Saturday 29 January 2011

শেয়ারবাজারে সূচকে সার্কিট ব্রেকার চালু : লেনদেন বন্ধ : বিক্ষোভ ভাংচুর মতিঝিল রণক্ষেত্র


অর্থনৈতিক রিপোর্টার

পুঁজিবাজারের অস্বাভাবিক উত্থান-পতন ঠেকাতে সূচকের একদিনে হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সীমা (সার্কিট ব্রেকার) আরোপ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। আরোপিত সীমা অনুযায়ী, লেনদেন চলাকালে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক বেড়ে বা কমে ২২৫ পয়েন্ট অতিক্রম করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেশের দুই শেয়ারবাজারের লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে। গতকাল লেনদেন শুরুর আগে সূচকের এ নতুন সার্কিট ব্রেকার আরোপের বিষয়টি কার্যকর হয়। আর প্রথমদিনেই লেনদেন শুরুর মাত্র ১ ঘণ্টা ২৬ মিনিটের মাথায় ডিএসই সাধারণ সূচক আগের দিনের তুলনায় ২২৫ পয়েন্ট কমে সার্কিট ব্রেকারের সীমা অতিক্রম করায় তাত্ক্ষণিকভাবেই লেনদেন বন্ধ হয়ে যায় দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের।
এদিকে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পরই হাজার হাজার সাধারণ বিনিয়োগকারী রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ সমাবেশ ও ভাংচুর চালায়। রাজধানীর মতিঝিলস্থ ডিএসই ভবন এবং এর আশপাশের এলাকাসহ পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় বিনিয়োগকারীরা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে। অব্যাহত দরপতনে পুঁজি হারিয়ে রাস্তায় নেমে আসা বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর, ডিএসই প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করেন। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও নানা সেম্লাগান দেয়।
সূচকের সার্কিট ব্রেকার আরোপের বিষয়ে এসইসির দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কবির ভূইয়া সাংবাদিকদের জানান, কমিশনের বাজার পর্যালোচনা কমিটির বৈঠকে সূচকে সার্কিট ব্রেকার আরোপের সিদ্ধান্ত হয়েছে। মঙ্গলবার লেনদেন বন্ধ করার পর ডিএসই সাধারণ সূচক ২৩৭ পয়েন্টে গিয়ে স্থির হয়েছিল। সে পয়েন্টকে ভিত্তি ধরে তার ( ৫ %) হিসাবে সূচকের ক্ষেত্রে এ সার্কিট ব্রেকার আরোপ করা হয়েছে। সে হিসাবে কোনো লেনদেন দিবসে যদি ডিএসই সাধারণ সূচক একদিনে ২২৫ পয়েন্ট বেড়ে বা কমে যায় তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই দিনের লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে। পরের দিন থেকে আবার লেনদেন শুরু হবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেনও বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, লেনদেন চলাকালে প্রতি ৫ মিনিট পর পর সূচক সমন্বয় করা হয়। এ কারণে কোনো একটি পয়েন্টে সূচকের সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া যায়নি। একবার সমন্বয়ের পর পরের ৫ মিনিটের মধ্যে যাতে বড় ধরনের উত্থান বা পতন ঘটতে না পারে সে জন্য ২৩৭ পয়েন্টকে ভিত্তি ধরা হলেও হ্রাস-বৃদ্ধির পরিমাণ ২২৫ পয়েন্টের বেশি হলেই লেনদেন বন্ধ করে দেয়া হবে। পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এড়াতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই সার্কিট ব্রেকার আরোপ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। আনোয়ারুল কবির ভূইয়া বলেন, একদিনে সূচক ৪০০ থেকে ৫০০ পয়েন্ট পড়ে যাওয়া আবার ১ হাজার পয়েন্ট বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরে আনতে সার্কিট ব্রেকার আরোপ করা হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে সার্কিট ব্রেকার আরোপ করা হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শেয়ারবাজারেও সূচকের এ সার্কিট ব্রেকার রয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, বেশ ক’দিন ধরেই গুজব চলছে বাজার আরও পড়বে। বাজার গুজবনির্ভর হয়ে পড়েছে। সারা বিশ্বজুড়েই পুঁজিবাজারে নানা গুজব থাকে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আমরা আশাবাদী। গতকাল থেকে সূচকের এ সার্কিট ব্রেকার আরোপের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। আর কার্যকরের প্রথমদিনই সার্কিট সীমা অতিক্রম করায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে দিনের লেনদেন।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : বর্তমান বাজার পরিস্থিতির জন্য তারল্য এবং আস্থার সঙ্কটকে প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, সার্কিট ব্রেকার দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। বাজারে তারল্য সঙ্কট ছিল, এখন তা রূপ নিয়েছে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কটে। এ সঙ্কট কাটাতে না পারলে বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে না।
এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আমার দেশকে বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য স্টক মার্কেটে সূচকের ওপর সার্কিট ব্রেকার আরোপ করা হলেও তা কাজ করেনি। বর্তমানে বাজারে অস্থিতিশীলতার জন্য বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাবকে প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনাটা এখন সবচেয়ে জরুরি। ঢাকা বিশ্বদ্যািরয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক সালাহ উদ্দিন আহমেদ খান বলেন, সার্কিট ব্রেকার আরোপ ভালো কোনো সিদ্ধান্ত নয়। এর ফলে বাজার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। বাজারে আস্থার যে সঙ্কট তা কাটাতে হবে।
২ ঘণ্টা পর লেনদেন শুরু : গতকাল দিনের লেনদেন শুরু হয়েছে স্বাভাবিক সময়ের ২ ঘণ্টা পর। ১১টায় দিনের লেনদেন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয় যে, বুধবার লেনদেন ১টা থেকে শুরু হয়ে বেলা ৩টা পর্যন্ত চলবে। মূলত মঙ্গলবারের লেনদেন বন্ধ করাসহ বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সকালে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে এসইসি। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান উপস্থিত ছিলেন। মূলত ওই বৈঠকের কারণে লেনদেনের সময় ২ ঘণ্টা পিছিয়ে দেয়া হয়। বৈঠকে বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা শেষে সূচকের ওপর সার্কিট ব্রেকার আরোপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানা গেছে। আর সূচকের হ্রাস-বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়ার পর বেলা ১ থেকে দিনের লেনদেন শুরু হয়।
লেনদেন বন্ধ : সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপের প্রথম দিনে লেনদেন শুুরুর পর দেড় ঘণ্টার মধ্যেই শেয়ারবাজারে সূচকের নতুন সার্কিট ব্রেকারের সীমা অতিক্রম করায় লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল বেলা ১টার দিকে লেনদেন শুরুর পর ৫ মিনিটের মধ্যে বেশিরভাগ শেয়ারের দরবৃদ্ধি হলে ডিএসই সাধারণ সূচক আগের দিনের চেয়ে ১৬০ পয়েন্টের মতো বেড়ে যায়। কিন্তু এরপরই ব্যাপক হারে কমতে থাকে শেয়ারের দর। ১৫ মিনিট ধরে এ ধারা চলার পর বেলা ১টা ২৫ মিনিটের দিকে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে সূচক। তবে ১৫ মিনিট পর থেকে আবার একটানা দরপতন হতে থাকে। বেলা ২টা ৩০ মিনিটে ডিএসই সাধারণ সূচক হ্রাসের মাত্রা নির্ধারিত সর্বোচ্চসীমা অতিক্রম করে। এ সময় এই সূচক আগের দিনের চেয়ে ২৩১ পয়েন্ট কমে ৬৯০২.৪৮ পয়েন্টে দাঁড়ায়। ফলে ওই অবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে দিনের লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়।
বাজার পরিস্থিতি : গতকাল লেনদেন হওয়া ২৪০টি কোম্পানির মধ্যে ২৩০টিরই দর ব্যাপক মাত্রায় কমেছে। এর বিপরীতে ৭টির দর বেড়েছে এবং ৩টির দর ছিল অপরিবর্তিত। অধিকাংশ শেয়ারের দর ও সূচকে ব্যাপক নেতিবাচক প্রবণতা থাকলেও আর্থিক লেনদেনের মাত্রা ছিল গত কয়েক দিনের তুলনায় বেশি। মাত্র দেড় ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ডিএসইতে বুধবার ৫৩৭ কোটি ৪০ লাখ ৪৭ হাজার টাকার লেনদেন হয়েছে। আগের দিন ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে লেনদেন হয়েছিল ৬০৯ কোটি ৮৬ লাখ ১১ হাজার টাকা।
বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ : লেনদেন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিনিয়োগকারীরা মতিঝিল, দিলকুশা, দৈনিক বাংলা মোড়সহ আশপাশের এলাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ ও ভাঙচুর শুরু করে। তারা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে ইত্তেফাক মোড় থেকে দৈনিক বাংলা মোড় এবং পুরো দিলকুশা এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর সেম্লাগানে উত্তাল হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। এসময় আশপাশের অফিস, দোকানপাটের প্রধান ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়। খণ্ড খণ্ড মিছিলে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ ব্যাংক, এসইসি ও ডিএসই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন। বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারের পতনের প্রতিবাদে হরতালের পক্ষে সেম্লাগান দেয়। ‘হরতাল’, ‘হরতাল’ সেম্লাগানে মতিঝিল এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য প্রধানত অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করেন তারা। এজন্য তারা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগ দাবি করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বেলা আড়াইটার দিকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে লাঠিচার্জ করে বিনিয়োগকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এসময় বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা আরও কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে। এ অবস্থায় বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ শুরু করে।
বেলা সাড়ে ৩টার দিকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ এ এলাকায় বিক্ষোভরত বিনিয়োগকারীদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। এতে পথচারীসহ ৮-১০ জন আহত হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারমুখী অবস্থানের কারণে টিকতে না পেরে বিনিয়োগকারীরা এলাকা থেকে চলে যেতে থাকলে বেলা সাড়ে ৪টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। বিক্ষোভ চলাকালে বিভিন্ন এলাকা থেকে পুলিশ ৭-৮ জনকে আটক করে। অবশ্য সন্ধ্যায় এদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে মতিঝিল থানা সূত্রে জানা গেছে।
বিনিয়োগকারীরা জানান, আমরা শেয়ারবাজারে দরপতনের প্রেক্ষিতে সুষ্ঠু সমাধান চেয়েছিলাম। কিন্তু তা হয়নি। সূচকে সার্কিটব্রেকার আরোপ করে লেনদেন স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক, এসইসির এ বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতা নেই। এজন্য অর্থমন্ত্রী, গভর্নর এবং এসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ করা উচিত। ১:২ হারে ঋণ সুবিধা দেয়ার জন্য মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে বলা হলেও তারা তা মানছে না। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়ার কারণে অনেক বিনিয়োগকারীই ফোর্স সেলের মুখে পড়ছেন। এর ফলে অনেক বিনিয়োগকারীর এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। বাজারে প্রতিদিনই পতন হচ্ছে। আর কত পতন হবে?
মো. জাহেদ নামে এক বিনিয়োগকারী জানান, শেয়ারবাজারে দরপতন হবেই। কিন্তু যেভাবে দরপতন হচ্ছে, তাতে আমরা শুধু পুঁজিই হারাচ্ছি। আমরা এখন শঙ্কিত হয়ে পড়ছি। সোহেল নামে আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজি হারিয়ে রাস্তায় নেমে আসছেন। কিন্তু বাজারের সিন্ডিকেট চক্র পর্দার আড়ালে থেকে বাজারে দরপতন ঘটিয়ে শেয়ার কিনছে। তারা আবার মার্কেটকে টেনে তুলবে। তিনি বলেন, গত কয়েকদিনের দরপতনে অধিকাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজির ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ হারিয়েছেন। ১ লাখ টাকা যদি কেউ বিনিয়োগ করে থাকেন, এখন তা ৩০ হাজারে নেমে এসেছে। মৌলভিত্তিসম্পন্ন শেয়ার ক্রয়ের জন্য বলা হচ্ছে কিন্তু সেগুলোর দামও কমছে। আমরা এখন কোনো কথায় আস্থা রাখতে পারছি না। লিটন সিকদার নামে অপর এক বিনিয়োগকারী বলেন, আমাদের এখন শেয়ার কেনার ক্ষমতা নেই। দাম কমলে শেয়ার কেনার কথা বলা হয়। ১০০ টাকার শেয়ারের দাম ৮০ টাকায় নেমে আসার পর তা কিনেছি। আবার ৭০ টাকায় নামার পরও কিনেছি। এখন তা আরও নেমে ৪০ থেকে ৫০ টাকায় এসেছে। কিন্তু আমরা এখন আর কিনতে পারছি না। আর কত কম দামে শেয়ার কিনব? প্রতিদিনই দাম কমছে। এর ফলে আমরা বাজারের লেনদেন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছি না।
অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক : পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, ড. মশিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার, সদস্য মো. ইয়াসিন আলী, মো. আনিসুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে পুঁজিবাজার পরিস্থিতি ও সঙ্কট উত্তরণে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হলেও সূচকের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ ছাড়া আর কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। তবে বৈঠক থেকে বর্তমান পরিস্থিতি শেয়ারের অতিমূল্যায়ন রোধ ও বাজার থেকে অতিরিক্ত অর্থ স্থানান্তর বন্ধে বুকবিল্ডিং পদ্ধতির কার্যকারিতা স্থগিত রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এছাড়া পুঁজিবাজারে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরির পেছনে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর কারসাজি রয়েছে কিনা—তা খুঁজে বের করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বৈঠকে এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার জানিয়েছেন, পুঁজিবাজারের নেতিবাচক পরিস্থিতি উত্তরণে এসইসি তাদের হাতে থাকা প্রায় সব ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। এখন পুঁজিবাজার সামাল দিতে এসইসির তেমন কিছুই করার নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান বৈঠকে বলেন, পুঁজিবাজারের বর্তমান নেতিবাচক পরিস্থিতি ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু নগদ সহায়তা দিয়ে বেশিদিন এ পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
ডিএসইর ব্রিফিং : বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বিকালে ডিএসইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সতিপতি মৈত্র সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এসময় তিনি সূচকের সার্কিটব্রেকার আরোপের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যাদের হাতে ভালো কোম্পানির শেয়ার আছে, কোনোভাবেই তাদের আতঙ্কে তা বিক্রি করা ঠিক হবে না। বিনিয়োগকারীরা ধৈর্য ধারণ করলে অবশ্যই পুঁজিবাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
এসইসির একের পর এক সিদ্ধান্ত : এদিকে টানা দরপতন ঠেকাতে গত এক মাসের মধ্যে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি। কিন্তু এতেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। ৮ ডিসেম্বর থেকে শেয়ারবাজারে প্রায় টানা দরপতনের ঘটনা ঘটছে। আর এসব দরপতনের পরপরই একের পর এক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে তারা। এ সময়ে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—মার্জিন লোন সুবিধা বৃদ্ধি, একক ব্যক্তির ক্ষেত্রে মার্জিন লোনের সীমারেখা তুলে নেয়া, গ্রামীণফোনের শেয়ারের বিপরীতে নেটিং সুবিধা, মার্জিন সুবিধা অযোগ্য কোম্পানির শেয়ারের বিপরীতে আর্থিক নেটিং সুবিধা চালু, স্পট মার্কেট থেকে সব কোম্পানিকে মূল মার্কেটে ফিরিয়ে নিয়ে আসা, মিউচুয়াল ফান্ডের প্রাইভেট প্লেসমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর সীমা বৃদ্ধি এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সীমা তুলে দেয়া, মার্জিন লোনের ক্ষেত্রে এনএভিভিত্তিক পদ্ধতি স্থগিতসহ আরও বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বলতে গেলে এসইসি মার্কেট নিয়ন্ত্রণের সব ধরনের বিধিমালা প্রত্যাহার এবং সুবিধা বৃদ্ধি করেছে। মঙ্গলবার স্টক ডিলারদের জামানতবিহীন লেনদেনের সীমা তিনগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও বাজারের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। সর্বশেষ গতকাল সূচকের ক্ষেত্রে আরোপ করা হলো সার্কিটব্রেকার।
টানা ৫ দিন দরপতন : এদিকে টানা দরপতনের শিকার হয়েছে শেয়ারবাজার। গতকাল নিয়ে টানা ৫ দিন শেয়ারবাজারের সূচকের পতন হয়েছে। আর এ সময়ে ডিএসই সাধারণ সূচক কমেছে প্রায় ৬০০ পয়েন্ট। গতকাল দিনশেষে ডিএসই সাধারণ মূল্যসূচক কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৯১৩ পয়েন্টে। একই সময়ে বাজার মূলধন কমেছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এবছরের শুরুতে ডিএসই সাধারণ সূচক ছিল ৮ হাজার ৩০৪ পয়েন্টে। অর্থাত্ এ বছরের মাত্র ১৩ লেনদেন দিবসে সূচক কমেছে ১ হাজার ৯১ পয়েন্ট।
‘বুকবিল্ডিং’ পদ্ধতির কার্যকারিতা স্থগিত : শেয়ারের মূল্য নির্ধারণে বহুল আলোচিত ‘বুকবিল্ডিং’ পদ্ধতির কার্যকারিতা আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ পদ্ধতিতে শেয়ারের মূল্য নির্ধারণে বড় ধরনের কারসাজির অভিযোগ রয়েছে। অবশেষে এ পদ্ধতিটি আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দু’একদিনের মধ্যেই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হতে পারে। গতকাল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সরকারি বাসভবনে পুঁজিবাজার বিষয়ক অনুষ্ঠিত বৈঠকে অর্থমন্ত্রী বর্তমান পরিস্থিতিতে বুকবিল্ডিং পদ্ধতি স্থগিত রাখার জন্য এসইসিকে পরামর্শ দেন। এরই প্রেক্ষিতে এসইসি বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সূত্র জানায়, বুকবিল্ডিং পদ্ধতি স্থগিত হলে যেসব কোম্পানি এরই মধ্যে নির্দেশক মূল্য নির্ধারণ করে এসইসিতে আবেদন জমা দিয়েছে, সেসব কোম্পানি চাইলে নির্ধারিত মূল্য (ফিক্সড প্রাইস) পদ্ধতিতে আইপিওর জন্য আবেদন করতে পারবে। অন্যথায় এসব কোম্পানিকে বুকবিল্ডিং পদ্ধতি নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে এরই মধ্যে যে দুটি কোম্পানি বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণের পর আইপিও আবেদন জমা নিয়েছে, সেগুলো লটারির মাধ্যমে শেয়ার বরাদ্দের পর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হবে

অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে গণবিদ্রোহ হতে পারে : অলি : বিরোধী দমনে সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণ : দ্রব্যমূল্য ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ : ৩৫ বছরেও এত বেশি দুর্নীতি হয়নি



চট্টগ্রাম ব্যুরো

মহাজোটের অংশীদার লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান ও পরিকল্পনাবিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এক বিশেষ সাক্ষাত্-কারে বলেছেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বিমাতাসুলভ ও অসহিষ্ণু আচরণ করা হচ্ছে। বিরোধী দলকে দমন করার জন্য সরকারের মধ্যে এক ধরনের প্রতিহিংসা ও অস্থিরতা কাজ করছে। সরকারের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের ফলে জনগণের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। সঠিক সময়ে এই বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে গণবিদ্রোহ দেখা দিতে পারে।
কর্নেল (অব.) অলি সোমবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য এবং সম্মেলনের আগে ও পরে আমার দেশকে দেয়া একান্ত সাক্ষাত্কারে এসব কথা বলেন।
দ্রব্যমূল্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। বর্তমানে নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। জনগণের দুর্ভোগ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়ে কখনও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হতে থাকলে নিম্নআয়ের কর্মচারী, শ্রমিক, দরিদ্র ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র কৃষকদের অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে হবে। তিনি বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অনেক সমস্যা রয়েছে। সমস্যা চিহ্নিত করে ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিতে হবে।
দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে কর্নেল (অব.) অলি বলেন, গত এক বছরে ৪৩৬টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৭৫ জন নিহত ও ৭ হাজার ১০৩ জন আহত হয়েছে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৫৭৬টি ও বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৯২টি ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৩৮ জন নিহত ও ৫৬১৪ জন আহত হয়েছে। বিএনপির ৭ জন নিহত ও ১১৪৬ জন আহত হয়েছে। গত বছরে ১৩৩ জন বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। গণপিটুনীতে নিহত হয়েছে ১২৮ জন। নিখোঁজ ও গুপ্ত হত্যার ঘটনা আতঙ্কজনক। ১৬ জন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আইন-শৃঙ্খলা সংস্থার হেফাজতে ২০১০ সালে মারা গেছেন ১১০ জন। গত বছর ৬২৫ জন নারী ধর্ষিত হয়েছে। ধর্ষণের পর ৭৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। অপমান সইতে ও প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ২০ জন। বিগত বছরে সর্বমোট ৪১৬২টি হত্যা ও ৮৭১টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে।
বিদ্যুত্ ও গ্যাস সঙ্কট সম্পর্কে কর্নেল (অব.) অলি বলেন, বিদ্যুত্ ও গ্যাসের অবস্থা ভয়াবহ। গ্যাসের অভাবে সার কারখানা, বিদ্যুত্ ও শিল্প কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুত্ সঙ্কট নিরসনে গত দু’বছরে সরকারের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। চুক্তির পর চুক্তি করেও বাড়েনি বিদ্যুত্। অযোগ্য ও অসত্ লোক দিয়ে এ ধরনের কঠিন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
দুর্নীতি প্রসঙ্গে কর্নেল (অব.) অলি বলেন, প্রতিদিন দেশে সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি বাড়ছে। বিগত ৩৫ বছরেও দেশে এত বেশি দুর্নীতির ঘটনা ঘটেনি। দুর্নীতি বন্ধের নেই কোনো পদক্ষেপ। সরকার আইন সংশোধন করে দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করেছে বিধায় বিচার কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। দুর্নীতির ব্যাপারে টিআইবি প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর সরকার ও বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব দেখিয়েছেন। এতে সরকারের একনায়কত্বসুলভ আচরণ প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে। সরকারের উচিত ছিল টিআইবির তথ্য কাজে লাগিয়ে সঠিক তথ্য উদ্ঘাটন করা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। তা না করে হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অহঙ্কারীর পতন অপরিহার্য। আত্মঅহঙ্কার আল্লাহ কখনও সহ্য করে না।
জনশক্তি রফতানি, শ্রমবাজার ও রেমিট্যান্স প্রসঙ্গে কর্নেল (অব.) অলি বলেন, মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসগুলোর ব্যর্থতার কারণে ধীরে ধীরে শ্রমবাজার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর দখলে চলে যাচ্ছে। নানামুখী কূটনৈতিক তত্পরতা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ মন্ত্রীদের সফরের পর সৌদিআরব, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও শ্রমবাজার পুনরুদ্ধার করা যায়নি। প্রবাসী বাংলাদেশীদের সমস্যাগুলো নিরসন হয়নি। বরং সরকারের অর্থ অপচয় হয়েছে। তিনি বলেন, যেখানে ২০০৮ সালে ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জন বিদেশে যায় সেখানে ২০০৯ সালে গিয়েছে মাত্র ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২২৮ জন, ২০১০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৮৩ জন। ফলে বিদেশে জনশক্তি রফতানি হ্রাস পাওয়ায় প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সের উপরে। ২০১০ সালে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৬৯ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। অথচ ২০০৯ সালে রেমিট্যান্স ছিল ৭৩ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা।
রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার সম্পর্কে কর্নেল (অব.) অলি বলেছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার যে কটি সুপারিশ করেছে তার সবকটি সরকারদলীয় সমর্থকদের। আবার এমন মামলাও প্রত্যাহার করা হয়েছে যেসব মামলার বাদী-বিবাদী কেউ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এভাবেই দুর্নীতি, খুন, ডাকাতের অনেক মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে অবনতি ঘটছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির।
কর্নেল (অব.) অলি বলেন, ২০১১ সাল বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর। তাই অহঙ্কারী ও সবজান্তা মনোভাব পরিহার করতে হবে। সব ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে। অন্যথায় যা হওয়ার তাই হবে

শেয়ারবাজারে মহাধস : মতিঝিল রণক্ষেত্র : ৫০ মিনিটে সূচক পতন ৬৩৫ : ট্রেড বন্ধ : আজ চালু হবে



কাওসার আলম

আবারও ভয়াবহ বিপর্যয়ে শেয়ারবাজার। ট্রেড শুরুর আধঘণ্টার মধ্যে গতকাল ৬ শতাধিক পয়েন্ট সূচক নেমে গিয়ে দরপতনের সব রেকর্ড অতিক্রম করে ডিএসসি। এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ৫০ মিনিটের মাথায় নজিরবিহীনভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের ট্রেড বন্ধ করে দেয়। দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো লেনদেন স্থগিত করার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীসহ সারাদেশে।
তবে আজ থেকে যথারীতি লেনদেন শুরু হবে বলে জানিয়েছে এসইসি। লেনদেন বন্ধ করে দেয়ার আগ পর্যন্ত দেশের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচকের পতন হয় ৬৩৫ দশমিক ৫৮ পয়েন্ট। শতাংশ হিসাবে এ পতনের হার ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া ২৩৩টি কোম্পানির মধ্যে ৪টি ছাড়া সবক’টির দর কমে। গতকাল একদিনেই ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। অপরদিকে চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারে গতকাল সার্বিক মূল্য সূচকের পতন হয়েছে ১ হাজার ৩৬৯ পয়েন্ট। শতাংশ হিসাবে সূচক পতনের এ হার ৬ দশমিক ৭৭ ভাগ।
এদিকে দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণে পুঁজি হারানো হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারী রাস্তায় বিক্ষোভ, সমাবেশ, মিছিল, ভাংচুর করেছে। রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড় থেকে ইত্তেফাকের মোড় পর্যন্ত এলাকা ছিল বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের দখলে। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে দফায় দফায় পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় পুরো মতিঝিল এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশ বিনিয়োগকারীদের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে। পুলিশের লাঠিপেটা থেকে রেহাই পাননি সাংবাদিকরা। পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হয়েছেন এবিসি রেডিওর সীমা ভৌমিক, আমাদের অর্থনীতির মাসুদ আহমেদ, শীর্ষ নিউজের মর্তুজা ও প্রথম আলোর ওয়ারিশ। এছাড়া পুলিশ বেশ কয়েকজন বিনিয়োগকারীকেও আটক করে করে। বিনিয়োগকারীরা ডিএসই ভবন ও এসইসি কার্যালয়ের সামনে আগুন জ্বালিয়ে রাস্তা অবরোধ করে রাখে। বিনিয়োগকারীরা এসইসি কার্যালয়ে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে তারা ভবনের নিচতলায় ভাংচুর চালায়। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের খণ্ড খণ্ড মিছিলে উত্তপ্ত ছিল রাজপথ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ ও ভাংচুর করেছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
অপরদিকে বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে মার্জিন লোন সুবিধা বৃদ্ধি, ঋণ অযোগ্য কোম্পানির জন্য আর্থিক সমন্বয় সুবিধা চালু, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। অপরদিকে পুঁজিবাজারের স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক এক খাত থেকে অন্যখাতে ঋণ সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়িয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের ফলে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে বলে আশা করছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি।
গতকাল বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার বলেন, অস্বাভাবিক দরপতনের প্রেক্ষিতে শেয়ারবাজারে লেনদেন কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। মাত্র আধঘণ্টায় সূচক ৬০০ পয়েন্ট পড়ে যাওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রথম হলেও পৃথিবীর অনেক দেশেই লেনদেন কার্যক্রম বন্ধ রাখার নজির রয়েছে। পুঁজিবাজারে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এসইসির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, লেনদেন বন্ধ রাখার পর বাজারে চলমান সঙ্কট দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগামীকাল (আজ) সকাল থেকে স্টক এক্সচেঞ্জে স্বাভাবিক লেনদেন কার্যক্রম চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। এসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ফলে বাজারে স্বাভাবিকতা ফিরবে বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। তিনি শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তারল্য সঙ্কটকে দায়ী করেন। মুদ্রানীতির জন্য তারল্য সঙ্কট তৈরি হয়েছে বলে বলে মন্তব্য করেন এসইসি চেয়ারম্যান।
শেয়ারবাজারে ক্রমাগত দরপতনের কারণে বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এসইসি চেয়ারম্যান, ডিএসই প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান এবং পদত্যাগ দাবি করেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও নানা স্লোগান দেন। এসইসি ভবনের সামনের রাস্তায় বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের ‘প্রধানমন্ত্রীর ... জুতা মারো তালে তালে’ স্লোগান দেন। শেয়ারবাজারের দরপতনের জন্য তারা অর্থমন্ত্রীর ভূমিকার সমালোচনা করেন এবং তার পদত্যাগ দাবি করেন। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের কারণে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটছে বলে বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেন। বিনিয়োগকারীরা বলেন, ব্যাংকগুলো যখন শেয়ারবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করেছিল তখন বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এখন হঠাত্ করেই যেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘুম ভেঙেছে। তারা ব্যাংকগুলোর সিআরআর এবং এসএলআরের পরিমাণ বাড়িয়েছে। আবার ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে বলেছে। কিন্তু শুরুতেই ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত বিনিয়োগ করে শেয়ারবাজারে তারল্যের জোয়ার বইয়ে দিয়েছিল, এখন তাদের বাধ্য করা হয়েছে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে। এর ফলে বিনিয়োগকারীর ভাগ্য বিপর্যয় ঘটছে। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। এর দায় নিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরকে। তারা বলেন, ব্যাংকগুলো তার আমানতের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু যখন এ নিয়ম করা হয় তখন শেয়ারবাজারের সূচক ছিল মাত্র ২ হাজার পয়েন্ট। পুঁজিবাজারে পরিধিও ছিল খুব ছোট। তখনকার হিসাবে ১০ শতাংশ বিনিয়োগ বৈধ হলে এখন বাজার অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর বাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসীমা ১০ শতাংশ যথেষ্ট নয়। এ সীমা আরও বাড়ানো উচিত ছিল। অদূরদর্শী ভূমিকার জন্য বিনিয়োগকারীরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ দাবি করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে পুঁজিবাজারবিরোধী উল্লেখ করে বিনিয়োগকারীরা বলেন, গভর্নর শেয়ারবাজারকে ‘ফটকা কারবার’ বলে অভিহিত করে থাকেন। আমরা কোনো ফটকা কারবারি নই। যারা শেয়ারবাজারে কারসাজি করছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
এদিকে এসইসির ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের তীব্র সমালোচনা করে বিনিয়োগকারীরা বলেন, বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। এসইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যেসব কোম্পানির মূল্য-আয় (পিই) অনুপাত ৪০ এর বেশি সেসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ এবং সেসব কোম্পানির শেয়ারের বিপরীতে মার্জিন লোন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এসইসি নিজেই বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৬৫ থেকে ৭০ পিই অনুপাতে কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলে নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সম্প্রতি আইপিও আবেদন শেষ হওয়া মবিল যমুনা লুব্রিকেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তারা বলেন, এ কোম্পানি ৬০ এর বেশি পিই অনুপাতে শেয়ার থেকে টাকা উত্তোলন করার অনুমতি পেয়েছে কিভাবে? মাত্র ৩০ কোটি টাকার শেয়ার ছেড়ে ৫৫৫ কোটি টাকা সংগ্রহে হোটেল ইউনিক অ্যান্ড রেস্টুরেন্টকে অনুমতি দেয়া হয়েছে। অতি মূল্যায়িত বাজার থেকে কোম্পানিগুলোকে ফায়দা লুটতে এসইসি সুযোগ করে দিয়েছে বলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেন। এজন্য তারা এসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করেন।
বাজার পরিস্থিতি : গতকাল শেয়ারবাজারে মাত্র ৫০ মিনিট লেনদেন হয়েছে। এরই মধ্যে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচকের পতন হয় ৬৩৫ দশমিক ৫৮ পয়েন্টের। শতাংশ হিসাবে এ পতনের হার ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। এছাড়া ডিএসআই সূচকের ৩৮৭ পয়েন্ট এবং ডিএসই ২০ সূচকের ৫১৭ পয়েন্টের পতন হয়েছে। ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া ২৩৩টি কোম্পানির মধ্যে ৪টি ছাড়া সবক’টির দর কমেছে। কোম্পানির দরপতনের কারণে গতকাল একদিনেই ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। গতকাল লেনদেন হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। অপরদিকে চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারের সার্বিক মূল্যসূচকের পতন হয়েছে ১ হাজার ৩৬৯ পয়েন্টের। শতাংশ হিসাবে সূচক পতনের এ হার ৬ দশমিক ৭৭ ভাগ। চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারে লেনদেন হওয়া ১৫৬টি কোম্পানির মধ্যে দাম কমেছে ১৪৭টির, বেড়েছে ৭টির এবং অপরিবর্তিত ছিল ২টির দাম। লেনদেন হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা।
কেন এ দরপতন : শেয়ারবাজারে ক্রমাগত দরপতনের জন্য বাজারের তারল্য সঙ্কটকেই দায়ী করা হচ্ছে। তারল্য সঙ্কটের কারণে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলো গ্রাহকদের মার্জিন লোন সুবিধা দিতে পারছে না। অপরদিকে অব্যাহত দরপতনের কারণে শেয়ারের দর কমে যাওয়ায় শেয়ার বিক্রি করতে না পেরে সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরও শেয়ার কেনার ক্ষমতা কমে যায়। দরপতনের কারণে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করলেও ক্রেতা না থাকায় শেয়ারের দরপতন ঘটে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও এ ক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীর মতো আচরণ করায় পরিস্থিতি আরও সঙ্কটময় হয়ে ওঠে। এদিকে কারসাজি করে শেয়ারের দরপতন ঘটানো হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
লেনদেনের সেটেলমেন্ট হবে : শেয়ারবাজারে গতকাল ৫০ মিনিট লেনদেন হওয়ায় লেনদেন বাতিল করা হবে বলে জোর গুঞ্জন ওঠে। তবে লেনদেনের সেটেলমেন্টট হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রেসিডেন্ট ফখর উদ্দিন আলী আহমদ। তিনি বলেন, যে পরিমাণ লেনদেন হয়েছে তার সেটেলমেন্ট করা হবে। সেটেলমেন্ট করা না হলে আইনি জটিলতায় পড়তে হবে বলে জানান তিনি।
এসইসির সাবেক চেয়ারম্যানের বক্তব্য : এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, বাজারে যা ঘটছে তা দুভার্গজনক। বাজারে সংশোধন অনিবার্য ছিল। তবে এ সংশোধন খুব দ্রুত হয়েছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। যাদের হাতে শেয়ার ছিল তারা অতি দ্রুত পতনের কারণে শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি। তিনি বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে বলেন, যাদের হাতে ভালো শেয়ার রয়েছে তাদের উচিত ধৈর্য ধরা। এসইসির সিদ্ধান্তের ফলে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে কিনা—জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব সিদ্ধান্তের ফলাফল কী হবে তা বলা মুশকিল। তিনি বাজারের স্থিতিশীলতার ওপর জোর দিয়ে বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে না এলে তা কঠিন হবে

Saturday 22 January 2011

শেয়ারবাজারে ভয়াবহ বিপর্যয়



কাওসার আলম
দেশের পুঁজিবাজারে দরপতনে সব রেকর্ড ভেঙে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছে। গতকাল একদিনেই দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচকের পতন হয়েছে ৬০০ পয়েন্ট। শতাংশ হিসাবে এ হার ৭ দশমিক ৭৬। এ ঘটনায় কয়েক লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। বিনিয়োগকারীদের বোবাকান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে শেয়ারবাজারের বাতাস। সব হারানোর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন তারা। মুনাফার আশায় যেসব সাধারণ বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন, এখন তা পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে। ১৯৯৬ সালের বিপর্যয়ে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছিল। এখন অব্যাহত দরপতনে ’৯৬ সালের চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে গতকাল শেয়ারবাজারের ইতিহাসে ভয়াবহ বিপর্যয় হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করতে পারেনি। বিনিয়োগকারীরা ছিলেন অবরুদ্ধ। সকাল থেকেই মতিঝিলে ডিএসই ভবন এবং তার আশপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক র্যাব-পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিনিয়োগকারীরা যাতে কোনো অবস্থায় বিক্ষোভ করতে না পারে সেজন্য রাস্তায় কয়েকজন একসঙ্গে জড়ো হওয়া মাত্রই তাদেরকে সরিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিল র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। পুলিশের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির শিকার হন ওই এলাকায় কর্তব্যরত সাংবাদিকরা। প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি মনজুর আহমেদকে পুলিশ আটক করে ভ্যানে উঠিয়ে নেয়। পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। অবশ্য শেয়ারবাজারে দরপতনের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ, ভাংচুর করেছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বিভিন্ন রাস্তা অবরোধ করে এবং শেয়ারবাজারের দরপতনের কারণে এসইসি চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ দাবি করেন তারা।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ বছরের প্রথম লেনদেন দিবস ছাড়া বাকি ৫ লেনদেন দিবসে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতন হয়েছে। বছরের শুরুতে ডিএসই’র বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। গতকাল লেনদেন শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাত্ এ বছরের মাত্র ৬ লেনদেন কার্যদিবসে বাজার মূলধন কমেছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। অপরদিকে ডিএসই সাধারণ সূচক কমেছে ১ হাজার ১৫৫ পয়েন্ট। বছরের শুরুতে ডিএসই সাধারণ সূচক ছিল ৮ হাজার ২৯০ পয়েন্ট, যা গতকাল দিনশেষে ৭ হাজার ১৩৫ পয়েন্টে নেমে আসে। এর মধ্যে গতকাল একদিনেই সাধারণ সূচক কমেছে সর্বোচ্চ ৬০০ পয়েন্ট। বাজার মূলধন কমেছে প্রায় ১৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। দরপতনের এ ঘটনায় ভাগ্য বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন লাখ লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারী। তাদের অধিকাংশের অভিযোগ, সিন্ডিকেটের কারসাজি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ও সরকারের অদূরদর্শিতায় শেয়ারবাজারে এ বিপর্যয় ঘটেছে।
বাজারে অব্যাহত দরপতনে বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার। তিনি বিনিয়োগকারীদের সহনশীল আচরণ ও ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে বলেন, শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে এসইসি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেবে।
এদিকে গতকাল এসইসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ৪টি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এগুলো হলো—গ্রামীণফোনের শেয়ারের বিপরীতে নেটিং সুবিধা চালু, ব্যক্তির ক্ষেত্রে মার্জিন লোন সুবিধার সীমা প্রত্যাহার, নতুন বিও অ্যাকাউন্ট খোলার ১৫ দিন পরই ঋণ সুবিধা এবং সালভো কেমিক্যালের আইপিও আবেদনের সময় পরিবর্তন। তবে এসইসির এসব সিদ্ধান্তে বাজার পরিস্থিতির উন্নতি হবে কিনা, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তারল্য সঙ্কটের কারণে গত মাস থেকেই মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলো তাদের গ্রাহকদের ঋণ সুবিধা দিতে পারছিল না। ফলে ঋণ সুবিধা বাড়ানো হলেও তাতে খুব একটা লাভ হবে না বলেই সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাজারে তারল্য সঙ্কট এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঙ্কট তৈরি হওয়ায় বাজারে বড় ধরনের দর সংশোধন হয়েছে। এ অবস্থায় তারা বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কগ্রস্ত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেন, যারা মৌল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের উচিত হবে শেয়ার ধরে রাখা। অযথা আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে ধৈর্য ধরা উচিত বলে তারা মনে করেন। বর্তমানে শেয়ারবাজারে কিছুটা তারল্য সঙ্কট রয়েছে। তবে এ সঙ্কট কাটিয়ে বাজার আবার স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে আসবে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
বাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, গত ক’দিন ধরেই বাজারে দর সংশোধন হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় একদিনেই ৬০০ পয়েন্টের পতন হয়েছে। এটিকে ‘বিপর্যয়’ না বলে বরং বেশিমাত্রায় দর সংশোধন হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ও ডিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আহমেদ খান বলেন, বাজারে তারল্য সঙ্কটের কারণে শেয়ারের অতিরিক্ত দর সংশোধন হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হওয়ায় তারা ভালো কোম্পানির শেয়ারও বিক্রি করে দিচ্ছেন। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কগ্রস্ত না হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তবে গতকাল একদিনেই ৬০০ পয়েন্টের পতনকে বিপর্যয় বলে মন্তব্য করেছেন বাজার বিশ্লেষক ও বেসরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান এইমস বাংলাদেশের এমডি ইয়াওয়ার সাঈদ। তিনি বলেন, একদিনে ৬০০ পয়েন্ট পতন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। একে বিপর্যয়ই বলতে হবে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ডিএসইতে ২৪৪টি কোম্পানি, মিউচুয়াল ফান্ড ও করপোরেট বন্ডের লেনদেন হয়। এর মধ্যে দর বেড়েছে মাত্র ৩টির, বাকি ২৪১টি তাদের দর হারিয়েছে। যে তিনটি কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে, সেগুলো হলো—রহিম টেক্সটাইল, মুন্নু স্টাফলার এবং এপেক্স স্পিনিং। বাকি সবক’টির দরই কমেছে। দরপতনের এ ঘটনা শেয়ারবাজারের ইতিহাসে নজিরবিহীন। কোম্পানিগুলোর দরপতনে গতকাল একদিনেই ডিএসইর সাধারণ সূচক কমে গেছে ৬০০ পয়েন্ট। পুঁজিবাজারের ইতিহাসে এ যাবত্কালের এটিই সর্বোচ্চ দরপতনের ঘটনা। এর আগে মাত্র ১৫ কার্যদিবস আগে গত ১৯ ডিসেম্বর একদিনে সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছিল ৫৫১ পয়েন্টের। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে নভেম্বর মাসে রেকর্ড ২৩৩ পয়েন্টের পতন হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের তুলনায় গতকাল ১৩৬.৪৮ শতাংশ বেশি দরপতন হয়েছে।
শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতনের কারণে কয়েক লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। ব্যাংকের আমানত, সঞ্চয়পত্র ভেঙে, পেনশনের টাকা নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা শেয়ারবাজারে মুনাফা লাভের আশায় বিনিয়োগ করেছিলেন। ব্যাংকের আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমে যাওয়ায় বাড়তি লাভের আশায় ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন তারা।
এদিকে শেয়ারবাজার অতিমূল্যায়িত হলেও সরবরাহ না বাড়ার কারণে বাজারে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছিলেন। এমনকি দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের প্রেসিডেন্টদ্বয় গত ৯ অক্টোবর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সরকারের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, দ্রুত সরকারি শেয়ার বাজারে ছাড়া না হলে শেয়ারবাজারে বিপর্যয় হবে। আর এজন্য দায়ী থাকবে সরকার। তাদের এ ঘোষণার পরও সরকারি শেয়ার বাজারে ছাড়া হয়নি। আর তাদের ঘোষণার মাত্র দুই মাসের মাথায় দেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে ভয়াবহ দরপতন ঘটে, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। গত ৮ ডিসেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ মূল্য সূচক কমেছে ১ হাজার ৪৫০ পয়েন্ট। অপরদিকে একই সময়ে বাজার মূলধন কমেছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
বাজার অস্থিরতার পেছনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকেও দায়ী করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এদিকে গতকালও এসইসি নতুন করে ৪টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এসইসির চার সিদ্ধান্ত : গ্রামীণফোনের শেয়ারের বিপরীতে নেটিং সুবিধা চালু করা হয়েছে, যা আজ থেকে কার্যকর হবে। মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউস থেকে কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা মার্জিন ঋণ সুবিধা নিতে পারতেন। গতকাল তার সীমা অনির্দিষ্ট করে দিয়েছে এসইসি। এর ফলে একটি মার্চেন্ট ব্যাংক একজন গ্রাহককে যে কোনো পরিমাণে ঋণ সুবিধা দিতে পারবে। নতুন বিও অ্যাকাউন্ট খোলার প্রথম ১৫ দিন পরই মার্জিন লোন সুবিধা পাবেন গ্রাহকরা। আগে ৩০ দিন পর্যন্ত মার্জিন লোন সুবিধা পেতেন না গ্রাহকরা। অপরদিকে সালভো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের আইপিও সময় ৩০ জানুয়ারির পরিবর্তে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে।
বাজার বিশেষজ্ঞদের অভিমত : পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাজারে তারল্য সঙ্কট রয়েছে। আর এ সঙ্কট মোকাবিলায় বড় বিনিয়োগকারী, অর্থাত্ ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, লিজিং কোম্পানি, মার্চেন্ট ব্যাংক ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয় অংশ নিলে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। তিনি আরও বলেন, সংশোধনের মাধ্যমে এখন বাজার অনেকটা নিচ দিকে চলে এসেছে। এ অবস্থায় বাজারে আর বেশি কারেকশন হবে না বলে মনে করেন তিনি।
ডিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন আহমেদ খান বলেন, বাজার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পলিসি নিতে হবে। পুঁজিবাজারবিষয়ক সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এসইসির একটি সমন্বয় থাকতে হবে। আর বাজার সংশোধন এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের ক্ষতির শিকার না হন। জোর করে দর সংশোধন করা কখনও কাম্য নয়।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রেসিডেন্ট ফখর উদ্দিন আলী আহমেদ বলেন, বিনিয়োগকারীরা আস্থার অভাবে তাদের ভালো শেয়ারই বিক্রি করে দিচ্ছেন। যারা মৌলভিত্তি দেখে শেয়ার কিনেছেন তাদের আতংকগ্রস্ত না হয়ে উচিত শেয়ার ধরে রাখা। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়ায় অনেক কোম্পানির পিই অনুপাত ২০০ থেকে ৩০০-তে পৌঁছেছিল। এখন বাজারে দর সংশোধন হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এদিকে দেশের শেয়ারবাজারে ভয়াবহ দরপতনের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল, ভাংচুর হয়েছে। এসব বিষয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট :
সিলেট : শেয়ারের অব্যাহত দরপতনে সিলেটের বিনিয়োগকারীরা গতকাল রাস্তায় বিক্ষোভ করেন। এ কারণে সিলেটের অধিকাংশ ব্রোকারেজ হাউসে এক ঘণ্টা লেনদেন বন্ধ ছিল। বিনিয়োগকারীরা বেলা ১টার দিকে চৌহাট্টায় ডিএসই ও সিএসই অফিসের সামনে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এ সময় তারা ডিএসই প্রেসিডেন্ট এবং সিএসই প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করেন।
বিনিয়োগকারী সিরাজুল ইসলাম জানান, দরপতনের কারণে তারা বিক্ষোভ করেছেন। তিনি বলেন, শেয়ারের অব্যাহত দরপতনে সিলেটের স্বল্প পুঁজির তরুণ বিনিয়োগকারীরা বেশ হতাশ হয়ে পড়েছেন।
রাজশাহী : পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক দরপতনের কারণে গতকাল ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা রাজশাহীতে ব্যাপক বিক্ষোভ করেছেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে সাহেববাজারে বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিলটি নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট হয়ে কুমারপাড়ায় আইসিবি কার্যালয়ের সামনে গিয়ে সমাবেশ করে। গতকাল দুপুর ১২টায় বিক্ষোভ চলাকালে বিনিয়োগকারীদের চাপের মুখে আইসিবি ও অন্যান্য ব্রোকারেজ হাউসে শেয়ার বেচাকেনা বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর আড়াইটায় আবার চালু হয়। এসময় তারা আইসিবি কার্যালয়ে ভাংচুর চালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। পরে পুলিশ এসে আবার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। বিনিয়োগকারীরা এ পরিস্থিতিতে এসইসি চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ দাবি করেন।
বগুড়া : শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও সড়ক অবরোধ করেছেন বগুড়ার বিনিয়োগকারীরা। গতকাল বেলা ২টায় শহরের বড়গোলা আইসিবি থেকে মিছিলটি বের হয়। মিছিল শেষে বিনিয়োগকারীরা বড়গোলায় সড়ক অবরোধ করেন। মিছিলকারীরা শেয়ারবাজারে ভয়াবহ দরপতনের কারণ হিসেবে এসইসিকে দায়ী করেন। বিনিয়োগকারীরা অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর এবং এসইসি ও ডিএসই প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করেন। বিনিয়োগকারীরা বলেন, অব্যাহত দরপতনের কারণে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন।


সরকারের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন : আতঙ্কের রাজত্ব ও এক ব্যক্তির শাসন কায়েম করা হয়েছে : খালেদা জিয়া



স্টাফ রিপোর্টার

বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশের সাধারণ মানুষ আজ ভালো নেই। অল্প কিছু লোক ভালো আছে। তারা দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে। দেশজুড়ে কায়েম করেছে ভীতি ও আতঙ্কের রাজত্ব। একব্যক্তির শাসনে চলছে দেশ। শাসক আর শাসিত এই দু’ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে বাংলাদেশকে। একদলীয় বাকশালী দুঃশাসনের প্রবক্তারা আবার এক-ব্যক্তির শাসন কায়েম করেছে। গত দু’বছরে সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী জাতিকে অসত্য তথ্য ও কল্পকাহিনী শুনিয়েছেন। তার ডিজিটাল স্টোরি এখন ভয়ঙ্কর দুর্নীতি ও পরিহাসে পরিণত হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সিন্ডিকেটে জড়িত হওয়ায় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। শাসক দলের উত্পীড়নে মনে হয় ভিনদেশী শত্রুকবলিত দেশ। এ পরিস্থিতিতে সর্বাত্মক গণঐক্য গড়ে তুলতে তিনি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
বর্তমান সরকারের দুই বছরের শাসনের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া দেশবাসীর প্রতি এ আহ্বান জানান। গতকাল বিকালে তার গুলশান কার্যালয়ে প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী ভাষণে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে ভুল, অসত্য, ভিত্তিহীন ও বিকৃত তথ্যে ভরা বলে উল্লেখ করেন।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেন, একাংশ মানুষ এখন দেশের মালিক-মোক্তার সেজে বসেছে। তারা দেশের সর্বনাশ করে নিজেদের ভাগ্য গড়ছে। দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে। কেউ যাতে এর প্রতিবাদ করতে না পারে সেজন্য তারা দেশজুড়ে কায়েম করেছে ভীতি ও আতঙ্কের রাজত্ব। তাদের ভয়ে কেউ টুঁ-শব্দটিও করতে পারছে না।
তিনি বলেন, জনগণের কণ্ঠ হিসেবে যাতে সাংবাদিকরা সত্য তুলে ধরতে না পারে সেজন্য তাদের গলাটিপে ধরা হয়েছে। হত্যা, গ্রেফতার-নির্যাতনের মাধ্যমে গণমাধ্যমে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ করায় দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
বেগম জিয়া বলেন, সবখানেই আজ বিপজ্জনক পরিস্থিতি। হামলা, হুমকি, মামলা, গ্রেফতার, খুন, জখম, জুলুম, নির্যাতন, সন্ত্রাসের মাধ্যমে গোটা দেশকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। শুধু কথা বলে যাচ্ছে একদল স্তাবক। শাসক আর শাসিত এই দু’ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে বাংলাদেশকে। একদলীয় বাকশালী দুঃশাসনের প্রবক্তারা আবার এক-ব্যক্তির শাসন কায়েম করেছে। এক-ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ক্রীতদাসে পরিণত করা হয়েছে বাকি সবাইকে।
খালেদা জিয়া বলেন, মানবতা আজ লাঞ্ছিত। শাসক দলের বাইরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে অধঃপতিত করা হয়েছে। তাদের কারও মর্যাদা নেই। সামান্যতম নিরাপত্তাবোধও অবশিষ্ট নেই। শাসক দলের উত্পীড়ন ও ঘৃণা-বিদ্বেষের মাত্রা দেখে সবার মনে হচ্ছে, এ যেন ভিনদেশী শত্রুকবলিত এক অচেনা স্বদেশ।
এই ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে বর্তমান শাসক দল তাদের ক্ষমতা আরোহণের তৃতীয় বছরে পা রেখেছে।
দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রঙচঙে প্রকাশনা ও বর্ণিল প্রচারণা দেশবাসী অবাক হয়ে দেখেছে ও শুনেছে। প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিয়েছেন। তার অনুগত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ আনন্দ-মিছিল করেছে।
তিনি বলেন, ছাত্রলীগ যখন আনন্দ-মিছিল করে তখন ছাত্র কিংবা শিক্ষক-সমাজ কেবল নয়, সারাদেশের সব পর্যায়ের মানুষই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কেননা, ছাত্রলীগ আজ মানুষের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নারী-নির্যাতন, বন্দুক-বোমা-চাপাতি-কুড়াল নিয়ে হামলা, দখল, শিক্ষক লাঞ্ছনা, চোরাচালান, মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে এহেন অপকর্ম নেই যার সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত নয়। একই রকম ঘৃণিত অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ শাসক দলের অন্যান্য সহযোগী সংগঠন। সন্ত্রাস চালিয়ে প্রতিবাদী সব কণ্ঠ তারা স্তব্ধ করে দিয়েছে। লিপ্ত হয়েছে নিজেদের মধ্যে মারামারি, হানাহানি, সশস্ত্র সন্ত্রাস এবং ভাগাভাগি ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে। তিনি বলেন, এখন কোথাও কোনো হাঙ্গামা হলেই মানুষ জানতে চায়—কোন লীগ কোন লীগের ওপরে হামলা করেছে। দুই বছরপূর্তি উপলক্ষে এই ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের আনন্দ-মিছিল প্রমাণ করে, গত দুই বছরে দেশজুড়ে চলেছে সন্ত্রাস, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দুষ্কর্মের উত্সব। আর তাদের উল্লাস দেখে শোষিত, বঞ্চিত, উত্পীড়িত মানুষ হয়ে পড়েছে আরও আতঙ্কিত। তাদের ভাবনা, আগামীতে এই লুটেরা, সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্তরা হয়তো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। দেশবাসী হয়ে পড়বে আরও বেশি অসহায়।
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, যে কোনো তথ্য-উপাত্তের চেয়ে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অনেক বেশি মূল্যবান। কারও বক্তৃতা থেকে কিছু শোনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজের দেখা ও জানা বিষয়। কাজেই আমি কী বক্তৃতা করব আজ? দেশের অবস্থা কী সাধারণ মানুষ আমার চেয়ে কম জানেন না?
তিনি বলেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের ম্যানেজিং কমিটির ইলেকশন হয়ে গেল সম্প্রতি। সব ভয়ভীতি, শাসক দলের চোখরাঙানি, অর্থের ছড়াছড়ি ও লোভনীয় হাতছানিকে ঘৃণাভরে উপেক্ষা করে আপনারাই শাসক দলের বিরোধীদের সেখানে নির্বাচিত করেছেন। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, উত্সবমুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে সুচিন্তিত রায় দেয়ার জন্য আমি আপনাদের এবং আপনাদের মাধ্যমে বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজকে অভিনন্দন জানাই। তিনি বলেন, এই নির্বাচনের ফলাফলকে গুণ্ডামির মাধ্যমে বানচালের অপচেষ্টা হয়েছিল। হামলা চালিয়ে ফল পাল্টাতে না পেরে এখন শাসকদলের মদতে মামলার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কেবল জাতীয় প্রেস ক্লাবে নয়, মানুষ যেখানেই সুযোগ ও পরিবেশ পাচ্ছে সেখানেই শাসকদলের বিরুদ্ধে ব্যালট বিপ্লব ঘটাচ্ছে। চট্টগ্রাম সিটির মানুষ সেই প্রমাণ দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে প্রেস ক্লাব, বার ও পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে এর প্রমাণ মিলছে। বেগম জিয়া বলেন, আসন্ন পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু হলে সেখানেও ভোটাররা একই রকম রায় দেবেন বলে আমরা দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল। তার আভাস বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আপনাদের করা জনমত জরিপেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
খালেদা জিয়া বলেন, আপনারা নিজেরাই দেখেছেন, গত দুই বছর ধরে ক্ষমতাসীনরা কীভাবে অসত্য কথার তুবড়ি ছুটিয়ে চলেছে। কিন্তু তাদের ব্যর্থতা এত সর্বব্যাপী এবং তাদের অপকর্ম এতটাই পর্বতপ্রমাণ যে, মিথ্যা দিয়ে আজ আর সত্যকে ঢাকা দেয়া যাচ্ছে না। একজন মহান ব্যক্তি বলে গেছেন, তুমি কিছু লোককে সব সময়ের জন্য এবং সব মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানাতে পার, কিন্তু সব মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছেন, তাদের ধোঁকা দিয়ে কিছুদিনের জন্য বোকা বানানো হয়েছিল। এখন তাদের চোখ খুলে গেছে। ধোঁকাবাজদের তারা চিনতে পেরেছেন। এখন অসত্য বলে, ধোঁকা দিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না। তাই ক্ষমতাসীনরা এখন সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। দেশের মানুষ বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে দেখে ক্ষমতাসীনরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে দেখে শাসকদল বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের কথাবার্তাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে সেই বেসামাল অবস্থার চিত্র।
ক্ষমতার দুই বছর পূর্তিতে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে ভুল, অসত্য, ভিত্তিহীন ও বিকৃত তথ্যে ভরা উল্লেখ করে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, এই ভাষণের কী প্রতিক্রিয়া আমি দেব? তিনি বলতে চেয়েছেন, দেশে তেমন কোনো সমস্যাই নেই। দু’বছরে সব ফয়সালা করে ফেলেছেন। যা কিছু বাকি আছে, সেগুলোরও সুরাহা করে দেবেন ২০২১ সালে। আসলে দেশের বাস্তব ছবি কি তাই বলে? বেগম জিয়া বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) এখন এক তথাকথিত ‘রূপকল্প’র গল্প শোনাচ্ছেন। ভোটের আগে শুনিয়েছিলেন ডিজিটাল গল্প। ওয়াদা করেছিলেন, দশ টাকা কেজি দরে চাল, ফ্রি সার ও ঘরে ঘরে চাকরি দেবেন। তার ডিজিটাল স্টোরি এখন ভয়ঙ্কর দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও ব্যর্থতায় পরিণত হয়েছে। ৩৮ থেকে ৪০ টাকা কেজিতে মোটা চাল কেনার সামর্থ্য হারিয়ে এদেশের গরিব মানুষেরা অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। সারাদেশে চলছে নীরব দুর্ভিক্ষ। ফ্রি সার ও চাকরি এখন সোনার হরিণ হয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তাই এখন আর কোনো কল্পকাহিনী কিংবা রূপকথা শুনতে চান না। তারা ক্ষুধার অন্ন চান, শীত নিবারণের বস্ত্র চান। তারা গ্যাস চান, বিদ্যুত্ চান, তৃষ্ণা নিবারণের বিশুদ্ধ পানি চান, চাকরি চান, সুস্থ ও নিরাপদ জীবন চান। ক্ষমতাসীন সরকার গত দু’বছরে এসব চাওয়ার কতটা পূরণ করতে পেরেছে, দেশের মানুষ সে কথাই জানতে চান।
দ্রব্যমূল্য প্রসঙ্গে : খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে দ্রব্যমূল্যের যে চিত্র দিয়েছেন তা সত্য নাকি বিকৃত, সেটা বাজার করতে গিয়ে প্রতিটি নাগরিকই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। আমরা সরকারে থাকা সময়ে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও অন্যান্য জিনিসের দাম সাংঘাতিক বেড়ে গিয়েছিল। আমরা ভর্তুকি দিয়ে এবং সুষ্ঠু বাজার-ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য পদক্ষেপের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু সে সময়কার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির পথ বেছে নিয়েছিল। আর এখন তারা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির ধুয়া তুলছেন। তিনি বলেন, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বিএনপি আমলের তুলনায় অনেক কম আছে। তারপরও জিনিসপত্রের দাম জনগণের নাগালের বাইরে চলে গেল কেন? এ প্রসঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির একটা তুলনামূলক মূল্যতালিকা তুলে ধরে বেগম জিয়া বলেন, আমাদের বিগত সরকারের প্রথম চার বছর জিনিসপত্রের দাম অনেক কম ছিল। ২০০৬ সালে আমরা দায়িত্ব ছাড়ার বছরে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে সেই দাম একটু বেড়েছিল।
কিন্তু ২০০৬ সালের তুলনায় জিনিসপত্রের দাম এখন বেড়ে প্রায় তিন গুণ হয়ে গেছে। শেখ হাসিনার ‘আন্দোলনের ফসল’ মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের জরুরি সরকার জিনিসপত্রের দাম ভয়ঙ্কর বাড়িয়ে ফেলে। আজকের ক্ষমতাসীনরা তাদের পদাঙ্কই অনুসরণ করে চলেছেন। এরই নাম ডিজিটাল সরকারের সাফল্য!
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে ক্ষমতাসীনদের লাগামহীন দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেটবাজি, অব্যবস্থাপনা এবং আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির কারণে। নানা কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে সরকারের লোকরা ফায়দা লুটছেন আর কাফ্ফারা দিতে হচ্ছে ক্রেতাসাধারণকে। এইসব দুষ্কর্মের কথা সারাদেশের ভুক্তভোগী মানুষ জানলেও প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে সেসব বেমালুম চেপে গেছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত সে কথা দেশবাসী সরকার সমর্থক পত্রিকার মাধ্যমে অনেক আগেই জানতে পেরেছে। টিসিবির জন্য দেশের ভেতর থেকেই চড়া দামে পেঁয়াজ কেনার বাণিজ্য তিনি তার এক নিকটাত্মীয়কে দিয়েছিলেন।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তিনি উত্তরাঞ্চল থেকে নাকি মঙ্গা ও অভাব বিতাড়িত করেছেন। মূলত তিনি সারাদেশে মঙ্গা ছড়িয়ে দিয়েছেন। ওএমএসের নিম্নমানের চাল কেনার জন্য গরিব-দুঃখী, অভাবী মানুষের দীর্ঘ সারি, তাদের অপুষ্টি-জর্জর দেহ, বেদনাক্লিষ্ট মুখ, হতাশ শূন্যদৃষ্টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চোখে কি কখনও পড়ে না? সেই অসহায় মানুষগুলোর ক্ষুধার অন্ন নিয়েও চলছে তেলেসমাতি ও দুর্নীতি। শাসকদলের সাঙ্গোপাঙ্গরা ওএমএসের চাল নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি করায় দীর্ঘ লাইনে সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকেও অনেক ক্ষুধার্ত মানুষকে খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ১৯৭৪ সালে মুজিব আমলের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় অনাহারে যখন হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন, সে সময় উপোসী মানুষের লঙ্গরখানার খাদ্য নিয়েও আওয়ামী লীগের লোকেরা চরম দুর্নীতিতে মেতেছিল। তাদের সেই চুরির স্বভাব আজও যে রয়ে গেছে, সেটা দেশবাসী চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ক্ষুধিত মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে খাওয়ার এই ধারাটা অন্তত বন্ধ করুন। নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী দশ টাকায় চাল দেয়ার সাধ্য আপনার নেই, আমরা জানি। বিএনপি সরকারের আমলের প্রথম চার বছরের কথা বলছি না। আমাদের দায়িত্ব ছাড়ার বছরে জিনিসপত্রের যে দাম ছিল, অন্তত সেই পর্যায়ে দ্রব্যমূল্য নামিয়ে আনুন—দেশবাসী কৃতজ্ঞ থাকবে।
গত দু’বছরের কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন ধারাবাহিক সরকারের প্রক্রিয়া উল্লেখ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, অতীতের কিছু উন্নয়ন প্রকল্প চালু রাখা এবং রুটিন কাজকর্মকে উন্নয়ন বলে জাহির করার চেষ্টা সত্যি হাস্যকর। জোট সরকারের প্রথম দুই বছরের সঙ্গে বর্তমান সরকারের দু’বছরের তুলনাকে স্বাগত জানিয়ে বেগম খালেদা জিয়া ২০০১ থেকে ২০০৩ সালে বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্পের উল্লেখ করেন।
র্যাট এবং পরে র্যাব গঠনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, পলিথিন ও থ্রি-স্ট্রোক ইঞ্জিন নিষিদ্ধ করা, নগরীতে সিএনজিচালিত মোটরযান ও উন্নতমানের বাস চালু, যানজট নিরসনে মহাখালী ও খিলগাঁও ফ্লাইওভার তৈরি, ভৈরবে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু, শিকারপুর-দোয়ারিকা সেতুসহ বেশ কটি বড় সেতু এবং নলকা-হাটিকামরুল-বনপাড়া সড়কসহ বেশ কটি সড়ক চালু করা, যমুনা সেতুর ওপর দিয়ে রাজশাহী ও খুলনা থেকে ঢাকা পর্যন্ত রেল চালু করা, নকলমুক্ত পরীক্ষা নিশ্চিত করা, শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো পাঠ্যবই তুলে দেয়া, মেয়েদের দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিনা বেতনে লেখাপড়া ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে নতুন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, কৃষিতে ভর্তুকি বাড়িয়ে ৩ গুণ করা, কৃষিতে সেচ সহায়তার জন্য কম মূল্যে বিদ্যুত্ সরবরাহ, পল্লীবিদ্যুত্ কর্মসূচির আওতায় ৩৫টি উপকেন্দ্র স্থাপন, কয়েক হাজার কিলোমিটার বিদ্যুত্ বিতরণ লাইন নির্মাণ, ৫ হাজার গ্রামে নতুন বিদ্যুতায়ন এবং প্রায় সাড়ে ১০ লাখ নতুন বিদ্যুত্ সংযোগ দেয়া, দেশের উত্তরাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের উদ্যোগ, বিভিন্ন অঞ্চলে গ্যাস লাইন নির্মাণ ও ২ লাখ নতুন গ্রাহককে গ্যাস সংযোগ দেয়া, বড়পুকুরিয়ায় বার্ষিক ১০ লাখ টন উত্পাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাখনির বাণিজ্যিক উত্তোলন শুরু হয় এবং সে কয়লা ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র নির্মাণ, বিদেশে জনশক্তি প্রেরণের বন্ধ দরজা খোলা, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক নতুন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, স্কুল-কলেজে কম্পিউটার পৌঁছানো হয়। শিক্ষকদের দেয়া হয় কম্পিউটার ট্রেনিং, প্রত্যেক জেলায় ইন্টারনেট সুবিধা সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন উদ্যোগের বর্ণনা তুলে ধরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, এ বিবরণীও আমাদের বিগত সরকারের প্রথম ২ বছরের উন্নয়ন-সাফল্যের এক খণ্ডচিত্র মাত্র। এগুলো আপনারা জানেন। দেশবাসী এসব উন্নয়নের সুফল ভোগ করছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় জানেন না কেবল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।বর্তমান সরকারের দুই বছরপূর্তিতে দু’টি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের হেডলাইন পড়ে শোনান বেগম খালেদা জিয়া। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ‘মহাজোট সরকারের দু’বছর পূর্তি আজ \ নির্বাচনী ইশতেহার উপেক্ষিত’। একই পত্রিকার আরেক শিরোনাম : ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা ঠিক হয়নি দুই বছরে’। সাপ্তাহিক বুধবার পত্রিকার শীর্ষ শিরোনাম : ‘প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দুই বছর’। ওই পত্রিকায় চিন্তাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা, ‘দিনবদলের দুই বছর : উন্নতির নিচে আর্তনাদ’ এবং কমিউনিস্ট নেতা হায়দার আকবর খান রনোর ‘দিনবদলের স্লোগান এখন হাস্যকর বুলি’ শীর্ষক নিবন্ধের শিরোনাম তুলে ধরেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, পত্রিকাগুলোর লেখক-সাংবাদিকরা বিএনপি করেন না। তারাই যা লিখেছেন, আমার আর বেশিকিছু বলার প্রয়োজন নেই। তারা যেসব তথ্য দিয়েছেন ও প্রশ্ন তুলেছেন, প্রধানমন্ত্রী দয়া করে অন্তত সেসবের জবাব দেবেন কী?
বিদ্যুত্ প্রসঙ্গে : প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে দেয়া বিভিন্ন তথ্যকে ডাহা মিথ্যা অভিহিত করে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের সরকারের আমলে নাকি দেশে এক মেগাওয়াট বিদ্যুত্ও উত্পাদন হয়নি। কিন্তু লুটপাট হয়েছে হাজার কোটি টাকা।’ একই মিথ্যা কথা বারবার বলাটা মনে হয় তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ২০১০ সালের ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বইটির ১১৮ পৃষ্ঠায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, আমাদের সরকারের ৫ বছরে নতুন ১২৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ জাতীয় গ্রিডে সংযোজন করা হয়েছে। ২০০১ সালে আমরা সরকারের দায়িত্ব নেয়ার সময় বিদ্যুতের মোট স্থাপিত উত্পাদন-ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৫ মেগাওয়াট। ২০০৬ সালে আমরা দায়িত্ব ছাড়ার সময় এ উত্পাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে ৫ হাজার ২৭৫ মেগাওয়াটে উন্নীত করি। নিজেদের সরকারের এ তথ্য গোপন করে শীর্ষ পর্যায় থেকে যদি অবিরাম মিথ্যা বলা হয়, তাহলে মানুষ কার ওপর আস্থা রাখবে?
খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের সময়ে বিদ্যুত্ নিয়ে কিছু সমস্যা থাকলেও এখন তা সঙ্কটে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুত্ উত্পাদনে সফলতার নানা মেগাওয়াট-কাহিনী শুনিয়েছেন। দেশবাসী এসব বানোয়াট গল্প আর শুনতে চায় না। তারা দেখছেন, সরকার বিদ্যুতের সব ধরনের নতুন সংযোগ দেয়া বন্ধ রেখেছে। তারা জানছেন, দীর্ঘদিন হাত গুটিয়ে বসে থেকে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির পর সরকার আত্মীয়স্বজন ও দলীয় লোকদের কাছ থেকে চড়া দামে বিদ্যুত্ কেনার উদ্দেশ্যে রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট বসানোর চুক্তি করছে বিনা টেন্ডারে। এসব কাজে কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। বরং রয়েছে বিশাল দুর্নীতির অভিযোগ।
বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, এ অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার জন্য আগামীতে যাতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হয়, তার জন্য এগুলোকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। বিশিষ্টজন ও বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে একে ‘দুর্নীতি ও চুরির ইনডেমনিটি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এতো কিছু করার পরও বিদ্যুতের অভাবে কারখানা বন্ধ, উত্পাদন ব্যাহত এবং জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে মানুষ মেগাওয়াটের হিসাব শুনতে চায় না, পেতে চায় বিদ্যুত্। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞদের হিসাবে রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টওয়ালারা আগামী ৩ বছরে লুটে নেবে অতিরিক্ত ২০ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা।
তার অর্থ হচ্ছে, দুর্নীতি করবেন তারা, আর ভুক্তভোগী হবে জনগণ। আর চলমান দুর্নীতি ঢাকতে অপপ্রচার করবেন, এ খাতে অতীতে দুর্নীতি হয়েছে—সেটা চলবে না।
শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে : সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ারবাজার লুট হয়ে যায়। তাদের আগের সরকারের আমলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হয়েছিল। এবারও একই আলামত শুরু হয়েছে। অব্যবস্থাপনার ফলে দু’বছরেই পুঁজিবাজার ও মানি মার্কেট দুটোকেই সরকার অস্থির করে ফেলেছে। ফলে অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত। ১৯৯৬-এর মতো বর্তমানে সরকারের ছত্রছায়ায় পুঁজিবাজারে চলছে লুটপাট। একটি চক্রকে লুটপাটের সুযোগ করে দিতে সরকারের একেকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বারবার পুঁজি হারাচ্ছেন। সরকারদলীয় এ চক্রটিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে বিতর্কিত নির্দেশনার মাধ্যমে কখনও দরপতন আবার কখনও দর-উত্থানের খেলা এখন সবার কাছেই দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মূলধন কেড়ে নেয়ার এ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। মানি মার্কেটে কলমানির সুদের হার ইতিহাসের সর্বোচ্চ, প্রায় ২শ’ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল। মূলত শাসক দলের সদস্যদের মালিকানাধীন কয়েকটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণহীন আচরণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ভারতীয় এয়ারটেলের কাছ থেকে কোনো ট্রান্সফার ফি গ্রহণ না করার প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, বিটিআরসি চেয়ারম্যান ব্যাখ্যা প্রদান করেন, ভারতীয় এয়ারটেল মাত্র ৭০ লাখ টাকায় অর্থাত্ ১শ’ টাকার প্রতিটি শেয়ার ৬ পয়সা দরে ক্রয় করেছে। আমি দুর্নীতির রাহুগ্রাস সম্পর্কে সামান্য কিছু ইঙ্গিত দিলাম। আগামীতে বিস্তারিত বলব ইনশাল্লাহ।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে : আইনশৃঙ্খলার ভঙ্গুর চিত্র তুলে ধরে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে নাকি আইনশৃঙ্খলা এখন ভালো। দেশবাসীই জানে এ তথ্য কতটা সত্য! এ ব্যাপারে একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন বেগম জিয়া। তিনি বলেন, সরকারি হিসাবেই গত দু’বছরে খুন হয়েছে ৮ হাজারের বেশি মানুষ। ধর্ষণের ঘটনা ৫ হাজারের বেশি। গত অক্টোবর-নভেম্বর এ দু’মাসেই ১৮৯ জন গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রায় ৫শ’ নিহত ও প্রায় ২৭ হাজার লোক আহত হয়েছেন। গতবছর ইভটিজিংয়ের ঘটনায় ৫ শতাধিক আহত এবং প্রতিবাদ করায় ১৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনে জীবন দিয়েছেন প্রায় ২শ’ মানুষ। বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন প্রায় আড়াইশ’। সীমান্তে শুধু গত বছরই শতাধিক বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়েছে। এর কোনো প্রতিবাদ করার সাহসও সরকার রাখে না। এ সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আমাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।
শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও পাঠ্যবই বিতরণের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দাবি করা সাফল্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এই শিক্ষানীতি প্রণয়নে একটি বিশেষ মত ও পথের শিক্ষাবিদদের নিয়েই কেবল কমিশন গড়া হয়েছিল। তারা সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিক ও দেশের স্বীকৃত আলেম-ওলামাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। ফলে এটি জাতীয় শিক্ষানীতি হিসেবে সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি। গতবছর ভারত থেকে ছাপিয়ে আনা পাঠ্যবইয়ের অর্ধেক এখনও দেশে এসে পৌঁছায়নি। ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নতুন শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই এখনও পাঠ্যবই থেকে বঞ্চিত রয়েছে।
প্রশাসনকে অস্থির করে তোলা হয়েছে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, সারাদেশে অসংখ্য যোগ্য সরকারি কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ অফিসার এবং আনসার-বিডিআরকে প্রায়ই সরকারি দলের ক্যাডাররা বিভিন্ন স্থানে মারধর করছে। পাবনায় সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর ছাত্রলীগ-যুবলীগ সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনা সারাদেশে আলোচিত হয়েছে। অথচ সেসব সন্ত্রাসী সবাই মুক্তি পেয়ে গেছে।
জাতীয় সংসদ অকার্যকর : জাতীয় সংসদকে সরকারই অকার্যকর করে রেখেছে অভিযোগ করে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেন, আমরা সংসদকে কার্যকর করতে চাই। এর মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে চাই। এজন্যই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পরও প্রথম সংসদ অধিবেশনেই আমরা অংশ নিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে কী আচরণ করা হয়েছে, জাতীয় নেতাদের সম্পর্কে কী ধরনের অশালীন উক্তি করা হয়েছে—তা সবাই জানেন।
জনগণের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য আমরা সংসদে বহু প্রস্তাব ও নোটিশ দিয়েছি। কিন্তু এর একটিও গ্রহণ করা হয়নি। বিরোধী দলের নেতার বক্তব্য সরকারের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় মিডিয়ায় প্রচার করা হয়নি। দেশ-জাতির সমস্যা নিয়ে যে সংসদে কথা বলার সুযোগ নেই, সেই সংসদের প্রতি মানুষের কোনো আস্থা থাকে না। এখন বিচার বিভাগ পর্যন্ত বলছে এ সংসদ সার্বভৌম নয়। এরপর আমাদের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোনো কথা বলার মুখ থাকে কি? তিনি অবিলম্বে সংসদে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করার আহ্বান জানান।
ভারত সফর ও চুক্তির পরবর্তী অবস্থা প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে কেন স্থান পায়নি জানতে চেয়ে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী নানারকম চুক্তি করে ভারত সফর শেষে ফিরে এসে বলেছিলেন : ‘আমি জয়ী হনু আজ।’ আশ্চর্যের বিষয়, দু’বছর পূর্তির ভাষণে ভারত সফর ও চুক্তি নিয়ে তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। এতে সবাই হতবাক হয়েছে। তাহলে কী এতদিন পর তিনি বুঝতে পেরেছেন—জয়ী নন, তিনি পরাজিত হয়ে এসেছিলেন? ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাওয়ার প্রবক্তারাও এখন নিশ্চুপ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, বিদেশ থেকে চাকরি হারিয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশী নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসছে। বিদেশে জনশক্তি প্রেরণের হার এরই মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ কমেছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোনো উদ্বেগ কিংবা উদ্যোগ নেই।
নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ না দেয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, দেশবাসী জানতে চায়—এই অঙ্গীকার গত দু’বছরে প্রতিপালন করা হয়নি কেন? আগেরবার ক্ষমতায় এসে নিজেরা দেশকে বিশ্বের এক নম্বর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে পরিণত করেছিলেন। এবার ক্ষমতায় এসে নিজেদের দুর্নীতির সব মামলা খারিজ করাচ্ছেন বা তুলে নিচ্ছেন। আর আমাদের বিরুদ্ধে দিচ্ছেন নতুন নতুন মামলা। এই অবিচার ও বৈষম্যের বিচার কোনোদিনই হবে না বলে কি নিশ্চিত হয়েছেন?
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বিডিআর ধ্বংস করা হয়েছে অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার আজও হয়নি। প্রকৃত অপরাধীরা অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। জ্বলন্ত নানান প্রশ্নের কোনো জবাব দু’বছরে মেলেনি। ন্যায্য প্রশ্ন তোলার দায়ে অনেকে নির্যাতিত হয়েছেন, চাকরি হারিয়েছেন।
বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেন, শাসক দল আজ সমঝোতা, সৌহার্দ্য ও জাতীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভাজন এবং প্রশ্নবিদ্ধ বিচারের নামে তারা রক্তপিপাসা মেটাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা, মর্যাদা আজ ভূলুণ্ঠিত। জাতীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি আজ বিপন্ন। ধর্মপ্রাণ নাগরিকরা আক্রান্ত। এ পরিস্থিতিতে দেশ বাঁচাতে, মানুষ বাঁচাতে আমাদেরকে গড়ে তুলতে হবে গণমানুষের সার্বিক ঐক্য ও প্রতিরোধ। চরম এই দুঃসময়ে সব দেশপ্রেমিকের কাছে সেই নিবিড় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান খালেদা জিয়ার।
এ ভাষণের সময় আরও উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম শামসুল ইসলাম, ড. আরএ গনি, এম কে আনোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ.স.ম. হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক, মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, চেয়ারপার্সনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল

গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সংবাদ সম্মেলন : প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ দেশবাসীকে চরমভাবে হতাশ করেছে

স্টাফ রিপোর্টার

গত ৬ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। গতকাল নগরীর তোপখানা রোডের অস্থায়ী কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশ ও জনগণের এক সঙ্কটময় সময়ে দেশবাসী প্রধানমন্ত্রীর কাছে সঙ্কট ও দুর্ভোগ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে বক্তব্য ও পদক্ষেপের ঘোষণা আশা করেছিল, ভাষণ শুনে সে ব্যাপারে জনগণ চরম হতাশ হয়েছে। উল্টো প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শোনার পর জনগণের উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বেড়ে গেছে।
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা দাবি করেছে, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ জনগণের মাঝে কোনো আস্থা সৃষ্টি করতে পারেনি। কারণ দেশের উন্নতির যে ফিরিস্তি তিনি দিয়েছেন, বাস্তবজীবনে তার কোনো প্রতিফলন নেই। বরং প্রতিদিন মন্ত্রী-এমপিরা সরকারের সাফল্যের সাফাই গেয়ে যেসব একঘেয়ে কথাবার্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রী তারই পুনরাবৃত্তি করেছেন মাত্র।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আ’লীগ সরকারের একটি বড় অঙ্গীকার হলেও প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদে যুদ্ধপরাধীদের উপযুক্ত বিচারের ব্যাপারেও জনমনে কোনো ভরসা জাগাতে পারেননি। অন্যদিকে মহাজোট সরকারের ‘দিনবদলের সনদ’ সরকারের দুই বছরের মাথায় মুখথুবড়ে পড়ে তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। নিজেদের ব্যর্থতার জন্য দুই বছর পরও প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দায় চাপিয়ে পার পেতে চেয়েছেন। তাই তার ভাষণে আশাবাদ ছাড়া সঙ্কট উত্তরণের কোনো কার্যকরী নির্দেশনা দেখা যায়নি। সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়, প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদের বাকি তিন বছরও কি জনগণকে ধৈর্য ধরার কথা বলে পার করে দেবেন?
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা ও ভুল পদক্ষেপের কারণে ভরা মৌসুমেও চালের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। অসত্ সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা জনগণকে জিম্মি করে তাদের পকেট থেকে হাজার কোটি টাকা কেটে নিচ্ছে।
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা বলেছে, সরকার ও সরকারি দলের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জবরদখল, দলীয়করণ, ঘুষ, দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, খুন, ডাকাতিসহ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। অন্যদিকে বিদ্যুত্-জ্বালানি-গ্যাস-পানি-যানজট প্রভৃতি ক্ষেত্রে অসহনীয় পরিস্থিতির কথা প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে নেই। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এ সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যুর মতো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অব্যাহত রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত দুই বছরে দুর্নীতি দমন কমিশন অকার্যকর সংস্থায় পরিণত হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনও এখন ক্ষমতাহীন। বিচার বিভাগ কাগজে-কলমে স্বাধীন হলেও সরকারি প্রভাবের বাইরে নয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান মোর্চার সমন্বয়ক বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, জোনায়েদ সাকী, বাবুল বিশ্বাস, নজরুল ইসলাম, আবু তাহের, হামিদুল হক, মহিউদ্দিন চৌধুরী লিটন, বহ্নিশিখা জামালী প্রমুখ।

গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সংবাদ সম্মেলন : প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ দেশবাসীকে চরমভাবে হতাশ করেছে

স্টাফ রিপোর্টার

গত ৬ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। গতকাল নগরীর তোপখানা রোডের অস্থায়ী কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশ ও জনগণের এক সঙ্কটময় সময়ে দেশবাসী প্রধানমন্ত্রীর কাছে সঙ্কট ও দুর্ভোগ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে বক্তব্য ও পদক্ষেপের ঘোষণা আশা করেছিল, ভাষণ শুনে সে ব্যাপারে জনগণ চরম হতাশ হয়েছে। উল্টো প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শোনার পর জনগণের উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বেড়ে গেছে।
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা দাবি করেছে, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ জনগণের মাঝে কোনো আস্থা সৃষ্টি করতে পারেনি। কারণ দেশের উন্নতির যে ফিরিস্তি তিনি দিয়েছেন, বাস্তবজীবনে তার কোনো প্রতিফলন নেই। বরং প্রতিদিন মন্ত্রী-এমপিরা সরকারের সাফল্যের সাফাই গেয়ে যেসব একঘেয়ে কথাবার্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রী তারই পুনরাবৃত্তি করেছেন মাত্র।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আ’লীগ সরকারের একটি বড় অঙ্গীকার হলেও প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদে যুদ্ধপরাধীদের উপযুক্ত বিচারের ব্যাপারেও জনমনে কোনো ভরসা জাগাতে পারেননি। অন্যদিকে মহাজোট সরকারের ‘দিনবদলের সনদ’ সরকারের দুই বছরের মাথায় মুখথুবড়ে পড়ে তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। নিজেদের ব্যর্থতার জন্য দুই বছর পরও প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দায় চাপিয়ে পার পেতে চেয়েছেন। তাই তার ভাষণে আশাবাদ ছাড়া সঙ্কট উত্তরণের কোনো কার্যকরী নির্দেশনা দেখা যায়নি। সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়, প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদের বাকি তিন বছরও কি জনগণকে ধৈর্য ধরার কথা বলে পার করে দেবেন?
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা ও ভুল পদক্ষেপের কারণে ভরা মৌসুমেও চালের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। অসত্ সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা জনগণকে জিম্মি করে তাদের পকেট থেকে হাজার কোটি টাকা কেটে নিচ্ছে।
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা বলেছে, সরকার ও সরকারি দলের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জবরদখল, দলীয়করণ, ঘুষ, দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, খুন, ডাকাতিসহ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। অন্যদিকে বিদ্যুত্-জ্বালানি-গ্যাস-পানি-যানজট প্রভৃতি ক্ষেত্রে অসহনীয় পরিস্থিতির কথা প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে নেই। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এ সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যুর মতো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অব্যাহত রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত দুই বছরে দুর্নীতি দমন কমিশন অকার্যকর সংস্থায় পরিণত হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনও এখন ক্ষমতাহীন। বিচার বিভাগ কাগজে-কলমে স্বাধীন হলেও সরকারি প্রভাবের বাইরে নয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান মোর্চার সমন্বয়ক বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, জোনায়েদ সাকী, বাবুল বিশ্বাস, নজরুল ইসলাম, আবু তাহের, হামিদুল হক, মহিউদ্দিন চৌধুরী লিটন, বহ্নিশিখা জামালী প্রমুখ।

Saturday 8 January 2011

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ নিয়ে বিশিষ্টজনের প্রতিক্রিয়া : জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি


মাহবুবুর রহমান

সরকারের দুই বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, দুই বছরের মেয়াদে একটি সরকারকে চূড়ান্ত মূল্যায়ন করা ঠিক নয়। তবে এ সময়ে তারা জনগণের মৌলিক চাহিদা-সম্পৃক্ত বিষয়ে কতটুকু সফল, তার মূল্যায়ন করবেন জনগণ। এ সরকারের অনেক উদ্যোগ আছে, অর্জনও আছে। কিন্তু ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঠেকাতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। রাজনৈতিক ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার জাতিকে বিভক্ত করে ফেলেছে। পররাষ্ট্র নীতি পরনির্ভর হয়ে পড়েছে। দুই বছরে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে এসব বিষয়ে ব্যর্থতা স্বীকার করে আগামীতে তা সমাধানের আশ্বাস শুনতে চেয়েছিলেন দেশবাসী। কিন্তু তা না হওয়ায় জাতি হতাশ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ধৈর্য ধরতে বলেছেন, কিন্তু মানুষের ধৈর্যেরও একটি সীমা আছে। এ বিষয়টি অনুধাবন করতে বিশিষ্টজনরা প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের মূল্যায়ন করেছেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ, বিশিষ্ট দার্শনিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, এফবিসিআই’র সাবেক সভাপতি আনিসুল হক, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ধৈর্য ধরতে বলেছেন, দেশবাসী ধৈর্য ধরে আছেন। কিন্তু ধৈর্যেরও একটি সীমা আছে। তিনি তার সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদক্ষেপের কথা বলেছেন। কিন্তু জনগণের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ কী কী তা নির্দিষ্ট করে বলেননি। সরকারের বিষয়ে জনগণের মূল্যায়ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। তা দেখে-বুঝে সরকার পরিচালনা করা উচিত।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ জাতির কাছে হতাশাব্যঞ্জক। তার দুই বছরের শাসনকালে কিছুই যে সাফল্য নেই, তা বলা যাবে না। জনকল্যাণে কিছু উদ্যোগ তার সরকার নিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফলতাও আছে। কিন্তু ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে এমন ইস্যুতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থই বলা যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য এতো বেড়ে গেছে যে, সবকিছুই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। গ্যাস, বিদ্যুত্, পানি সমস্যাও কমেনি। যে উদ্দেশ্য পূরণে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক শক্তির দিকে তাকিয়ে থাকে, তা পুরোপুরি ব্যাহত হয়েছে। আর এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা সন্তোষজনক নয়।
গত দুই বছরে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক ছিল না। গত ২০ বছরের মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে গেল বছর। ২০১০ সালকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বছর বলা যেতে পারে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা বাস্তবতাবিরোধী। কেননা, গত দু’বছরে ২৯৮ জন সাংবাদিক নিগৃহীত হয়েছেন। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ওপর নিপীড়ন ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অর্থনীতির গতিও মন্থর। বিদেশে আমাদের শ্রমিক রফতানি বন্ধ হয়ে গেছে। ২৫টি দেশ থেকে আমাদের শ্রমিকদের যাতায়াতের ব্যবস্থা সুরাহা হয়নি।
গত দুই বছরে জাতি ভয়ঙ্করভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। জাতীয় গতি আজ অবরুদ্ধ। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণ ও অনুগতদের ভিড়ে স্থবির হয়ে পড়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর রিপোর্ট বলেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগ দুর্নীতির শীর্ষে।
পররাষ্ট্রনীতিতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিকে স্বাধীন বলা যায় না। দিন দিন দেশ নির্ভরশীল হতে চলেছে।
জাতীয় সংসদ কার্যকরের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক নয়। বিরোধী দলকে জাতীয় সংসদে টেনে আনার বিষয়ে ইশতেহারে উল্লেখ থাকলেও হয়েছে তার উল্টোটা। সংসদে অসংসদীয় ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে বিরোধী দলকে সংসদের বাইরে রাখা হয়েছে। বিরোধী দল নির্যাতনেও সরকার রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। বহু বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ রাখা হয়েছে।
এসব ব্যর্থতা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীও অবগত বলে আমি মনে করি। আগামী বছরের মধ্যে এসব সমাধান করবেন মর্মে তিনি জাতিকে আশ্বাস দিতে পারতেন। জাতি সমস্যা সমাধানের আশ্বাস শুনতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চার বছর আগে ক্ষমতায় থাকা জোট সরকারকে দোষারোপ করে গেছেন। এটা জনগণকে তৃপ্ত কিংবা আশান্বিত কোনোটিই করেনি।
বিশিষ্ট দার্শনিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ গতানুগতিক। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে রাজনৈতিক ইস্যুগুলোকেই সামনে টেনে আনা হয়েছে। তাদের অনেক অর্জনও আছে। তবে জনগণের যে অর্থনৈতিক সমস্যা, তা তিনি তুলে ধরেননি। আবার সমাধানের কোনো আশ্বাসও দেননি। আমরা জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে প্রত্যাশা করি রাজনীতিকরা চর্বিত চর্বণ যেন না করেন। প্রধানমন্ত্রীকে মনে রাখতে হবে, আমি এখন ক্ষমতায় আছি। জনগণ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের দায়িত্ব। দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতি গণমানুষের প্রতিনিয়ত চিন্তার বিষয়। এ নিয়ে চিন্তা করা সরকারের প্রধান দায়িত্ব। আমি বিরোধী দলের ব্যাপারেও সন্তুষ্ট নই। কেননা, বিরোধী দলের ব্যর্থতা, সংসদে গিয়ে কথা না বলার কারণেই আজ সরকার জনদাবির চেয়ে রাজনৈতিক ইস্যুকে প্রাধান্য দিতে পারছে।
দলে ঐক্য, রাজনৈতিক দলে ঐক্য, জনগণে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সরকারের উদ্যোগ নেয়া দরকার। দেশকে এগিয়ে নিতে চাই—এমনটা প্রমাণ করতে চাইলে তাদের দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে হবে। স্থানীয় সরকার থেকে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে। জনগণের চাহিদা বুঝে কাজ করতে হবে। এসব বিষয় গত দু’বছরে তারা করেনি, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে এ বিষয়গুলোও অনেকক্ষেত্রেই এড়িয়ে গেছেন।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে কিছু মৌলিক বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। বিশেষ করে বিনিয়োগের নেতিবাচক পরিস্থিতি তিনি তুলে ধরেননি। বিনিয়োগের জন্য গ্যাস-বিদ্যুত্সহ অবকাঠামোগত পরিবেশ সরকার যে দিতে পারেনি, তা তিনি এড়িয়ে গেছেন। বরং প্রধানমন্ত্রী গ্যাস-বিদ্যুত্ সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার দায় বিরোধী দলকে দিয়েছেন। পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুত্ উত্পাদনে সরকারের উদ্যোগ আছে, সমন্বিত প্রোগ্রামও এগিয়ে চলছে, তবে তা বিলম্বিত হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সাধারণের কাছে তা যৌক্তিক বলে মনে হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ মূলত গত দু’বছরে তাদের কার্যক্রমের বিবরণ। এ বিষয়টিকে দু’ভাবে দেখা যায়। আন্তর্জাতিকভাবে এ সরকার গত দু’বছরে বেশকিছু সফলতা পেয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তারা সফল। তাদের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে, তা বাস্তবায়নের পর অবশ্য দেখা যাবে আমাদের স্বার্থ কতটা রক্ষা হয়েছে। এরপরও এতটুকু বলা যায়, ভারত-বাংলাদেশের পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝির যে জায়গাটা ছিল, তা নিরসন হয়েছে। আর জাতীয় ইস্যুতে সরকারের ব্যর্থতাই বেশি। যদিও দু্’বছরেই সরকারকে ব্যর্থ বলাটা ঠিক হবে না। জ্বালানি সঙ্কট নিরসনে সরকারের প্রতি জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা সরকার পূরণ করতে পারেনি। তবে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। দু’বছরে সরকারের হিসাব-নিকাশ করতে সময় লেগেছে। মানুষ কিন্তু এসব দেখতে চায় না। তারা দেখতে চায় সমস্যার সমাধান হয়েছে কিনা। সরকারের ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় জায়গাটা হলো সংসদ কার্যকর করতে না পারা। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে গত দু’বছরে দূরত্ব বেড়েছে। বিরোধের জায়গাটা আরও কঠিন রূপ ধারণ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও তা স্পষ্ট হয়েছে। এ বিরোধের জায়গা কমবে বলে জনগণ আশা করেছিল।
এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আনিসুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের ভাষা প্রয়োগই প্রমাণ করে তিনি জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সচেষ্ট। কিন্তু সমস্যা হলো তিনি যে গতিতে এগুতে চান, তার প্রশাসন সে গতিতে চলতে পারছে না। দু’বছরেই একটি সরকারের সফলতা-ব্যর্থতার চূড়ান্ত মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। এখন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়। জনগণ এর কিছুটা ফল পাবে আগামী দু’বছরে।
বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া বলেন, সরকার অনেক ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও এর কিছু উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ সরকারের প্রতি জনগণের যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ করতে পারেনি। নির্বাচনী ইশতেহার দেখে তাদের প্রতি জনগণের আশার জোয়ার এসেছিল। তা এখন ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়েছে। এটা আমাদের জন্য, সাধারণ জনগণের জন্য বেদনাদায়ক। সরকার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারছে না। মানুষ নীরবে কাঁদছে। হাঁপিয়ে উঠছে। সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা গভীরভাবে উপলব্ধি করা দরকার। জনগণের মাঝে সাম্য, মৈত্রীর বন্ধন নষ্ট করেছে। সংবিধান ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। কাঠামোগতভাবে দেশকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে।
এ সরকারের আমলে বিচার ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। সামরিক বাহিনীও আস্থা হারিয়ে ফেলছে। মুক্তবুদ্ধির চর্চা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা প্রাণ খুলে কথা বলতে পারছি না। বলার স্বাধীনতা নেই। লেখার স্বাধীনতা নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে আন্তরিকতা আছে বলে মনে হয়েছে। আবার দুর্বৃত্তায়নও হয়েছে

হামলা মামলা গ্রেফতার সহিংসতায় আওয়ামী লীগ সরকারের দুই বছর : রাজনৈতিক খুন ৪৭০, বিচারবহির্ভূত হত্যা ২৮১, গুম ১৬

নাছির উদ্দিন শোয়েব

মামলা, হামলা, গ্রেফতার ও সহিংস ঘটনার মধ্য দিয়ে অতিক্রম হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দুই বছর। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সাংবাদিক নির্যাতন, খুন, গুম, ডাকাতি ও রাহাজানিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ছিল নিত্যদিনকার ঘটনা। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির ঘটনায় অতিষ্ঠ ছিল মানুষ। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকার অঙ্গীকার করলেও তা অব্যাহতভাবে চলেছে। নতুন যোগ হয় সাদা পোশাকে অপহরণ, গুপ্ত হত্যা। বিগত বছর বখাটেদের নারী উত্ত্যক্ত করার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ইভটিজিং বা নারী নির্যাতনের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় অভিভাবকরা ছিলেন উদ্বিগ্ন। প্রতিবাদকারীরা বখাটেদের রোষানলে পড়েন। অন্যদিকে ফাঁসির আসামি, হত্যা মামলার আসামিসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলাকারীদের রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তি পাওয়ার ঘটনায় হতবাক হয়েছেন সমাজের বিবেকবান মানুষ ।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ ও ’১০ সালে দেশে আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। বিডিআর বিদ্রোহ, খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে প্রখ্যাত আলেম, রাজনৈতিক নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতিহিংসামূলক গ্রেফতার, হয়রানি, তুচ্ছ ঘটনায় মামলা দায়ের এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনায় মানুষ ছিল উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায়। রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা, ডাবল ও ট্রিপল মার্ডার, গলাকেটে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। নিরপেক্ষভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেননি সাংবাদিকরা। এ সময়ে ৪ সাংবাদিক নিহত, ১৭০ সাংবাদিক আহত, ৫০ জন লাঞ্ছিত ও ৫৫ জন হুমকির সম্মুখীন হন। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ১৭ জনের ওপর হামলা, দু’জনকে গ্রেফতার, একজন অপহৃত ও ১৩ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দুই বছরে প্রায় ৮ হাজার হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সে অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১ জন খুন হয়েছে। ২৮১ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের স্বীকার, রাজনৈতিক সহিংসতায় খুন ৪৭০, বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে ১৭০ জন।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুসারে ২০০৯ ও ’১০ সালে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ছিল নাজুক। ২০০৯ সালে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানোর কথা বলেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তা অব্যাহতভাবে চলেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কোন্দল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস ও অবৈধ হল দখলের মতো ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নির্যাতন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, রাজনৈতিক সহিংসতা, সভা-সমাবেশ বন্ধে ১৪৪ ধারা জারি, গার্মেন্ট শ্রমিকদের নির্যাতন ও গ্রেফতার, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেশি ঘটেছে বিগত বছরে।
হত্যাসহ ভয়ঙ্কর অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল। কখনও কখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিরাও সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। অধিকাংশ ঘটনায় গ্রেফতার হয়নি ঘাতকরা। হত্যাকাণ্ডের পরও খুনি ও তাদের সহযোগীরা মামলার বাদীকেও হত্যার হুমকি দেয়ার অনেক অভিযোগ রয়েছে। খুনিরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকায় পুলিশও তাদের গ্রেফতার করছে না মর্মে বহু অভিযোগ পুলিশ সদর দফতরে জমা আছে। তবে আইনশৃঙ্খলার অবনতির কথা স্বীকার করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এমনকি গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণেও বলেছেন, মহাজোট সরকারের দু’বছরে দেশে আইনশৃঙ্খলা অনেক ভালো ছিল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতা : অপরাধমূলক ঘটনার ব্যাপকতায় গত দু’বছর জনমনে বেশ উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা ছিল। দেশজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও এর সুফল সাধারণ মানুষ পেয়েছেন যত্সামান্য। জনবল বৃদ্ধিসহ পুলিশ বিভাগকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার ঘোষণা থাকলেও কার্যকর হয়নি তেমন কিছুই। গত বছরের ৩১ আগস্ট পুলিশের মহাপরিদর্শক পদে পরিবর্তন আনা হয়। বিগত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে দায়িত্ব নেয়া নূর মোহাম্মদের স্থলাভিষিক্ত হন হাসান মাহমুদ খন্দকার। কাছাকাছি সময়ে র্যাবের মহাপরিচালক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার পদসহ পুলিশের মাঠপর্যায়েও ব্যাপক রদবদল করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কর্মকর্তা নিযুক্তির ক্ষেত্রে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রাধান্য দেয়া হয়। এতে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। পরে মাঠপর্যায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়। পাশাপাশি সারাদেশে থানার সংখ্যা বাড়ানো হয়। বর্তমানে ঢাকায় ৪১টি থানার কার্যক্রম চলছে। অধিকাংশ থানার ওসি পদে রদবদল করা হয়। ডিএমপির অধিকাংশ থানার ওসি, ইন্সপেক্টর ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একটি বিশেষ জেলার বাসিন্দা। দলীয় বিবেচনায় পুলিশ কর্মকর্তারা যা খুশি তাই করছেন। কিন্তু পুলিশ পেশাগত কাজের চেয়ে এখন রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নেই বেশি সময় দিচ্ছে—এমন অভিযোগ রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যেতে না পারায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের দমনে ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে এক ধরনের ধস নামে।
নারী নির্যাতন/ইভটিজিং : ইভটিজিংয়ের ঘটনায় খুনখারাবি, অভিভাবকের ওপর হামলা ও তরুণীদের হাত-পা কেটে নেয়ার মতো লোমহর্ষক ঘটনা দেশবাসীর কাছে এখন অজানা কোনো ব্যাপার নয়। বখাটেদের বেপরোয়া আচরণ ও নারীদের উত্ত্যক্ত করার প্রবণতায় সারাদেশে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানামুখী প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ নেয়া হলেও বখাটেদের অপতত্পরতা বন্ধ করা যায়নি। এমনকি প্রতিবাদকারীরাও রোষানলে পড়েছেন। বখাটেদের হামলায় নাটোরের কলেজশিক্ষক মিজানুর রহমান এবং ফরিদপুরে এক কিশোরীর মা চাঁপা রানী ভৌমিকের মৃত্যু ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। অপরাধ দমনে র্যাব-পুলিশ ও গোয়েন্দাদের মাঠে নামানো হয়। তাতেও কাজ হচ্ছিল না। পরে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে সারাদেশে এ অপরাধ প্রতিরোধ করার কার্যক্রম চালু করা হয়। পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত উত্ত্যক্ততার শিকার হয়ে ২৮ নারী আত্মহত্যা করেছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৫ অভিভাবক খুন হয়েছেন এবং বখাটেদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ১৮ তরুণী। ইভটিজিং প্রতিরোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত এ সময় ঢাকায় একজন শিক্ষকসহ বিভিন্ন স্থানে অর্ধশত দুর্বৃত্তকে আটক করে সাজা দিয়েছে। র্যাবের হিসাব মতে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছে ১৩৮ কিশোরী ও তরুণী এবং এ অপকর্মের দায়ে গ্রেফতার হয়েছে ১২৬ জন।
গুম ১৬ জন : সাদা পোশাকধারীদের হাতে আটক হওয়ার ঘটনায় অপরাধের নতুন মাত্রা যোগ হয়। গত দু’বছরে আটক হওয়ার পর নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা কোথাও গিয়ে প্রিয়জনকে খুঁজে পাননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দাদের কাছে লিখিতভাবে আবেদন জানিয়ে এবং আদালতের শরণাপন্ন হয়েও কাজ হয়নি। তাদের উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও রহস্যজনকভাবে নীরব ছিল বলে স্বজনহারা পরিবারের অভিযোগ। এ অবস্থায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো চরম অসহায়ত্বের মধ্যে থাকে। ভুক্তভোগীরা বলেন, আদালত থেকে পুলিশকে গুরুত্বসহকারে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হলেও পাওয়া যায়নি নিখোঁজ ব্যক্তিদের। তারা বেঁচে আছে, নাকি গুম করা হয়েছে এ নিয়ে চিন্তিত থাকে পরিবার। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকের পর অনেকেরই লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যার পর লাশ গুম করার ঘটনা ঘটেছে অহরহ। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং ঢাকা মহানগর ৫৬নং ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম গত বছর ২৫ জুন ইন্দিরা রোডের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে প্রাইভেটকারে ধানমন্ডি যাওয়ার সময় সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিদের হাতে আটক হন। গাড়ি থামিয়ে তাকে আটক করে নিয়ে যায় বলে পরিবার থেকে অভিযোগ রয়েছে। চৌধুরী আলমের বড় ছেলে আবু সাইদ চৌধুরী হিমু জানান, তার বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর ৬ মাসেরও বেশি সময় হয়েছে; কিন্তু খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১৭ এপ্রিল বাড্ডা-কুড়িল এলাকা থেকে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা মিজানুর রহমান মিজান, নাজমুল হক মুরাদ ও ফোরকানকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে মোহাম্মদপুর ঢাকা উদ্যানের পেছনে তুরাগ নদীর বালিতে তিনজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একজন পরে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসে। আগে বরিশালের মজনু খান, ঢাকার লাল বাবু ও জালাল, হাসিবুল হক জনি, ঠাকুরগাঁওয়ের আকবর আলী ও রিপন, গাজীপুরের সেলিম, গাইবান্ধার ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান, ঝালকাঠির ব্যবসায়ী হুমায়ুন, যুবলীগ নেতা লিয়াকত, মাদারীপুরের আকবর আলী সরদারকে সাদা পোশাকে অপহরণের পর এখনও তারা নিখোঁজ।
সহিংসতা : অধিকারের তথ্য অনুযায়ী গত দু’বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৪৭০ জন। আহত হয়েছেন প্রায় ২০ হাজার। ১১ অক্টোবর সিরাজগঞ্জে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সভাস্থলে ট্রেনে কাটাপড়ে পাঁচজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। যমুনা সেতুর পশ্চিম সংযোগ সড়কের মুলিবাড়ী রেলওয়ে ক্রসিংসংলগ্ন এলাকায় এ দুর্ঘটনায় আহত হন অর্ধশতাধিক। নিহতরা বিএনপিকর্মী ও সমর্থক। এ ঘটনায় র্যাব, পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষও হয়। পুলিশ মিছিলে গুলি ছোড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা ট্রেনটিতে অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনাকে বিএনপি পরিকল্পিত বলে অভিযোগ করেছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সেনা আবাসন প্রকল্পের নাম করে কম দামে জমি কেনা ও জমি দখল নিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে সেনা, পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে সংঘর্ষে মোস্তফা জামাল উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। বছরের প্রথমদিকে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর খুন হন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’পক্ষের সংঘর্ষে উভয়পক্ষ রামদা, চাপাতি, লাঠি, হকিস্টিক নিয়ে একে অপরের ওপর হামলা চালায়। এ সময় আবু বকর এএফ রহমান হলের চতুর্থ তলায় তার কক্ষের সামনের বারান্দায় গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। ওই ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় হলেও ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ ছাড়াও ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধে সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের বহু ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে থানায় মামলা পর্যন্ত হয়নি।
চাঁদাবাজি : দুই বছরে দেশজুড়ে ছিল চাঁদাবাজির মহোত্সব। চাঁদাবাজি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, শিক্ষক, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী, খেটে খাওয়া মানুষ কেউই নিস্তার পায়নি। সমাজের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে শুরু করে পেটের দায়ে রাস্তায় দাঁড়ানো ভাসমান পতিতা পর্যন্ত সবাইকে চাঁদা দিতে হয়েছে। ফুটপাতে, পরিবহনে পাড়া-মহল্লায়, ক্লাব ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদাবাজি হয়েছে। পুলিশের চাঁদাবাজি, মহল্লার বিভিন্ন সমিতির নামে চাঁদাবাজি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও অঙ্গ সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি মিলিয়ে চাঁদাবাজদের ভয়ে চরম অস্থিরতার মধ্যে থাকে সর্বস্তরের মানুষ। বাসাবাড়ি, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, টার্মিনাল, ফেরিঘাটসহ কোনো ক্ষেত্র চাঁদাবাজি থেকে বাদ পড়েনি। চাঁদাবাজি বন্ধ করার দাবি জানিয়ে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে সরকারকে চাপ সৃষ্টি করেন। ঢাকায় ক্ষমতাসীন দলের দুই এমপি চাঁদাবাজদের হুমকিতে নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেন।
ডাকাতি : ডাকাত আতঙ্কে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষ রাত জেগে পাহারা দিয়েছে। একের পর এক ঘটেছে দুর্ধর্ষ ডাকাতি। মুখোশধারী ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে লুট করে নেয় মালামাল। প্রতিরোধ করতে গিয়ে সশস্ত্র ডাকাত দলের হামলায় নিহত এবং আহত হয়েছে মানুষ। ডাকাতি রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় আইন হাতে তুলে নেয় ক্ষুব্ধ জনতা। জানা যায়, দেশের কয়েকটি অঞ্চলে রাত হলেই নেমে আসে ডাকাত আতঙ্ক। চুরি, ডাকাতি-দস্যুতা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আস্থা হারায় মানুষ। রাজধানী ঢাকার নিম্নাঞ্চলের অনেক এলাকায় লাঠি-বাঁশি নিয়ে বিগত বছরে রাত জেগে পাহারার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। কেরানীগঞ্জ, সাভার ও আশুলিয়াসহ দেশের আরও কয়েকটি এলাকায় রাত জেগে মানুষ পাহারা দেয়। সাভার ও আশুলিয়ায় পরপর কয়েকটি দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনায় অনেকে এখন দিনের বেলায়ও ঘরের দরজায় তালা দিয়ে রাখছে। এসব অঞ্চলে রাতে দরজা খুলে মানুষ ঘরের বাইরে যেতেও ভয় পাচ্ছে।
হত্যাকাণ্ড : দুই বছরে কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটনায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সরকার দলের ক্যাডারদের হাতে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘাতকদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকায় যুবলীগ নেতা ইব্রাহীম হত্যা, যাত্রাবাড়ীতে ব্যবসায়ী দম্পতিসহ ট্রিপল মার্ডার, গুলশানে বাসায় ঢুকে মা ও মেয়েকে গুলি করে হত্যা, মগবাজারে যুবলীগ নেতা ইউসুফ আলী সরদার, খিলগাঁওয়ে প্রকৌশলী হত্যা, মহাখালীতে কর্মচারী নেতা সিদ্দিকুর রহমান ও খিলগাঁওয়ে গৃহবধূ কণিকা হত্যা, মিরপুরে ইডেন কলেজের ছাত্রী মেনকা ও স্বর্ণ ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান হত্যাকাণ্ড নগরবাসীর মাঝে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। যুবদল ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) সভাপতি ও ৭০নং ওয়ার্ড কমিশনার হাজী আহমেদ হোসেন, ক্যান্টনমেন্টের মানিকদি এলাকায় ছাত্রলীগ নেতা ফারুক, কারওয়ান বাজারে দিনদুপুরে গুলি করে তিন ব্যবসায়ী হত্যা, মোহাম্মদপুরে অপহরণের পর গুলি করে বিএনপি নেতা শিপু, ধনিয়া কলেজের ছাত্র আমজাদ হোসেন, সবুজবাগে ওসমান গণি ও গৃহবধূ শাহিনুর বেগম, পুরান ঢাকায় ৪০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে দুর্বৃত্তদের গুলিতে জুয়েলারি ব্যবসায়ী প্রেমকৃষ্ণ রায় খুন, গুলশানের কালাচাঁদপুরে নিজ বাড়িতে নার্সারি ব্যবসায়ী সাদেকুর রহমান ও তার স্ত্রী রোমানা নার্গিস খুন, পুরান ঢাকার কোতোয়ালি থানার সাব-ইন্সপেক্টর গৌতম, মগবাজারে টেন্ডার বিরোধে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় যুবলীগ নেতা ইউসুফ আলী সরদার, বনানীতে ছিনতাইকারীদের গুলিতে পুলিশের এসআই, গুলশানে মানিচেঞ্জ ব্যবসায়ী ফারুক আহম্মদকে হত্যা এবং তেজতুরি বাজারে স্কুলছাত্র রুবেল আহমেদকে হত্যা করা হয়। পুরান ঢাকার ডিশ ব্যবসায়ী আজগরকে হত্যা করে লাশ ১৫ টুকরা করে সন্ত্রাসীরা। ২৭ অক্টোবর ব্রহ্মণবাড়িয়ায় সন্ত্রাসীদের হামলায় সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান ও হোসেন মিয়া মারা যান। এছাড়াও লালমনিরহাটে বিএনপি নেতা ও ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম, বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবু, নাটোরে কলেজ শিক্ষক মিজানুর রহমান, রূপগঞ্জে জামাল উদ্দিন, কুষ্টিয়া-১ আসনের আওয়ামী লীগদলীয় এমপি আফাজউদ্দিন আহম্মেদের বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণে তিনজন নিহত হন। অন্যদিকে ২০০৯ সালের উল্লেখযোগ্য খুনের মধ্যে যাত্রাবাড়ীতে মা ও তার দুই মেয়ে, ফকিরাপুল বাজারের সামনে ৩২নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সালাউদ্দিন সুমন, মতিঝিলে মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক, সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মী আসাদুজ্জামান, মিরপুরে একটি পেট্রল পাম্পের হিসাবরক্ষককে গুলি করে পৌনে ৮ লাখ টাকা ছিনতাই, বাড্ডায় ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেনের শ্বশুর মোবারক আলী, খিলগাঁও আইডিয়াল সিটি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল চন্দন চক্রবর্তী ওরফে সাজ্জাদ হোসেন, ধলপুরে অ্যাডভোকেট শামসুল হক রিন্টুকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়।
টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ পুলিশ : মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি ও ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে হানাহানিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অশান্ত হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগের সশস্ত্র মহড়া, অস্ত্রবাজির ঘটনা ছিল ওপেন সিক্রেট। ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতা ও ক্যাডার ব্যাপক টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির দায়ে অভিযুক্ত হয়। একপর্যায়ে এদের কর্মকাণ্ড এত মাত্রা ছাড়িয়ে যায় যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক ছিন্ন করার মৌখিক ঘোষণা দেন। মূল দলের সাধারণ সম্পাদক বারবার হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। তাতেও টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি বন্ধ থাকেনি। প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও তা ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, টেন্ডারবাজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কিছু লোক জড়িত। দিনাজপুরের টেন্ডার নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রথম সারির কয়েকজন ঠিকাদার পুলিশের কাছে এই অভিযোগ করেন। একপর্যায়ে পুলিশের তখনকার আইজি টেন্ডারবাজি নিয়ে উত্কণ্ঠা প্রকাশ করেন। পুলিশ সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলন করে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, যেসব এলাকায় টেন্ডারবাজি ঘটছে, সেসব স্থানে পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট এসপি ও ওসির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি দলের ক্যাডারদের ব্যাপারে শক্তভাবে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় টেন্ডাবাজদের ব্যাপারে পুলিশও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। টেন্ডারবাজিতে জড়িতদের ছাড় দেয়া হবে না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের এমন হুঙ্কারেও সরকারি দলের ক্যাডারদের বেপরোয়া টেন্ডারবাজি ঠেকাতে প্রশাসনও ব্যর্থ হয়।