Tuesday 26 April 2011

নির্বাহী কমিটির সভায় খালেদা জিয়া : মধ্যবর্তী নির্বাচনে সরকারকে বাধ্য করতে আন্দোলনের ঘোষণা














বাছির জামাল ও মাহাবুবুর রহমান

মধ্যবর্তী নির্বাচনে সরকারকে বাধ্য করতে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী এ সরকারকে আর ক্ষমতায় রাখা যাবে না। সরকারকে হঠাতে লংমার্চ, রোডমার্চ এবং জেলায় জেলায় গণমিছিলসহ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়ার কথা তিনি ঘোষণা করেন।
গতকাল রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে অনুষ্ঠিত দলের নির্বাহী কমিটির সমাপনী বক্তব্যে তিনি এ ঘোষণা দেন। এর আগে নির্বাহী কমিটির রুদ্ধদ্বার সভায় নির্বাহী কমিটির সম্পাদক, সদস্য ও জেলা সভাপতিসহ প্রায় অর্ধশতাধিক নেতার বক্তব্য শোনেন তিনি। নেতাদের বক্তব্যের পর রাত পৌনে ৯টার দিকে বেগম জিয়া তার সমাপনী বক্তব্য শুরু করেন।
বেগম খালেদা জিয়া বলেন, মধ্যবর্তী নির্বাচন এখন জনগণের দাবি। এ নির্বাচন আদায়ে সরকারকে বাধ্য করা হবে। তিনি বলেন, নির্বাচনে কারচুপির কৌশল হিসেবেই সরকার ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি চালু করতে চাচ্ছে। এ পদ্ধতি আমরা মানি না। বিএনপি ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি করতে দেবে না। সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলে টালবাহানা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ পদ্ধতি অবশ্যই বহাল থাকতে হবে। তবে বর্তমান প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করার যে পরিকল্পনা নিয়েছে বিএনপি তা মেনে নেবে না। কারণ তিনি দলীয় লোক। নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে বেগম জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশন দলীয়করণ করার যে পরিকল্পনা নিয়েছে বিএনপি তা প্রতিরোধ করবে। দলের সাংগঠনিক অবস্থা সম্পর্কে বেগম জিয়া বলেন, বিএনপিতে এর কথায়, ওর কথায় কমিটি নয়। সবাইকে নিয়ে কমিটি করা হবে। পকেট কমিটি আর সহ্য করা হবে না। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আমি জেলায় জেলায় যাব। সংশ্লিষ্ট জেলা কমিটি কর্মসূচি আশানুরূপ পালন করতে না পারলে সেই জেলা কমিটি তাত্ক্ষণিকভাবে ভেঙে দেয়া হবে। তিনি দলে নতুন প্রজন্মকে গুরুত্ব দেয়ার কথাও উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে তিনি নির্বাহী কমিটিতে কারা সক্রিয় ও কারা নিষ্ক্রিয় তাদের তালিকা তৈরির জন্য ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে দায়িত্ব দিয়ে বলেন, এর আলোকে প্রয়োজনে নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠন করা হতে পারে।
নির্বাহী কমিটির সভায় উপস্থিত সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, খালেদা জিয়া দলকে শক্তিশালী করার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি নির্বাহী কমিটির নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সবক্ষেত্রেই ব্যর্থ। এজন্য তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জনগণ আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিতে তাদের ষড়যন্ত্র রুখতে হলে সংগঠনকে শক্তিশালী করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। কারণ জনগণের ভোটকে রক্ষা করতে হলে শক্তিশালী সংগঠন অবশ্যই প্রয়োজন।
খালেদা জিয়া এজন্য নিজেদের মধ্যে দলাদলি, চক্রান্ত, ল্যাংমারা ইত্যাদি বাদ দিয়ে এক হয়ে দলকে শক্তিশালী করায় মনোনিবেশ করতে নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি পৌর নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বলেন, আপনারাই বলেছেন, সংগঠন শক্তিশালী বলে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনায় দল ভালো করেছে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলে বরিশাল অঞ্চলে দল ভালো করতে পারেনি। প্রার্থীকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দলকে শক্তিহীন করলে কোনো লাভ হবে না।
২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির পঞ্চম কাউন্সিল অধিবেশনের পর ৩৮৬ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। ২০১০ সালের ৩১ জুলাই নতুন নির্বাহী কমিটির প্রথম সভা হয়। এটি হচ্ছে দ্বিতীয় সভা।
রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় নির্বাহী কমিটির এ সভা শুরু হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বেগম খালেদা জিয়া। প্রথমে উদ্বোধনী পর্ব হয়। এতে খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বক্তব্য রাখেন। এর আগে লন্ডনে চিকিত্সাধীন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বাণী পড়ে শোনানো হয়। বাণীটি পাঠ করেন বিরোধীদলীয় নেতার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল।
পরে দুপুর সাড়ে ১২টায় শুরু হয় রুদ্ধদ্বার সভা। মহানগর নাট্যমঞ্চ মিলনায়তনে নির্বাহী সভার মূল মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গনি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এমপি, তরিকুল ইসলাম, এম কে আনোয়ার এমপি, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার এমপি, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আসম হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
১৯ সদস্যের মধ্যে তারেক রহমান লন্ডনে চিকিত্সাধীন এবং সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কারাগারে থাকায় সভায় উপস্থিত হতে পারেননি। এছাড়াও এম. শামসুল ইসলাম, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান এবং গয়েশ্বর চন্দ্র রায় অনুপস্থিত ছিলেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান জানান, তিনি অসুস্থ। সবেমাত্র হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। এজন্য নির্বাহী কমিটির সভায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় এম. শামসুল ইসলাম ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। সভায় উপস্থিত ছিলেন নির্বাহী কমিটির ৩৮৬ জন সদস্য ছাড়াও সহ-সভাপতি, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টাসহ কাউন্সিলর ও ৭৪ জেলা কমিটির সভাপতিরা। কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে নির্বাহী সভার উদ্বোধনী পর্বের সূচনা হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন দলের প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক।
পরে দলের মহাসচিব মরহুম খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার লে. জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলী, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আলহাজ কমরউদ্দিন আহমেদ, সাবেক হুইপ জাহেদ আলী চৌধুরী, সাবেক কোষাধ্যক্ষ শাহ আলম, চট্টগ্রাম মহানগরের সিনিয়র সহ-সভাপতি দস্তগীর চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা কফিল উদ্দিন মাহমুদ, মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী, শিল্পী কলিম শরাফী, শাহ আবদুল করিম, সাহিত্যিক আবদুল মান্নান সৈয়দ, চিত্রপরিচালক শিবলী সাদিক, আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী ও লুত্ফুল হাই সাচ্চু, ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট কোরাজন একুইনো, হলিউডের অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেইলর, সাংবাদিক অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক পথিক সাহাসহ গত ৯ মাসে মারা যাওয়া দলীয় নেতাকর্মী, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে একটি শোকপ্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। শোক প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। পরে মরহুম নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়।
বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া নির্বাহী কমিটির সমাপনী বক্তব্যে দলের প্রতিটি নেতাকর্মীকে গণমাধ্যমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সরকারের ব্যর্থতা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। কারণ, বর্তমান গণমাধ্যমের অধিকাংশই সরকারি দলের তোয়াজে ব্যস্ত। এজন্য জনগণ প্রকৃত সংবাদ পাচ্ছে না। জনগণকে সরকারের প্রতিটি ব্যর্থতার কথা জানাতে হবে। তাহলে আমরা যে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তুলেছি, তাতে জনগণ অংশ নেবে।
তিনি দ্রব্যমূল্য, পানি, গ্যাস সঙ্কটসহ বিভিন্ন সঙ্কট নিরসনে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতার কথা নিজেদের জেনে জনগণকে জানানোরও নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি সরকারের নিষ্পেষণে অতিষ্ঠ জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্যও নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। সঙ্কট উত্তরণে জনগণকে ভরসা দিতে হবে। সরকারি দল ও প্রশাসনের নির্যাতনের জবাব দিতে হবে সংগঠনকে শক্তিশালী করে, মাঠে কর্মসূচি পালন করে। নিজেদের মধ্যে দলাদলি থাকলে কখনোই শক্তিশালী হওয়া যায় না।
খালেদা জিয়া কে ত্যাগী আর কে বেঈমান—সবকিছু বিবেচনা করেই কমিটি দেয়া বলে জানিয়ে বলেন, তবে তা হতে হবে শক্তিশালী ও আন্দোলনের জন্য উপযুক্ত। যারা পদ পেয়েও দলে নিষ্ক্রিয়, কাজ না করে শুধু ঘোরাঘুরি করছেন, তারা কাজ করুন। এ প্রসঙ্গে তিনি নির্বাহী কমিটিতে কারা সক্রিয় ও কারা নিষ্ক্রিয় তাদের তালিকা তৈরির জন্য ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে দায়িত্ব দেন। এ তালিকা অনুযায়ীই কেউ কমিটিতে থাকবে কেউ বাদ যাবে উল্লেখ করে বলেন, যারা বাদ যাবেন তারা যেন মন খারাপ না করেন। আর যারা থাকবেন তারা নিজ যোগ্যতা বলেই টিকেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, এই অংশকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন হতে দেয়া হবে না। সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা হবে।
এর আগে সকালে উদ্বোধনী বক্তব্যে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচানোর লড়াইয়ের দায়িত্ব পড়েছে বিএনপির ওপর। আজ দেশ ও জনগণ বিপন্ন। বর্তমান সরকারের অপশাসন, অযোগ্যতা, ব্যর্থতা ও নিপীড়নে জনগণ ক্ষুব্ধ ও পরিবর্তনের প্রত্যাশায় অধীর। তাদের সংগঠিত করে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা বিএনপির আছে। তাই জনগণের এই দুঃসময়ে আমাদের আরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নিজেদের মধ্যকার বিভেদ ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়া তার উদ্বোধনী বক্তব্যে সরকারের অপশাসন ও নানা ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেন। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা, শেয়ারবাজার বিদ্যুত্-গ্যাস-পানি সঙ্কটে জনগণের চরম দুর্ভোগের চিত্র বর্ণনা করে তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণ দিশেহারা। ১০ টাকায় চাল ও বিনামূল্যে সার দেয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা সরকারি দল আজ অস্বীকার করছে। ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার মতো চটকদার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা বেকার জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করেছে। দেশ-বিদেশে শ্রমিক চাকরি হারাচ্ছেন। বিনিয়োগ নেই বলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। ২০০৬ সালের ১৭ টাকার কেজির চাল এখন ৪০ টাকার ওপরে। একই অবস্থা ডাল, তেল, মাছ ও মাংসে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও সাংঘাতিক অবনতি ঘটেছে বলে উল্লেখ করে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, দেশের সীমান্ত আজ অরক্ষিত। ফেলানীর লাশ সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকে। তাঁবেদার সরকার এ ঘটনার প্রতিবাদ করারও সাহস পায় না। নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ সরকার গদি রক্ষার জন্য সব অন্যায় মেনে নিতে পারে। কিন্তু যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনকারী এদেশের জনগণ কারও আগ্রাসনের কাছে নতিস্বীকারে রাজি নয়। দেশের জনগণ বর্তমান সরকারের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ। তারা ক্রোধে ফুঁসছে। কাজেই জনস্বার্থে গৃহীত সব কর্মসূচিতে আমরা জনগণকে পাশে পাব।
খালেদা জিয়া আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, যত দিন যাবে, আন্দোলন ও বিজয়ের মূলশক্তি হবে দলের সাংগঠনিক ঐক্য এবং জনগণের সমর্থন। আমরা যত বেশি ও দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হতে পারব, ততই আমাদের প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়বে। এজন্য দলের ঐক্য ও সংহতি জোরদার করার তাগিদ দেন চেয়ারপার্সন।
দীর্ঘ বক্তব্যে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে প্রতিবেশী দেশ ও কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে যারা লাভবান হয়েছে, তাদের আগামীতে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। একই সঙ্গে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদেরও আগামীতে বিচার করার কথা বলেন তিনি।
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। সরকারবিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও হয়রানি করে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুপ্ত হত্যা ও মানুষ গুম করার মতো নৃশংসতা।
নোবেল পুরস্কারবিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর সরকারের প্রতিহিংসার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। খালেদা জিয়া বলেন, এখন আর শুধু প্রতিবাদ করলে চলবে না, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে সব অন্যায়, অবিচার ও নিপীড়নের।
খালেদা জিয়া বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুত্, গ্যাস, পানির অভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গ্রীষ্মকাল শুরু হতে না হতেই যে ভয়াবহ লোডশেডিং শুরু হয়েছে, তাতে আগামী মাসগুলোতে পরিস্থিতি কেমন হবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে কলকারখানা ঠিকমত চলছে না। উত্পাদনের জন্য প্রস্তুত শত শত শিল্প উত্পাদনে যেতে পারছে না। এসবের বেশিরভাগই আমাদের আমলে শুরু হয়েছিল। বিনিয়োগকারীরা প্রতিদিন লোকসান গুনছেন। যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। এই ঢাকা শহরে হাজার হাজার ফ্ল্যাট বাড়ি বসবাসের জন্য প্রস্তুত হওয়া সত্ত্বেও গ্যাস-বিদ্যুত্ সংযোগ না পাওয়ায় শূন্য পড়ে আছে। বিনিয়োগকারী ও যারা এসব ফ্ল্যাট কিনেছেন তারা সবাই নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। অথচ ২০০৬ সালে তো এমন অবস্থা ছিল না।
খালেদা জিয়া তার সরকারের আমলের বিদ্যুত্ পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিনিয়ত মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করে বলেন, আমাদের আমলে নাকি এক মেগাওয়াট বিদ্যুত্ও উত্পাদন করা হয়নি। অথচ বর্তমান সরকারের বিভিন্ন প্রকাশনায়ই স্বীকার করা হয়েছে যে, বিগত জোট সরকারের আমলে ১২৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই হিসেবে শুধু বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড ও তার আওতাধীন কোম্পানিগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে আমাদের সরকারের আমলে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড এবং আরপিসিএলের মাধ্যমে আরও আড়াইশ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছিল। এছাড়াও ১২৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছিল, যার অধিকাংশ অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিয়েছে। এর বাইরেও ২৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের ব্যবস্থা আমরা করে এসেছিলাম।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার এবং তাদের আন্দোলনের ফসল অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেসব বাস্তবায়ন না করে রেন্টাল বিদ্যুত্ উত্পাদনের ব্যবস্থা নিয়েছে। এতে কিছু ব্যক্তি লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জাতীয় অর্থনীতি ও দেশের জনগণ। আমাদের সরকারের আমলে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুত্ উত্পাদন ও সঞ্চালন ব্যয় ছিল ২ টাকা ৩০ পয়সা মাত্র এবং বছরে এই খাতে ভর্তুকি দেয়া হতো ৫-৬শ’ কোটি টাকা। অথচ বর্তমানে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুত্ উত্পাদন ও সঞ্চালনে ব্যয় হচ্ছে ৪ টাকা ৬৮ পয়সা এবং গত অর্থবছরে বিদ্যুত্ খাতে ভর্তুকি দিতে হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এই সরকারের আমলে বিদ্যুতের দাম দুই দফা বাড়ানোর পরও এ বছর ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ে জনগণের কোনো কল্যাণ হয়নি। লোডশেডিং বেড়েই চলেছে। শিল্প-বাণিজ্য-কৃষি কোনো খাতেই অতিরিক্ত কিংবা কম দামে বিদ্যুত্ দেয়া হচ্ছে না। তাহলে লাভবান হলো কারা?
তিনি বলেন, এতদিন পর সরকার গ্যাসকূপ খননের কথা বলছে। এরই মধ্যে নতুন গ্যাস সংযোগ না দেয়ার সরকারি ঘোষণা এসেছে। জনগণকে অনেক বেশি দামে এলপিজি কিনতে হলে তাদের প্রকৃত উপার্জন কমে যাবে। অর্থাত্ জনগণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেখানে গ্যাস নেই, সেখানে গ্যাস দেয়ার সরকারি প্রতিশ্রুতি ভাঁওতা বলেই প্রমাণিত হচ্ছে।
পানি সঙ্কট সমাধানেরও কোনো লক্ষণ নেই, উদ্যোগও নেই। খাল, বিল, নদী, নালা সরকারি দল দখল করে এমন সব প্রতিষ্ঠান গড়ছে যাতে পানি দূষণ বাড়ছে।
তিনি বলেন, গঙ্গার পানি সরবরাহ ক্রমাগত কমতে থাকায় নদীপথ সঙ্কুচিত হওয়ার পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে, নদীপৃষ্ঠ উঁচু হওয়ায় বন্যার প্রকোপ বাড়ছে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চল মরূকরণ দ্রুততর হচ্ছে। এ ব্যাপারেও দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার কোনো সরকারি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরসহ আশুগঞ্জ নৌবন্দর প্রতিবেশী দেশকে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হলো, কিন্তু বিনিময়ে কঠিন শর্তে ও বেশি সুদে কিছু অর্থ ঋণ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। এমনকি তিনবিঘা করিডোর সমস্যারও সমাধান হয়নি। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টিকেও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
বিরোধীদলীয় নেতা কারা নির্যাতিত আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের কথা উল্লেখ করে বলেন, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে নির্যাতনের পাশাপাশি সত্য কথা বলার জন্য আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করেছে এ সরকার।
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান সরকারের হাত থেকে জনগণকে রক্ষায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য সরকারকে অবশ্যই পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে।
তিনি আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, এমন একজন নির্ভীক সম্পাদক ও কলামিস্টের ওপর সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতন দেশবাসী তথা সারাবিশ্বের নজর কেড়েছে।
নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সংগঠন এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৪৩টি পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি হয়েছে। ১০টি বাকি রয়েছে। আশা করি আগামী এক মাসের মধ্যে সবগুলো জেলা কমিটি করা সম্ভব হবে। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব জানান, দলের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অচিরেই শুরু হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিএনপির ওয়েবসাইট উদ্বোধন করেন খালেদা জিয়া। ওয়েবসাইটের ঠিকানা : www.bangladeshnationalistparty-bnp.org
জনগণের সংগ্রামে দেশের বর্তমান দুঃসময় কেটে যাবে—তারেক রহমান : জনগণের সংগ্রামে দেশের বর্তমান দুঃসময় কেটে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন লন্ডনে চিকিত্সাধীন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গতকাল দলের নির্বাহী কমিটির পূর্ণাঙ্গ সভায় পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তারেক রহমান বলেন, আমি দূর থেকে আপনাদের কঠিন সংগ্রামের কথা ভেবে আলোড়িত ও আন্দোলিত হই। আমি সাহসে উদ্দীপ্ত হয়ে ভাবি, এই দুঃসময় কেটে যাবে বীর জনগণের দুর্জয় সংগ্রামে।
এক পৃষ্ঠার লিখিত বাণীটি পাঠ করে শোনান খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান। এ সময় পুরো সভাস্থলে ছিল পিনপতন নীরবতা। ২০০৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উচ্চতর আদালত থেকে জামিন নিয়ে লন্ডনে চিকিত্সার জন্য যান তারেক রহমান। ওই বছরের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে যৌথ বাহিনী গ্রেফতার করে।
বাণীতে তারেক রহমান বলেছেন, জনগণের দুর্জয় সংগ্রামে নতুন সূর্যোদয়ের প্রত্যাশায় আমরা সবাই গভীর অমানিশার প্রহর যাপন করছি। সংগ্রামের প্রস্তুতি ও পথনির্দেশনায় এ সভা সফল হোক।
যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক কমরউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বিবৃতিতে তারেক রহমান বলেন, লন্ডনে তিনি আমার পরম সুহৃদ ছিলেন। অকস্মাত্ তার এই মৃত্যু আমার কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এবং স্বজন হারানোর বেদনার মতো।
তিনি নির্বাহী কমিটির সদস্যদের প্রতি সালাম ও শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, আপনারা যখন এই সভায় মিলিত হয়েছেন, আমি তখন অনেক দূরে বিদেশ বিভূঁইয়ে চিকিত্সাধীন রয়েছি।
তারেক রহমান নির্বাহী কমিটির সফলতা কামনা করেন।

অপহরণ আতঙ্ক দেশজুড়ে : কারও লাশ মেলে, কারও খোঁজ মেলে না








নাছির উদ্দিন শোয়েব

অপহরণ আতঙ্ক দেশজুড়ে! ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, ধনাঢ্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী-শিশু কেউই এ আতঙ্কের বাইরে নয়। মুক্তিপণ ও চাঁদা দাবি, পূর্বশত্রুতার জের ধরে পরিকল্পিতভাবে ঘটছে এসব ঘটনা। অপহরণের ক্ষেত্রে নতুন আতঙ্ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা। এ ধরনের অপহরণের পর গুম-নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আতঙ্কের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। নিখোঁজের পর কারও লাশ পাওয়া যায় আবার কারও খোঁজ মেলে না। সম্প্রতি বেশ ক’জন রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ী অপহৃত হন। দীর্ঘদিন গত হওয়ার পরও তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ওইসব পরিবারের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী সদস্যরা এসব ব্যক্তিকে আটক করে নিয়ে গেছে। রাজশাহীতে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণের তিন দিন পর তার ৯ টুকরো লাশ পাওয়া যায়। এসব ঘটনায় স্বজনহারা পরিবারগুলো চরম উদ্বিগ্ন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপহরণের পর শিশুসহ ১০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, অপহরণের পর কোথাও খুঁজে না পেয়ে থানায় মামলা বা জিডি করার পরও নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অনেকেই অভিযোগ করেন, অপহরণের পর মামলা দায়ের করা হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শিথিলতার সুযোগে দুর্বৃত্তরা হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এমনকি সাদা পোশাকে অপহরণের কোনো ঘটনার বিষয়ে এখন পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী কোনো সংস্থা দায়িত্ব নেয়নি। এসব ব্যক্তির ভাগ্যে কী ঘটেছে তা কেউ জানে না।
কিছু দিন আগে ক্ষমতাসীন দলের এমপি আফজাল হোসেন তার কিশোরী কন্যা তুষাকে অপহরণের অভিযোগে রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলা করেছিলেন। খোদ সরকারি দলের এমপির অপহরণ মামলা দায়েরের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয় পুলিশ প্রশাসনে। হন্তদন্ত হয়ে তদন্তে নামে র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দারা। ঘটনার ১০ দিন পর পুলিশ তুষাকে উদ্ধার এবং অপহরণকারীকে গ্রেফতার করায় স্বস্তি আসে।
পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছেন, পুলিশ-র্যাবের নামে অপহরণের ঘটনা ঘটছে।
এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত নয়। অপরাধীরাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ব্যবহার করছে। এটা অপরাধীদের
একটা কৌশল। যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার তদন্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনা তদন্ত করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, এসব ঘটনায় র্যাব-পুলিশের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি আরও বলেন, এই দুর্বৃত্তদের ধরতে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। র্যাব মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে অপহরণের অভিযোগ সঠিক নয়। র্যাবের নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাসীরা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত দুই বছরে সারাদেশে ১ হাজার ৭২৮টি অপহরণের ঘটনা ঘটে। পুলিশের হিসাবে ২০১০ সালে অপহরণ হয়েছে ৮৭০টি। ২০০৯ সালে ছিল ৮৫৮টি। আগের বছরের চেয়ে গত বছর ১২টি ঘটনা বেশি ঘটেছে। চলতি বছর জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ তিন মাসে ১৮৬টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। জানুয়ারিতে ৪৫, ফেব্রুয়ারিতে ৬৩ ও মার্চে ৭৪টি। তবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, এই চিত্র আরও ভয়াবহ। মানবাধিকার সংস্থার জরিপ অনুযায়ী তিন মাসে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই অপহরণের ঘটনা ঘটেছে শতাধিক।
খোঁজ নেই মুফতি আমিনীর ছেলের : ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির চেয়রম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ছেলে মাওলানা আবুল হাসনাতের সন্ধান মেলেনি ১০ দিনেও। সাদা পোশাকধারীদের হাতে আটক হওয়ার পর থেকেই নিখোঁজ আছেন হাসনাত। আবুল হাসনাত কোথায় আছেন, তিনি জীবিত না মৃত সে ব্যাপারে মেলেনি নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য। এমনকি সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আটক কিংবা গ্রেফতারের দায়িত্ব স্বীকার না করায় হাসনাতের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তার পরিণতির কথা ভেবে চিন্তিত হাসনাতের স্বজনরা। গত ১০ এপ্রিল সূত্রাপুরের টিপু সুলতান রোডে একটি কনফেকশনারি থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য পরিচয় দিয়ে ৬/৭ জন লোক আমিনীর ছেলে মাওলানা হাসনাতকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার আর হদিস মেলেনি। মাওলানা হাসনাতকে যখন অপহরণ করা হয় তখন তার সঙ্গে ছিলেন দুই বন্ধু আবু রায়হান ও হুমায়ুন কবীর। এরা পরে আমিনী ও তার পরিবারের সদস্যদের জানান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তাকে ছাই রংয়ের একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। র্যাব, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দায়িত্বশীল সূত্রগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব সংস্থার কোনো সদস্যই হাসনাতকে গ্রেফতার করেনি। আমিনী অভিযোগ করেছেন, এ ঘটনার পর ছেলের মোবাইল ফোন থেকে তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে।
১১ দিন ধরে নিখোঁজ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী : রাজধানীর সূত্রাপুরে র্যাব পরিচয়ে অপহৃত গার্মেন্ট ব্যবসায়ী তারিক উদ্দিন আহম্মেদ রানার (৩৪) খোঁজ মেলেনি। অপহৃতের পরিবারের সদস্যরা আশঙ্কা করছেন, অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যা করতে পারে। এ ঘটনায় সূত্রাপুর থানায় একটি সাধারণ ডাইরি করেছে রানার পরিবার। রানার বড়ভাই মামুনুর রশীদ জানান, তার ছোট ভাইয়ের নামে থানায় কোনো মামলা বা অভিযোগ নেই। তিনি সদরঘাট ইস্ট বেঙ্গল মার্কেটের কালার প্লাস গার্মেন্টের মালিক। গত ৯ এপ্রিল সূত্রাপুরের লালকুঠি ফরাশগঞ্জ ক্লাব কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত বড় ভাই ইয়াদ আহম্মেদ দিপুর বৌ-ভাতের অনুষ্ঠানে সে উপস্থিত ছিল। বিকেল ৪টার দিকে কমিউনিটি সেন্টারের সামনে রানা এসে দাঁড়ালে ৬/৭ জন সাদা পোশাকের অস্ত্রধারী তাকে টেনে একটি মাইক্রোবাসে তোলে। ওই সময় স্থানীয় লোকজন অজ্ঞাত অস্ত্রধারীদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা নিজেদেরকে র্যাবের লোক বলে দাবি করে। পরবর্তীতে র্যাব-১০-এর কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় র্যাব-১০-এর কমান্ডিং অফিসার এসএম কামাল হোসেন বলেন, রানা নামে কাউকে তাদের কেউ ধরে আনেনি। সূত্রাপুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) আল-মামুন গতকাল জানান, ঘটনার একদিন পরই তিনি ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গেছেন। তবে গতকাল সোমবার পর্যন্ত ব্যবসায়ী তারেককে পাওয়া যায়নি বলে জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
মতিঝিলে ব্যবসায়ী নিখোঁজ ৮ দিন : ফকিরাপুল এলাকার ব্যবসায়ী হারুন অর রশিদ হারুন বাসা থেকে বাজার করার উদ্দেশে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। হারুন অর রশিদের ছেলে মোস্তফা জামান ফরহাদ জানান, গত ১২ এপিল রাত ৮টার দিকে শান্তিনগর বাজারে যাওয়ার উদ্দেশে ৭৮ নম্বর ফকিরাপুলের বাসা থেকে তার বাবা বের হন। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। ফরহাদ বলেন, ১০২ ফকিরাপুলে সম্পত্তি নিয়ে তার এক ফুফার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে তাদের বিরোধ রয়েছে। বাজারে যাওয়ার সময় ওই আত্মীয়ও তার বাবার সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু তিনিও নিখোঁজের ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারছেন না। এ ব্যাপারে মতিঝিল থানায় একটি জিডি করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরেও লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। ফরহাদ আরও বলেন, ঘটনার পর সম্ভাব্য সব স্থানে তারা খোঁজ নিয়েছেন। হাসপাতাল ও মর্গে অনুসন্ধান করেছেন, কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি তার বাবাকে।
চৌধুরী আলম নিখোঁজ ১০ মাস : বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমকে ২০১০ সালের ২৫ জুন ফার্মগেট এলাকা থেকে সাদা পোশাকধারী লোকজন অপহরণ করে। চৌধুরী আলমের ছোটভাই খুরশিদ আলম মিন্টু জানান, রাজনৈতিক কারণে তাকে অপহরণ করা হয়েছে। গত বছরের ২০ জুন ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিত্সাধীন ডিসিসি’র মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে দেখে ফেরার পথে র্যাব পরিচয়ে তাকে উঠিয়ে নেয়া হয়। তার ভাইকে বহনকারী প্রাইভেটকারটি কারওয়ান বাজার ওয়াসা ভবনের বিপরীতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার ছেলে আবু সাঈদ আলম চৌধুরী হিমু বলেন, এ নিয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি অপহরণ মামলা করা হয়েছে। ভাইয়ের মতো র্যাবও আমাকে অপহরণ করার চেষ্টা করছে। ভাইকে হত্যা করা হলে তার লাশ ফেরত দেয়ার দাবি জানান তিনি। হিমু বলেন, সব চেয়ে বেশি কষ্ট, বাবার ভাগ্যে কি ঘটেছে আমরা কিছুই জানি না।
রাজশাহীতে অপহৃত ব্যবসায়ীকে খুন : ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে অপহৃত রাজশাহীর ব্যবসায়ী আমিনুল হকের ৯ টুকরো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১০ এপ্রিল একটি হোটেল থেকে নিখোঁজ হন আমিনুল। এরপর থেকে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ ছিল। পরিবারের দাবি, তাকে অপহরণ করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মহানগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় সাধারণ ডাইরি ও পরে আমিনুলের স্ত্রী সালমা সুলতানা সীমা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার ৩ দিন পর আমিনুল হকের মোবাইল ট্র্যাকিং করে নগরীর আলুপট্টি এলাকার জহির উদ্দিনের বাড়ির নিচতলা থেকে ১২ এপ্রিল রাতে তার ৯ খণ্ড লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশের টুকরোগুলো কয়েকটি বস্তায় রাখা ছিল। পুলিশের ধারণা, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে পরিবারের অভিযোগ, অপহরণের পর মুক্তিপণ হিসেবে ২০ লাখ টাকা নেয়ার পরও তাকে খুন করার ঘটনা রহস্যজনক। এর পেছনে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে।
কয়েকটি আলোচিত ঘটনা : গত ১৪ এপ্রিল যশোরের বড়বাজার ব্যবসায়ী সমিতির নেতা অপহৃত রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে মুল্লুক চাঁনকে ব্যবসায়ীদের চাপে এক ঘণ্টার ভেতরেই উদ্ধার করে পুলিশ। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় এমপি খালেদুর রহমান টিটোর ছেলে ও শ্যালকের নেতৃত্বে একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী তাকে অপহরণ করে। এতে বাধা দেয়ায় সুবল ও জাহাঙ্গীর নামে দুই শ্রমিক সন্ত্রাসী হামলায় আহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বড়বাজার বন্ধ রেখে ধর্মঘট পালন করে। ১৫ এপ্রিল বান্দরবান শহরতলির বেসরকারি পর্যটন রিসোর্ট ‘শাকুরা ভিলেজ’ থেকে ওমর ফারুক নামের এক কর্মচারীকে দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে। অপহরণকারীরা পরে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। আমাদের প্রতিনিধি জানান, অপহৃতকে উদ্ধারে পুলিশ ও সেনাবাহিনী অভিযানে নেমেছে। ১১ এপ্রিল রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়ন থেকে ওই ইউনিয়নের ১০ নম্বর গ্রামের বিক্রম চাকমা (২৯) এবং শিজক ছড়া গ্রামের প্রদীপ চাকমাকে (৪০) অপহরণ করেছে দুর্বৃত্তরা। গত ১৬ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে অপহৃত গৃহবধূ মিনু বেগমকে (২০) পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন তার বোন সোনিয়া আক্তার। মিনু জানান, রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা তাকে আটক করে মোহনগঞ্জ থানায় নিয়ে যায়। থানায় নিয়ে তাকে সন্দেহজনক অপরাধী বানিয়ে পুলিশ নির্যাতন চালায়। এ ব্যাপারে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় একটি খবর ছাপা হয় এবং ১৭ এপ্রিল পুলিশ তাকে কোর্টে চালান না দিয়ে ছেড়ে দিলে তিনি পুরান ঢাকার নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন।
১১ ফেব্রুয়ারি বাড্ডা থেকে অপহৃত ব্যবসায়ী হাবিবুল করিমের (৩৫) লাশ পাওয়া যায় চার দিন পর। পুলিশ জানায়, খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগ এলাকায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি তার হাত-পা বাঁধা পচা লাশ উদ্ধার করা হয়। খিলগাঁও থানার সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) শরিফুল জানান, স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে দুপুর দুটার দিকে সিপাহীবাগের সাহেরুনবাগ এলাকায় নির্মাণাধীন ৭ তলা ভবনের পঞ্চম তলার ফ্ল্যাট থেকে হাবিবুলের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। রাজধানীর শুক্রাবাদের বাসিন্দা ইউসুফ আলী সুজনকে (৩১) অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ উঠেছে র্যাবের বিরুদ্ধে। ৯ মাস ধরে নিখোঁজ সুজনকে অপহরণের অভিযোগে র্যাবের দু’জন সোর্সকে আসামি করে শেরে বাংলানগর থানায় করা মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ। এরই মধ্যে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া এক সোর্সের বরাত দিয়ে সুজনের পরিবার দাবি করেছে, র্যাব-২-এর কিছু কর্মকর্তা এ ঘটনায় জড়িত। সুজনের ভাই ৫১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান গত ১ জানুয়ারি সাংবাদিকদের জানান, আমার ভাইকে র্যাব-২-এর সদস্যরা ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করেছে। তিনি বলেন, বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। পুরান ঢাকার লালবাগ থেকে অপহরণের ৩২ দিন পর পরিবহন ব্যবসায়ী মনির হোসেনকে (৪২) গত ২৭ ফেব্রুয়ারি অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। মনিরের স্বজনরা বলেন, মনিরের শ্যালক ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন (৩০) প্রায় চার মাস ধরে নিখোঁজ। এদিকে সিলেট সদর উপজেলায় অজ্ঞাত পরিচয় দুই তরুণের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সোমবার বিকালে উপজেলার কান্দিরগাঁও ইউনিয়নের ডালুয়া বিল এবং রোববার সন্ধ্যায় জালালাবাদ ইউনিয়নের আলকিনগর গ্রামে লাশ দুটি পাওয়া যায়। সিলেট কোতোয়ালি থানার সহকারী সাব-ইনপক্টর (এএসআই) আবদুর রহিম জানান, ডালুয়া বিলে গলাকাটা লাশটি (২৫) দেখে এলাকাবাসী পুলিশে খবর দেয়। এদিকে আলকিনগর গ্রামের একটি ডোবা থেকে একটি গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশের ধারণা, অন্য কোথাও থেকে এ দু’জনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে।

৫৫ ভাগ কোটায় মেধাশূন্য প্রশাসন






কাদের গনি চৌধুরী

সরকারি চাকরিতে ৫৫ ভাগ কোটা চালু হওয়ায় বঞ্চিত হচ্ছেন মেধাবীরা। ফলে প্রশাসন মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে দলবাজি। মাত্র ৪৫ ভাগ রাখা হয়েছে মেধা কোটা। সেখানেও আবার দলীয়করণ আর তদবির। এতে মেধাবীরা শেষ পর্যন্ত টিকতে পারছেন না প্রতিযোগিতায়। লিখিত পরীক্ষায় টিকলেও কোটার কারণে বাদ পড়ছেন মৌখিক পরীক্ষায়। পিএসসি সূত্রে জানা যায়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদগুলোতে ৫৫ ভাগই নিয়োগ দেয়া হয় নির্ধারিত কোটা পদ্ধতিতে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা এবং উপযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী পাওয়া না গেলে মুক্তিযোদ্ধা/শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পুত্র ও কন্যা ৩০ ভাগ, মহিলাকোটা ১০ ভাগ, উপজাতি কোটা ৫ ভাগ এবং জেলা কোটা ১০ ভাগ হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সাইদুর রহমান আমার দেশকে জানান, তিনি দু’বার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছেন। দু’বারই মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়েছেন। অথচ তারই আরেক ইয়ারমেট তার চেয়ে অনেক খারাপ ফলাফল করার পরও কোটার সুযোগ নিয়ে প্রথমবারই চাকরি পেয়ে গেছেন। সাইদুর তার কষ্টটা প্রকাশ করলেন এভাবে—‘তাহলে ওর চেয়ে বেশি পড়ালেখা ও ভালো রেজাল্ট করে লাভটা হলো কি?’ সাইদুরের মতো এমন অভিযোগ অনেক মেধাবীরই। সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায়ও ঘটেছে একই ঘটনা। পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ, অনেক প্রার্থী ৭০ নম্বর পেয়েও বাদ পড়েছেন। অথচ কোটার সুবাদে অনেকে ৬০ পেয়েই মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাক পেয়েছেন।
কোটা প্রথা তুলে দেয়ার দাবিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনও করেছে ছাত্রছাত্রীরা। পিএসসিও বলছে এতে সংস্কার দরকার। এরপরও কোটা থাকছেই। এ ব্যাপারে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব আশরাফুল মকবুল আমার দেশকে বলেন, কোটা প্রথা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসে গেছে। দানছদকা নিয়ে আর যাই হোক প্রশাসন চালানো যাবে না।
জানা গেছে, প্রতি বছর বিসিএস-এ সাধারণত ৭ হাজার প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত যেতে পারে। এই হিসাবে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রার্থী থাকার কথা ২১০০ জন। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, মৌখিক পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মধ্য থেকে যেতে পারে মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ জন। অথচ মেধা কোটায় ৭ হাজারের মধ্যে ৬ হাজার গেলেও জেনারেল ক্যাডারে চাকরি হয় মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ জনের। ২৯তম বিসিএসে ১ লাখ ২৩ হাজার ৯৪৯ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। এদের মধ্যে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় ৭২১৭ জন প্রার্থী পাস করে। ১৭ আগস্ট থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত মৌখিক পরীক্ষায় ৬৫২৩ জন প্রার্থী অংশ নেয়। অনুপস্থিত ছিল ৬৯৪ জন। এদের মধ্যে ৫০৬২ জন চূড়ান্তভাবে পাস করলেও ক্যাডার পদে নিয়োগ পাচ্ছে মাত্র ১৭২২ জন। পিএসসি সূত্রে জানা যায়, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও শূন্য পদের সংখ্যা কম থাকায় সবাইকে বিসিএস ক্যাডার পদে সুপারিশ সম্ভব হয়নি। অথচ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় লোক না পাওয়ায় ৫৩৮টি পদ খালি থাকছে। এছাড়া উপজাতি ১১১ ও মহিলা কোটায় ৮১টি পদ পূরণ করা যাচ্ছে না। মোট অপূরণকৃত পদের সংখ্যা ৭৯২টি। ২৮তম বিসিএসেও ঘটেছে একই ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধার
সন্তানদের নির্ধারিত কোটায় পূরণ হয়েছে শতকরা ১৯ ভাগ। বাকি ১১ ভাগ এখনও পূরণ হয়নি। ভ্যাট ও রাজস্ব অধিদফতরে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য জানুয়ারিতে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। এতে ১৫২টি পদের কথা উল্লেখ করা হয়। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষাশেষে ফল প্রকাশিত হয় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী শতকরা ৩০ ভাগ হিসাবে ১৫২ জনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান থাকার কথা ৪৫ জন। অথচ পাওয়া গেছে মাত্র ৪ জন। ৪১টি খালি রয়েছে। শতকরা ৫ ভাগ হিসেবে ৭ জন উপজাতির মধ্যে প্রার্থী ছিল না একজনও। সব মিলিয়ে নিয়োগ হয়েছে ১০৪ জনের, আর ৪৮টি পদ পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ২০১০ সালে ২৬২৭ জন নার্স নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য বরাদ্দ ছিল ৭৩৭টি পদ। অথচ পর পর ৩ বার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মাত্র ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পাওয়া গেছে। বাকি ৭১৯টি পদ খালি থাকার পরেও কাউকে নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না।
আগে সরকারি চাকরির যে নীতিমালা ছিল সেখানে বলা ছিল মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা কিংবা উপজাতি কোটায় লোক পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে তা পূরণ করা যাবে। কিন্তু ২০১০ সালে সরকার যে আইন পাস করেছে তাতে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান পাওয়া না গেলে প্রয়োজনে পদ খালি থাকবে। নতুন নিয়মের কারণে বিসিএসসহ সব চাকরির ক্ষেত্রে হাজার হাজার পদ খালি থাকছে অথচ সেখানে মেধাবীরা সুযোগ পাচ্ছেন না ।
সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের ঠাঁই না হওয়ায় সরকারি কর্মকমিশনও উদ্বিগ্ন বলে সেখানকার কর্মকর্তারা জানান। পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদনেও উদ্বেগের কথা ফুটে উঠেছে। সর্বশেষ পিএসসির ২০০৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটা নীতিমালা প্রয়োগে জটিলতার কথা উল্লেখ করে এ পদ্ধতি সরলীকরণের সুপারিশ করা হয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের ২০০৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংসদকার্যে সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা, উপজাতি প্রাধিকার কোটাসমূহ জাতীয় পর্যায়ে বণ্টন করা যেতে পারে। অর্থাত্ প্রাধিকার কোটাসমূহকে পুনরায় জেলা/বিভাগভিত্তিক ভাগ করা যাবে না বা জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্য পদের সর্বোচ্চ সংখ্যা দ্বারা সীমিত করা যাবে না। এ ধরনের কোটার পদসমূহ জাতীয়ভিত্তিক নিজস্ব মেধাক্রম অনুযায়ী কোটায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে বণ্টন করা যেতে পারে। কোটা বণ্টনের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশন মনে করে, বর্তমান কোটা সংক্রান্ত নীতিমালার প্রয়োগ অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ। প্রচলিত পদ্ধতির জটিলতার কারণে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন শতভাগ নিখুঁতভাবে সম্পাদন করা প্রায় অসম্ভব।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিবিধ ক্যাডার, প্রার্থীদের বিবিধ চাকরির পছন্দক্রম এবং বিবিধ কোটার সঙ্গে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগের জন্য আরোপিত সংখ্যাগত সীমা এমন একটি জটিলতার সৃষ্টি করেছে, যার নির্ভুল সমাধান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করা সম্ভব নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন মনে করে, বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত প্রার্থী মনোনয়নের জন্য বর্তমানে প্রচলিত কোটা প্রয়োগ পদ্ধতির সরলীকরণ অপরিহার্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বল্প সময়ে নির্ভুলভাবে বিসিএস পরীক্ষাসহ নন-ক্যাডার, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে পরীক্ষার ফলাফল প্রস্তুত করতে কোটা প্রয়োগ পদ্ধতি সহজ করা প্রয়োজন। অন্যথায় কোটা প্রয়োগ সংশ্লিষ্ট জটিলতা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান আমার দেশকে বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে র্বতমানে যে ৫৫ শতাংশ প্রাধিকার কোটা রয়েছে তা সংবিধান পরিপন্থী বলে আমি মনে করি। কারণ, সংবিধানে মেধাবীদের চাকরি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে। কিন্তু তা কোনোভাবেই মেধা কোটার বেশি হতে পারে না। তাই পিএসসি যে সুপারিশ করেছে অর্থাত্ ৫০ শতাংশ মেধা ও ৫০ শতাংশ প্রাধিকার কোটার মাধ্যমে চাকরির নিয়োগ দিতে হবে, তা খুবই যৌক্তিক। তিনি বলেন, কোটার ব্যাপারে ভারতের সুপ্রিমকোর্টের একটি রুলিং রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, কোটা ৫০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও বলেন, ১৯৭২-৭৩ সালে যখন কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল তখন দেশে জেলার সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭টি। র্বতমানে ৬৪ জেলা হওয়ায় তা বিন্যাস করা খুবই দুরূহ। এর পরিবর্তে বিভাগ হিসেবে আঞ্চলিক কোটা প্রবর্তন করা হলে অপেক্ষাকৃত বেশি মেধাবীরা চাকরির সুযোগ পাবেন।
কোটা ব্যবস্থার অসঙ্গতি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায়ও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ড. আকবর আলি খান এবং সাবেক সচিব কাজী রকিবুদ্দিন আহমাদ ২০০৮ সালের মার্চ মাসে ‘কোটা সিস্টেম ফর সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট : এন এক্সপ্লোরেটার’ শীর্ষক একটি গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেন। ওই গবেষণায় সংবিধান, বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা এবং অন্য দেশের তুলনামূলক অবস্থা পর্যালোচনা করে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে বিদ্যমান অধিকাংশ কোটাকে সংবিধান ও ন্যায়নীতির পরিপন্থী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই গবেষণায়ও বলা হয়েছে, মেধার ভিত্তিতে মাত্র শতকরা ৪৫ জনকে নিয়োগ সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধান বৈষম্যহীনতার কথা বলেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম হিসেবে (যেমন, সমাজের অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য) কোটাকে অনুমোদন করেছে। ব্যতিক্রমী নিয়োগ (শতকরা ৫৫ ভাগ) কখনও সাধারণ নিয়োগের (শতকরা ৪৫ লাভ) চেয়ে বেশি হতে পারে না। পিএসসি এ গবেষণাকর্মটি তাদের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করেছিল।
এতে বলা হয়, সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ নাগরিকদের ‘অনগ্রসর অংশের’ জন্য চাকরিতে বিশেষ কোটা প্রদান অনুমোদন করেছে। কিন্তু সংবিধান ‘অনগ্রসর অঞ্চলের’ জন্য কোনো কোটাকে অনুমোদন করে না। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুসারে এ ধরনের কোটার সুবিধা ভোগ করে অনগ্রসর অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত বিত্তবান ও সচ্ছল শ্রেণী, যাদের অবস্থা অন্যান্য অঞ্চলের অনেক মানুষের চেয়ে উন্নত। ফলে জেলা কোটার সাংবিধানিক ভিত্তি সন্দেহজনক।
গবেষণায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই উল্লেখ করে বলা হয়, এই কোটা কেবল তখনই যৌক্তিক হবে যদি প্রমাণ করা যায় যে, মুক্তিযোদ্ধারা নাগরিকদের মধ্যে অনগ্রসর অংশ। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য এই কোটার ভিত্তি আইনগতভাবে আরও দুর্বল। নারী ও উপজাতি কোটার ব্যাপারে গবেষণায় বলা হয়, সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে নারী ও উপজাতিদের জন্য কোটা সংরক্ষণ আইনসম্মত ও বৈধ। গবেষণাপত্রে বলা হয়, কোনো কোটাই চিরস্থায়ী হওয়া উচিত নয় এবং প্রতিটি কোটার প্রয়োজনীয়তা সময়ে সময়ে পর্যালোচনা করা উচিত।
ড. খান ও রকিবের গবেষণা অনুসারে ১৯৭৭ সালে তত্কালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের প্রায় সব সদস্য সরকারি নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে একমাত্র এম এম জামান কোটার পক্ষে অবস্থান নিলেও প্রচলিত কোটাসমূহ প্রথম ১০ বছর বহাল রেখে ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন। অথচ ১৯৯৭ সালেই এই কোটাব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারিত করা হয় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করে। মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে মুক্তিযোদ্ধা কিংবা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের জন্য সংরক্ষণ করা নানা বিবেচনায় একটি প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত ছিল।
কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাদবাকিদের ওপর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০০৫ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দুই লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জন মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ ২১ হাজার ৩১৮ জন (গড় খানার আকার ৪ দশমিক ৮৫ ধরে)। সে হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানসন্ততির সংখ্যা দেশের জনসংখ্যার ৭ শতাংশের কম। এদের জন্য মোট শূন্যপদের ৩০ ভাগ সংরক্ষণ সমানুপাতিক নয়, যৌক্তিকও নয়। তা ছাড়া এই কোটা সংরক্ষণের কারণে একদিকে যেমন মেধাতালিকায় শীর্ষস্থানীয় একজন চাকরি থেকে বঞ্চিত হন, অন্যদিকে মেধাতালিকায় অধিকাংশের নিচে থেকেও কারও কারও গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি হয়ে যায়। ফলে সার্বিকভাবে দেশ মেধাবী আমলাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।
তাছাড়া ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা হয় তারা যেন চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পান। সে কারণে তাদের বয়সের ঊর্ধ্বসীমা শিথিল করে ৩২ করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাদের অবদান ও বিড়ম্বনার কথা বিবেচনা করে এটি একটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু বয়সের ঊর্ধ্বসীমার শিথিলতা স্বাধীনতার এক কিংবা দেড় দশক পর জন্ম নেয়া তাদের সন্তানের বেলায় প্রয়োগের কোনো যুক্তি নেই। এ প্রসঙ্গে আরো বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মধ্য থেকে উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে তাদের জন্য নির্ধারিত পদসমূহ শূন্য রাখায় প্রশাসনিক সচলতাও ব্যাহত হচ্ছে। ২৮তম বিসিএসে পেশাগত ও কারিগরি ক্যাডারে বিভিন্ন কোটায় ৮১৩টি পদের জন্য কোনো যোগ্য প্রার্থীই পাওয়া যায়নি। ফলাফল প্রকাশের এক মাসেরও কম সময় আগে পরিবর্তন করা আইনের কারণে পিএসসি কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছে এই পদগুলো শূন্য রেখে দিতে। অথচ কোটাহীন শত শত মেধাবী চিকিত্সক, প্রকৌশলী উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি পাননি।
ড. আকবর আলি খানের রিপোর্টে ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখানো হয়েছে, এ সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ ভাগ কোটার খুব সামান্যই পূরণ হয়েছে। যেমন ২১, ২২ ও ২৫তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, এই বিসিএসগুলোতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত কোটার যথাক্রমে মাত্র ১০ দশমিক ৮, ২ দশমিক ২ ও ৫ দশমিক ২ ভাগ পূর্ণ হয়েছে। আর এই বিশাল সংখ্যার পদ অপূর্ণ থেকে যাওয়ার মূল কারণ হলো কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কিংবা অন্যান্য কোটায় উপযুক্ত প্রার্থীর স্বল্পতা

আইন প্রতিমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজন সবাই রাজাকার : বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী










স্টাফ রিপোর্টার

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ চেয়ারম্যান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, আজ অনেকেই বড় বড় কথা বলছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় তাদের পাওয়া যায়নি। সরকার একজনকে আইনের হাফ মন্ত্রী বানিয়ে রেখেছে। এই আইন প্রতিমন্ত্রী আইনের ‘অ’ জানেন কিনা সন্দেহ। তার আত্মীয়স্বজন সবাই রাজাকার ছিল। এখন তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের একজন মন্ত্রী—দলে থাকলে মুক্তিযোদ্ধা না থাকলে রাজাকার।
গতকাল রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে দলের বর্ধিত সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (বীরপ্রতীক) পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, দেশের এক-দশমাংশ এই পার্বত্য চট্টগ্রাম আগামী ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অংশ থাকবে কিনা এ সন্দেহ এখন আমার মনে দানাবেঁধে উঠেছে।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হাছান চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকীর সহধর্মিণী নাসরীন কাদের চৌধুরী প্রমুখ। এতে সারা বাংলাদেশের শতাধিক প্রতিনিধি অংশ নেন। সভায় জানানো হয়, বর্ধিত সভায় আলোচনার ভিত্তিতে এ বছরই দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নেয়া হবে।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ বারবার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে গোটা জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ দেশের মানুষকে ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়ানোর কথা বলে এখন ৫০ টাকা কেজি চাল খাওয়াচ্ছে। এ ধরনের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়ার কারণে আজ দেশের প্রধানমন্ত্রীর কোনো সম্মান নেই। রাস্তার ফকিরও তাদের জঘন্য ভাষায় গালি দেয়।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের অবস্থা এখন ভালো নয়। সবকিছুই বিশৃঙ্খলায় ভরে গেছে। প্রতিদিন নারীর সম্মানহানি হচ্ছে। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নারীর প্রতি অসম্মান করেছে তখন আমরা প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু আজ প্রতিনিয়ত যে নারীর সম্মানহানি হচ্ছে এর কোনো প্রতিবাদ করতে পারছি না।
মহাজোট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেদিন আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী এরশাদের সঙ্গে জোট করেছে সেদিনই আওয়ামী লীগের সম্মান চলে গেছে। গণতন্ত্রী এবং স্বৈরাচার এখন এক সঙ্গে বসে সরকার চালাচ্ছে। এতে করে ডা. মিলন, নূর হোসেনের আত্মা শান্তি পাচ্ছে!
লন্ডন প্রবাসী কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সম্পর্কে তিনি বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের মানুষের ওপর যে অত্যাচার করেছে— আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এদেশের মানুষের সঙ্গে তার চেয়েও বেশি অন্যায় করেছে কলমের মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর তিনি বঙ্গবন্ধুকে যাচ্ছেতাই বলেছেন। আর আমি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলায় সেই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে আওয়ামী লীগ আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের বেয়াকুবরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়ে তাকে ছোট করতে চাইছে। তার সম্মান হানি করতে চাইছে। আমি বেঁচে থাকতে জাতির জনককে ঘোষক হতে দেব না।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সরকার আন্তরিক নয়— পপুলার হওয়ার জন্য তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলছে।
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন একটি অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শান্তিবাহিনী নামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দাবি ছিল সেখান থেকে বাঙালিদের প্রত্যাহার করা। কিন্তু শান্তিচুক্তিতে বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় সরকার এটা করতে পারছে না। সবমিলিয়ে দেশের এক-দশমাংশ এই পার্বত্য চট্টগ্রাম আগামী ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অংশ থাকবে কিনা এ সন্দেহ এখন আমার মনে দানাবেঁধে উঠেছে।
তিনি বলেন, দেশ এখন বিপজ্জনক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেড় বছর পর দেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুত্ এবং গ্যাস সঙ্কটের কারণে বিক্ষোভের আগুন জ্বলবে। ‘দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে’— দুই বছর আগে এমন কথা বলে দেশবাসীকে নাচানো হয়েছে। সে গ্যাসের কোনো হদিস এখন নেই। এখন সরকার গ্যাস-বিদ্যুত্ সমস্যার কথা বলে দেশবাসীকে নাচাচ্ছে। এই সমাধানের প্রতিশ্রুতিও কার্যত ভুয়া।
নাসরীন কাদের সিদ্দিকী বলেন, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার কথা বলেছিল। কিন্তু এখন প্রতিদিনই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত সব শ্রেনীর মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। তিনি দলকে শক্তিশালী করার জন্য উপস্থিত নেতাকর্মীদের আহ্বান জানান।

খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে নিহত ৩ আহত ১০ : ৪০টি বাড়িঘরে আগুন, ১৪৪ ধারা জারি









খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি
খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার বড়পিলাকের কচুবাউন্তি এলাকায় গতকাল দুপুর ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে ভূমি বিরোধের জের ধরে পাহাড়ি-বাঙালি দুইপক্ষের সংঘর্ষে তিনজন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়েছে। তিনজনকেই কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে ইউপিডিএফ রেমং মারমা নামে এক পাহাড়ি নিহত হওয়ার দাবি করেছে। নিহতরা হচ্ছে আইয়ুব আলী (৩৮), পিতা আবদুল আউয়াল, নোয়াব আলী (৬০), পিতা তেনা গাজী, সুনিল সরকার (৩০), পিতা নারায়ণ সরকার। এদের বাড়ি বড়পিলাক গ্রামে।
বাঙালিদের অভিযোগ, ৪/৫শ’ পাহাড়ি সন্ত্রাসী বাঙালিদের ঘেরাও দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এর মধ্যে মুমূর্ষু অবস্থায় দু’জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। অপর ছয়জন মানিকছড়ি হাসপাতালে রয়েছেন। এ ঘটনায় এলাকাজুড়ে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। অনেককে ভয়ে এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে। বিকাল ৪টা থেকে ঢাকা-খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঘটনার জন্য পাহাড়ি-বাঙালি পরস্পরকে দায়ী করেছে। এদিকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মানিকছড়ির মহামুনী এলাকায় ১০টি পাহাড়ি ঘরে কে বা কারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। রামগড় ও মানিকছড়ি উপজেলায় পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কচুবাউন্তি এলাকায় জয়নাল পিসির জমিতে ৮/১০ জন শ্রমিক আদা হলুদ লাগানোর জন্য কাজ করছিলেন। এ সময় পাশের চালাড়ংপাড়া ও রেমরংপাড়া গ্রামের ৪/৫শ’ পাহাড়ি সন্ত্রাসী শ্রমিকদের ঘিরে ফেলে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। সন্ত্রাসীরা এ সময় বেশ কয়েকটি বাড়ি ভাংচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে উভয়পক্ষে ৪০টি বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়েছে।
ঘটনার পরপরই পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। সহকারী পুলিশ সুপার রামগড় সার্কেল তিনজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।
এ ঘটনার প্রতিবাদে বাঙালি ছাত্র পরিষদ আজ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ডাক দিয়েছে। তারা এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তও দাবি করেন

ঘরে-বাইরে সঙ্কটে মহাজোট সরকার








স্টাফ রিপোর্টার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে এখন সমস্যার পাহাড়। সরকার, নিজ দল ও জোট-মহাজোট নিয়ে নতুন নতুন সঙ্কট মোকাবিলায় হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসে মধ্যমেয়াদ পার করতে না করতেই নিত্যনতুন সমস্যা তাকে চেপে ধরেছে। সরকারের সকল কর্মকাণ্ড মূলত একব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়ায় প্রতিটি ক্ষেত্রে জটলা বেঁধে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, শেযারবাজার কেলেঙ্কারি, বিদ্যুত্ ও গ্যাস সঙ্কট, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, রাজধানীর অসহনীয় যানজটসহ জনজীবনের অন্তহীন সমস্যা সমাধানে বলা যায় আ’লীগ সরকার পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ড. ইউনূসকে অপসারণ, সংবিধান সংশোধন, নারীনীতিসহ স্পর্শকাতর ইস্যুতে হাত দিয়ে টালমাটাল হয়ে পড়েছে সরকার। এরই মধ্যে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন রিপোর্ট এবং বৈদেশিক সহায়তা পেতে দাতাগোষ্ঠীর কঠিন শর্তারোপ সরকারকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। এদিকে সরকার আর দল একাকার হয়ে যাওয়ায় সাংগঠনিক স্থবিরতা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে গ্রাস করে ফেলেছে। স্তিমিত হয়ে পড়ছে দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা দিন দিনই নেমে যাচ্ছে উল্লেখ করে দলের মধ্যমসারির নেতৃত্ব থেকে অভিযোগ উঠেছে, প্রাচীন ও জনপ্রিয় দলটি আজ বামদল সিপিবি ও ন্যাপে রূপান্তরিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ বর্তমানে অতীতের যে কোনো অবস্থার তুলনায় দুর্বল—এমনটা দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেও স্বীকার করা হচ্ছে। কেবলমাত্র দিবসকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীন দল। দিবসকেন্দ্রিক কর্মসূচি সফল করতেও ভাড়াটিয়া লোক আনা হচ্ছে, এমন অভিযোগও দল থেকে এসেছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে অচিরেই ঐতিহ্যবাহী এ দলটিকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হবে বলে দলের সিনিয়র নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। আওয়ামী লীগের বিপর্যস্ত পরিস্থিতির পাশাপাশি মহাজোটেও ভাটার টান লেগেছে। সমন্বয়হীনতা এবং আওয়ামী লীগ কর্তৃক জোটের শরিকদের অবমূল্যায়ন করার কারণে মহাজোট তথা ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গেও দলটির দূরত্ব দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। সব মিলিয়ে ঘরে-বাইরে নানামুখী সঙ্কটে পড়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।
ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, শরিক দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতৃত্বসহ সরকারের বিভিন্নস্তরে আলাপ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এসবের মধ্যে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরে বিরোধী দলের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের কর্মসূচি সরকারকে আরও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে।
মহাজোট সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই বিপর্যয়কর পরিস্থিতির শিকার হয়। এর মধ্যে বিডিআর বিদ্রোহসহ কয়েকটি ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও এর বাইরে বেশকিছু ঘটনা সরকারের ভেতর থেকেই উস্কে দেয়া হয়েছে। একের পর এক এসব কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে সরকার জনজীবনের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। সভা-সেমিনারসহ দলীয় ফোরামের আলোচনায় সরকারের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজ ফোরামের প্রকাশ্য জনসভায় সরকারের ব্যর্থতার কথা বলা হচ্ছে। খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, বিদ্যুত্ ও গ্যাস সঙ্কট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি এবং মন্ত্রীদের অতিকথনের সমালোচনা আসছে। ব্যর্থতার কারণে সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান ও খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগের দাবিও করা হয়েছে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানসহ একাধিক মন্ত্রীর ব্যর্থতার অভিযোগ করা হয়। দলীয় ফোরামগুলোতে একাধিক এমপি-মন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে তাদের সমালোচনা হলেও প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাদের পক্ষে অবস্থান নেন। এতে করে অভিযুক্ত এমপি-মন্ত্রীরা উত্সাহিত হচ্ছে বলে নিজ দল থেকে আক্ষেপ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত সংসদের গেল অধিবেশনে আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ রাস্তাঘাট সংস্কার প্রসঙ্গে যোগাযোগমন্ত্রীর সমালোচনা করলে প্রধানমন্ত্রী ওই সংসদেই যোগাযোগমন্ত্রীর পক্ষাবলম্বন করে বক্তব্য দেন। গত মাসে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায়ও দল ও সরকারের সমালোচনা করা হয়। ওই বৈঠকে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আতিউর রহমান আতিক সরকার ও দলের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে আসন পেয়েছিল কম কিন্তু সরকার ছিল শক্তিশালী; আর এবার আসন পেয়েছে অনেক বেশি কিন্তু সরকার অনেক দুর্বল।’ শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ফলে সরকারের যে ইমেজ সঙ্কট দেখা দেয় তা পুনরুদ্ধারে উচ্চ পযার্য়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এই কমিটির রিপোর্ট নিয়ে সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান ও সরকার মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। সরকার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদৌ ব্যবস্থা নেবে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে।
সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করলেও বছর না যেতেই এতে ভাটা লেগেছে। সরকারের মতে, ‘চিহ্নিত’ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর গ্রেফতার ও তদন্ত কমিটির কয়েকটি স্থান পরিদর্শন ছাড়া এতে কোনো অগ্রগতি নেই। বিদেশের প্রভাবশালী গণমাধ্যমও এ বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সম্প্রতি লন্ডনভিত্তিক একটি প্রভাবশালী পত্রিকা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন বলে উল্লেখ করেছে। এদিকে এতদিন সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বর্তমান সরকারের মেয়াদে এ বিচার শেষ করার কথা বলা হলেও অতিসম্প্রতি বলা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের সময়ে বিচার ‘শুরু করা’ হবে।
সরকারের এই দুর্বল অবস্থার চেয়ে সরকারি দলের অবস্থা আরও সঙ্গীন। গত আড়াই বছরে শাসক দল আওয়ামী লীগের বড় সাংগঠনিক অর্জনের মধ্যে রয়েছে কেবল জাতীয় অনুষ্ঠান। অবশ্য এটাও হয়েছে নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণের জন্য। এর বাইরে কেন্দ্রীয় কমিটির একটি বর্ধিতসভা হলেও ওই সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। জাতীয় কাউন্সিলের পর শিগগিরই দলের তৃণমূল কাউন্সিল অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হলেও জেলা-উপজেলা তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত ওয়ার্ড পর্যায়ের একটি কাউন্সিলও অনুষ্ঠিত হয়নি।
ক্ষমতার প্রায় আড়াই বছরে আওয়ামী লীগ গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত নিলেও তা ওই সিদ্ধান্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বার বার উদ্যোগ নেয়ার পরও নতুন কোনো সাংগঠনিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারছে না শাসক দলটি। ঘরোয়া সভা-সেমিনার আর জাতীয় ও দলীয় দিবসভিত্তিক কর্মসূচির বাইরে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম চলছে না। সরকারের মধ্যেই যেন হারিয়ে গেছে দেশের প্রাচীন এই রাজনৈতিক দল। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সর্বত্রই সাংগঠনিক অবস্থা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় নাজুক বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আট মাস আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জনমত সৃষ্টি করতে বিভাগীয় মহাসমাবেশ করার জন্য দুই দফা সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও এখনও তা শুরুই হয়নি। কবে হবে তারও কোনো খবর নেই। এক কোটি নতুন সদস্য সংগ্রহের টার্গেট নিয়ে গত বছর জানুয়ারিতে দলের সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রমের উদ্বোধন হলেও ঢাকা মহানগরসহ দেশের অর্ধেক জেলায় তা শুরুই করা যায়নি। গত ১৮ মার্চ কেন্দ্রীয় নেতাদের সাংগঠনিক জেলা সফর কর্মসূচি শুরু হলেও তা মাঝ পথে থেকে যায়। এক মাসে ৭৩টি সাংগঠনিক জেলায় বর্ধিতসভা সম্পন্ন করার টার্গেট নিয়ে সফর কর্মসূচি শুরু হলেও ২০টির মতো জেলা সফর বাকি থাকতেই কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমানে সংগঠনের বিভিন্নস্তরে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার ও ব্যক্তিস্বার্থকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল কার্যক্রম। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে তৃণমূলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরিই স্থবির হয়ে পড়েছে। গ্রুপিংয়ের কারণে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায় থেকে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ তো দূরের কথা, কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিগুলোও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কোনো কোনো জেলা বা উপজেলায় ৩/৪টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এসব গ্রুপের কোনোটার নেতৃত্বে রয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি, কোনোটার সাধারণ সম্পাদক আবার কোনোটার নেতৃত্বে আছেন স্থানীয় দলীয় সংসদ সদস্য, কোথাও কোথাও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দও এসব গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে পড়েছেন। অভ্যন্তরীণ কোন্দল এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, সম্প্রতি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান গ্রুপের কর্মীরা স্থানীয় সংসদ সদস্যকে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে।
এককালের সুসংগঠিত আওয়ামী লীগ আজ কর্মসূচি সফল করতে ভাড়া করে লোক নিয়ে আসে, এমন অভিযোগও উঠেছে। আর এই অভিযোগটা এসেছে দলেরই একটি সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে। গত ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক যৌথসভায় যুব মহিলা লীগের সভানেত্রী নাজমা আক্তার এমপি বঙ্গবন্ধু কনভেনশন সেন্টারে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভার প্রসঙ্গ টেনে ভাড়ায় লোক আনার অভিযোগ করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কয়েকটি অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, অনুষ্ঠানে কারা যায় তাদের আমরা চিনি না। অনুষ্ঠানে ভাড়াটিয়া লোক নিয়ে আসা হয়। তারা সামনের সারির আসনগুলো দখল করে রাখে। আর নির্দিষ্ট একজন নেতা বক্তৃতা দিলেই তারা হাততালি দেয়।
গত সোমবার ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিতসভায় নগরের সহ-সভাপতি কামাল আহমেদ মজুমদার এমপি সংগঠনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, দেশের সবচে প্রাচীন এ দলের কর্মসূচি কেবলমাত্র কিছু আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ কারণে দলের সমর্থন দিন দিন শূন্যের কোঠায় চলে যাচ্ছে। নেতৃবৃন্দ শুধুমাত্র ব্যানার ও নামসর্বস্ব সংগঠনের অনুষ্ঠানে গিয়ে বক্তৃতাবাজি করছেন। ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় এ দলটি কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপে রূপান্তরিত হচ্ছে।
সরকার ও দলের বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ আর সরকার একাকার হয়ে গেছে—এমন মন্তব্য করে দলের এক শীর্ষ নেতা এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সাংগঠনিক কার্যক্রম বৃদ্ধির পাশাপাশি পুরনোদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর কথা বলেন। ওই নেতা বলেন, আগে আওয়ামী লীগ পরে সরকার। কাজেই সরকারকে সফল করতে হলে সংগঠনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। সংগঠন শক্তিশালী না হওয়ার কারণে সরকারের সফলতাগুলো প্রচারণা পাচ্ছে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি মন্ত্রিসভার রদবদলের প্রয়োজনীয়তার কথাও জানান।
সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন আমার দেশ’কে বলেন, সরকার মোটামুটি সঠিক পথেই চলছে। ঘোষিত ইশতেহার ধরেই সরকার এগুচ্ছে। দু’একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলেও তাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। দলের মৌলিক সিদ্ধান্তের বাইরে সরকার যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন।
সাংগঠনিক বিষয়ে জানতে চাইলে আ’লীগ সভাপতিমণ্ডলীর অপর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ বলেন, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড তেমন কিছু হচ্ছে না। স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডই বর্তমানে চলছে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, জাতির জনকের জন্মদিনসহ স্বাধীনতার মাসের কর্মসূচি নিয়ে মার্চ মাসে ব্যস্ত ছিল। এখন এমপি-মন্ত্রীসহ নেতাকর্মীরা হয়তো পহেলা বৈশাখ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। এ কারণে এই মুহূর্তে সাংগঠনিক কাজের তেমনটা সুযোগ নেই। তৃণমূল কাউন্সিল অনুষ্ঠান বিষয়ে নীতিনির্ধারণী এই নেতা বলেন, মনে হয় না আপাতত কোনো পর্যায়ে কাউন্সিল হবে। সময় তো অনেক রয়েছে, অবশ্যই আগামীতে হবে

সরকারকে সাফ জানিয়ে দিল দাতারা : বিচারবহির্ভূত হত্যা দুর্নীতি বন্ধ না হলে সাহায্য নয়









স্টাফ রিপোর্টার
বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পরিচিত দাতা দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা সরকারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সাহায্য পেতে হলে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ, বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। দুনীতি বন্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের ক্ষমতা খর্ব করা চলবে না, দুদকের সংশোধিত আইন বাতিল করতে হবে।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া নিয়ে গতকাল দাতাদের সঙ্গে সরকারের প্রতিনিধিদের পরামর্শ সভায় তাদের এ মতামত উঠে আসে। এসব বিষয়ে পরিকল্পনা দলিলে সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থান ও বক্তব্য থাকা প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন দাতারা। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সভায় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার এ খসড়া উপস্থাপন করা হয়।
এ সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পরিকল্পনামন্ত্রী একে খন্দকার, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এবং উন্নয়ন অংশীদারদের মধ্যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি, ইউএস এইড, ডিএফআইডি, জাইকাসহ বাংলাদেশে নিযুক্ত দাতা দেশ এবং সংস্থার ৪২ জন রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলম খসড়াটি উপস্থাপনের পর পরই এর ওপর দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা তাদের মতামত দেন। খসড়া উপস্থাপনের পর ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত মি. এস ওলিং, বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি এলেন গোল্ডস্টেইন ও এডিবির প্রতিনিধিসহ অন্যরা বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত পরামর্শসভায় দাতাদের পক্ষে বাংলাদেশে সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি উপস্থাপিত খসড়ার নবম অধ্যায়ের সূত্র ধরে বলেন, সরকারকে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজের নিশ্চয়তা দিতে হবে। আদালতের রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার কথা বলেন তিনি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বৈঠকে বলা হয়, একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে, এটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও সুশাসনের অন্তরায়। এসব বিষয়ে সরকারের ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকা দরকার। দুর্নীতি বন্ধে সরকারের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতিও দাবি করেন দাতারা। দুদকের আইন পরিবর্তন করে দুর্বল করায় দাতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। দুদককে শক্তিশালী করা এবং এর আইনে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে সেগুলো বাতিলের পক্ষেও তারা মত দেন। মানবাধিকার কমিশন যাতে স্বাধীন ও সক্রিয় হয়ে কাজ করতে পারে তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় বৈঠকে।
বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধি মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ নিয়ে সরকারের আরও সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দেন। বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও সারের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেয় আইএমএফ।
উন্নয়ন অংশীদাররা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার পরামর্শ দেন। এছাড়া বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো ও সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারা। একই সঙ্গে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা তৈরির প্রতি গুরুত্ব দেয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয় উন্নয়ন অংশীদারদের পক্ষ থেকে।
পক্ষান্তরে এসব সেক্টরে সাহায্য প্রদানের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করার আহ্বান জানান ড. মশিউর রহমান। তিনি উন্নয়ন অংশীদারদের উদ্দেশে বলেন, সাহায্য হিসেবে দেয়া পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য দাতা দেশগুলোর আরও বেশি অর্থ দেয়া প্রয়োজন।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় মোট বাজেটের ৯৬.০৮ শতাংশ আসবে দেশি সম্পদ থেকে। এর সিংহভাগ ব্যয় হবে স্বাস্থ্যসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৩। সর্বশেষ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫.৮।
বৈঠক শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এরই মধ্যে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া নিয়ে বেশকয়েকটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। দাতাদের সঙ্গে আলোচনা করা এ প্রক্রিয়ারই অংশ। এতে দাতাদের কোনো শর্ত বা পরামর্শের ব্যাপার নেই বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, দাতাদের সামনে আগেই খসড়াটির মূল বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা হয়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, দাতারা খসড়াটি দেখে প্রশংসা করেছেন। তবে তারা এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে আঞ্চলিক অসমতা দূর করতে এবং উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে একটি কর্মকৌশল গ্রহণ করা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে কৃষি খাতে আরও বেশি দৃষ্টি দেয়া। দাতার অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি বিনিয়োগের হার ও মান বাড়ানোর বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। এর বাইরে বেসরকারি বিনিয়োগ মোট অভ্যন্তরীণ উত্পাদনের চার শতাংশে নিয়ে যাওয়া এবং জলবায়ু, আঞ্চলিক বাণিজ্যের প্রচার এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগের সুপারিশ করেছে উন্নয়ন সহযোগীরা।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম জানান, মে মাসের ভেতরেই এর খসড়া জাতীয় সংসদে পাঠানো হবে। প্রয়োজনীয় সংশোধন শেষে জুনের মধ্যেই চূড়ান্ত অনুমোদন শেষে এর বাস্তবায়ন শুরু হবে।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদকাল ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত। এ অর্থবছরে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার (জিডিপি) টার্গেট করা হয়েছে ৮ শতাংশ। শিল্প খাতে জাতীয় আয়ের অংশ ২০ দশমিক ৩ ভাগ থেকে বেড়ে ২২ দশমিক ৩ ভাগ হবে। তবে কৃষি খাতে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান ১৯ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ১৬ দশমিক ৬ ভাগে নেমে যাবে। বর্তমান মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে তা ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে ১০ দশমিক ২ মিলিয়ন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ আছে।
এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পাঁচ বছরে ১৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন টাকার প্রয়োজন হবে। এর ৯২ দশমিক ৮ ভাগ সরকারের অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে জোগান দেয়া হবে। বাকি ৭ দশমিক ২ শতাংশ দাতাদের সহযোগিতা থেকে পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে দাতাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দারিদ্র্যবিমোচন কৌশলপত্র (পিআরএসপি) বাস্তবায়ন হচ্ছে। আগামী জুনে এটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। দাতা সংস্থাগুলো চেয়েছিল এই পিআরএসপি আবারও অব্যাহত থাকুক। তাই শুরু থেকেই তারা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিল। শেষ মুহূর্তে দাতাদের অর্থ ছাড় দিতে রাজি করানোর জন্য তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে সরকার।
জানা গেছে, দেশে বিদেশি সাহায্যপ্রবাহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। আগের বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে প্রকৃত সাহায্য এসেছে মাত্র ৩৬ কোটি ডলার বা দুই হাজার ৫২০ কোটি টাকা। সাহায্যের এই পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ে ছাড় করা অর্থের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। গত বছর প্রথম সাত মাসে এর পরিমাণ ছিল ৯৯ কোটি ১১ লাখ ডলার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিশ্বব্যাংক থেকে প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশ বাজেট সহায়তা খাতে ২০ কোটি ডলারের মতো ঋণসহায়তা পেয়ে আসছে। কিন্তু এবার বিশ্বব্যাংক এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা দেয়নি। এ বছর আর সহায়তা দেয়া হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই সরকার সংশোধিত বাজেটে বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ অনেকটাই কাটছাঁট করেছে

ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে সার্বভৌমত্ব আজ বিপন্ন : আমরা দেশটির পর্নো সংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকার : ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী















হাসান শান্তনু

দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতির অস্তিত্ব বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের মুখে কোণঠাসা। আকাশ সংস্কৃতির উন্মুক্ত পথে ভিনদেশি ঐতিহ্য, আচার ব্যবহার, পোশাক এবং ধর্মীয় প্রভাব বাংলাদেশী কিশোর-কিশোরী ও শিশুদের মনোজগতে যে প্রভাব ফেলছে তাতে দেশপ্রেম ও সাজাত্যবোধ গড়ে ওঠার পথে বিরাট বাধার সৃষ্টি করছে। ফলে এদেশের শিশু-কিশোররা তার অতীতে সংগ্রামী বীর পুরুষদের কথা ভুলে জাতীয় বীর হিসেবে ভিনদেশি চরিত্রকে স্নাত স্মরণীয় মনে করছে। এভাবে এদেশীয় শিশু-কিশোরদের মনে হীনমন্যতা ধীরে ধীরে শিকড় বিস্তার করছে। ফলে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক দখলদারিত্বের পথ নির্মাণে ভারতীয়দের তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। এতে দেশটির সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের থাবায় বিপন্ন এদেশের সার্বভৌমত্ব। এখন আমাদের একটি দেশকে পদানত করতে হলে সে দেশের সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে চূরমার করার রেওয়াজ অতি প্রাচীন। সংস্কৃতিতে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের লোলুপ থাবা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। ভারত সরকারের চাপে এদেশের সরকার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অসহায়। শিল্প, সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশ বিষয়ক অধিকাংশ প্রকল্প সরকার নিচ্ছে ভারতীয়দের চাপে। বাংলাদেশ হয়ে উঠছে ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চার ‘উর্বর ক্ষেত্র’, শিল্পীদের রমরমা বাজার। তারা বাংলাদেশকে ‘বাণিজ্যিক ক্ষেত্র’ হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। দু’দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি থাকলেও এসব চলছে চুক্তির তোয়াক্কা না করে। এ দেশের বিদ্যমান আইন না মেনে তারা চালাচ্ছেন তাদের দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা। এতে সংস্কৃতি ধ্বংসের পাশাপাশি ভারতে চলে যাচ্ছে দেশের কোটি কোটি টাকা।
এ দেশে এখন সরকারি, বেসরকারি অনেক অনুষ্ঠান শুরু হয় ভারতীয়দের অনুকরণে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে, ঢোল বাদ্য বাজিয়ে।
মন্ত্রী, সচিব, সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, আওয়ামীপন্থী, বাম সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এটা করছেন। ভারতীয় শিল্পীদের দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। গত মার্চ মাসে এ দেশের স্বাধীনতা লাভের চল্লিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে ছিল ভারতীয়দের জয়জয়কার। অনুষ্ঠান শুরুর আগে ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীত বাজানোও আজকাল আর বিচিত্র কিছু নয়। গত ১ এপ্রিল ঢাকায় আয়োজিত রোটারি ক্লাবের বাংলাদেশ শাখার সম্মেলনে নীতিমালা অমান্য করে বাজানো হয় ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীত। শিল্পীর পাশাপাশি হিন্দিভাষী উপস্থাপিকাও আনা হচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংগঠনের উদ্যোগে এসব অনুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে।
এক গবেষণা মতে, সরকারি সহায়তার পাশাপাশি গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, সঙ্গীত শিক্ষালয়, নাট্যবিদ্যালয়, নাট্যশালা, আর্ট স্কুল, ফ্যাশন শো, সঙ্গীত-অভিনয়-সুন্দরী প্রতিযোগিতা, পাঠ্যপুস্তক, সাহিত্য, সেমিনার, এনজিও, হাসপাতাল, রূপচর্চা কেন্দ্র, শিক্ষাবৃত্তি, ক্লাব-সমিতি, সাংস্কৃতিক সফর, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি এদেশে ঢুকছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এক রাষ্ট্রের আইন না মানাটা ওই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননা। অবমাননার বিষয়টা যেভাবে চলে আসছে তাতে সার্বভৌমত্ব বিপন্ন। ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দিন দিন বিস্তৃত হয়ে উঠছে।’
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ভারত প্রাচীন সংস্কৃতির দেশ হলেও আমরা দেশটির পর্নো সংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকার। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, মিডিয়া ব্যবসায়ীরা ওই পর্নো সংস্কৃতি উপভোগ করছে। এতে এ দেশের সংস্কৃতি বিকশিত হতে পারছে না। সংস্কৃতি চর্চার নামে এ দেশের যারা আইন না মেনে ভারতীয় শিল্পীদের আনছেন, তাদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। ফলে তারা একের পর এক শিল্পীকে আনছেন।’
বলা হয়ে থাকে, একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পর এ জাতির সাংস্কৃতিক জাগরণের উজ্জ্বলতম উদাহরণ একুশের বইমেলা। গত ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে আয়োজিত বাংলা একাডেমীর এবারের বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন নোবেলজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. অমর্ত্য সেন। মেলা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেলজয়ী একমাত্র বাংলাদেশী। তাকে ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ দেশের একমাত্র নোবেলজয়ীকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে একজন ভারতীয়কে বিশেষ অতিথি করায় নানা প্রশ্নের জন্ম হয়। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে বলা হয়, দু’দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাড়াতে, এ দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রমাণের জন্য ড. অমর্ত্যকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ড. অমর্ত্য নিজেই সাম্প্রদায়িক চেতনার। তার সাম্প্রতিক ‘আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ বইয়ে ইসলাম ধর্ম বাদ দিয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। এবারের বইমেলার এক মাসের আলোচনা অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যা আগে কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে এভাবে হয়নি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ফসল বাংলা একাডেমীর বইমেলার পুরো মাসের আলোচনা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথকে বিষয় করায় নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। কেননা, ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনো সম্পর্ক নেই। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আলোচনা করতে আমন্ত্রণ জানানো হয় কলকাতার অনেককে। একই বিষয়ে এদেশে বিশেষজ্ঞ থাকলেও তাদের মধ্যে অনেকে আমন্ত্রণ পাননি। একাডেমীর দাবি, রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এ বিষয় নির্ধারিত হয়। মেলার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানাতে গত বছরের ২ ডিসেম্বর একাডেমীর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এর পরিচালক শামসুজ্জামান খানের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুলকে নিয়ে একইভাবে পুরো মাসের আলোচনা অনুষ্ঠান করবেন কি-না?’ প্রশ্নটার উত্তর দেননি তিনি। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে চলছে রবীন্দ্রবন্দনা। রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়নে, তাকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানাতে আর্থিক সহায়তা দিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নতুন একটি প্রকল্প নিয়েছে। শিল্পকলা একাডেমী এ প্রকল্প পরিচালনা করছে। অথচ জাতীয় কবি নজরুলকে নিয়ে এরকম প্রকল্প সরকারের নেই। নজরুল এখন চরম উপেক্ষিত। অভিযোগ আছে, ভারত সরকারের চাপে সরকার এ প্রকল্প নেয়।
গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাত্র সাতদিন পর আর মর্মান্তিক বিডিআর বিদ্রোহের দ্বিতীয় বার্ষিকীর আগ মুহূর্তে ঢাকায় ‘ডেসটিনি গ্রুপ ট্রাইনেশন বিগ শো’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত হয় ভারতীয় শিল্পীদের দিয়ে উদ্দেশ্যমূলক কনসার্ট। অনুষ্ঠানটি করা হয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সঙ্গে মানুষকে সম্পৃক্ত করার জন্য। শো’র টিকিটের দাম রাখা হয় দুই হাজার থেকে দুই লাখ টাকা। দেশের সংস্কৃতিসেবীরা বলেন, ‘অনুষ্ঠানটির সঙ্গে বিশ্বকাপের সম্পর্ক নেই। খেলোয়াড়রা মাঠে ভালো খেললে দর্শকরা ক্রিকেট উল্লাসে মেতে ওঠে। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষা চর্চার পরিবর্তে বলিউডের শিল্পীদের এনে হিন্দিগান পরিবেশন গর্হিত কাজ।’
অন্যদিকে একাত্তর সালে স্বাধীনতা লাভের চল্লিশ বছর পূর্ণ হয় এবার। এ উপলক্ষে সরকারি, বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে মার্চ মাসজুড়ে। এর মধ্যে অনেকের অনুষ্ঠানের তালিকায় ছিলেন ভারতীয় শিল্পীরা, আর তাতে উপেক্ষিত ছিলেন এদেশের শিল্পীরা। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা একাডেমী ও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ধিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার’ মিলেও ভারতীয় শিল্পীদের দিয়ে অনুষ্ঠান করে। এ দু’প্রতিষ্ঠানের যৌথ আয়োজনে গত ৪ মার্চ শিল্পকলা একাডেমীতে ছিল ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী বিদ্যা শাহ, ১৮ মার্চ পণ্ডিত যশরাজের সঙ্গীত সন্ধ্যা। তারা ঢাকার বাইরেও অনুষ্ঠান করেন। ওই আয়োজনে এ দেশের কোনো সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক কামাল লোহানী বলেন, ‘ভারতীয় কোনো শিল্পীর সঙ্গে এ দেশের কাউকে মঞ্চে উঠিয়ে দেয়ার মানে হয় না। তাই এ দেশের কাউকে রাখা হয়নি। তাছাড়া ভারতীয় দূতাবাসও এ দেশের কোনো শিল্পীকে অনুষ্ঠানে চাননি।’
আওয়ামীপন্থী সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর গণসঙ্গীত উত্সবে গত ২৮ মার্চ শিল্পকলা একাডেমীতে, ৩১ মার্চ বিয়াম মিলনায়তনে ছিল ভারতীয় শিল্পী মৌসুমী ভৌমিকের অনুষ্ঠান। গণসঙ্গীত শিল্পী না হলেও সরকারকে খুশি রাখা, ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চার পথ আরও বিকশিত করতে তাকে আনা হয়। স্বাধীনতার চার দশক পূর্তি উপলক্ষে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ভারতীয় শিল্পী ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলা বাদন আয়োজন করে সরকার সমর্থক একটি জাতীয় দৈনিক। গত ১৯ মার্চ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের শিল্পীদের সংগঠন ‘কিরাত’র উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারি-২ এ আয়োজিত হয় চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক মৈত্রীর সেতু স্থাপন এ প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য বলে আয়োজকরা জানান। তবে সেখানে এদেশের কোনো শিল্পীর চিত্রকর্ম ছিল না।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত দুই বছর তিন মাসে শতাধিক ভারতীয় সঙ্গীত, অভিনয়শিল্পী এ দেশে কনসার্ট করেন। এ সময়ের মধ্যে কতজন এসেছেন, এর ঠিক পরিসংখ্যান সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়েও নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে অভিজাত ক্লাবগুলো ভারতীয় শিল্পীকে আনলেও তা গোপন রাখেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লুকোচুরি করে শিল্পীদের আনা হয়। ট্যাক্স ফাঁকি দিতে আয়োজকরা এ লুকোচুরি করেন। অভিজাত ক্লাবগুলো ভারতীয় আইটেম গার্ল, ডিজিটাল জকিদের নিয়ে অনুষ্ঠান করেন অনুমতি ছাড়া। দেশের প্রতিভাবান শিল্পীরা অবজ্ঞা, উপেক্ষার ন্যক্কারজনক শিকার হচ্ছেন। ভারতীয়দের কদর বাড়লেও এ দেশের কোনো শিল্পী ভারতে যেতে পারছেন না। সেখানে তাদের নিয়ে বড় ধরনের কোনো অনুষ্ঠানও হচ্ছে না। গত কয়েক বছরে ভারতে বাংলাদেশী শিল্পীদের অংশগ্রহণে বড় কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। বাংলাদেশের দুই জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীনের কোনো কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়নি আজ পর্যন্ত। অথচ সে দেশের শিল্পীরা এদেশে আসছেন। কামিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক বৈষম্যের মতো সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। সুস্থ সাংস্কৃতিক বিনিময়ের নামে এ ধরনের এক তরফা, যথাযথ অনুমতি ছাড়াই ভারত থেকে শিল্পীরা আসছেন। ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন তারা। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজিত বলিউড কিং শাহরুখ খানের ‘কিং খান লাইভ শো ইন ঢাকা’য় অংশ নিয়ে শাহরুখ পান কোটি কোটি টাকা। তিনি কোনো ট্যাক্স দেননি বলে জানায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্র। ওই অনুষ্ঠানে বলিউড তারকা অর্জুন রামপাল, রানি মুখার্জি অংশ নেন। তারাও ট্যাক্স দেননি

সেনা সদরের সতর্কবাণী : পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন পূর্ব তিমুর না হয়











এমএ নোমান
পার্বত্য চট্টগ্রামে যাতে পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের মতো কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে সেজন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন নীতিনির্ধারণী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেনা সদর দফতর। সেনা সদর দফতর থেকে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ও সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করছে। মিয়ানমার ও ভারতীয় কয়েকটি গ্রুপের কাছ থেকে পার্বত্যাঞ্চলে অস্ত্র আসছে। সম্প্রতি পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের রাজনৈতিক পরিবর্তন লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেখানে এর সূচনা হয়েছিল প্রায় ৭৫-৮০ বছর আগে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যাতে দক্ষিণ সুদান ও পূর্ব তিমুরের মতো কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে, তা এখন থেকেই সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সপ্তম সভায় সেনা সদর দফতর থেকে এ আশঙ্কা ব্যক্ত করে বেশ কিছু প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সেনা সদর দফতরের এ বক্তব্যের বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূতরা ঘন ঘন পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশি সাংবাদিক ও বিভিন্ন লোকের আনাগোনাও বেড়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে বিদেশিদের নিশ্চয় কোনো গোপন এজেন্ডা রয়েছে। বৈঠকে উপস্থাপিত এসব আশঙ্কা, প্রস্তাব ও বক্তব্যের সমন্বয়ে তৈরি করা কার্যবিবরণী ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদর দফতরগুলোতে দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বৈঠকের আলোচ্য বিষয় ও সুপারিশমালা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুর কাছে জানতে চাইলে তিনি আমার দেশকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যাতে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সহাবস্থান নিশ্চিত থাকে সেজন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন। সে অনুযায়ী সুপারিশ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি ও বাঙালি নির্বিশেষে সবার মধ্যে সহাবস্থান ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আমাদের সেনাবাহিনী তাদের মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও কঠোর শ্রম দিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। শান্তিচুক্তিবিরোধী কোনো গোষ্ঠী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে।
উল্লেখ্য, পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদান যথাক্রমে ইন্দোনেশিয়া ও সুদানের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দুটি দেশ থেকে পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানিয়েছে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ৭ম সভা অনুষ্ঠিত হয়। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক অবস্থা নিয়ে অনুষ্ঠিত এ সভায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সচিব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর প্রতিনিধি ও সেনা সদর দফতরের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তাদের সবার বক্তব্য, প্রস্তাব, সুপারিশ এবং সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত কার্যবিবরণী আকারে তৈরি করে এর আলোকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তা মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব, প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার সেনা সদর দফতর, চিফ অব জেনারেল স্টাফ সেনা সদর দফতর, পুলিশের মহাপরিদর্শক, বিজিবি মহাপরিচালক, ডিজিএফআই মহাপরিচালক, এনএসআই মহাপরিচালক ও র্যাব মহাপরিচালককে দেয়া হয়।
সেনা সদরের আশঙ্কা ও প্রস্তাব : বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে সেনা সদরের বক্তব্য প্রসঙ্গে কার্যবিবরণীর ২য় পৃষ্ঠার ১০নং প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে সভায় উপস্থিত সেনা সদরের প্রতিনিধি সভাকে অবহিত করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিয়মিত রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত অস্ত্র ও মাদকের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।’ একই কার্যবিবরণীর ১১নং প্যারায় সেনা সদরের প্রতিনিধির উদ্ধৃতি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে, ‘সেনা সদরের প্রতিনিধি সভাকে আরও জানান, সম্প্রতি দক্ষিণ সুদান ও পূর্ব তিমুরের রাজনৈতিক পরিবর্তন লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এর সূচনা হয়েছিল প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ বছর আগে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যাতে এ ধরনের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে, তা এখন থেকেই আাামাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে চিন্তা করতে হবে। সেনা সদরের প্রতিনিধি আরও উল্লেখ করেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীদের কাছে আর্মস আসে মূলত মিয়ানমারের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে। পাশাপাশি ভারতীয় কিছু গ্রুপও আর্থিক কষ্টে পড়লে পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে। সেনা সদরের ওই প্রতিনিধি আরও জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ইস্যু একটি বিরাট সমস্যা। এ সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান হওয়া প্রয়োজন। এছাড়াও অনেকদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে না। জরুরি ভিত্তিতে এ নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন।
দাতা সংস্থাকে দায়ী করছে ডিজিএফআই : পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই’র প্রতিনিধির উদ্ধৃতি দিয়ে কার্যবিবরণীর ১২নং প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে ডিজিএফআই প্রতিনিধি জানান, ইন্টারনেটের কারণে তথ্য আদান-প্রদান খুবই সহজ হয়েছে। কোনো কোনো বিষয়ে বিদেশি সাংবাদিকরা চট্টগ্রামে না গিয়েও তথ্য সংগ্রহ করছেন। ইউএনডিপিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে নিয়োগকৃত উপজাতীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা থেকে এটা স্পষ্ট যে, এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান উপজাতীয়রা চাকরির মাধ্যমে পুনর্বাসিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণত উপজাতীয়রা গভীর জঙ্গলে বসবাস করে। তারা ছোটখাটো দোকান, নদী, খাল ও লেকে বোট চালিয়ে এবং জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা যাতে তাদের দরিদ্রতার সুযোগ গ্রহণ করে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধন করতে না পারে সেজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়নসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন। এতে পার্বত্য এলাকার অধিবাসীদের সঙ্গে দেশের অন্যান্য জেলার অধিবাসীদের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হবে। সম্প্রতি ইউপিডিএফের কার্যক্রম শক্তিশালী হয়ে পড়েছে, এটা বড়ই উদ্বেগজনক।
তথ্যমন্ত্রীর উদ্বেগ : তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের উদ্ধৃতি দিয়ে কার্যবিবরণীর ১০নং প্যারায় বলা হয়েছে, তথ্যমন্ত্রী সভাকে জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি কমিশন নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূতরা ঘন ঘন পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করছেন। বিদেশি সাংবাদিক ও বিভিন্ন লোকের আনাগোনাও বেড়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে বিদেশিদের নিশ্চয়ই কোনো গোপন অ্যাজেন্ডা রয়েছে। এখানে কিছু লোক উস্কানিও দিচ্ছে। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন।
কমিটি পুনর্গঠনের সুপারিশ : বিস্তারিত আলোচনা শেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে—পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের কাজ যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় সে বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩টি জেলায় স্থানীয় সরকারগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। এজন্য আইনশৃঙ্খলাসহ নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে যাতে কোনো দেশি-বিদেশি চক্রান্ত সফল না হয় এবং অশান্ত পরিস্থিতির উদ্ভব না হয়, সে বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নবিষয়ক জাতীয় কমিটিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করে কমিটি পুনর্গঠন করা যেতে পারে।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য : স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমার দেশকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয় ও বাঙালিদের মধ্যে সহাবস্থান নিশ্চিত করা এবং শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থেই শান্তিচুক্তি করা হয়েছিল। শুরু থেকেই চারদলীয় জোটসহ কয়েকটি মহল এ চুক্তির বিরোধিতা করে আসছে। তারপরও শান্তিচুক্তি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠক সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, সেনাবাহিনী বরাবরই পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বৈঠকে তারা তাদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। সরকার বরাবরই পার্বত্য ভূমি বিরোধ সমস্যাসহ অন্যান্য সমস্যা নিরসন করতে আন্তরিকভাবে কাজ করে চলেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোসহ কিছু সংগঠন শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে। আমরা তাদের সেই ফায়দা হাসিলের সুযোগ দেব না। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয় ও বাঙালি নির্বিশেষে সবার মধ্যে সহাবস্থান ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আমাদের সেনাবাহিনী তাদের মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও কঠোর শ্রম দিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে