ মালিকানা। ইনফো টেক গ্লোবাল যুক্তরাষ্ট্রের এবং ই ডট জেন বাংলাদেশি মালিকানাধীন। এনবিআরের বদলে কেন আইএফসির হাতে বেসরকারি সংস্থা মনোনয়ন ছেড়ে দেওয়া হলো_এমন প্রশ্নের জবাবে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এনবিআরের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, এনবিআর মনোনয়ন করলে পক্ষপাতে প্রভাবিত হয়ে কোনো পছন্দের সংস্থাকে কাজ দেওয়ার অভিযোগ ওঠার আশংকা ছিল। তাই এনবিআর এ দায়িত্ব নেয়নি। যদি স্বচ্ছতার জন্যই বিশ্বব্যাংকের সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তবে ওই সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্রে বসেই যদি পক্ষপাত করে_এ আশংকার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, আইএফসির মাধ্যমেও পক্ষপাত বা যুক্তরাষ্ট্রে বসেই বিদেশি সংস্থার পক্ষে জোর লবিং থাকতে পারে। তবে আইএফসি বলেছে এরকম আশংকা কম। তাই তাদেরকে নির্বাচন করা হয়েছে বলে যুক্তি দেখান তিনি। তবে তিনি স্বীকার করেন, এ কর্মকাণ্ড বেসরকারি খাতে গেলে সাধারণ করদাতার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতাসহ সব ভিআইপির নথিও হুমকিতে পড়তে পারে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর যে পাঁচটি বেসরকারি সংস্থা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে প্রেজেন্টেশন দিয়েছে, তার মধ্যে আইএফসির পছন্দের তালিকায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ভারতীয় সংস্থা ইনফোসিস সলিউশনের তৈরি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সংস্থাটি মনে করে, তাদের কাজের সুবিধার্থে জড়িত সংশ্লিষ্ট যাবতীয় তথ্যভাণ্ডারে প্রবেশের সুযোগ দেবে এনবিআর এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেবে। তবে ইনফোসিস সলিউশন নিজেই বাংলাদেশের করবিষয়ক তথ্যের গোপনীয়তা ও এর নিরাপত্তা রক্ষা করাকে তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে অভিহিত করেছে। তারপরও সংস্থাটি আশা করছে, যেহেতু তারা ভারতেও একটি বিশ্বস্ত সংস্থা এবং আইএসও সনদপ্রাপ্ত, তাই তারা বাংলাদেশের কর-সংক্রান্ত কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারবে। তাদের প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, গ্রাহকরা বাসায় বসে বা অনলাইনে টিআইএন সনদের জন্য আবেদন করবেন। তবে তার জন্য প্রয়োজনীয় দলিলপত্র নিকটস্থ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রে সরবরাহ করতে হবে। রিটার্ন জমার ক্ষেত্রে অনলাইনে জমা দেওয়া যাবে ঘরে বসেই। তবে রিটার্নের সঙ্গে জড়িত করদাতার আয়-ব্যয়ের যাবতীয় দলিলপত্র এক কপি জমা দিতে হবে নিকটস্থ ব্যবস্থাপনা সেন্টারে। পরে ওই কেন্দ্র থেকে এসব দলিলপত্র পাঠানো হবে আঞ্চলিক কেন্দ্রে। সেখানে তা স্টোরেজ করা হবে। ওই স্টোরেজ অনেক সুরক্ষিত এবং সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরা বসানো থাকবে বলেও ইনফোসিস তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
সূত্র আরো জানায়, কর ব্যবস্থাপনায় কার্যাদেশ পাওয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি একটি টিআইএন ইস্যু করার জন্য সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা সার্ভিস চার্জ নিতে পারবে। সরাসরি তা করদাতার কাছ থেকে নেবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি। এ আয় থেকে এনবিআর কিছুই পাবে না। এ টাকা সরাসরি কাজ পাওয়া সংস্থার অ্যাকাউন্টে জমা হবে। করদাতা অনলাইনে বা ক্রেডিট কার্ডে চার্জ পরিশোধ করবেন। এ কার্যক্রমের ফলে শুধু নতুন করদাতা নয়, পুরনো করদাতা যাঁদের বৈধ টিআইএন রয়েছে বলে দাবি করা হয়, তাঁদেরও নিজেদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিআইএনটি নবায়ন করে নিতে হবে। এতে করে জাতীয় পরিচয়পত্রে যেসব তথ্য রয়েছে, সেটাই স্থান পাবে টিআইএন সার্টিফিকেটে। তবে কম্পানির ক্ষেত্রে যেসব কম্পানি জয়েন্ট স্টক কম্পানিতে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে, ওই নাম্বারসহ টিআইএন নবায়ন করতে হবে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রমের শুরুতে টিআইএন ইস্যু করার পাশাপাশি কম্পানি করদাতার কাছ থেকে উৎসে কর কেটে রাখার সুবিধার জন্য একটি টিডিএন নাম্বার দেবে। তার জন্য ওই সংস্থার কাছে একটি রিটার্নও দাখিল করতে হবে, যেখানে বাংলাদেশি কম্পানি করদাতার যাবতীয় তথ্যও জমা দিতে হবে। এ বিষয়টিও গোপনীয়তার দিক থেকে হুমকিতে পড়তে পারে। আর ব্যক্তি করদাতার রিটার্ন জমা দেওয়া শুরু হলে তার হুমকি তো রয়েছেই। এনবিআর কর্মকর্তারা আরো জানান, ভারতীয় যে সংস্থাই কাজ পাক না কেন, শর্তানুযায়ী বাংলাদেশি কোনো কম্পানিকে সহযোগী হিসেবে নিতে হবে। তবে বাংলাদেশি কোনো কম্পানি ভারতীয় ওই কম্পানিটির সঙ্গে জড়িত হলেও বাস্তবে মূল দায়িত্ব এবং বেশি শেয়ার থাকবে ওই ভারতীয় কম্পানিটিরই। তাই সব ধরনের নিয়ন্ত্রণও থাকবে মূল সংস্থার হাতে

http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&type=gold&data=Natok&pub_no=660&cat_id=1&menu_id=13&ne