Friday 7 January 2011

জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু উপেক্ষিত সংসদে



এমরান হোসাইন

গেল বছরে জাতীয় সংসদ চলেছে একতরফাভাবে। সংসদে উপেক্ষিত হয়েছে জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সরকারি দল সংসদকে অকার্যকর মানতে না চাইলেও বিরোধী দলবিহীন সংসদ কার্যত অকার্যকরই ছিল। সংসদের অকার্যকর পরিস্থিতির জন্য সরকার ও বিরোধী দল একে অপরকে দায়ী করে এসেছে। সরকারি দল বলেছে, বিরোধী দল সংসদকে অকার্যকর করতে দুরভিসন্ধিমূলকভাবে সংসদ বর্জন করেছে। অপরদিকে বিরোধী দলের অভিযোগ জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়ে সরকারি দল পরিকল্পিতভাবেই সংসদকে অকার্যকর করে রেখেছে। জনগণের টাকায় পরিচালিত এই সংসদে জনস্বার্থের পরিবর্তে সরকারি দল ও দলীয় প্রধানের স্তুতি এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ বক্তৃতায় ব্যস্ত ছিল বলেও বিরোধী দলের অভিযোগ। গত বছরের প্রথম তথা নবম সংসদের ৪র্থ অধিবেশনের শেষদিকে বিরোধী দল যোগ দিয়ে সংসদে কিছুটা উত্তাপ ছড়ালেও বছরের বাকি দিনগুলোতে সংসদ ছিল নিষ্প্রাণ। সংসদ কার্যক্রমে অংশ নেয়ার ব্যাপারে সরকারি দলের সদস্যদের মাঝেও ছিল অনীহা। অধিবেশন চলাকালে অনেকে মোবাইলে কথা বলা, একে অন্যের সিটে গল্পগুজব ও পত্রিকা পড়ে সময় কাটিয়েছেন। এসব অসংসদীয় কার্যক্রমের জন্য ক্ষুব্ধ হয়ে স্পিকারকে একাধিকবার রুলিং দিতে দেখা গেছে।
নবম সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিন থেকেই সংসদে যোগ দিয়ে বিরোধী দল সুন্দর এক নজির সৃষ্টি করলেও পরবর্তীতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি। বিরোধী দলের অনুপস্থিতির জন্য সরকারি দলের সদস্যদের মধ্যে যেমন সংসদ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ব্যাপারে দিন দিন অনীহা বাড়ছে তেমনি জনগণও সংসদের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। জাতীয় সংসদও দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পরিপূর্ণভাবে সফল হতে পারেনি। সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিসহ সংসদকে অকার্যকর রাখার জন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সরকার ও বিরোধী দল উভয়কে দায়ী করেছেন।
২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি শুরু হওয়া নবম জাতীয় সংসদের এ পর্যন্ত ৭টি অধিবেশন শেষ হয়েছে। ১৭৪ কার্যদিবসের এ অধিবেশনে বিরোধী দল ৪৫ দিন উপস্থিত ছিল। এ সময় বিল পাস হয় ১৩০টি। বিলগুলোর মধ্যে প্রথম অধিবেশনে ৩২টি, দ্বিতীয় অধিবেশনে ১১টি, তৃতীয় অধিবেশনে ১১টি, গত বছর অনুষ্ঠিত চতুর্থ অধিবেশনে ২৩টি, পঞ্চম অধিবেশনে ২৪টি, ষষ্ঠ অধিবেশনে ১৩টি ও সপ্তম অধিবেশনে ৪টি বিল পাস হয়। এদিকে নবম সংসদের ৭টি অধিবেশনের মধ্যে গত বছর অনুষ্ঠিত হয় ৪টি অধিবেশন। এ সময় চলা ৮৮ কার্যদিবসের বিরোধী দল উপস্থিত ছিল ২৩ দিন। শেষ তিনটি অধিবেশনে বিরোধী দল মাত্র ১ দিন সংসদে গিয়েছে। গত বছর সংসদে ৬৪টি বিল পাস হয়। এর মধ্যে বেশকিছু আলোচিত ও বিতর্কিত বিলও রয়েছে। এগুলো হচ্ছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-এমপিসহ অন্যদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত ৬টি বিল। এই বিল পাসের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের বেতন-ভাতা ৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। গত বছর ৪ এপ্রিল বিলটি পাসের প্রতিবাদ জানিয়ে বিরোধী দল সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে। এছাড়া আলোচিত অন্য বিলের মধ্যে রয়েছে বরিশালে জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে প্রণীত শহীদ জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় (সংশোধন) আইন, দ্রুত বিচার আইন, জ্বালানি ও বিদ্যুত্ খাতে সরকারি কর্মকর্তাদের ইমডেমনিটি দিয়ে প্রণীত আইন, বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে প্রণীত বর্ডার গার্ড আইন ইত্যাদি। সংসদে অনেক বিল কোনো ধরনের আপত্তি ছাড়াই পাস হয়েছে। কোনো ধরনের বিরোধিতা না থাকায় স্পিকারকে একাধিকবার উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট সংসদ কার্যক্রম চলাকালে সদস্যদের ভাষা ও শব্দ চয়নেরও সমালোচনা করেছেন। গত ১২ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যকালে তিনি বলেন, কিছু সংসদ সদস্যের ভাষার কারণে সংসদে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সংসদের এমন পরিবেশ ধীরে ধীরে দেশের পরিবেশ নষ্ট করে বলেও তিনি ওই সময় মন্তব্য করেন।
এদিকে সংসদে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা গত বছরের ৪টি অধিবেশনে তিন শতাধিক মুলতবি প্রস্তাব দিলেও তার একটিও গৃহীত হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ভারতকে ফ্রি ট্রানজিট দেয়া, বিএসএফের হাতে বাংলাদেশীদের হত্যা-নির্যাতন, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, তীব্র বিদ্যুত্ সঙ্কট, ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তিবাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম, রাজধানীর অসহনীয় যানজট, জিয়া বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সাংবাদিক নির্যাতন ও মিডিয়া দলন, রিমান্ডে নির্যাতন, বাংলাদেশের ভূমিতে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন, মিথ্যা হলফনামা দিয়ে সরকারি দলের এমপিদের রাজউকের প্লট গ্রহণসহ জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট এসব মুলতবি প্রস্তাব সংসদে নাকচ হয়ে যায়। সর্বশেষ সপ্তম সংসদে মাত্র ৫ মিনিটে বিরোধী দলের সদস্যদের ৬০টি মুলতবি প্রস্তাব নাকচ করা হয়। কেবল মুলতবি প্রস্তাবই নয়, জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ৭১ বিধিতে জমা দেয়া নোটিশ প্রতিদিন নিষ্পত্তি করা হলেও বিরোধীদলীয় সদস্যদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংক্রান্ত তাদের নোটিশও গ্রহণ করা হয়নি।
গত এক বছরের সংসদ কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিবেশনে বক্তব্যের সিংহভাগজুড়ে সংসদ নেতা থেকে শুরু করে সরকারি দলের মন্ত্রী, নেতা ও সংসদ সদস্যরা বিগত জোট সরকার, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া, তার জ্যেষ্ঠ ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও আরেক ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে শালীনতাবর্জিত ভাষায় বিষোদগার করেছেন। বিরোধী দলের সদস্য এমনকি বিরোধীদলীয় নেতা সংসদে উপস্থিত থাকলে এ ধরনের বিষোদগারের মাত্রা আরও তীব্রতর হয়। এ ক্ষেত্রে স্পিকার কোনো বাধা তো দেনইনি বরং নির্ধারিত সময় বাড়িয়ে দেয়ারও নজির রয়েছে। সর্বশেষ সপ্তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে সংসদ নেতা বিরোধীদলীয় নেতার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বাড়ির বাথরুম-টয়লেট নিয়েও কথা বলেন। ওই ভাষণে বাড়ি থেকে বিরোধীদলীয় নেতার জিনিসপত্র নেয়া প্রসঙ্গে লাউশাক তুলে নেয়ার প্রসঙ্গও নিয়ে আসা হয়। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছেলে জয়ের কোনো সমালোচনা করামাত্রই সরকারদলীয় সদস্যদের ধমক, তুমুল হৈ চৈ ও হট্টগোল শুরু হয়। এ বছরের প্রথম অধিবেশনে বিরোধী দল যোগ দেয়ার পর তাদের ওপর সরকারি দলের সদস্যদের আক্রমণাত্মক কথাবার্তা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়।
তবে, এসবের মধ্যেও গেল বছর সংসদে বেশকিছু ইতিবাচক কর্মকাণ্ড হয়েছে। সংসদের অধিবেশনে না গেলেও বিরোধীদলীয় সদস্যরা নিয়মিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যোগ দিয়ে ভূমিকা রেখেছেন। সংসদ কার্যক্রমে আধুনিকতা ও প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। গত বছরই প্রথম ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাওয়ার পয়েন্টে বাজেট উপস্থাপন করা হয়। সদস্যদের বক্তৃতার সময় নিয়ন্ত্রণ ও প্রশ্ন বাছাইয়ে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে।
গত এক বছরের সংসদ কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, সংসদ জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার পরিকল্পিতভাবেই সংসদকে অকার্যকর করে রেখেছে। জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তাদের মুলতবি প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে একতরফাভাবে সংসদ চালানো হয়েছে। জাতীয় ইস্যুতে আলোচনার সুযোগ দেয়া হয়নি।
এদিকে সংসদকে অকার্যকর আখ্যায়িত করে বিরোধী দলের দেয়া বক্তব্যকে নাকচ করে দিয়ে চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ বলেন, দুই বছরে জনুরুত্বপূর্ণ ১৩০টি আইন পাসই প্রমাণ করে সংসদ কার্যকর। তিনি বলেন, সংসদে বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হচ্ছে। কাজেই সংসদকে অকার্যকর বলার কোনো সুযোগ নেই। তবে, এটা ঠিক যে বিরোধী দল সংসদে এলে সংসদ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
বিরোধী দলই বর্জন করে সংসদকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন।
বিরোধী দল সংসদে না এসে জনগণের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনে বিরোধী দল যোগ দেবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমরা সংসদে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। জনগণকে দেয়া প্রতিটি প্রতিশ্রুতি আমরা একে একে পালন করে যাব

No comments:

Post a Comment