Friday 7 January 2011

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ অন্তঃসারশূন্য লুকোচুরি

স্টাফ রিপোর্টার

সরকারের দুই বছরপূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণকে অন্তঃসারশূন্য ও জাতির সঙ্গে লুকোচুরি হিসেবে অভিহিত করেছেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির তিন সিনিয়র নেতা।
ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরার সাহস পাননি। দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা, গ্যাস-বিদ্যুত্-পানিসহ জনদুর্ভোগ পাশ কাটিয়ে তিনি অসত্য তথ্য উপস্থাপন করেছেন। জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জনদাবি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে গুরুত্ব পায়নি। এতে দেশের মানুষ হতাশ হয়েছে। সব শ্রেণীর মানুষকে নিরাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এটি কোনো ভাষণ হয়নি, এটা হয়েছে একটি লুকোচুরির বাজেট বক্তৃতা।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ : সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ভাষণ দেশের সব শ্রেণীর মানুষকে নিরাশ করেছে। দেশের মানুষ অপেক্ষা করছিল, জনসাধারণের মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধানে সরকার কী করতে চায়— তা শোনার জন্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে দেশের বিদ্যমান সঙ্কটগুলো সমাধানের কোনো দিকনির্দেশনা দেখা যায়নি বলে সবাই হতাশ হয়েছেন। তিনি বলেন, এটা মোটেও জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ হয়নি বরং এটা হয়েছে বাজেট বক্তৃতা। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রমাণ হয়েছে, সরকার জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কারণ জনগণ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিতে মারাত্মক সঙ্কটে কালাতিপাত করছে।
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি রোধ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিশীল অবস্থা থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে তার সরকার কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ওপর প্রতিহিংসামূলকভাবে যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে, গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে যে নির্যাতন করা হচ্ছে, সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমে সরকার যে হস্তক্ষেপ করছে— সে ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী কোনো কথা বলেননি। এসব নির্যাতন কবে নাগাদ বন্ধ করা হবে তা তিনি বলেননি।
মওদুদ আহমদ বলেন, চারদলীয় জোট সরকারের ওপর বিভিন্ন বিষয়ে দোষ চাপিয়ে প্রধানমন্ত্রী আবারও তার সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণ করেছেন। কারণ চারদলীয় জোট চার বছর আগে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে।
তিনি বলেন, ভারতকে করিডোর দেয়া এবং তাদের গাড়ি চলাচলের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সে দেশের এক্সিম ব্যাংক থেকে আত্মঘাতী শর্তে সরকার যে ঋণ নিয়েছে সে ব্যাপারেও তিনি জনগণকে কিছু বলেননি। ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর নির্বিচারে বাংলাদেশী হত্যা, ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ সম্পর্কে সরকারের পদক্ষেপ কী সে ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে কিছু ছিল না। এতে প্রমাণ করে জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি এ সরকার মোটেও গুরুত্ব দেয় না।
তিনি বলেন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে বলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন; কিন্তু এটা মোটেই সত্য নয়। দেশের মানুষ ভালোভাবেই জানে, এসব সংস্থা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না।
এম কে আনোয়ার : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরতে সাহস করেননি। দেশ পরিচালনায় তিনি কি কি পরিকল্পনা করেছেন তার কোনো কথা ভাষণে নেই। উল্টো বিগত বিএনপি সরকারের কুত্সাই স্থান পেয়েছে তার ভাষণে। কিছু কিছু জায়গায় অসত্য তথ্য উপস্থাপন এবং কোথাও সত্যকে লুকিয়ে কথা বলেছেন তিনি। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা, বিদ্যুত্, গ্যাস, পানি সমস্যাসহ জনদাবিগুলোর সঠিক চিত্র প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরতে সাহস পাননি। দুর্নীতি দমন কমিশন, উচ্চ আদালত, পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ জনগুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের ভাবমর্যাদার বর্তমান পরিস্থিতিও তার বক্তব্যে স্থান পায়নি।
এম কে আনোয়ার বলেন, প্রধানমন্ত্রী ভাষণ শুরু করেছিলেন নির্বাচনী ইশতেহার দিয়ে, কিন্তু ইশতেহারের বিষয়গুলো তুলে ধরার সাহস পাননি। ইশতেহারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানোর ব্যর্থতাকে আড়াল করা হয়েছে। ২০১০ সালে এক বছর পূর্তির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ৪৮ টাকা থেকে চালের দাম কমিয়ে ১৮ টাকা করা হয়েছে। আর এবার বললেন, চালের দাম ৪৫ টাকা থেকে কমিয়ে ১৮ টাকা করেছেন। এমন অসত্য তথ্য প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে স্থান পেয়েছে। এখন ভরা মৌসুমেই চালের দাম বেড়ে গেছে। ৪০ থেকে ৫০ টাকা এখন চালের কেজি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন। আমার মনে হয়, অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কোনো কথা হয় না। কেননা অর্থমন্ত্রী গত রমজানে বলেছিলেন, সিন্ডিকেটের কারণে সবকিছুর দাম বাড়ে। তারা এ সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না কেন?
মূলত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পেছনে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, এমপি-মন্ত্রীদের লুটপাটসহ নানা বিষয় জড়িত থাকে। আর এসব বিষয়ে বর্তমান সরকারের নানা কাহিনী দেশবাসীর জানা রয়েছে। ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, যশোর থেকে একটি ট্রাক আসতে ২৮ হাজার টাকা খরচ হয়। এর ২২ হাজার টাকাই চাঁদা দিতে হয়।
২০১১ সালের ৩ জানুয়ারির একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে এম কে আনোয়ার বলেন, গত এক বছরে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৩০ ভাগ। তেল ৪৫ ভাগ ও রসুন ৬৫ ভাগ। এটি টিসিবির হিসাব।
প্রধানমন্ত্রী অর্থনীতির বিষয়ে তেমন কিছু বলেননি উল্লেখ করে এম কে আনোয়ার বলেন, তিনি বলেছেন রফতানি বেড়েছে। কিন্তু দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ যে হচ্ছে না সে বিষয়টিতে তিনি কিছু বলেননি। প্রধানমন্ত্রী এমডিজি পুরস্কারপ্রাপ্তির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এমডিজি পুরস্কারের ক্ষেত্রে সর্বশেষ ২০০৭ সালের তথ্য বিবেচনা করা হয়েছে। আর ২০০৭ সাল পর্যন্ত এদেশে ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। সে হিসেবে এমডিজি পুরস্কারের বিষয়টি বর্তমান সরকারের কোনো সফলতা নয়। বর্তমান প্রবৃদ্ধির কথা বলা হলেও আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কত হবে, তা নিয়ে কোনো লক্ষ্যের কথা প্রধানমন্ত্রী বলেননি। আর এডিপিতে কত টাকা আছে তা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব টাকা কোন খাতে, কিংবা কতটা তারা খরচ করতে পারবে তা নিয়ে তিনি কিছুই বলেননি।
বিগত বিএনপি সরকারের সময়ে বিদ্যুত্ উত্পাদন ও দুর্নীতি-লুটপাট নিয়ে বিষোদগার করা হয়েছে উল্লেখ করে এম কে আনোয়ার বলেন, লুটপাট কারা করেছে, তা ভবিষ্যতে বেরিয়ে আসবে। কুইক রেন্টালের নামে লুটপাটের চিত্র জনগণ এখন দেখছে। টেন্ডার হচ্ছে, উত্পাদনের প্রক্রিয়া নেই। বিএনপি সরকারের আমলে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করা হয়েছে জানিয়ে এম কে আনোয়ার বলেন, এ সরকার দু’বছরে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ ঘাটতি করেছে। ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি বিদ্যুত্ উত্পাদন ছিল ৩৭০০ মেগাওয়াট, যা এক বছর পর ২০১১ সালের একই দিনে দাঁড়িয়েছে ৩৩০০ মেগাওয়াটে। এখানেই ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ ঘাটতি সৃষ্টি করেছে বর্তমান সরকার।
লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান : বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, দেশের যে অবস্থা তাতে জনগণ খুব কষ্টে আছে। আওয়ামী লীগের ইশতেহারে অনেক ভালো ভালো কথা ছিল। কিন্তু তাদের প্রতিশ্রুতি সরকার ভঙ্গ করছে। এতে দেশের জনগণ নিরাশ হয়েছেন।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা মোটেও ঠিক নয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বর্তমানে গুম, খুন, চুরি, ডাকাতি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো অগ্রগতি নেই। মাহবুবুর রহমান বলেন, চালের ব্যাপারে যে বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন তার জবাব জনগণই ভালো জানেন। চালের দাম মোটেও কমছে না। বরং চালের দামসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম এখন আকাশচুম্বী।
তিনি বলেন, গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেনি। অথচ গণতন্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংসদে প্রধান বিরোধী দল তাদের যথাযথ ভূমিকা পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ কথাটি ঠিক নয়। বিরোধী দল সংসদে কেন যাচ্ছে না তার উত্তর সরকার দিক। সংসদে এক পক্ষের উপস্থিতি সংসদকে অকার্যকর করে ফেলেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

No comments:

Post a Comment