Wednesday 23 November 2011

টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিবাদে সিলেটে ১ ডিসেম্বর হরতাল : ঢাবি শিক্ষকসহ বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ, ব্রিফিংয়ে দিল্লি বলেছে ক্ষতি হবে না


সিলেট অফিস

কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর উজানে বরাক নদীতে ভারতের টিপাইমুখের মরণবাঁধ রুখতে সিলেটে ক্রমেই দানা বাঁধছে প্রবল গণজাগরণ। টিপাইমুখে বিদ্যুত্ উত্পাদনের নামে বাঁধ নির্মাণ চুক্তির প্রতিবাদে জেলা ও মহানগর বিএনপি ১ ডিসেম্বর সিলেট জেলার সর্বত্র হরতালসহ সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি দিয়েছে।
গতকাল স্থানীয় একটি হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে জেলা ও মহানগর বিএনপির পক্ষে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপি কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জেলা সভাপতি সাবেক এমপি এম ইলিয়াস আলী।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, ২৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বেলা ২টায় ঐতিহাসিক কোর্ট পয়েন্টে গণজমায়েত, বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল। ২৬ নভেম্বর শনিবার সিলেট জেলার প্রতিটি উপজেলা ও থানায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল। ২৭ নভেম্বর রোববার বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সিলেট শহর বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল। ২৮ নভেম্বর সোমবার বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের নগরীতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল। ২৯ নভেম্বর মঙ্গলবার বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদলের বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল। ৩০ নভেম্বর বুধবার সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল এবং ১ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সিলেট মহানগরী এবং জেলার সব উপজেলা ও থানায় সর্বাত্মক সকাল-সন্ধ্যা হরতাল।
সংবাদ সম্মেলনে মহানগর সভাপতি এমএ হক, জেলা সহ-সভাপতি সাবেক এমপি দিলদার হোসেন সেলিম, জেলা সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আবদুল গফফার ও মহানগর সেক্রেটারি আবদুল কাইয়ুম জালালী পিংকি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এম ইলিয়াস আলী বলেন, যারা পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে এ মহাবিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, সেই আগ্রাসী অপশক্তি ভারতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া কোনো গতি নেই। তিনি বলেন, টিপাইমুখের বাঁধ বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলকে প্রথমেই মরুভূমিতে পরিণত করবে। পাশাপাশি ভারতীয়রা ইচ্ছামত বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে হাজার হাজার ফুট উঁচু পানির উচ্চতায় প্লাবিত করার নীলনকশা এঁটেছে। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বাস্তবায়ন হওয়া মানে সিলেটসহ বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ডে জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক পরিবর্তন নেমে আসবে। সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনার অববাহিকার অধিবাসীরা ও সিলেট, বৃহত্তর কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং মুন্সীগঞ্জের একটি অংশে ব্যাপক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটবে। শুকনা মৌসুমে সুরমা কুশিয়ারা মেঘনাসহ সব নদনদী শুকিয়ে যাবে এবং বর্ষা মৌসুমে আমরা স্বাভাবিক পানি থেকে বঞ্চিত হব এবং নদীগুলোর নাব্য হারিয়ে যাবে। ফলে ফসল উত্পাদন ব্যাহত হবে। গাছপালা তরুলতা স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারবে না। পশুপাখি স্বাভাবিকভাবে এ অঞ্চলে বিচরণ করতে পারবে না। নদী-হাওরগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে উত্পাদিত মাছ থাকবে না। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। মাটি তার স্বাভাবিক জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলবে। আর তখন নানা সমস্যা বা সামান্য ভূমিকম্পের কারণে ব্যাপক ধ্বংলীলা সংঘটিত হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারত তাদের টিপাইমুখ নামক স্থানে বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করেছিল এবং ক্রমান্বয়ে তারা তা বাস্তবায়ন অব্যাহত রেখেছে। গত সপ্তাহে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এ বাঁধ নির্মাণের চুক্তি করেছে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক-ছাত্র, আইনজীবী সব পেশা শ্রেণীর মানুষ এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে আসছে। পাশাপাশি সব শ্রেণীর বিবেকবান মানুষরা বর্তমান সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়ে আসছে, সরকার যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে এর প্রতিবাদ জানায় এবং বাঁধ নির্মাণ থেকে ভারতকে নিবৃত্ত রাখতে রাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক তত্পরতা চালায়। সবার পরামর্শ ছিল বাংলাদেশের বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রতিবাদ এবং বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার তা করেনি। উপরন্তু সরকারের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী টেলিভিশনে সাক্ষাত্কার দিয়ে বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের বক্তব্যের নিন্দা জানানোর ভাষাও আমাদের জানা নেই। অদক্ষ, অযোগ্য, অনভিজ্ঞ, সেবাদাস, তাঁবেদার সরকারের উদ্দেশে বলছি—একাধিক রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীতে কোনো একক রাষ্ট্রের বাঁধ নির্মাণ কিংবা নদীর ওপর কোনো ধরনের কাজ করার একক অধিকার নেই। ভারত আন্তর্জাতিক নদী আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তার নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কারণে এবং ভারত তোষণ নীতির কারণে এর প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, বেশ কিছুদিন আগে সরকারের একটি প্রতিনিধি দল টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ যাতে না হয়, সেজন্য ভারত-বাংলাদেশের যৌথ আলোচনার উদ্দেশ্যে দিল্লিতে গিয়েছিলেন এবং দিল্লি বৈঠকের পর বাংলাদেশের এই সরকারি প্রতিনিধি দল ভারতীয় মেহমান হিসেবে তাদের দেয়া হেলিকপ্টার নিয়ে টিপাইমুখ পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন। তখন তারা পরিদর্শন করেছিলেন কি-না বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে তারাই ভালো জানেন। কিন্তু প্রতিনিধি দলের প্রধান আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকসহ সবাই বাংলাদেশে ফিরে এসে সাফাই গেয়েছিলেন যে, টিপাইমুখে ভারত কোনো বাঁধ নির্মাণ করবে না। তত্কালীন সময়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তারা বলেছিলেন, মেঘ, বৃষ্টি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হেলিকপ্টার টিপাইমুখ পৌঁছতে পারেনি। তারা আকাশ থেকেই টিপাই দর্শন করেছিলেন। আজ শেখ হাসিনা সরকারের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা, তারা কেন বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সেদিন এ উপহাস করেছিলেন। কিছুদিন আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং বলেছিলেন বাংলাদেশকে না জানিয়ে টিপাইমুখে কোনো ধরনের বাঁধ নির্মাণ করা হবে না। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে প্রদত্ত সংবর্ধনায় একই কথা বলেছিলেন। আজ ভারত সরকার বাঁধ নির্মাণের যে চুক্তি সম্পাদন করেছে এবং এটা ডিসেম্বরে উদ্বোধন করবে—মনমোহনের এ ঘোষণা শুনে আমরা বিস্মিত ও স্তম্ভিত। ভারতীয়রা এবং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশের প্রতি শুধু বিগ ব্রাদারসুলভ আচরণই করছে না, তারা আমাদের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতায় অবতীর্ণ হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে ভারতীয়দের এ অপকর্মের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এবং তাদের এই আগ্রাসী তত্পরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে লেন্দুপ দর্জির ভূমিকায় অবতীর্ণ শেখ হাসিনার দেশদ্রোহী সরকারের এই মুহূর্তে ক্ষমতায় থাকার আর কোনো অধিকার নেই। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের মতো বিশাল রাজনৈতিক দলের যেসব দেশপ্রেমিক নেতাকর্মী রয়েছেন তারাও যেন দেশ, মাটি ও মানুষ রক্ষার আন্দোলনে শরিক হন তার আহ্বান জানানো হয়।
প্রতিবেশী বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না : ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
শফিকুল ইসলাম কলকাতা থেকে জানান, টিপাইমুখ জলবিদ্যুত্ প্রকল্পে বাঁধ নির্মাণ করা হলে প্রতিবেশী বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। এ দাবি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্রের। গতকাল নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
প্রসঙ্গত, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে ১৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিতর্কিত টিপাইমুখ জলবিদ্যুত্ প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে সেদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এনএইচপিসি লিমিটেড। এনএইচপিসি’র চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস কে গার্গ জানিয়েছেন, টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্প্রতি সরকারি প্রতিষ্ঠানটি মণিপুরের রাজ্য সরকার এবং সাতলুজ জলবিদ্যুত্ নিগম (এসজেভিএন) লিমিটেডের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছে। তিনি জানান, এই যৌথ উদ্যোগে এনএইচপিসি’র (যা আগে ন্যাশনাল হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেড নামে পরিচিত ছিল) ৬৯ শতাংশ শেয়ার থাকবে। এই কোম্পানিতে মণিপুর রাজ্য সরকার এবং এসজেভিএন লিমিটেডের যথাক্রমে ৫ শতাংশ ও ২৬ শতাংশ মালিকানা থাকবে। যৌথ উদ্যোগে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় এনএইচপিসি লিমিটেড, এসজেভিএন লিমিটেড এবং মণিপুর রাজ্য সরকার গত ২৮ এপ্রিল একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে বলেও জানান এস কে গার্গ। ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন— ‘টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাপারে ভারত এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না যাতে বাংলাদেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।’ ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ ভারত করবে না বলে মনমোহন সিং তাকে সুস্পষ্ট আশ্বাস দিয়েছেন। এনএইচপিসি’র চেয়ারম্যান জানান, নয়াদিল্লি ঢাকাকে বলেছে যে এই প্রকল্প বাংলাদেশে বন্যা প্রশমনে সাহায্য করবে। নয়াদিল্লিতে এনএইচপিসি লিমিটেডের বার্ষিক সংবাদ সম্মেলনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা (ঢাকাকে) জানিয়েছি যে তারা (বাংলাদেশ) এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপকৃত হবে। কারণ এই প্রকল্প ভাটি এলাকায় বন্যা কমিয়ে আনবে।’ ভারতীয় কর্মকর্তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন, টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাপারে এনএইচপিসি লিমিটেডের এই পদক্ষেপ শেখ হাসিনাকে দেয়া মনমোহন সিংয়ের আশ্বাসের পরিপন্থী নয়। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা মনে করি এই প্রকল্প বাংলাদেশের ক্ষতি করবে না। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ভারত এমন কিছু করবে না যা বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থী হবে। এবং আমরা এখনও সেই অবস্থানেই আছি।’ ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মাও টিপাইমুখ প্রকল্পকে সেদেশের অনুন্নত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার অবকাঠামো খাতে একটি বড় প্রকল্প হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ অঞ্চলের আরও দুটি রাজ্য হলো মণিপুর ও আসাম, যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে। জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের পাশাপাশি ভাটি এলাকায় বন্যা প্রশমনের লক্ষ্যে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের চুরাচাঁদপুর জেলায় বরাক নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের জন্য এই টিপাইমুখ বহুমুখী প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্প থেকে বছরে প্রায় ৩৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন হবে বলে ধরা হয়। ভারত সরকারের অর্থনৈতিক বিষয়ক কেবিনেট কমিটির অনুমোদন পাওয়ার পর এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সাড়ে সাত বছর লাগতে পারে। এনএইচপিসি প্রধান অবশ্য বলেন, টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে যে উদ্বেগ-আশঙ্কা রয়েছে তা তথ্যভিত্তিক নয়। এ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘এই প্রকল্প শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রাপ্যতাও নিশ্চিত করবে। যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে তা যথার্থ নয়। কারণ এটি পানি ধরে রাখার প্রকল্প নয়।’
বাংলাদেশ ও ভারতের পরিবেশবাদীদের একটি অংশ টিপাইমুখ প্রকল্পের বিরোধিতা করছে। তারা বলছে, বরাক নদীর ওপর এই বাঁধ নির্মাণ হলে বাংলাদেশের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাবে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সংগঠন টিপাইমুখ প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে। তারা প্রকল্প বন্ধে পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বানও জানান। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি এ বিষয়টিকে একটি প্রধান রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘টিপাইমুখের জলবিদ্যুত্ প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় জলবিদ্যুত্ সংস্থা (এনএইচপিসি), রাষ্ট্রায়ত্ত জলবিদ্যুত্ সংস্থা (এসজেভিএন) ও রাজ্য সরকারের মধ্যে গত ২২ অক্টোবর যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি সই হয়েছে।’
বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি দূর করতে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে সংসদ সদস্য আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংসদীয় দলের দিল্লি সফরের বিষয়টি উল্লেখ করে ভারতীয় ওই মুখপাত্র আরও বলেন, ‘সে সময় সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশের সংসদীয় প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে, বিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্যে প্রকল্পটিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু সেচকাজের জন্য নদীর গতিপথ পাল্টে দেয়া হবে না।’
ভারতীয় বক্তব্য বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
কূটনৈতিক রিপোর্টার জানান, বিতর্কিত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া বক্তব্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তি হিসেবে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের জন্য চুক্তি সইয়ের ৩ সপ্তাহ পর মিডিয়ার ব্যাপক সমালোচনার মুখে গতকাল রাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ইস্যু করা হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া বক্তব্যই মূলত তুলে ধরা হয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের জন্য স্বাক্ষরিত চুক্তির ব্যাপারে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া বক্তব্যও ঢাকার নজরে এসেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে বলা হয়, ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ রেখে এই হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রকল্পের নকশা করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সেচের জন্য কোনো পানি প্রত্যাহার করা হবে না।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তির দ্বিতীয় প্যারাতেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ের অংশবিশেষ তুলে ধরে বলা হয়, ‘গত ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছিলেন, টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের ব্যাপারে ভারত এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যাতে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময়ও একই নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।’
সংবাদ বিজ্ঞপ্তির তৃতীয় প্যারায় বাংলাদেশের একটি নতজানু বক্তব্য তুলে ধরে বলা হয়, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ ধরনের নিশ্চয়তার পর যা নদী তীরবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মনে করে বরাক নদীর মতো অভিন্ন নদীর ওপর কিছু করার আগে তা আলোচনা করা দরকার। বাংলাদেশ আশা করে ভারত এই প্রস্তাবিত প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানাবে, যাতে দু’দেশের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে কোনো দূরত্ব তৈরি না হয়।
টিপাই বাঁধ : ৬ নদী হবে ধূ-ধূ বালুচর
মিলাদ জয়নুল বিয়ানীবাজার থেকে জানান, সিলেটের ছয় উপজেলার নদনদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের স্রোতস্বিনী অনেক নদী ভরাট ও ভাঙনের কারণে নদীগুলো সবুজ মাঠে পরিণত হচ্ছে। তাছাড়া নদী দূষণ ও দখলের কারণে একে একে অনেক নদী মরে যাচ্ছে, হারাচ্ছে তাদের বিশালত্ব। সুরমা-কুশিয়ারা হারিয়েছে নাব্য। এ দুই প্রধান নদীর উত্সস্থল বরাকের মোহনা ভরাট হয়ে চর জেগে উঠেছে। সুরমা ও কুশিয়ারার উত্সস্থলে বর্তমান শুষ্ক মৌসুমে আছে হাঁটু পানি। সীমান্ত আইনের কারণে বরাকের চরে খেলাধুলাও করা যাচ্ছে না বলে জানায় আমলসীদ গ্রামের কিশোর রেজাউল। নতুবা হাঁটু পানি মাড়িয়ে বন্ধুদের নিয়ে সুরমা ও কুশিয়ারার উত্সস্থলে খেলাধুলা করত বলে সে আরও জানায়। ভারতকর্তৃক টিপাইবাঁধ নির্মাণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করায় সিলেটের মৃতপ্রায় এই ৬ নদী হবে খেলার মাঠ, এমনটি জানালেন একই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হারিছ আলী। বরাকের প্রতিবেশী আমলসীদ মসজিদের ইমাম জানান, সুরমা ও কুশিয়ারায় এমনিতেই পানি নেই। তার ওপর টিপাইবাঁধ হলে দুই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনবসতি চরম দুর্ভোগে পড়বে।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি উত্স থেকে নেমে আসা মনু নদী কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে কুলাউড়া, রাজনগর ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ওপর দিয়ে ৫৬ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সদর উপজেলার মনমুখ নামক স্থানে কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ভারত সরকার ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের নালকাটা নামক স্থানে মনু নদীর ওপর একটি ব্যারেজ নির্মাণ করায় গ্রীষ্ম ও বর্ষা উভয় মৌসুমে নদীর পানি স্রোত নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সেখানকার কর্তৃপক্ষের হাতে চলে গেছে। এর ফলে বাংলাদেশ অংশ নদীর তলদেশ মারাত্মকভাবে ভরাট হয়ে নদীর এই অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হয়েছে। সিলেটের পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, বন্যার পানির সঙ্গে লাখ টন পাহাড়ি বালু ও পলি ভেসে যাচ্ছে। নদীতে স্রোত না থাকায় নদীগুলোর তলদেশে বালু ও পলি জমে নদী ভরাট হয়ে উঠেছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সিলেটের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা, কুশিয়ারা, সুনাই, ধলাই, লোলা ও মনু নদী অস্বাভাবিকভাবে ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে অদূর ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেবে। সিলেটের সব প্রধান নদীরই উত্স হচ্ছে ভারতের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা। এসব নদনদীর উত্স এলাকায় বিভিন্ন সময়ে ভারত সরকার পরিকল্পিতভাবে তাদের মতো করে প্রজেক্ট তৈরি করায় এসব নদীর পানিপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে তাদেরই হাতে। ফলে নদীর স্বাভাবিক স্রোত ব্যাহত হচ্ছে। মনু, ধলাই, সুরমা ও কুশিয়ারা নদী এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় ভরাট হয়ে গেছে। অনেক স্থানে নদীতে স্রোত আছে কি নেই বোঝারই উপায় নেই। ফলে নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবনে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়।
নদী দূষিত হওয়ার ফলে দ্রুতগতিতে মরুকরণের দিকে যাচ্ছে সিলেট। শুকিয়ে যাচ্ছে খাল-বিল, হাওর ও জলাশয়। পানি নিম্নস্তরে নেমে গেছে। বিনষ্ট হচ্ছে কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য। পাহাড়ি ঢলের উজান থেকে নেমে আসা পলি, নদীভাঙন, নদী সংলগ্ন এলাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন কারণে বছরের পর বছর ধরে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের প্রায় সবক’টি নদীই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে এ অঞ্চলের অনেক নৌপথ সঙ্কটাপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এককালের খরস্রোতা সুরমা এখন বিভিন্ন পয়েন্টে স্রোতহীন একটা খালে পরিণত হয়েছে। এখানে এখন জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। এতে বহু নদীতীরবর্তী এলাকায় সেচ প্রকল্প বন্ধ রয়েছে। প্রয়োজনীয় খননের অভাবে এসব নদীর নাব্য হারিয়ে যাচ্ছে।
ঢাবি’র ২৫০ শিক্ষকের উদ্বেগ
বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫০ জন শিক্ষক এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন, চরম উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার সঙ্গে আমরা অবগত হয়েছি যে, বাংলাদেশকে দেয়া পূর্বের প্রতিশু্রতির প্রতি কোনো শ্রদ্ধা না দেখিয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে বিতর্কিত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের চুক্তি চূড়ান্ত করেছে ভারত। এ ক্ষেত্রে ভারত আন্তর্জাতিক আইনের কোনো তোয়াক্কা না করেনি। এ আচরণ কোনোভাবেই সত্ ও প্রতিবেশীসুলভ ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
শিক্ষকরা বলেন, বাংলাদেশের জনগণের অনুরোধ, দাবি ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পদক্ষেপ কেবল দুঃখজনকই নয়, এতে করে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের এ ধরনের অবন্ধুত্বসুলভ ও অন্যায় আচরণের আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অর্থাত্ বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লাসহ প্রায় ১২টি জেলার কৃষি উত্পাদন ব্যাপকহারে কমে যাবে। আর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। এসব কারণেই স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সব সরকারই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপ ও ক্ষোভের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি যে, বর্তমান সরকার দেশের স্বার্থ রক্ষায় টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে কোনো ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সরকারের দুর্বল ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণেই বাংলাদেশ আজ চরম ক্ষতির মুখোমুখি। কোনোভাবেই যেন ভারত বাংলাদেশের জন্য মরণ ফাঁদ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করতে না পারে, তার জন্য প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলার ও বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করার কার্যকর প্রচেষ্টা নিতে বর্তমান সরকারকে বাধ্য করতে হবে। দেশের স্বার্থ রক্ষায় গণআন্দোলন এবং যার যার অবস্থান থেকে সোচ্চার হওয়ার জন্য আমরা দলমত নির্বিশেষে সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
বিবৃতিদাতারা হলেন অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন, অধ্যাপক ড. মো. আমিনুর রহমান মজুমদার, অধ্যাপক ড. মো. সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. আফম ইউসুফ হায়দার, অধ্যাপক ড. তাজমেরী ইসলাম, অধ্যাপক ড. মো. আখতার হোসেন খান, অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক, অধ্যাপক ড. আবদুর রশিদ, অধ্যাপক ড. মিসেস শাহিদা রফিক, অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন, অধ্যাপক ড. এ. বি. এম. ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত, মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান, অধ্যাপক ড. মো. আশরাফুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজ, অধ্যাপক তাহমিনা আখতার, অধ্যাপক চৌধুরী মাহমুদ হাসান, অধ্যাপক আকা ফিরোজ আহমদ, অধ্যাপক ড. জাহিদুল ইসলাম, অধ্যাপক মামুন আহমেদ, অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দীন খান, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, ড. লুত্ফর রহমান প্রমুখ।

No comments:

Post a Comment