Tuesday 29 November 2011

যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর অন্য রকম প্রতিবেদন

বুধবার, ৩০ নভেম্বর ২০১১
মানবজমিন ডেস্ক: বাংলাদেশে স্থাপিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতে বিচারের নামে প্রহসন করা হচ্ছে। এতে রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আগামী নির্বাচনের আগে এই বিচার করা গেলে বিরোধী দলকে দুর্বল করে দেয়া যাবে। আর এসব ঘটলে বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস লেখা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। গতকাল অনলাইন নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এই প্রতিবেদনটি ওই পত্রিকার ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে। এর লেখক ব্যাংককের সাংবাদিক টম ফেলিক্স জোয়েনক। তার প্রতিবেদনের শিরোনাম- এ ওয়ার ক্রাইমস কোর্ট অ্যান্ড এ ট্রাভেসটি অব জাস্টিস। এতে বলা হয়েছে, পুরান ঢাকায় ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া একটি সরকারি ভবন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের প্রত্যক্ষদর্র্শীদের সাক্ষ্যের কপি একত্রিত করে স্ট্যাপলিং করছেন কেরানিরা। বাংলাদেশ সরকারের মতে, ওই যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ওই সব কেরানির মাথার ওপর একটি মানচিত্র দেখা যায়, তাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর পাশের কক্ষেই বসেন বাংলাদেশে স্থাপিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান তদন্তকারী আবদুল হান্নান খান। ২০১০ সালের মার্চে এই আদালত স্থাপন করে বাংলাদেশ সরকার। এর উদ্দেশ্য, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং অন্যান্য অপরাধ কোন ব্যক্তি, গ্রুপ, সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা অথবা সহযোগী বাহিনীর কেউ করে থাকলে তাদের বিচার করে শাস্তি দেয়া। আবদুল হান্নান খান পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক। তিনি অমায়িক লোক। তার মধ্যে কোন তাড়াহুড়ো নেই। তিনি ধীর স্থির মানুষ। তাকে দেখে মনে হয় রাজনীতিতে তার কোন আগ্রহ নেই। তিনি বলেছেন, তার সংস্থা ৭ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করেছে। তাদের মধ্যে গত ২০শে নভেম্বর প্রথম জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এই ইসলামপন্থি দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। ৮৯ বছর বয়সী এই দলটির সাবেক প্রধান গোলাম আযম সহ জামায়াতে ইসলামীর প্রায় সবাই, বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র প্রথম সারির দু’জন নেতার সঙ্গে সাঈদীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। এখনও কোন বিচার হয়নি। তবে এরই মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত নামমাত্রই আন্তর্জাতিক আদালত। এর প্রধান লক্ষ্য- ওই সব বাংলাদেশী, যারা পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তায় হত্যাযজ্ঞে মেতেছিল। মনে হচ্ছে এই আদালতের মাধ্যমে সরকার দেশের ভিতরে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের জন্য পাকিস্তানের সাবেক সেনা সদস্যদের, যারা বাংলাদেশে সহিংসতার জন্য দায়ী তাদের বিচার করা ও শাস্তি দেয়া রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর। এর ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুরোপুরিভাবে ভেঙে যেতে পারে। তাছাড়া, দুই দেশের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকায় তা করা সম্ভাবও নয়।
এ ঘটনায় আরও লোকজন গ্রেপ্তার করা হবে নিশ্চিত। আবদুল হান্নান খান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ৬ সদস্য, বিএনপি’র ২ সদস্য সহ আরও মোট ১০ সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করছেন। এছাড়া, আছেন আশরাফুজ্জামান খান নামে এক মার্কিন নাগরিক, মইনুদ্দিন চৌধুরী নামে এক বৃটিশ নাগরিক। অভিযোগ আছে, তারা দু’জনেই আধা-সামরিক সংস্থা বলে পরিচিত আলবদরের নেতা ছিলেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে এই আলবদরই বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। আবদুল হান্নান খান বলেন, এর মধ্যে আশরাফুজ্জামান খান থাকেন নিউ ইয়র্কে এবং মইনুদ্দিন চৌধুরী থাকেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। তাদের এত দূরে থাকাটা বিচার ব্যবস্থায় একটি বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে। একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, এই বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে না। কারণ, এ দু’ব্যক্তির অনুপস্থিতিতেই তাদেরকে অভিযুক্ত করা হবে এবং বিচার করা হবে।
আদালত বিচারের প্রহসনে রূপ নিচ্ছে। অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করা সরকারের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল। এখন দৃশ্যত সরকার আদালতকে রাবারস্ট্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করছে। বেশির ভাগ বাংলাদেশীর কাছে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯৫ সালে। তখন বর্তমান আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিশিষ্ট নাগরিকদের স্বপ্রণোদিত একটি দল (প্যানেল) ১৬ ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ হাজির করেন। তাদের মধ্যে বর্তমানে ৭ জন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের জন্য অপেক্ষা করছেন। ১৯৯৫ সালের ওই প্যানেলে ছিলেন একজন বিচারক। জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের ডিফেন্স টিম ওই বিচারকের অপসারণ দাবি করছে। যদিও প্রত্যাশিত নয়, তবুও যদি জামায়াতে ইসলামীর পুরো নেতৃত্বকে অভিযুক্ত করা হয় এবং দুই বছরের মধ্যে ফাঁসি দেয়া হয় তাহলে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠেয় পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের আগেই বাংলাদেশের বিরোধী শক্তি বেশ দুর্বল হয়ে পড়বে। এ রকম নগ্ন দলীয় বিচারিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের জন্মের প্রকৃত ইতিহাস লেখার কাজকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলবে। ১৯৭১ সালের গণহত্যার স্বাধীন তদন্ত সংস্থা ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি। এই কমিটির এমএ হাসানের মতে, পাকিস্তানি সেনারাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। তারাই নৃশংসতার শতকরা ৯৫ ভাগ সংঘটিত করেছিল। দেশভাঙার চেষ্টা ব্যর্থ করতে তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তারা একটি তত্ত্বের ভিত্তিতে এসব কাজ করেছিল। তাহলো- দুই পাকিস্তানের ইসলামিক একত্বের সঙ্গে কোন কিছুর আপস করা হবে না। এখনও তাদেরকে আদালতে আনা হয়নি। পাকিস্তানিদের প্রতি অনুগত হাজার হাজার বিহারি অভিবাসীকে যেসব স্বাধীনতাপন্থি হত্যা করেছিল তাদের কোন সদস্যকেও আদালতে আনা হবে না।
বর্তমান অভিযুক্তদের তালিকা দেখে মনে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সুবিধা নিতে চায়। আর তা হলো- আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে স্বাধীন যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুমোদনের বিষয়টিকে সামনে এনে শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ ভাল কাজ করেছেন তা দেখানো।
বিবাদীপক্ষ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীকে নিযুক্ত করেছে। কিন্তু সরকার কার্যত তাদেরকে আদালতে উপস্থিত হতে দেয়া ঠেকিয়ে দিয়েছে। এমনকি তাদেরকে বাংলাদেশে ঢুকতেই দেয়া হয়নি।
রাজনীতিকরণের এই অবস্থার মাঝে এমএ হাসান পক্ষপাতহীন অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কয়েক বছর আগে, তিনি যুদ্ধাপরাধের অপরাধে জড়িত সন্দেহে সরকারকে ১৭৭৫ জনের একটি তালিকা দিয়েছেন। বর্তমানে যাদের বিরুদ্ধে বিচার হচ্ছে তারাও রয়েছেন ওই তালিকায়। এতে আরও নাম আছে আওয়ামী লীগ জোটের কিছু ব্যক্তির ও পাকিস্তানের সাবেক কিছু সেনা সদস্যের। এমএ হাসানের অফিসে গত মঙ্গলবারের সাক্ষাতের শেষে তিনি দায়মুক্তির চলমান ধারায় দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি ঢাকার গণহত্যার একটি মানচিত্র দেখান। এতে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ সহ দেখানো হয়েছে ৪৮টি গণকবর।

সর্বশেষ আপডেট বুধবার, ৩০ নভেম্বর ২০১১ ০১:২৭

No comments:

Post a Comment