Tuesday 31 May 2011

সংবিধান সংশোধন কমিটির নীতিগত সিদ্ধান্ত : এবার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ যাচ্ছে



সংসদ রিপোর্টার
সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকছে না। সংবিধান সংশোধনে বিশেষ কমিটি তাদের সুপারিশে এ বিষয়ে নেতিবাচক প্রস্তাবনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম বিষয়টি ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপে পাওয়া প্রস্তাবনা বিবেচনা করে কমিটির অধিকাংশ সদস্য খসড়া সুপারিশে এটা না রাখার বিষয়ে একমত হয়েছেন। তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর বিধায় কমিটির কয়েকজন সদস্য এক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার ওপর ফেলে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা বিবেচনা করে বিশেষ কমিটি এর আগে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার বিষয়ে একমত হলেও গতকাল অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে এটা নিয়ে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত হয় বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, গতকালের বৈঠকে কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ক (২ক) অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে ‘প্রজাতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মাবলম্বী মানুষ স্ব স্ব ধর্ম পালনে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার পাইবে’ এ ধরনের বক্তব্য সম্বলিত একটি লিখিত প্রস্তাব দেন। খসরু শিরোনামে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ শব্দটি পরিবর্তন করে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’-এর কথা বলেন। কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সদস্য রাশেদ খান মেননও গতকাল পৃথক লিখিত প্রস্তাবনা দেন। অবশ্য রাশেদ খান মেনন দলীয়ভাবেও এর আগে এ ধরনের প্রস্তাব বিশেষ কমিটিকে দিয়েছেন। সদস্যদের এ প্রস্তাবনার পাশাপাশি রাজনীতিক, সাবেক বিচারপতি ও আইনজ্ঞ, পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে কমিটির সংলাপ, ৫ বাম দল, কমিউনিস্ট পার্টি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সঙ্গে মতবিনিময়ের সুপারিশ ও প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। সংলাপে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রধর্ম না রাখার প্রস্তাব এসেছে উল্লেখ করে গতকাল কমিটির একাধিক সদস্য বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনেন। ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম থাকার সুযোগ নেই বলেও কমিটির একাধিক সদস্য মন্তব্য করেন। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের সঙ্গে একমত পোষণ করে রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে ‘স্পর্শকাতর’ উল্লেখ করে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার পক্ষেও মত দেন। পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন আলোচনা করে কমিটির সদস্য ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ এর পরিবর্তে তারা ‘প্রজাতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ/জনগণের ধর্ম ইসলাম’ এমন শব্দগুলো যুক্ত করার সুপারিশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি সুপারিশে হিন্দু, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সমঅধিকারের কথা এবং শিরোনামে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ শব্দের পরিবর্তে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ বা অন্য কোনো বিকল্প শব্দ রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। অবশ্য কমিটি তাদের এ নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করবে। তার পরই এ বিষয়ে তাদের চূড়ান্ত সুপারিশ তৈরি করবে।
প্রসঙ্গত, বর্তমান সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদে রয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে’। আর এ অনুচ্ছেদটির শিরোনাম হচ্ছে ‘রাষ্ট্রধর্ম’। এ বিষয়ে কমিটির সদস্য রাশেদ খান মেনন গতকাল বৈঠকের পর আমার দেশ’র কাছে এক প্রতিক্রিয়ায় সুপারিশে রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ে পরিবর্তন আনার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে গতকাল আলোচনা হয়েছে। কমিটি এ অনুচ্ছেদে ভাষাগত পরিবর্তনের চিন্তা করছে। ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে রাশেদ খান মেনন রাষ্ট্রধর্মের বিপক্ষে বলেও গতকাল আমার দেশকে জানান।
এদিকে গতকালের বৈঠকে কমিটি ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, ১২ অনুচ্ছেদ (চার মূলনীতি) পুনর্জীবিতকরণ, নারী আসন ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০টিতে উন্নীত করা, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণ, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রাখার পাশাপাশি বিচারপতিদের চূড়ান্ত অভিসংশন সংসদের হাতে রাখা, সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণসহ বেশকিছু বিষয়ে তাদের সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে।
কমিটির সুপারিশ অনুসারে সংসদীয় আসন শূন্য হওয়ার বিধান সম্বলিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বর্তমান বিধানের পরিবর্তে কেবলমাত্র অনাস্থা প্রস্তাব, অর্থবিল (বাজেট) ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাজনিত বিষয় ছাড়া অন্য যে কোনো বিষয়ে সংসদ সদস্যরা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন কথা যুক্ত করা হয়েছে।
বিচারপতিদের অভিসংশন বিষয়ে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কার্যক্রম সম্পর্কে বলা হয়েছে, কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তা তদন্তের ভার এই কাউন্সিলের উপরই বর্তাবে। তবে তদন্ত শেষে কাউন্সিলের আর কিছু করার থাকবে না। তাদের দেয়া তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী সংসদই অভিযুক্ত বিচারকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। পরবর্তীতে সংসদের এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করা হবে।
সূত্র জানিয়েছে, কমিটি আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে নির্বাচিত সরকারের অধীনে করা যায় তার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা, শক্তি, জনবল, আর্থিক স্বাধীনতাসহ নির্বাচন কমিশনকে সার্বিক শক্তিশালী করার সুপারিশ করছে। এক্ষেত্রে নির্বাচন চলাকালে নিয়োগ, বদলিসহ যাবতীয় কার্যক্রম কমিশনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এ সময় সরকারের ভূমিকা হবে বর্তমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো। অর্থাত্ ওই সময়ে সরকার রুটিন কাজের বাইরে কিছু করতে পারবে না। কমিটি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সংসদের মাধ্যমে সার্চ কমিটি গঠনসহ কমিশনারের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করার সুপারিশ করবে।
গতকালের বৈঠকে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের আলোকে আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখার সিদ্ধান্ত হলেও কী পদ্ধতিতে এ ব্যবস্থা বহাল রাখা হবে সে বিষয়ে কমিটি কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে কমিটি ৩/৪টি বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাপ করে কমিটি এক্ষেত্রে সিদ্ধান্তে পৌঁছবে বলে সূত্র জানিয়েছে। গতকালের বৈঠকে বিশেষ কমিটি স্বল্পসময়ের মধ্যে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য কমিটির চেয়ারম্যান সাজেদা চৌধুরীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বৈঠকের দিনক্ষণ নির্ধারণের। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর আরেকটি বৈঠক করে কমিটি তাদের চূড়ান্ত সুপারিশ তৈরি করবে

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দলীয় ক্যাডারদের ছড়াছড়ি








বশীর আহমেদ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এখন দলীয় ক্যাডারদের ছড়াছড়ি। শুধু রাষ্ট্রদূত পদে নয়, ফার্স্ট সেক্রেটারি থেকে শুরু করে সহকারী সচিবের মতো মধ্যম ও নিম্নস্তরের কূটনীতিক পদে চলছে চুক্তিভিত্তিতে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ। এ পর্যন্ত ১২ জনকে রাষ্ট্রদূত এবং ১১ জন দলীয় ক্যাডার, ক্যাডারদের স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনকে মধ্যম এবং নিম্নস্তরের কূটনীতিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এদের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছেন যারা অনার্স ও মাস্টার্সে তৃতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত। অনেকে ছিলেন গৃহিণী। কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের কোনো যোগ্যতাই নেই এসব দলীয় ক্যাডারের। এ নিয়ে পেশাদার কূটনীতিকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে চরম হতাশা এবং ক্ষোভ। দলীয় ক্যাডারদের এই নিয়োগের ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, ভারত এবং জাতিসংঘের মতো গুরুত্বপূর্ণ মিশনসহ মোট ১২টি মিশনে দলীয় লোকদের চুক্তিভিত্তিতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
এখন নিচের পদে চলছে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ। ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সহ-সভাপতি ওয়াহিদুর রহমান টিপুকে ম্যানচেস্টারে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই পদে নিয়োগের আগে তার পেশা ছিল রাজনীতি। ঠাকুরগাঁওয়ের সাবেক এক আওয়ামী লীগ এমপির ছেলে শাহেদুর রহমানকে নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনসুলেটে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই পদে নিয়োগ পাওয়ার আগে তার পেশা ছিল রাজনীতি। ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কুয়েত-মৈত্রী হল শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক অপর্ণা পালকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব (কনসুলার) পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে অপর্ণা পাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের ছাত্রী ছিলেন এবং তিনি অনার্স ও মাস্টার্সে তৃতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত।
অপর্ণা পাল এখন কানাডায় পোস্টিং নেয়ার চেষ্টা করছেন।
ছাত্রজীবনে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা মরহুম ওয়াইসুজ্জামানের স্ত্রী মৌসুমী ওয়াইসকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব (বাজেট) নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই পদে নিয়োগ পাওয়ার আগে তিনি একজন গৃহিণী ছিলেন। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মাসুম আহমেদকে নেদারল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসে সেকেন্ড সেক্রেটারি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই পদে নিয়োগের আগে তিনি পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর এপিএস ছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা মরহুম রুহুল আমীনের স্ত্রী আনিসা আমীনকে প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই পদে নিয়োগের আগে তিনি ছিলেন গৃহিণী।
ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী এবং ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্নার স্ত্রী ইরিন পারভীন বাঁধনকে সিঙ্গাপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশনে কাউন্সেলর নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি একজন সরকারি চাকরিজীবী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক মহাপরিচালক ফারুক আমীনের স্ত্রী রওনক আমীনকে থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই পদে নিয়োগ পাওয়ার আগে তিনি ছিলেন গৃহিণী। বিডিআর বিদ্রোহে নিহত এক সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর এপিএস (২) সাইফুজ্জামান শেখরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শামীমা পারভীনকে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে সেকেন্ড সেক্রেটারি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই পদে নিয়োগ পাওয়ার আগে তিনি ছিলেন গৃহিণী।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের পরিচালক এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা মরহুম শিকদার মোহাম্মদ জাহিদুর রহমানের স্ত্রী চৌধুরী সুলতানা পারভীনকে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনসুলেটে কনসল হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই পদে নিয়োগ পাওয়ার আগে তিনি ছিলেন একজন গৃহিণী।
এছাড়া বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুরস্কার হিসেবে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় সাবেক কূটনীতিক তারিক এ করিমকে ভারতে, সাবেক কূটনীতিক আকরামুল কাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এম সাইদুর রহমান খানকে ব্রিটেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। অর্থমন্ত্রীর ভাই ড. আবদুল মোমেনকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। নেপালে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় অযোগ্য ও বিতর্কিত ড. নিমচন্দ্র ভৌমিককে। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে পেশাদার কূটনীতিকদের বাদ দিয়ে চীনে সাবেক কূটনীতিক মুন্সী ফয়েজ, ওমানে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি নূরুল আলম, রাশিয়ায় ড. এসএম সাইফুল হক, পাকিস্তানে মো. সোহরাব হোসেন, ইরাকে মুহাম্মদ কামালউদ্দিন, লিবিয়ায় মুহাম্মদ নুরুজ্জামান এবং শেখ কামালের বন্ধু ও আবাহনী ক্লাবের সাবেক পরিচালক শাহেদ রেজাকে দলীয় লোক হিসেবে কুয়েতে রাষ্ট্রদূত পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। ক্ষমতায় আসতে নানাভাবে সহায়তা করার পুরস্কার হিসেবে এদের রাষ্ট্রদূত করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এছাড়া ১/১১’র অন্যতম প্রধান হোতা লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীকে হাইকমিশনার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় বহাল তবিয়তে রেখেছে বর্তমান সরকার।
দলীয় ক্যাডারদের এই নিয়োগের ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, অতীতে কখনও এভাবে অযোগ্য দলীয় ক্যাডার এবং তাদের আত্মীয়স্বজনদের কূটনীতিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়নি। পেশাদার কূটনীতিকদের বাদ দিয়ে এক্ষেত্রে ঢালাওভাবে যে দলীয়করণ শুরু হয়েছে তাতে অকার্যকর হতে চলেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে মেধাবীরা আর কূটনীতিক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে চাইবে না। এছাড়া দলীয়করণের ফলে কূটনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি কূটনীতির মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।
এদিকে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ নিয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।

সংবিধান সংশোধনে আওয়ামী লীগের প্রস্তাব প্রতারণা : কাদের সিদ্দিকী










স্টাফ রিপোর্টার

কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, সংবিধানে একইসঙ্গে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং ধর্মনিরপেক্ষতা রাখার প্রস্তাবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জনগণের সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। তারা এ প্রস্তাব দিয়েছে শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। কারণ ইসলাম ও বিসমিল্লাহ সংবিধান থেকে তুলে দেয়া হলে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে জিততে পারবে না। আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করতেই তারা সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সামাজিক সংগঠন ‘মুক্তচিন্তা’ আয়োজিত ‘যুুদ্ধাপরাধ ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন হাবিবুর রহমান বীরপ্রতীক, অ্যাডভোকেট হেদায়েত উল্লাহ প্রমুখ।
কাদের সিদ্দিকী বলেন, সংবিধান সংশোধন করা প্রয়োজন। কারণ এ ধরনের জোড়াতালির সংবিধান দিয়ে দেশ চলতে পারে না। সংবিধান সংশোধনে দেশের সব মানুষের সম্মতি প্রয়োজন। কারণ ছোটখাটো পরিবর্তনের ক্ষমতা সংসদের ওপর দেয়া হলেও সংবিধানের আমূল পরিবর্তনের ক্ষমতা কখনও কোনো দেশ সংসদকে দেয়নি। মহাজোট সরকার যদি মনে করে সংসদে তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে যা খুশি তাই করতে পারবে, তবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকার নিজেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে আন্তরিক নয়। প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য এ বিচার নয়, নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য এ বিচার। আর এ কারণেই সরকার বিষয়টিকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে জনগণকে ধৈর্য ধরতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান তারই ইঙ্গিত বহন করে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের যদি নির্যাতনের স্বভাব হয়ে যায় তবে তার হাত থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। কলেজছাত্র লিমনও পায়নি। লিমনকে পঙ্গু করে কারাগারে পাঠিয়ে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তা অমানবিক। দেশের বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ও জজ কোর্ট মিশে একাকার হয়ে গেছে। কাগজ-কলমেই শুধু স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকলে হবে না, বাস্তবেও থাকতে হবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমেরিকার ভাড়াটিয়া ও বাংলাদেশী কুচক্রীরা হত্যা করেছে। ওসামা বিন লাদেন ও বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কথা বলার কোনো অধিকার আমেরিকার নেই। নিরস্ত্র লাদেনকে হত্যা করে তারা এ অধিকার হারিয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারের সমর্থন নির্বাচনের সময়ের চেয়ে অনেকগুণ কমেছে। সরকার কোনো একটি গ্রামের ২ জনকে চাকরি দিতে পারেনি। বর্তমানে দুর্নীতি বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ দিশেহারা। হাজারো প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও সরকার কিছুই পূরণ করছে না

সংবিধান সংশোধন কমিটিতে আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সুপারিশ : বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখা যাবে না








সংসদ রিপোর্টার

সংবিধানে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল না রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন আওয়ামীপন্থী কয়েকজন বুদ্ধিজীবী। তাদের মতে, সংবিধানের চার মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এ বিষয়গুলো রাখা যাবে না। দু’একজন বুদ্ধিজীবী আবার রাষ্ট্রধর্মের বিরোধিতা করলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বহাল রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন। এদিকে বুদ্ধিজীবীদের কয়েকজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংশোধনের জন্য দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তারা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিবর্তন বা সংশোধন একটি রাজনৈতিক সমঝোতা। এ বিষয়ে বড় দুই রাজনৈতিক দল একমত না হয়ে সিদ্ধান্ত নিলে তা অর্থবহ হবে না; বরং এতে সংঘাত-সংঘর্ষ আরও বাড়বে। কেউ কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রস্তাব দেন। একজন বুদ্ধিজীবী বিতর্ক এড়াতে সংবিধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নাম না রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
গতকাল সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটির সঙ্গে মতবিনিময়কালে দেশের এসব বুদ্ধিজীবী তাদের প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। বিশেষ কমিটির সভাপতি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনে ১১টার দিকে এ সভা শুরু হয়ে দুপুর পৌনে ২টা পর্যন্ত চলে। বৈঠকে ২৬ জন বুদ্ধিজীবীকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তাদের মধ্যে ১৯ জন কমিটির সামনে তাদের মতামত তুলে ধরেন। বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সংশোধন, রাষ্ট্রধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, সংবিধানের মূলনীতি, বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা, মৌলিক অধিকার, সংবিধানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও জাতির জনকের নাম অন্তর্ভুক্তি, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের ভোটদান, নারী আসনসহ বিভিন্ন বিষয়ে বুদ্ধিজীবীরা তাদের মতামত তুলে ধরেন।
বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান, সাবেক উপদেষ্টা এএসএম শাহজাহান, টিআইবি চেয়ারপার্সন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা, সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সদস্য সচিব ড. বদিউল আলম মজুমদার, সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, কবি সৈয়দ শামসুল হক, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির (ঘাদানিক) নেতা শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আআমস আরেফিন সিদ্দিক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান অংশ নেন। বিশেষ কমিটির আমন্ত্রণ পেলেও অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা, অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ড. অজয় রায়, সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও কলামিস্ট মাহফুজউল্লাহ অংশ নেননি।
কবীর চৌধুরী : বৈঠক থেকে বেরিয়ে আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেন, বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম এবং ধর্মীয় রাজনীতি সংবিধানে থাকতে পারে না। তিনি ’৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো বাদ দেয়ার সুপারিশ করেছেন উল্লেখ করে বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক রাষ্ট্রধর্ম ও বিসমিল্লাহ সংবিধান থেকে বাদ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও ধর্মের অপব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দেন। তিনি মৌলিক অধিকারের বিষয়টি সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে বলেছেন বলে জানান।
কবীর চৌধুরী জানান, বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আজ মিশ্র প্রস্তাব এসেছে। অনেকে বলছেন এই ব্যবস্থার দরকার নেই। অনেকে বলেছেন দুই মেয়াদের পর এই বিধান উঠিয়ে দেয়া উচিত। তবে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই গুরুত্বপূর্ণ।
আকবর আলি খান : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এটি একটি রাজনৈতিক সমঝোতা। এটার জন্য বড় দুটি রাজনৈতিক দল একমত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করলে কোনো লাভ হবে না বরং সংঘাত আরও বাড়বে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতা করে সংশোধন করা উচিত। এ সরকারের মেয়াদ ৯০ দিন নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও তাদের বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতার পথ বন্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে নির্বাচন পদ্ধতি বলতে যা আছে তাতে জালিয়াতি হয়। এতে সঠিকভাবে জনমত প্রতিফলিত হয় না। এজন্য কী ধরনের নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত তা খতিয়ে দেখতে একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতাই নেই। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনা হওয়া উচিত। তার মতে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে হবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি যদি প্রধানমন্ত্রীর কোনো সুপারিশে একমত না হন তবে তা পুনর্বিবেচনার জন্য মন্ত্রিপরিষদে পাঠানোর বিধান রাখার প্রস্তাব করেছি।
রেহমান সোবহান : আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগসীমার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার কথা বলেছি। তার মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব উপদেষ্টা নির্দলীয় না হোক অন্তত নিরপেক্ষ হতে হবে।
সুলতানা কামাল : অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে রেহমান সোবহানের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি মানুষের পূর্ণ আস্থা নেই। এ অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তবে যতদিন এটা বহাল থাকছে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের মনোনীত করতে হবে। প্রধান বিচারককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার ক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
তার মতে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের ভোটদানের ক্ষেত্রে বাজেট সংক্রান্ত এবং অনাস্থা প্রস্তাবের বিষয়টি বাদ রেখে বাকি বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবার দরকার আছে। তিনি বলেন, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেয়ার বিধান যুক্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ : সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সংবিধানে জাতির জনক ও ঘোষকের নাম যুক্ত করা উচিত নয়। এ বিষয়টি যাতে না থাকে সেজন্য কমিটির কাছে প্রস্তাব রাখা হয়েছে। তিনি জানান, তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্তের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তার মতে, স্পর্শকাতর বিষয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে অন্যদের ইস্যু তৈরির সুযোগ যেন না দেয়া হয়। মুজিবনগর সরকারের ওই দিনটি সংবিধানে থাকলেই চলে। আমি বলেছি, এমন কোনো বিধান রাখা যাবে না যাতে পরবর্তী সরকার এসে তা পরিবর্তন করতে পারে। এছাড়া তিনি সংবিধান সংশোধনে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সমর্থনের স্থলে তিন-চতুর্থাংশ রাখার প্রস্তাব করেছেন।
আবুল মকসুদ বলেন, সংরক্ষিত নারী আসন বাড়ানোর বিরোধিতা করেছি। মনোনয়ন বাড়িয়ে সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছি।
আসিফ নজরুল : অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল তার প্রস্তাবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল চালু রাখার পক্ষে মত দেন। তিনি বলেন, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম এক সঙ্গে থাকতে পারে না। তাই আমি বলেছি, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাখা হলে রাষ্ট্রধর্ম ও বিসমিল্লাহ রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে, অবশ্যই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ থাকা উচিত। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অতিমাত্রায় ক্ষমতা ভোগ করছে মন্তব্য করে আসিফ নজরুল তার প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলেন। তিনি বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে ’৭২ সালের সংবিধানের বিধান হুবহু প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করেন। একই সঙ্গে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদের মতামত নেয়ার বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করেন। তিনি বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি সংসদে উত্থাপনের বিধান রাখার প্রস্তাব দেন।
সৈয়দ শামসুল হক : আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী কবি সৈয়দ শামসুল হক বলেন, রাষ্ট্রধর্ম, বিসমিল্লাহ ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাহাত্তরের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এগুলো সংবিধানে রাখা যাবে না। দুই জেনারেল (জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদ) সম্পূর্ণ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সংবিধানে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এটা ছিল তাদের মতলবি কাজ। এখন সেটা করার তো দরকার নেই। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৭২-এর সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম বাদ রেখে যদি নিজেকে মুসলমান প্রমাণ করতে পারেন তবে এখন কিসের সমস্যা?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নাগরিকদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ সব মৌলিক অধিকার সংবিধানে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। এ বিষয়টি নিয়ে কমিটির কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ৭০ অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিধান আরও নমনীয় করা দরকার বলে আমরা জানিয়েছি।
তিনি রাষ্ট্রধর্মের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, কোনো বিশেষ ধর্মকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হলে স্বাভাবিকভাবেই বৈষম্যের সৃষ্টি হবে।
আরেফিন সিদ্দিক : অধ্যাপক আআমস আরেফিন সিদ্দিক সংবিধান সংশোধনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার প্রস্তাব সমর্থন করেছেন বলে বৈঠক থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের জানান।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের জাতীয় দলিল। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহন করে। তাই এই বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কমিটিতে অভিমত দিয়েছি। এছাড়াও তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্ধারিত ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে সংসদ পুনরুজ্জীবিত করে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করেছি। পাশাপাশি তিনি ৭ মার্চের ভাষণকে সংবিধানে যুক্ত করার প্রস্তাব করেন।
ড. মিজানুর রহমান : ড. মিজানুর রহমান সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে সাংবাদিকদের বলেন, ওই অনুচ্ছেদে লেখা আছে—কোনো নাগরিকের প্রতি অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণ করা যাবে না। এই বিষয়টির সঙ্গে যদি এটি লঙ্ঘন করা হয় তাহলে ওই ব্যক্তি শাস্তিযোগ্য এটা অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে আমি মত দিয়েছি।
এবিএম মূসা : প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে এখনও অস্পষ্টতা রয়েছে। এই খণ্ডকালীন সরকারকে নির্দলীয় বলা হলেও ‘নিরপেক্ষ’ কোথাও উল্লেখ নেই। এই বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য কমিটিকে পরামর্শ দিয়েছি।
শাহরিয়ার কবির : আওয়ামী লীগকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়ে বিশেষ কমিটির বৈঠকে ব্যাপক সমালোচনা করেছেন আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী ও ঘাদানিক নেতা শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেছেন, সংশোধিত সংবিধানে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ রাখার প্রস্তাব দিয়ে দলটি (আওয়ামী লীগ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে বলে জানান তিনি। বৈঠকে শাহরিয়ার কবির উত্থাপিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, উচ্চ আদালত ৫ম সংশোধনী বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে আদি সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণভাবে পুনঃস্থাপিত হয়েছে। ৫ম ও ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ যুক্ত করার বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়, ওই সংশোধনী দুটি ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যার সঙ্গে ইসলামপ্রীতির কোনো সম্পর্ক নেই।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : আওয়ামী বুদ্ধিজীবী সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারও রাষ্ট্রধর্মের বিরোধিতা করে বৈঠকে বলেন, একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিধান আর অন্যদিকে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রাখা সাংঘর্ষিক। তাছাড়া রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান করলে সেটা সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী হবে। তিনি বলেন, সংবিধান শুধু বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক আর বিশিষ্টজনদের জন্য নয়; এর মালিক জনগণ। তাই এটি সংশোধনের আগে তাদের মতামত নেয়ার সুপারিশ করেছি।
এম হাফিজউদ্দিন আহমদ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন আহমদ জানান, একমাত্র তিনিই সবার মতের বিরুদ্ধে প্রস্তাব রেখেছেন। তিনি বলেন, ওই তিনটি (বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মভিত্তিক দল) বিষয়ে আমি তাদের সঙ্গে (বিশেষ কমিটির আমন্ত্রিত) একমত, বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে এগুলোর বিরুদ্ধে বলেছিও। কিন্তু বৈঠকে এবার জানিয়েছি, এখন সংশোধনীতে এসব বাদ দিলে নতুন করে গণ্ডগোল লাগবে, অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ‘বাস্তবতা’ বিবেচনায় বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মভিত্তিক দলের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়ার কথা জানান এম হাফিজউদ্দিন।
আজ সম্পাদকদের মতামত : আজ সকালে বিশেষ কমিটি দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করবে। বিশেষ কমিটির পক্ষ থেকে ২০টি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদককে মতবিনিময়ের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যেসব পত্রিকার সম্পাদকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সেগুলো হলো—প্রথম আলো, আমার দেশ, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ, দৈনিক ইত্তেফাক, ইনকিলাব, দিনকাল, বাংলাদেশ প্রতিদিন, নয়া দিগন্ত, মানবজমিন, আমাদের সময়, জনকণ্ঠ, সমকাল, খবর, ডেইলি স্টার, নিউ নেশন, নিউএজ, ইনডিপেন্ডেন্ট, যায়যায়দিন, সংবাদ, ডেসটিনি, ভোরের কাগজ, নিউজ টুডে ও ডেইলি সান।
এর আগে গত ২৪ এপ্রিল সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটি সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে। ২৫ এপ্রিল প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানায় কমিটি। তবে বিএনপি ওই বৈঠকে অংশ নেয়নি