Tuesday 29 November 2011

যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর অন্য রকম প্রতিবেদন

বুধবার, ৩০ নভেম্বর ২০১১
মানবজমিন ডেস্ক: বাংলাদেশে স্থাপিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতে বিচারের নামে প্রহসন করা হচ্ছে। এতে রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আগামী নির্বাচনের আগে এই বিচার করা গেলে বিরোধী দলকে দুর্বল করে দেয়া যাবে। আর এসব ঘটলে বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস লেখা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। গতকাল অনলাইন নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এই প্রতিবেদনটি ওই পত্রিকার ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে। এর লেখক ব্যাংককের সাংবাদিক টম ফেলিক্স জোয়েনক। তার প্রতিবেদনের শিরোনাম- এ ওয়ার ক্রাইমস কোর্ট অ্যান্ড এ ট্রাভেসটি অব জাস্টিস। এতে বলা হয়েছে, পুরান ঢাকায় ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া একটি সরকারি ভবন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের প্রত্যক্ষদর্র্শীদের সাক্ষ্যের কপি একত্রিত করে স্ট্যাপলিং করছেন কেরানিরা। বাংলাদেশ সরকারের মতে, ওই যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ওই সব কেরানির মাথার ওপর একটি মানচিত্র দেখা যায়, তাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর পাশের কক্ষেই বসেন বাংলাদেশে স্থাপিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান তদন্তকারী আবদুল হান্নান খান। ২০১০ সালের মার্চে এই আদালত স্থাপন করে বাংলাদেশ সরকার। এর উদ্দেশ্য, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং অন্যান্য অপরাধ কোন ব্যক্তি, গ্রুপ, সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা অথবা সহযোগী বাহিনীর কেউ করে থাকলে তাদের বিচার করে শাস্তি দেয়া। আবদুল হান্নান খান পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক। তিনি অমায়িক লোক। তার মধ্যে কোন তাড়াহুড়ো নেই। তিনি ধীর স্থির মানুষ। তাকে দেখে মনে হয় রাজনীতিতে তার কোন আগ্রহ নেই। তিনি বলেছেন, তার সংস্থা ৭ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করেছে। তাদের মধ্যে গত ২০শে নভেম্বর প্রথম জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এই ইসলামপন্থি দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। ৮৯ বছর বয়সী এই দলটির সাবেক প্রধান গোলাম আযম সহ জামায়াতে ইসলামীর প্রায় সবাই, বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র প্রথম সারির দু’জন নেতার সঙ্গে সাঈদীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। এখনও কোন বিচার হয়নি। তবে এরই মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত নামমাত্রই আন্তর্জাতিক আদালত। এর প্রধান লক্ষ্য- ওই সব বাংলাদেশী, যারা পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তায় হত্যাযজ্ঞে মেতেছিল। মনে হচ্ছে এই আদালতের মাধ্যমে সরকার দেশের ভিতরে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের জন্য পাকিস্তানের সাবেক সেনা সদস্যদের, যারা বাংলাদেশে সহিংসতার জন্য দায়ী তাদের বিচার করা ও শাস্তি দেয়া রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর। এর ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুরোপুরিভাবে ভেঙে যেতে পারে। তাছাড়া, দুই দেশের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকায় তা করা সম্ভাবও নয়।
এ ঘটনায় আরও লোকজন গ্রেপ্তার করা হবে নিশ্চিত। আবদুল হান্নান খান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ৬ সদস্য, বিএনপি’র ২ সদস্য সহ আরও মোট ১০ সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করছেন। এছাড়া, আছেন আশরাফুজ্জামান খান নামে এক মার্কিন নাগরিক, মইনুদ্দিন চৌধুরী নামে এক বৃটিশ নাগরিক। অভিযোগ আছে, তারা দু’জনেই আধা-সামরিক সংস্থা বলে পরিচিত আলবদরের নেতা ছিলেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে এই আলবদরই বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। আবদুল হান্নান খান বলেন, এর মধ্যে আশরাফুজ্জামান খান থাকেন নিউ ইয়র্কে এবং মইনুদ্দিন চৌধুরী থাকেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। তাদের এত দূরে থাকাটা বিচার ব্যবস্থায় একটি বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে। একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, এই বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে না। কারণ, এ দু’ব্যক্তির অনুপস্থিতিতেই তাদেরকে অভিযুক্ত করা হবে এবং বিচার করা হবে।
আদালত বিচারের প্রহসনে রূপ নিচ্ছে। অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করা সরকারের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল। এখন দৃশ্যত সরকার আদালতকে রাবারস্ট্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করছে। বেশির ভাগ বাংলাদেশীর কাছে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯৫ সালে। তখন বর্তমান আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিশিষ্ট নাগরিকদের স্বপ্রণোদিত একটি দল (প্যানেল) ১৬ ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ হাজির করেন। তাদের মধ্যে বর্তমানে ৭ জন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের জন্য অপেক্ষা করছেন। ১৯৯৫ সালের ওই প্যানেলে ছিলেন একজন বিচারক। জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের ডিফেন্স টিম ওই বিচারকের অপসারণ দাবি করছে। যদিও প্রত্যাশিত নয়, তবুও যদি জামায়াতে ইসলামীর পুরো নেতৃত্বকে অভিযুক্ত করা হয় এবং দুই বছরের মধ্যে ফাঁসি দেয়া হয় তাহলে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠেয় পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের আগেই বাংলাদেশের বিরোধী শক্তি বেশ দুর্বল হয়ে পড়বে। এ রকম নগ্ন দলীয় বিচারিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের জন্মের প্রকৃত ইতিহাস লেখার কাজকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলবে। ১৯৭১ সালের গণহত্যার স্বাধীন তদন্ত সংস্থা ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি। এই কমিটির এমএ হাসানের মতে, পাকিস্তানি সেনারাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। তারাই নৃশংসতার শতকরা ৯৫ ভাগ সংঘটিত করেছিল। দেশভাঙার চেষ্টা ব্যর্থ করতে তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তারা একটি তত্ত্বের ভিত্তিতে এসব কাজ করেছিল। তাহলো- দুই পাকিস্তানের ইসলামিক একত্বের সঙ্গে কোন কিছুর আপস করা হবে না। এখনও তাদেরকে আদালতে আনা হয়নি। পাকিস্তানিদের প্রতি অনুগত হাজার হাজার বিহারি অভিবাসীকে যেসব স্বাধীনতাপন্থি হত্যা করেছিল তাদের কোন সদস্যকেও আদালতে আনা হবে না।
বর্তমান অভিযুক্তদের তালিকা দেখে মনে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সুবিধা নিতে চায়। আর তা হলো- আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে স্বাধীন যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুমোদনের বিষয়টিকে সামনে এনে শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ ভাল কাজ করেছেন তা দেখানো।
বিবাদীপক্ষ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীকে নিযুক্ত করেছে। কিন্তু সরকার কার্যত তাদেরকে আদালতে উপস্থিত হতে দেয়া ঠেকিয়ে দিয়েছে। এমনকি তাদেরকে বাংলাদেশে ঢুকতেই দেয়া হয়নি।
রাজনীতিকরণের এই অবস্থার মাঝে এমএ হাসান পক্ষপাতহীন অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কয়েক বছর আগে, তিনি যুদ্ধাপরাধের অপরাধে জড়িত সন্দেহে সরকারকে ১৭৭৫ জনের একটি তালিকা দিয়েছেন। বর্তমানে যাদের বিরুদ্ধে বিচার হচ্ছে তারাও রয়েছেন ওই তালিকায়। এতে আরও নাম আছে আওয়ামী লীগ জোটের কিছু ব্যক্তির ও পাকিস্তানের সাবেক কিছু সেনা সদস্যের। এমএ হাসানের অফিসে গত মঙ্গলবারের সাক্ষাতের শেষে তিনি দায়মুক্তির চলমান ধারায় দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি ঢাকার গণহত্যার একটি মানচিত্র দেখান। এতে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ সহ দেখানো হয়েছে ৪৮টি গণকবর।

সর্বশেষ আপডেট বুধবার, ৩০ নভেম্বর ২০১১ ০১:২৭

Wednesday 23 November 2011

টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিবাদে সিলেটে ১ ডিসেম্বর হরতাল : ঢাবি শিক্ষকসহ বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ, ব্রিফিংয়ে দিল্লি বলেছে ক্ষতি হবে না


সিলেট অফিস

কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর উজানে বরাক নদীতে ভারতের টিপাইমুখের মরণবাঁধ রুখতে সিলেটে ক্রমেই দানা বাঁধছে প্রবল গণজাগরণ। টিপাইমুখে বিদ্যুত্ উত্পাদনের নামে বাঁধ নির্মাণ চুক্তির প্রতিবাদে জেলা ও মহানগর বিএনপি ১ ডিসেম্বর সিলেট জেলার সর্বত্র হরতালসহ সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি দিয়েছে।
গতকাল স্থানীয় একটি হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে জেলা ও মহানগর বিএনপির পক্ষে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপি কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জেলা সভাপতি সাবেক এমপি এম ইলিয়াস আলী।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, ২৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বেলা ২টায় ঐতিহাসিক কোর্ট পয়েন্টে গণজমায়েত, বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল। ২৬ নভেম্বর শনিবার সিলেট জেলার প্রতিটি উপজেলা ও থানায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল। ২৭ নভেম্বর রোববার বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সিলেট শহর বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল। ২৮ নভেম্বর সোমবার বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের নগরীতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল। ২৯ নভেম্বর মঙ্গলবার বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদলের বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল। ৩০ নভেম্বর বুধবার সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল এবং ১ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সিলেট মহানগরী এবং জেলার সব উপজেলা ও থানায় সর্বাত্মক সকাল-সন্ধ্যা হরতাল।
সংবাদ সম্মেলনে মহানগর সভাপতি এমএ হক, জেলা সহ-সভাপতি সাবেক এমপি দিলদার হোসেন সেলিম, জেলা সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আবদুল গফফার ও মহানগর সেক্রেটারি আবদুল কাইয়ুম জালালী পিংকি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এম ইলিয়াস আলী বলেন, যারা পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে এ মহাবিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, সেই আগ্রাসী অপশক্তি ভারতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া কোনো গতি নেই। তিনি বলেন, টিপাইমুখের বাঁধ বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলকে প্রথমেই মরুভূমিতে পরিণত করবে। পাশাপাশি ভারতীয়রা ইচ্ছামত বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে হাজার হাজার ফুট উঁচু পানির উচ্চতায় প্লাবিত করার নীলনকশা এঁটেছে। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বাস্তবায়ন হওয়া মানে সিলেটসহ বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ডে জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক পরিবর্তন নেমে আসবে। সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনার অববাহিকার অধিবাসীরা ও সিলেট, বৃহত্তর কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং মুন্সীগঞ্জের একটি অংশে ব্যাপক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটবে। শুকনা মৌসুমে সুরমা কুশিয়ারা মেঘনাসহ সব নদনদী শুকিয়ে যাবে এবং বর্ষা মৌসুমে আমরা স্বাভাবিক পানি থেকে বঞ্চিত হব এবং নদীগুলোর নাব্য হারিয়ে যাবে। ফলে ফসল উত্পাদন ব্যাহত হবে। গাছপালা তরুলতা স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারবে না। পশুপাখি স্বাভাবিকভাবে এ অঞ্চলে বিচরণ করতে পারবে না। নদী-হাওরগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে উত্পাদিত মাছ থাকবে না। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। মাটি তার স্বাভাবিক জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলবে। আর তখন নানা সমস্যা বা সামান্য ভূমিকম্পের কারণে ব্যাপক ধ্বংলীলা সংঘটিত হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারত তাদের টিপাইমুখ নামক স্থানে বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করেছিল এবং ক্রমান্বয়ে তারা তা বাস্তবায়ন অব্যাহত রেখেছে। গত সপ্তাহে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এ বাঁধ নির্মাণের চুক্তি করেছে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক-ছাত্র, আইনজীবী সব পেশা শ্রেণীর মানুষ এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে আসছে। পাশাপাশি সব শ্রেণীর বিবেকবান মানুষরা বর্তমান সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়ে আসছে, সরকার যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে এর প্রতিবাদ জানায় এবং বাঁধ নির্মাণ থেকে ভারতকে নিবৃত্ত রাখতে রাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক তত্পরতা চালায়। সবার পরামর্শ ছিল বাংলাদেশের বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রতিবাদ এবং বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার তা করেনি। উপরন্তু সরকারের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী টেলিভিশনে সাক্ষাত্কার দিয়ে বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের বক্তব্যের নিন্দা জানানোর ভাষাও আমাদের জানা নেই। অদক্ষ, অযোগ্য, অনভিজ্ঞ, সেবাদাস, তাঁবেদার সরকারের উদ্দেশে বলছি—একাধিক রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীতে কোনো একক রাষ্ট্রের বাঁধ নির্মাণ কিংবা নদীর ওপর কোনো ধরনের কাজ করার একক অধিকার নেই। ভারত আন্তর্জাতিক নদী আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তার নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কারণে এবং ভারত তোষণ নীতির কারণে এর প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, বেশ কিছুদিন আগে সরকারের একটি প্রতিনিধি দল টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ যাতে না হয়, সেজন্য ভারত-বাংলাদেশের যৌথ আলোচনার উদ্দেশ্যে দিল্লিতে গিয়েছিলেন এবং দিল্লি বৈঠকের পর বাংলাদেশের এই সরকারি প্রতিনিধি দল ভারতীয় মেহমান হিসেবে তাদের দেয়া হেলিকপ্টার নিয়ে টিপাইমুখ পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন। তখন তারা পরিদর্শন করেছিলেন কি-না বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে তারাই ভালো জানেন। কিন্তু প্রতিনিধি দলের প্রধান আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকসহ সবাই বাংলাদেশে ফিরে এসে সাফাই গেয়েছিলেন যে, টিপাইমুখে ভারত কোনো বাঁধ নির্মাণ করবে না। তত্কালীন সময়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তারা বলেছিলেন, মেঘ, বৃষ্টি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হেলিকপ্টার টিপাইমুখ পৌঁছতে পারেনি। তারা আকাশ থেকেই টিপাই দর্শন করেছিলেন। আজ শেখ হাসিনা সরকারের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা, তারা কেন বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সেদিন এ উপহাস করেছিলেন। কিছুদিন আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং বলেছিলেন বাংলাদেশকে না জানিয়ে টিপাইমুখে কোনো ধরনের বাঁধ নির্মাণ করা হবে না। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে প্রদত্ত সংবর্ধনায় একই কথা বলেছিলেন। আজ ভারত সরকার বাঁধ নির্মাণের যে চুক্তি সম্পাদন করেছে এবং এটা ডিসেম্বরে উদ্বোধন করবে—মনমোহনের এ ঘোষণা শুনে আমরা বিস্মিত ও স্তম্ভিত। ভারতীয়রা এবং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশের প্রতি শুধু বিগ ব্রাদারসুলভ আচরণই করছে না, তারা আমাদের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতায় অবতীর্ণ হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে ভারতীয়দের এ অপকর্মের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এবং তাদের এই আগ্রাসী তত্পরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে লেন্দুপ দর্জির ভূমিকায় অবতীর্ণ শেখ হাসিনার দেশদ্রোহী সরকারের এই মুহূর্তে ক্ষমতায় থাকার আর কোনো অধিকার নেই। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের মতো বিশাল রাজনৈতিক দলের যেসব দেশপ্রেমিক নেতাকর্মী রয়েছেন তারাও যেন দেশ, মাটি ও মানুষ রক্ষার আন্দোলনে শরিক হন তার আহ্বান জানানো হয়।
প্রতিবেশী বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না : ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
শফিকুল ইসলাম কলকাতা থেকে জানান, টিপাইমুখ জলবিদ্যুত্ প্রকল্পে বাঁধ নির্মাণ করা হলে প্রতিবেশী বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। এ দাবি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্রের। গতকাল নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
প্রসঙ্গত, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে ১৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিতর্কিত টিপাইমুখ জলবিদ্যুত্ প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে সেদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এনএইচপিসি লিমিটেড। এনএইচপিসি’র চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস কে গার্গ জানিয়েছেন, টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্প্রতি সরকারি প্রতিষ্ঠানটি মণিপুরের রাজ্য সরকার এবং সাতলুজ জলবিদ্যুত্ নিগম (এসজেভিএন) লিমিটেডের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছে। তিনি জানান, এই যৌথ উদ্যোগে এনএইচপিসি’র (যা আগে ন্যাশনাল হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেড নামে পরিচিত ছিল) ৬৯ শতাংশ শেয়ার থাকবে। এই কোম্পানিতে মণিপুর রাজ্য সরকার এবং এসজেভিএন লিমিটেডের যথাক্রমে ৫ শতাংশ ও ২৬ শতাংশ মালিকানা থাকবে। যৌথ উদ্যোগে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় এনএইচপিসি লিমিটেড, এসজেভিএন লিমিটেড এবং মণিপুর রাজ্য সরকার গত ২৮ এপ্রিল একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে বলেও জানান এস কে গার্গ। ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন— ‘টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাপারে ভারত এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না যাতে বাংলাদেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।’ ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ ভারত করবে না বলে মনমোহন সিং তাকে সুস্পষ্ট আশ্বাস দিয়েছেন। এনএইচপিসি’র চেয়ারম্যান জানান, নয়াদিল্লি ঢাকাকে বলেছে যে এই প্রকল্প বাংলাদেশে বন্যা প্রশমনে সাহায্য করবে। নয়াদিল্লিতে এনএইচপিসি লিমিটেডের বার্ষিক সংবাদ সম্মেলনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা (ঢাকাকে) জানিয়েছি যে তারা (বাংলাদেশ) এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপকৃত হবে। কারণ এই প্রকল্প ভাটি এলাকায় বন্যা কমিয়ে আনবে।’ ভারতীয় কর্মকর্তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন, টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাপারে এনএইচপিসি লিমিটেডের এই পদক্ষেপ শেখ হাসিনাকে দেয়া মনমোহন সিংয়ের আশ্বাসের পরিপন্থী নয়। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা মনে করি এই প্রকল্প বাংলাদেশের ক্ষতি করবে না। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ভারত এমন কিছু করবে না যা বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থী হবে। এবং আমরা এখনও সেই অবস্থানেই আছি।’ ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মাও টিপাইমুখ প্রকল্পকে সেদেশের অনুন্নত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার অবকাঠামো খাতে একটি বড় প্রকল্প হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ অঞ্চলের আরও দুটি রাজ্য হলো মণিপুর ও আসাম, যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে। জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের পাশাপাশি ভাটি এলাকায় বন্যা প্রশমনের লক্ষ্যে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের চুরাচাঁদপুর জেলায় বরাক নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের জন্য এই টিপাইমুখ বহুমুখী প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্প থেকে বছরে প্রায় ৩৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন হবে বলে ধরা হয়। ভারত সরকারের অর্থনৈতিক বিষয়ক কেবিনেট কমিটির অনুমোদন পাওয়ার পর এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সাড়ে সাত বছর লাগতে পারে। এনএইচপিসি প্রধান অবশ্য বলেন, টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে যে উদ্বেগ-আশঙ্কা রয়েছে তা তথ্যভিত্তিক নয়। এ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘এই প্রকল্প শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রাপ্যতাও নিশ্চিত করবে। যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে তা যথার্থ নয়। কারণ এটি পানি ধরে রাখার প্রকল্প নয়।’
বাংলাদেশ ও ভারতের পরিবেশবাদীদের একটি অংশ টিপাইমুখ প্রকল্পের বিরোধিতা করছে। তারা বলছে, বরাক নদীর ওপর এই বাঁধ নির্মাণ হলে বাংলাদেশের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাবে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সংগঠন টিপাইমুখ প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে। তারা প্রকল্প বন্ধে পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বানও জানান। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি এ বিষয়টিকে একটি প্রধান রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘টিপাইমুখের জলবিদ্যুত্ প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় জলবিদ্যুত্ সংস্থা (এনএইচপিসি), রাষ্ট্রায়ত্ত জলবিদ্যুত্ সংস্থা (এসজেভিএন) ও রাজ্য সরকারের মধ্যে গত ২২ অক্টোবর যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি সই হয়েছে।’
বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি দূর করতে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে সংসদ সদস্য আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংসদীয় দলের দিল্লি সফরের বিষয়টি উল্লেখ করে ভারতীয় ওই মুখপাত্র আরও বলেন, ‘সে সময় সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশের সংসদীয় প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে, বিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্যে প্রকল্পটিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু সেচকাজের জন্য নদীর গতিপথ পাল্টে দেয়া হবে না।’
ভারতীয় বক্তব্য বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
কূটনৈতিক রিপোর্টার জানান, বিতর্কিত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া বক্তব্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তি হিসেবে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের জন্য চুক্তি সইয়ের ৩ সপ্তাহ পর মিডিয়ার ব্যাপক সমালোচনার মুখে গতকাল রাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ইস্যু করা হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া বক্তব্যই মূলত তুলে ধরা হয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের জন্য স্বাক্ষরিত চুক্তির ব্যাপারে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া বক্তব্যও ঢাকার নজরে এসেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে বলা হয়, ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ রেখে এই হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রকল্পের নকশা করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সেচের জন্য কোনো পানি প্রত্যাহার করা হবে না।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তির দ্বিতীয় প্যারাতেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ের অংশবিশেষ তুলে ধরে বলা হয়, ‘গত ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছিলেন, টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের ব্যাপারে ভারত এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যাতে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময়ও একই নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।’
সংবাদ বিজ্ঞপ্তির তৃতীয় প্যারায় বাংলাদেশের একটি নতজানু বক্তব্য তুলে ধরে বলা হয়, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ ধরনের নিশ্চয়তার পর যা নদী তীরবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মনে করে বরাক নদীর মতো অভিন্ন নদীর ওপর কিছু করার আগে তা আলোচনা করা দরকার। বাংলাদেশ আশা করে ভারত এই প্রস্তাবিত প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানাবে, যাতে দু’দেশের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে কোনো দূরত্ব তৈরি না হয়।
টিপাই বাঁধ : ৬ নদী হবে ধূ-ধূ বালুচর
মিলাদ জয়নুল বিয়ানীবাজার থেকে জানান, সিলেটের ছয় উপজেলার নদনদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের স্রোতস্বিনী অনেক নদী ভরাট ও ভাঙনের কারণে নদীগুলো সবুজ মাঠে পরিণত হচ্ছে। তাছাড়া নদী দূষণ ও দখলের কারণে একে একে অনেক নদী মরে যাচ্ছে, হারাচ্ছে তাদের বিশালত্ব। সুরমা-কুশিয়ারা হারিয়েছে নাব্য। এ দুই প্রধান নদীর উত্সস্থল বরাকের মোহনা ভরাট হয়ে চর জেগে উঠেছে। সুরমা ও কুশিয়ারার উত্সস্থলে বর্তমান শুষ্ক মৌসুমে আছে হাঁটু পানি। সীমান্ত আইনের কারণে বরাকের চরে খেলাধুলাও করা যাচ্ছে না বলে জানায় আমলসীদ গ্রামের কিশোর রেজাউল। নতুবা হাঁটু পানি মাড়িয়ে বন্ধুদের নিয়ে সুরমা ও কুশিয়ারার উত্সস্থলে খেলাধুলা করত বলে সে আরও জানায়। ভারতকর্তৃক টিপাইবাঁধ নির্মাণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করায় সিলেটের মৃতপ্রায় এই ৬ নদী হবে খেলার মাঠ, এমনটি জানালেন একই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হারিছ আলী। বরাকের প্রতিবেশী আমলসীদ মসজিদের ইমাম জানান, সুরমা ও কুশিয়ারায় এমনিতেই পানি নেই। তার ওপর টিপাইবাঁধ হলে দুই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনবসতি চরম দুর্ভোগে পড়বে।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি উত্স থেকে নেমে আসা মনু নদী কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে কুলাউড়া, রাজনগর ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ওপর দিয়ে ৫৬ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সদর উপজেলার মনমুখ নামক স্থানে কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ভারত সরকার ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের নালকাটা নামক স্থানে মনু নদীর ওপর একটি ব্যারেজ নির্মাণ করায় গ্রীষ্ম ও বর্ষা উভয় মৌসুমে নদীর পানি স্রোত নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সেখানকার কর্তৃপক্ষের হাতে চলে গেছে। এর ফলে বাংলাদেশ অংশ নদীর তলদেশ মারাত্মকভাবে ভরাট হয়ে নদীর এই অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হয়েছে। সিলেটের পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, বন্যার পানির সঙ্গে লাখ টন পাহাড়ি বালু ও পলি ভেসে যাচ্ছে। নদীতে স্রোত না থাকায় নদীগুলোর তলদেশে বালু ও পলি জমে নদী ভরাট হয়ে উঠেছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সিলেটের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা, কুশিয়ারা, সুনাই, ধলাই, লোলা ও মনু নদী অস্বাভাবিকভাবে ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে অদূর ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেবে। সিলেটের সব প্রধান নদীরই উত্স হচ্ছে ভারতের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা। এসব নদনদীর উত্স এলাকায় বিভিন্ন সময়ে ভারত সরকার পরিকল্পিতভাবে তাদের মতো করে প্রজেক্ট তৈরি করায় এসব নদীর পানিপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে তাদেরই হাতে। ফলে নদীর স্বাভাবিক স্রোত ব্যাহত হচ্ছে। মনু, ধলাই, সুরমা ও কুশিয়ারা নদী এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় ভরাট হয়ে গেছে। অনেক স্থানে নদীতে স্রোত আছে কি নেই বোঝারই উপায় নেই। ফলে নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবনে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়।
নদী দূষিত হওয়ার ফলে দ্রুতগতিতে মরুকরণের দিকে যাচ্ছে সিলেট। শুকিয়ে যাচ্ছে খাল-বিল, হাওর ও জলাশয়। পানি নিম্নস্তরে নেমে গেছে। বিনষ্ট হচ্ছে কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য। পাহাড়ি ঢলের উজান থেকে নেমে আসা পলি, নদীভাঙন, নদী সংলগ্ন এলাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন কারণে বছরের পর বছর ধরে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের প্রায় সবক’টি নদীই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে এ অঞ্চলের অনেক নৌপথ সঙ্কটাপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এককালের খরস্রোতা সুরমা এখন বিভিন্ন পয়েন্টে স্রোতহীন একটা খালে পরিণত হয়েছে। এখানে এখন জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। এতে বহু নদীতীরবর্তী এলাকায় সেচ প্রকল্প বন্ধ রয়েছে। প্রয়োজনীয় খননের অভাবে এসব নদীর নাব্য হারিয়ে যাচ্ছে।
ঢাবি’র ২৫০ শিক্ষকের উদ্বেগ
বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫০ জন শিক্ষক এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন, চরম উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার সঙ্গে আমরা অবগত হয়েছি যে, বাংলাদেশকে দেয়া পূর্বের প্রতিশু্রতির প্রতি কোনো শ্রদ্ধা না দেখিয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে বিতর্কিত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের চুক্তি চূড়ান্ত করেছে ভারত। এ ক্ষেত্রে ভারত আন্তর্জাতিক আইনের কোনো তোয়াক্কা না করেনি। এ আচরণ কোনোভাবেই সত্ ও প্রতিবেশীসুলভ ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
শিক্ষকরা বলেন, বাংলাদেশের জনগণের অনুরোধ, দাবি ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পদক্ষেপ কেবল দুঃখজনকই নয়, এতে করে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের এ ধরনের অবন্ধুত্বসুলভ ও অন্যায় আচরণের আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অর্থাত্ বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লাসহ প্রায় ১২টি জেলার কৃষি উত্পাদন ব্যাপকহারে কমে যাবে। আর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। এসব কারণেই স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সব সরকারই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপ ও ক্ষোভের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি যে, বর্তমান সরকার দেশের স্বার্থ রক্ষায় টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে কোনো ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সরকারের দুর্বল ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণেই বাংলাদেশ আজ চরম ক্ষতির মুখোমুখি। কোনোভাবেই যেন ভারত বাংলাদেশের জন্য মরণ ফাঁদ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করতে না পারে, তার জন্য প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলার ও বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করার কার্যকর প্রচেষ্টা নিতে বর্তমান সরকারকে বাধ্য করতে হবে। দেশের স্বার্থ রক্ষায় গণআন্দোলন এবং যার যার অবস্থান থেকে সোচ্চার হওয়ার জন্য আমরা দলমত নির্বিশেষে সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
বিবৃতিদাতারা হলেন অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন, অধ্যাপক ড. মো. আমিনুর রহমান মজুমদার, অধ্যাপক ড. মো. সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. আফম ইউসুফ হায়দার, অধ্যাপক ড. তাজমেরী ইসলাম, অধ্যাপক ড. মো. আখতার হোসেন খান, অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক, অধ্যাপক ড. আবদুর রশিদ, অধ্যাপক ড. মিসেস শাহিদা রফিক, অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন, অধ্যাপক ড. এ. বি. এম. ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত, মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান, অধ্যাপক ড. মো. আশরাফুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজ, অধ্যাপক তাহমিনা আখতার, অধ্যাপক চৌধুরী মাহমুদ হাসান, অধ্যাপক আকা ফিরোজ আহমদ, অধ্যাপক ড. জাহিদুল ইসলাম, অধ্যাপক মামুন আহমেদ, অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দীন খান, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, ড. লুত্ফর রহমান প্রমুখ।

যুদ্ধাপরাধের বিচার : নিউইয়র্ক টাইমস ও হেরাল্ড ট্রিবিউনের নিবন্ধ: বিচারের নামে প্রতিহিংসা কি-না প্রশ্ন

ডেস্ক রিপোর্ট

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতে চলমান বিচারের ফলাফল নিষ্পত্তিমূলক হবে না কি বিচারের নামে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্রিটিশ আইনজীবী জন কামেহ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই আইনজীবী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমের বেশকিছু মারাত্মক ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে সর্বজনীন ন্যায়বিচার ও দায়িত্বশীলতার পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেছেন। বিশ্বের অন্যান্য স্থানে এ ধরনের বিচারে যেসব আদালত স্থাপিত হয়েছে, সেগুলোর মানদণ্ডও এখানে অনুসৃত হচ্ছে না বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
মানবাধিকার আইনজীবী কামেহ বৃহস্পতিবার (১৮ নভেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসের মতামত কলামে এক প্রতিবেদনে বলেন, গত ২০ বছরে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে এবং বেশিরভাগ লোক এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে। হেগের (নেদারল্যান্ড) আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এবং সিয়েরা লিওন, কম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন দেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে এখন সবাই বুঝে ফেলেছে যে নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধকারী রাজনীতিবিদ ও যুদ্ধবাজেরা শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না। জন কামেহ’র এই প্রতিবেদন ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছে।
সিয়েরা লিওনে যুদ্ধাপরাধ আদালতে মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ আইনজীবী ব্যারিস্টার কামেহ ওই প্রতিবেদনে বলেন, বাংলাদেশে এমন এক বিচার হচ্ছে যা যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতিমালাকে বিদ্রূপ করছে। বস্তুত, এটা সর্বজনীন ন্যায়বিচার ও দায়িত্বশীলতার প্রতি ভয়াবহ হুমকি সৃষ্টি করছে। অস্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পাঁচ প্রবীণ নেতার মানবতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে (অপরজন বিএনপির নেতা)। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার ঘটনার জন্য তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এটা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী তখন নৃশংস কার্যক্রম চালিয়েছিল। কিন্তু সেটা স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী জামায়াতের মতো কোনো রাজনৈতিক দলের অপরাধ প্রমাণ করে না। ৪০ বছর আগের একটি সংঘাতের জন্য বিচার শুরু করার আগে পূর্ণাঙ্গ নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত ছিল বলে তিনি জানান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের বর্তমান বিচার কার্যক্রমে সে রকম কিছু হচ্ছে না। এই আদালতে সর্বজনীন নীতিমালা অনুসরণের কথা বলা হলেও অন্যান্য দেশে এ ধরনের যেসব ট্রাইব্যুনাল কাজ করেছে, এখানে সেগুলোর বিপরীত কাজ করা হচ্ছে। নাম বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হলেও সেখানে বহির্বিশ্বের কিছু নেই, কারণ সেগুলো সেখানে গ্রহণ করা হয় না।
কামেহ বলেন, অভিযুক্ত পক্ষ যে কয়েকজন ব্রিটিশ আইনজীবীর সহায়তা চেয়েছিলেন, আমি তাদের একজন ছিলাম। আমি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আইনজীবী নিযুক্ত হয়েছিলাম। গত মার্চে আমি একবারই ঢাকায় যেতে পেরেছিলাম, সেখানে নিরাপত্তা সংস্থার লোকজন আমার পিছু নেয়। বিচার কার্যক্রমে আমাকে বা অন্য কোনো ব্রিটিশ আইনজীবীকে অংশ নিতে দেয়া হচ্ছে না বা তাদের বাংলাদেশেও যেতে দেয়া হচ্ছে না।
যেকোনো দিক থেকে বিশ্লেষণ করলেই এই বিচার কার্যক্রমের বিচ্যুতিগুলো প্রকটভাবে দেখা যাবে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে বিবাদীপক্ষের আইনজীবী ও সাক্ষীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, সাঈদীর একজন আইনজীবীকে ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে মামলা পরিচালনা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা চলছে। তাকে গ্রেফতারেরও হুমকি দেয়া হয়েছে। আরেকজন খ্যাতিমান আইনজীবীর বিরুদ্ধে ঢাকায় এক দাঙ্গায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। অথচ ওই ঘটনার সময় তিনি ইউরোপে ছিলেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও জানায়, বিবাদীপক্ষের একজন প্রধান সাক্ষীকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে আরও ৯টি ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত : ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি নিজামুল হকের নিয়োগ বেআইনি : যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থার শুনানি আজ


স্টাফ রিপোর্টার

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের প্রতি আসামিপক্ষের দেয়া অনাস্থা আবেদনের ওপর আজ উভয়পক্ষের আইনজীবীদের শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। বিচারপতি নিজামুল হক এর আগে এ বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকায় দ্বিতীয় দফায় এই বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে তার নিযুক্তি বেআইনি ও বিচারকদের জন্য নির্ধারিত আচরণবিধির লঙ্ঘন বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে বিচারপতি নিজামুল হককে বিচার বিভাগ ও বিচারকের মর্যাদার প্রতি সম্মান দেখিয়ে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রখ্যাত আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক যেহেতু এর আগেও একবার যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন, কাজেই বর্তমানে তার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের পদে থাকা সম্পূর্ণ বেআইনি, নীতিবহির্ভূত ও গর্হিত কাজ। একজন বিচারক এ ধরনের বেআইনি কাজ করলে বিচার বিভাগের প্রতি বিচারপ্রার্থী জনগণের আস্থা থাকবে না।
বিচারপতি নিজামুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা : বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় ৬ জন নেতাকে বিভিন্ন অজুহাতে গ্রেফতার করার পর তাদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কথিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। পরবর্তীতে তাদের বিচারের জন্য বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম এর আগে গণআদালত ও গণতদন্ত কমিশনসহ যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে গঠিত ও আয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা ও কার্যক্রমের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বলে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন। সম্প্রতি বিচারপতি নিজামুল হকের প্রতি ট্রাইব্যুনালে অনাস্থা আবেদন জমা দিয়েছেন তারা। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদে থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে পেশ করা আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিচারকদের আচরণবিধির ৩-এর ৬-এর ঘ অনুযায়ী যখন বিচারক কোনো ঘটনার নিজেই সাক্ষী থাকেন বা তদন্ত ও মামলা পরিচালনা করেন; সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে তিনি আর সেই বিচার কাজে জড়িত থাকতে পারেন না। কারাগারে আটক মাওলানা সাঈদীর পক্ষে করা আবেদনে আরও বলা হয়েছে, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালে গঠিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণতদন্ত কমিশনের চল্লিশ সদস্যের অন্যতম ছিলেন বিচারপতি নিজামুল হক। ওই সময় তিনি সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ছিলেন। তার সহযোগিতায় তৈরি হওয়া গণতদন্ত কমিটির রিপোর্টে জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়; যেহেতু তিনি এর আগে একই ঘটনার তদন্ত করেছেন, কাজেই এখন তিনি আর ওই ঘটনার বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। একই ব্যক্তির তদন্ত কর্মকর্তা আবার বিচারক হওয়া বেআইনি। এ ধরনের নজির বিশ্বের বিচারিক ইতিহাসে নেই।
আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া : একই ব্যক্তির একই বিচার প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয়বার জড়িত হওয়াও সম্পূর্ণ বেআইনি ও নীতিবহির্ভূত কাজ বলে উল্লেখ করে প্রথিতযশা আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, কোনো বিষয়ের সঙ্গে একবার যুক্ত থাকার পর একই বিষয়ে বিচারকের দায়িত্ব পালন করা হবে সম্পূর্ণ অবৈধ, বেআইনি ও অনৈতিক। বিচারপতি নিজামুল হক গণআদালতে সম্পৃক্ত থাকলে অবিলম্বে তাকে সরে দাঁড়াবার আহ্বান জানান এই সিনিয়র আইনজীবী।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও খ্যাতিমান ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সরকার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বর্তমানে যাদেরকে গ্রেফতার করে বিচারের আয়োজন করেছে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমও তাদের বিচারের দাবিতে একসময় আন্দোলন করেছেন। তিনি ঘাতক দালাল নির্মূূল কমিটির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক গঠিত গণতদন্ত কমিশনের সেক্রেটারিয়েটের মেম্বারও ছিলেন তিনি। এই কমিশনের তৈরি করা রিপোর্টের আলোকেই তদন্ত সংস্থা তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে এখন বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য পেশ করেছে। কাজেই যিনি তদন্ত করেছেন তিনিই আবার বিচার করছেন—এটা বেআইনি এবং অবিচারের শামিল। তিনি বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক আচরণবিধি মানলে এ পদে তিনি থাকতে পারেন না। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণতদন্ত কমিশনে জড়িত থাকায় নৈতিক কারণেই তার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে থাকার কোনো আইনগত অধিকার নেই। সরকার তাকে জোর করে এ পদে রাখতে চাইলেও তার পদত্যাগ করা উচিত। বিচারপতি নিজামুল হক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে তার কার্যক্রম অব্যাহত রেখে সুস্পষ্টভাবে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, যখন কোনো বিচারকের নিরপেক্ষতা যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন সেই বিচারকের বিচারিক কার্যক্রম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত।
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান থাকা সম্পূর্ণ বেআইনি হিসেবে উল্লেখ করে সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, বিচার বিভাগের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকলে তিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে থাকতে পারেন না। ন্যায়বিচারের স্বার্থেই তাকে এ পদ থেকে সরে যাওয়া উচিত। বর্তমানে তার ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় যাদের বিচারের জন্য আনা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত গণতদন্ত কমিশনের তিনি অন্যতম সদস্য হিসেবে এর আগেই তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন। কাজেই একই ব্যক্তির তদন্ত কর্মকর্তা ও বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন সম্পূর্ণ বেআইনি ও ন্যায়বিচার পরিপন্থী। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণআদালতের সেক্রেটারিয়েটের সদস্য ছিলেন। সে কারণে তিনি এ ট্রাইব্যুনালের বিচারক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। আইনের সাধারণ নীতি হচ্ছে—কোনো ব্যক্তি যদি সাক্ষীর কোনো পর্যায়ে যুক্ত থাকেন তবে তিনি সেখানে বিচারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষিত হবেন। বিচারপতি নিজামুল হক সরাসরি গণতদন্ত কমিশন ও গণআদালতের সঙ্গে জড়িত থাকায় তার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারে বসার আইনগত অধিকার নেই। তিনি বহুবার গণআদালতের পক্ষে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছেন ও বক্তব্য দিয়েছেন। বিচারপতি নিজামুল হকের সহযোগিতায় তৈরি হওয়া গণতদন্ত কমিটির তদন্ত রিপোর্টে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন সেই গণতদন্ত কমিশনের তদন্ত রিপোর্টই দলিল হিসেবে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেছে। কাজেই বিচারপতি নিজামুল হক এই ট্রাইব্যুনালের সাক্ষী হতে পারেন, বিচারপতি হিসেবে বিচার করার আইনগত এখতিয়ার তার নেই।
সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, যিনি কোনো বিষয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা হন, তিনি আবার কি করে তার বিচারক হন—পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। বিচারপতি নিজামুল হক ১৯৯৩ সালে গণতদন্ত কমিশনের মাধ্যমে নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদীর ফাঁসির সুপারিশ করেছিলেন। এখন তিনিই আবার এ বিষয়ে বিচারকের দায়িত্ব পালন করলে অবশ্যই একই দৃষ্টিভঙ্গিতে রায় দেবেন। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হবার আগে অবশ্যই বিচারপতি নাসিমের উচিত ছিল এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে অপারগতা প্রকাশ করা, তা না করে তিনি আইনি ভাষায় মিস কন্ডাক্ট করেছেন। মিস কন্ডাক্টকারী যে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে অভিযোগ এনে শাস্তি দেয়া যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, যেখানে কমিউনিস্ট পার্টি পর্যন্ত মনে করছে যুদ্ধাপরাধের বিচার স্বচ্ছ হওয়া দরকার, সেখানে নিজামুল হক ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে একটি স্পর্শকাতর দায়িত্বে নিজেকে বহাল রাখতে পারেন না।
এ ব্যাপারে সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি বিচারাধীন। আবেদনটি আদালতে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। কাজেই এ বিষয়ে আমি আগাম কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
খ্যাতিমান আইনজ্ঞ ও সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক আমার দেশকে বলেন, বিচারপতি নিজামুল হকের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদে থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অনাস্থা আবেদন দিয়েছে আসামিপক্ষ। এতে বলা হয়েছে, বিচারপতি নিজামুল হক এর আগে একবার এ বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন। কাজেই দ্বিতীয় দফায় আবারও এ বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তার নিজেকে যুক্ত করা বেআইনি। আসামিপক্ষের এ আবেদনের পর বিষয়টি নিয়ে বিভিন্নমহলে জোরালো আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই আমার কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য চাচ্ছেন। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য হচ্ছে— এই বিষয়টি এখন বিচারাধীন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে বিচারপতি নিজামুল হকের নিযুক্তি ও আসামিপক্ষের আবেদনের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল এ বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত দেয়, আমরা সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই। ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের পর এর আইনগত যৌক্তিকতা ও ভিত্তি নিয়ে কথা বলার সুযোগ থাকবে।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল বলেছেন, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে বিচারপতি নিজামুল হক বহাল থাকলে তা হবে আচরণবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রচলিত রীতি হচ্ছে, একই ব্যক্তি বিচারের কোনো এক পর্যায়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করলে তিনি আর পরবর্তীতে ওই বিচার প্রক্রিয়ায় নিজেকে নিযুক্ত করতে পারেন না। এটা নীতিবহির্ভূত কাজ। বিচারপতি নিজামুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা আবেদন দিয়েছেন আসামিপক্ষ। আসামিপক্ষের করা আবেদন শোনারও অধিকার বিচারপতি নিজামুল হকের নেই। সাধারণত যাদের প্রতি আকার-ইঙ্গিতে অনাস্থা আনা হয়, সুপ্রিমকোর্টের রেওয়াজ অনুযায়ী তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিব্রতবোধ করে সরে দাঁড়ান। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম এখন কি করেন তা দেখার বিষয়। তবে আমরা আশা করছি, তিনি বিচার বিভাগের মর্যাদার কথা চিন্তা করে নিজ থেকেই সরে দাঁড়াবেন। তিনি গোঁ ধরে বসে থাকবেন না। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সাবেক প্রধান আবদুল মতিনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, একই ট্রাব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধানের বিরুদ্ধে এর আগে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি দেরি না করে ন্যায়বিচারের স্বার্থেই পদত্যাগ করে চলে গেছেন।
বিচারপতি নিজামুল হকের বিষয়ে দেশের খ্যাতিমান দুই মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ও কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বীর বিক্রম একটি টিভি চ্যানেলে মন্তব্য করেছেন। গত শুক্রবার একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত সাক্ষাত্কারে এ বিষয়ে চরম উষ্মা প্রকাশ করেছেন তারা। কাদের সিদ্দিকী বলেন, একথা ধ্রুব সত্য যে, নিজামুল হক ১৯৯২ সালে গণআদালতের তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, মামলা পরিচালনা করেছেন। এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি থাকা তার জন্য হবে সম্পূর্ণ অবৈধ। ড. অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারকে অবশ্যই প্রশ্নমুক্ত রাখতে হবে। এই বিচারের কোনো বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে তা আন্তরিকভাবে খতিয়ে দেখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, কোনো একজন বিচারপতির জন্য গোটা বিচার কাজ প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে না। কর্নেল অলির মতে, শুধু বাংলাদেশে নয়, এ বিচারকে সারা বিশ্বে গ্রহণযোগ্য করতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অর্জন ম্লান হয়ে যাবে।
এদিকে বিশ্বস্ত একটি সূত্রে জানা গেছে, বিচারপতি নিজামুল হক যাতে নিজ থেকেই অব্যাহতি নিয়ে সরে না যান সেজন্য সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী তাকে চাপ সৃষ্টি করছেন।

বিদেশ সফরে দীপু মনির সেঞ্চুরি : অর্জন শূন্য



বশীর আহমেদ
বিদেশ সফরে সেঞ্চুরি করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ১০১তম সফরে তিনি গতকাল রাতে সৌদি আরব গেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর গত ৩৪ মাসে তিনি প্রায় ১৩ মাস কাটিয়েছেন বিদেশের মাটিতে। রেকর্ড গড়া এই বিদেশ সফরে দেশের জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য অর্জন নেই। বাংলাদেশের আগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বিদেশ সফরের রেকর্ড অনেক আগেই ভেঙেছেন ডা. দীপু মনি। শুধু রেকর্ড গড়া বিদেশ সফর নয়, নানা কারণে আলোচিতও তিনি। বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বহীন বক্তব্য দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন তিনি। বিদেশ ভ্রমণ ছাড়া তার আর কোনো কাজ আছে কিনা—এমন প্রশ্ন হরহামেশাই তোলা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। তাতেও তিনি দমে যাননি। বিরামহীনভাবে দেশে দেশে ঘুরছেন। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দেশের স্বার্থরক্ষায় ব্যর্থ এ মন্ত্রীর দিল্লিকে খুশি রাখার চেষ্টায় কোনো কমতি নেই। ভারতের চাহিদা অনুযায়ী সবকিছু উজাড় করে দেয়ার পরও বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারগুলো নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর এ ব্যর্থতার দায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীরই।
ডা. দীপু মনির এই ১০১ বার বিদেশ সফরের মধ্যে তিনি মাত্র ১৫-১৬ বার গেছেন দ্বিপক্ষীয় সফরে। বাকি সফরে গিয়েছেন তিনি বিভিন্ন সম্মেলন, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে যোগ দিতে।
গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ সফর সম্পর্কে বলেন, আমরা এখন আর কোনো হিসাব রাখি না।
৯৭তম সফর পর্যন্ত হিসাব ছিল। এখন আর রাখছি না। মন্ত্রী তো কোনো একটা দাওয়াত পেলেই বিমানে চড়ে বসেন। দেশের জন্য তেমন কোনো ফল আসে না এসব সফর থেকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২০০৯ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৩৪ বার বিদেশ সফর করেন। ১ বছরে বাংলাদেশের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটা ছিল রেকর্ড সংখ্যক বিদেশ সফর। ওই ৩৪ বার বিদেশ সফরে তিনি প্রায় ৪ মাস বিদেশের মাটিতে কাটান। কাকতালীয়ভাবে ২০১০ সালেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৩৪ বার বিদেশ সফর করেন।
তবে এসব সফরে তিনি ১৪৬ দিন অর্থাত্ প্রায় ৫ মাস বিদেশের মাটিতে কাটান। চলতি বছর গত ১০ মাসে ডা. দীপু মনি ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, রাশিয়া, চীন, মিয়ানমার, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, মিসর, তিউনিসিয়া, কুয়েত, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ অন্তত ৩৩ বার সফর করেছেন। সৌদি আরব, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে তিনি সফর করেছেন একাধিকবার।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর ডা. দীপু মনি ভারতের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। গত ৩ বছরে ভারতকে রীতিমতো সবকিছু উজাড় করে দিয়েছে বর্তমান সরকার। ফ্রি ট্রানজিট, করিডোর সুবিধা, বিদ্রোহ দমনে বাংলাদেশকে সঙ্গী করা, উলফা নেতাদের ভারতের হাতে তুলে দেয়া, বন্দর ব্যবহারসহ দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ভারত যা যা চেয়ে আসছিল তার সবই পূরণ করা হয়েছে। ভারতের জন্য ট্রানজিট সুবিধা সঠিকভাবে কার্যকরের জন্য অবকাঠামো তৈরি করতে উচ্চ সুদে ১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিতেও কোনো কুণ্ঠাবোধ করেনি সরকার। যদিও এই ঋণ কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। সন্ত্রাস দমনে ভারতকে সহায়তা দিতে ভারতের প্রস্তাবিত ৩টি চুক্তিও সই করেছে বাংলাদেশ।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়ে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ভারত একটি ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট সই করিয়ে নিয়েছে।
অন্যদিকে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যা বন্ধের মতো বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে কোনো অগ্রগতি হয়নি। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে রীতিমতো ঢাকার সঙ্গে প্রতারণা করেছে দিল্লি। এরপরও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত বন্দনার শেষ নেই। কোনো ফি ছাড়াই ভারতের পণ্য এখন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অথচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেদেশের স্বার্থরক্ষায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে বলেছেন, ভারতের কাছ থেকে সব চার্জ আদায় করা হচ্ছে।
তবে অনেক ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপেক্ষিত থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এবং ড. গওহর রিজভী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাদ দিয়েই অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাই বার বার প্রশ্ন উঠছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালায় কে?
শুধু ভারতকে খুশি করতে গিয়ে বাংলাদেশ এখন বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশে জনশক্তি রফতানিতে ধস নেমেছে। বার বার সৌদি আরব সফর করেও বাংলাদেশী শ্রমিকদের আকামা সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির দুয়ার এখনও বন্ধ। গ্রামীণ ব্যাংকসহ নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক অবনতিশীল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে আস্থায় নিতে পারছে না চীন।
সব মিলিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যর্থতার চিত্রই ফুটে উঠছে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত এতো ঘোরাঘুরি করেও বাংলাদেশের ইমেজ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন হলো, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতিবাচকভাবে আলোচিত হচ্ছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে অর্থায়ন বন্ধ করেছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা। দুর্নীতির ব্যাপারে কড়া সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো অব্যাহতভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে সক্ষমতা হারাচ্ছে বাংলাদেশ। যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হওয়ার বিষয় নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। অর্থাত্ আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের বদনাম বাড়ছে আর বাড়ছে।
বিদেশ ভ্রমণ আর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পাশাপাশি উদ্ভট সব মন্তব্য এবং কাজের জন্য সব সময়ে আলোচনায় আছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ডা. দীপু মনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ঢাকা সফরে আসেন। তখন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এক ভারতীয় সাংবাদিক বাংলাদেশকে পাকিস্তানের বাফার স্টেট বলে মন্তব্য করেন। সেদিন বাংলাদেশের সাংবাদিকদের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সেদিন বলেছিলেন, ভারতীয় সাংবাদিকদের মন্তব্যের গুরুত্ব বোঝেননি দীপু মনি।
গত ১৯ অক্টোবর ফটোগ্রাফার হিসেবে ডা. দীপু মনিকে দেখা গেছে। তিনি ছবি তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনবিঘা করিডোর দিয়ে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলে যান। প্রধানমন্ত্রী সেখানে বিদ্যুত্ সঞ্চালন কার্যক্রম, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন এবং ১০ শয্যার একটি হাসপাতাল উদ্বোধন করেন। এছাড়া তিনি তিনবিঘা করিডোরে ১৫ মিনিটের এক চা-চক্র অনুষ্ঠানে অংশ নেন। দেখা যায়, এ সময় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ছবি তোলার দৃশ্য কয়েকটি টিভি চ্যানেলে প্রচার হয়। এটা নিয়ে বেশ আলোচনাও হয়েছে। এর একদিন আগে গত ১৮ অক্টোবর তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিজের এলাকার শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা নিয়েছেন। এ ঘটনাও পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে।
এর আগে একবার বিদেশের মাটিতে তিনি সবার নজর কাড়েন অটোগ্রাফ শিকারি হিসেবে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরে যান। ওই সফরে প্রধানমন্ত্রীকে ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার দেয়া হয়। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল রাষ্ট্রপতি ভবনে ওই পুরস্কার প্রদান করেন। ওই অনুষ্ঠানে দীপু মনিকে দেখা গেল অটোগ্রাফ শিকারি হিসেবে। সেই ভরা মজলিসে সবাই দেখলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিভা পাতিল, সোনিয়া গান্ধী এবং ড. মনমোহন সিংয়ের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেদিন অটোগ্রাফগুলো নিয়েছিলেন আমন্ত্রণপত্রের ওপর। এছাড়া সম্প্রতি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির ব্যাপারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি গণক নই। এই গণক নিয়ে এখনও আলোচনা হয়। তবে তিনি গণক না হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে ব্যর্থ তা বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। অনেকে তাকে ভ্রমণপ্রিয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন।