Saturday 8 January 2011

হামলা মামলা গ্রেফতার সহিংসতায় আওয়ামী লীগ সরকারের দুই বছর : রাজনৈতিক খুন ৪৭০, বিচারবহির্ভূত হত্যা ২৮১, গুম ১৬

নাছির উদ্দিন শোয়েব

মামলা, হামলা, গ্রেফতার ও সহিংস ঘটনার মধ্য দিয়ে অতিক্রম হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দুই বছর। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সাংবাদিক নির্যাতন, খুন, গুম, ডাকাতি ও রাহাজানিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ছিল নিত্যদিনকার ঘটনা। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির ঘটনায় অতিষ্ঠ ছিল মানুষ। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকার অঙ্গীকার করলেও তা অব্যাহতভাবে চলেছে। নতুন যোগ হয় সাদা পোশাকে অপহরণ, গুপ্ত হত্যা। বিগত বছর বখাটেদের নারী উত্ত্যক্ত করার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ইভটিজিং বা নারী নির্যাতনের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় অভিভাবকরা ছিলেন উদ্বিগ্ন। প্রতিবাদকারীরা বখাটেদের রোষানলে পড়েন। অন্যদিকে ফাঁসির আসামি, হত্যা মামলার আসামিসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলাকারীদের রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তি পাওয়ার ঘটনায় হতবাক হয়েছেন সমাজের বিবেকবান মানুষ ।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ ও ’১০ সালে দেশে আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। বিডিআর বিদ্রোহ, খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে প্রখ্যাত আলেম, রাজনৈতিক নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতিহিংসামূলক গ্রেফতার, হয়রানি, তুচ্ছ ঘটনায় মামলা দায়ের এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনায় মানুষ ছিল উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায়। রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা, ডাবল ও ট্রিপল মার্ডার, গলাকেটে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। নিরপেক্ষভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেননি সাংবাদিকরা। এ সময়ে ৪ সাংবাদিক নিহত, ১৭০ সাংবাদিক আহত, ৫০ জন লাঞ্ছিত ও ৫৫ জন হুমকির সম্মুখীন হন। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ১৭ জনের ওপর হামলা, দু’জনকে গ্রেফতার, একজন অপহৃত ও ১৩ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দুই বছরে প্রায় ৮ হাজার হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সে অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১ জন খুন হয়েছে। ২৮১ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের স্বীকার, রাজনৈতিক সহিংসতায় খুন ৪৭০, বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে ১৭০ জন।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুসারে ২০০৯ ও ’১০ সালে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ছিল নাজুক। ২০০৯ সালে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানোর কথা বলেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তা অব্যাহতভাবে চলেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কোন্দল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস ও অবৈধ হল দখলের মতো ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নির্যাতন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, রাজনৈতিক সহিংসতা, সভা-সমাবেশ বন্ধে ১৪৪ ধারা জারি, গার্মেন্ট শ্রমিকদের নির্যাতন ও গ্রেফতার, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেশি ঘটেছে বিগত বছরে।
হত্যাসহ ভয়ঙ্কর অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল। কখনও কখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিরাও সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। অধিকাংশ ঘটনায় গ্রেফতার হয়নি ঘাতকরা। হত্যাকাণ্ডের পরও খুনি ও তাদের সহযোগীরা মামলার বাদীকেও হত্যার হুমকি দেয়ার অনেক অভিযোগ রয়েছে। খুনিরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকায় পুলিশও তাদের গ্রেফতার করছে না মর্মে বহু অভিযোগ পুলিশ সদর দফতরে জমা আছে। তবে আইনশৃঙ্খলার অবনতির কথা স্বীকার করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এমনকি গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণেও বলেছেন, মহাজোট সরকারের দু’বছরে দেশে আইনশৃঙ্খলা অনেক ভালো ছিল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতা : অপরাধমূলক ঘটনার ব্যাপকতায় গত দু’বছর জনমনে বেশ উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা ছিল। দেশজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও এর সুফল সাধারণ মানুষ পেয়েছেন যত্সামান্য। জনবল বৃদ্ধিসহ পুলিশ বিভাগকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার ঘোষণা থাকলেও কার্যকর হয়নি তেমন কিছুই। গত বছরের ৩১ আগস্ট পুলিশের মহাপরিদর্শক পদে পরিবর্তন আনা হয়। বিগত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে দায়িত্ব নেয়া নূর মোহাম্মদের স্থলাভিষিক্ত হন হাসান মাহমুদ খন্দকার। কাছাকাছি সময়ে র্যাবের মহাপরিচালক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার পদসহ পুলিশের মাঠপর্যায়েও ব্যাপক রদবদল করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কর্মকর্তা নিযুক্তির ক্ষেত্রে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রাধান্য দেয়া হয়। এতে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। পরে মাঠপর্যায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়। পাশাপাশি সারাদেশে থানার সংখ্যা বাড়ানো হয়। বর্তমানে ঢাকায় ৪১টি থানার কার্যক্রম চলছে। অধিকাংশ থানার ওসি পদে রদবদল করা হয়। ডিএমপির অধিকাংশ থানার ওসি, ইন্সপেক্টর ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একটি বিশেষ জেলার বাসিন্দা। দলীয় বিবেচনায় পুলিশ কর্মকর্তারা যা খুশি তাই করছেন। কিন্তু পুলিশ পেশাগত কাজের চেয়ে এখন রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নেই বেশি সময় দিচ্ছে—এমন অভিযোগ রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যেতে না পারায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের দমনে ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে এক ধরনের ধস নামে।
নারী নির্যাতন/ইভটিজিং : ইভটিজিংয়ের ঘটনায় খুনখারাবি, অভিভাবকের ওপর হামলা ও তরুণীদের হাত-পা কেটে নেয়ার মতো লোমহর্ষক ঘটনা দেশবাসীর কাছে এখন অজানা কোনো ব্যাপার নয়। বখাটেদের বেপরোয়া আচরণ ও নারীদের উত্ত্যক্ত করার প্রবণতায় সারাদেশে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানামুখী প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ নেয়া হলেও বখাটেদের অপতত্পরতা বন্ধ করা যায়নি। এমনকি প্রতিবাদকারীরাও রোষানলে পড়েছেন। বখাটেদের হামলায় নাটোরের কলেজশিক্ষক মিজানুর রহমান এবং ফরিদপুরে এক কিশোরীর মা চাঁপা রানী ভৌমিকের মৃত্যু ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। অপরাধ দমনে র্যাব-পুলিশ ও গোয়েন্দাদের মাঠে নামানো হয়। তাতেও কাজ হচ্ছিল না। পরে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে সারাদেশে এ অপরাধ প্রতিরোধ করার কার্যক্রম চালু করা হয়। পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত উত্ত্যক্ততার শিকার হয়ে ২৮ নারী আত্মহত্যা করেছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৫ অভিভাবক খুন হয়েছেন এবং বখাটেদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ১৮ তরুণী। ইভটিজিং প্রতিরোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত এ সময় ঢাকায় একজন শিক্ষকসহ বিভিন্ন স্থানে অর্ধশত দুর্বৃত্তকে আটক করে সাজা দিয়েছে। র্যাবের হিসাব মতে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছে ১৩৮ কিশোরী ও তরুণী এবং এ অপকর্মের দায়ে গ্রেফতার হয়েছে ১২৬ জন।
গুম ১৬ জন : সাদা পোশাকধারীদের হাতে আটক হওয়ার ঘটনায় অপরাধের নতুন মাত্রা যোগ হয়। গত দু’বছরে আটক হওয়ার পর নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা কোথাও গিয়ে প্রিয়জনকে খুঁজে পাননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দাদের কাছে লিখিতভাবে আবেদন জানিয়ে এবং আদালতের শরণাপন্ন হয়েও কাজ হয়নি। তাদের উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও রহস্যজনকভাবে নীরব ছিল বলে স্বজনহারা পরিবারের অভিযোগ। এ অবস্থায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো চরম অসহায়ত্বের মধ্যে থাকে। ভুক্তভোগীরা বলেন, আদালত থেকে পুলিশকে গুরুত্বসহকারে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হলেও পাওয়া যায়নি নিখোঁজ ব্যক্তিদের। তারা বেঁচে আছে, নাকি গুম করা হয়েছে এ নিয়ে চিন্তিত থাকে পরিবার। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকের পর অনেকেরই লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যার পর লাশ গুম করার ঘটনা ঘটেছে অহরহ। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং ঢাকা মহানগর ৫৬নং ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম গত বছর ২৫ জুন ইন্দিরা রোডের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে প্রাইভেটকারে ধানমন্ডি যাওয়ার সময় সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিদের হাতে আটক হন। গাড়ি থামিয়ে তাকে আটক করে নিয়ে যায় বলে পরিবার থেকে অভিযোগ রয়েছে। চৌধুরী আলমের বড় ছেলে আবু সাইদ চৌধুরী হিমু জানান, তার বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর ৬ মাসেরও বেশি সময় হয়েছে; কিন্তু খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১৭ এপ্রিল বাড্ডা-কুড়িল এলাকা থেকে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা মিজানুর রহমান মিজান, নাজমুল হক মুরাদ ও ফোরকানকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে মোহাম্মদপুর ঢাকা উদ্যানের পেছনে তুরাগ নদীর বালিতে তিনজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একজন পরে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসে। আগে বরিশালের মজনু খান, ঢাকার লাল বাবু ও জালাল, হাসিবুল হক জনি, ঠাকুরগাঁওয়ের আকবর আলী ও রিপন, গাজীপুরের সেলিম, গাইবান্ধার ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান, ঝালকাঠির ব্যবসায়ী হুমায়ুন, যুবলীগ নেতা লিয়াকত, মাদারীপুরের আকবর আলী সরদারকে সাদা পোশাকে অপহরণের পর এখনও তারা নিখোঁজ।
সহিংসতা : অধিকারের তথ্য অনুযায়ী গত দু’বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৪৭০ জন। আহত হয়েছেন প্রায় ২০ হাজার। ১১ অক্টোবর সিরাজগঞ্জে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সভাস্থলে ট্রেনে কাটাপড়ে পাঁচজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। যমুনা সেতুর পশ্চিম সংযোগ সড়কের মুলিবাড়ী রেলওয়ে ক্রসিংসংলগ্ন এলাকায় এ দুর্ঘটনায় আহত হন অর্ধশতাধিক। নিহতরা বিএনপিকর্মী ও সমর্থক। এ ঘটনায় র্যাব, পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষও হয়। পুলিশ মিছিলে গুলি ছোড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা ট্রেনটিতে অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনাকে বিএনপি পরিকল্পিত বলে অভিযোগ করেছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সেনা আবাসন প্রকল্পের নাম করে কম দামে জমি কেনা ও জমি দখল নিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে সেনা, পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে সংঘর্ষে মোস্তফা জামাল উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। বছরের প্রথমদিকে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর খুন হন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’পক্ষের সংঘর্ষে উভয়পক্ষ রামদা, চাপাতি, লাঠি, হকিস্টিক নিয়ে একে অপরের ওপর হামলা চালায়। এ সময় আবু বকর এএফ রহমান হলের চতুর্থ তলায় তার কক্ষের সামনের বারান্দায় গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। ওই ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় হলেও ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ ছাড়াও ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধে সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের বহু ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে থানায় মামলা পর্যন্ত হয়নি।
চাঁদাবাজি : দুই বছরে দেশজুড়ে ছিল চাঁদাবাজির মহোত্সব। চাঁদাবাজি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, শিক্ষক, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী, খেটে খাওয়া মানুষ কেউই নিস্তার পায়নি। সমাজের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে শুরু করে পেটের দায়ে রাস্তায় দাঁড়ানো ভাসমান পতিতা পর্যন্ত সবাইকে চাঁদা দিতে হয়েছে। ফুটপাতে, পরিবহনে পাড়া-মহল্লায়, ক্লাব ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদাবাজি হয়েছে। পুলিশের চাঁদাবাজি, মহল্লার বিভিন্ন সমিতির নামে চাঁদাবাজি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও অঙ্গ সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি মিলিয়ে চাঁদাবাজদের ভয়ে চরম অস্থিরতার মধ্যে থাকে সর্বস্তরের মানুষ। বাসাবাড়ি, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, টার্মিনাল, ফেরিঘাটসহ কোনো ক্ষেত্র চাঁদাবাজি থেকে বাদ পড়েনি। চাঁদাবাজি বন্ধ করার দাবি জানিয়ে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে সরকারকে চাপ সৃষ্টি করেন। ঢাকায় ক্ষমতাসীন দলের দুই এমপি চাঁদাবাজদের হুমকিতে নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেন।
ডাকাতি : ডাকাত আতঙ্কে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষ রাত জেগে পাহারা দিয়েছে। একের পর এক ঘটেছে দুর্ধর্ষ ডাকাতি। মুখোশধারী ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে লুট করে নেয় মালামাল। প্রতিরোধ করতে গিয়ে সশস্ত্র ডাকাত দলের হামলায় নিহত এবং আহত হয়েছে মানুষ। ডাকাতি রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় আইন হাতে তুলে নেয় ক্ষুব্ধ জনতা। জানা যায়, দেশের কয়েকটি অঞ্চলে রাত হলেই নেমে আসে ডাকাত আতঙ্ক। চুরি, ডাকাতি-দস্যুতা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আস্থা হারায় মানুষ। রাজধানী ঢাকার নিম্নাঞ্চলের অনেক এলাকায় লাঠি-বাঁশি নিয়ে বিগত বছরে রাত জেগে পাহারার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। কেরানীগঞ্জ, সাভার ও আশুলিয়াসহ দেশের আরও কয়েকটি এলাকায় রাত জেগে মানুষ পাহারা দেয়। সাভার ও আশুলিয়ায় পরপর কয়েকটি দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনায় অনেকে এখন দিনের বেলায়ও ঘরের দরজায় তালা দিয়ে রাখছে। এসব অঞ্চলে রাতে দরজা খুলে মানুষ ঘরের বাইরে যেতেও ভয় পাচ্ছে।
হত্যাকাণ্ড : দুই বছরে কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটনায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সরকার দলের ক্যাডারদের হাতে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘাতকদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকায় যুবলীগ নেতা ইব্রাহীম হত্যা, যাত্রাবাড়ীতে ব্যবসায়ী দম্পতিসহ ট্রিপল মার্ডার, গুলশানে বাসায় ঢুকে মা ও মেয়েকে গুলি করে হত্যা, মগবাজারে যুবলীগ নেতা ইউসুফ আলী সরদার, খিলগাঁওয়ে প্রকৌশলী হত্যা, মহাখালীতে কর্মচারী নেতা সিদ্দিকুর রহমান ও খিলগাঁওয়ে গৃহবধূ কণিকা হত্যা, মিরপুরে ইডেন কলেজের ছাত্রী মেনকা ও স্বর্ণ ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান হত্যাকাণ্ড নগরবাসীর মাঝে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। যুবদল ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) সভাপতি ও ৭০নং ওয়ার্ড কমিশনার হাজী আহমেদ হোসেন, ক্যান্টনমেন্টের মানিকদি এলাকায় ছাত্রলীগ নেতা ফারুক, কারওয়ান বাজারে দিনদুপুরে গুলি করে তিন ব্যবসায়ী হত্যা, মোহাম্মদপুরে অপহরণের পর গুলি করে বিএনপি নেতা শিপু, ধনিয়া কলেজের ছাত্র আমজাদ হোসেন, সবুজবাগে ওসমান গণি ও গৃহবধূ শাহিনুর বেগম, পুরান ঢাকায় ৪০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে দুর্বৃত্তদের গুলিতে জুয়েলারি ব্যবসায়ী প্রেমকৃষ্ণ রায় খুন, গুলশানের কালাচাঁদপুরে নিজ বাড়িতে নার্সারি ব্যবসায়ী সাদেকুর রহমান ও তার স্ত্রী রোমানা নার্গিস খুন, পুরান ঢাকার কোতোয়ালি থানার সাব-ইন্সপেক্টর গৌতম, মগবাজারে টেন্ডার বিরোধে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় যুবলীগ নেতা ইউসুফ আলী সরদার, বনানীতে ছিনতাইকারীদের গুলিতে পুলিশের এসআই, গুলশানে মানিচেঞ্জ ব্যবসায়ী ফারুক আহম্মদকে হত্যা এবং তেজতুরি বাজারে স্কুলছাত্র রুবেল আহমেদকে হত্যা করা হয়। পুরান ঢাকার ডিশ ব্যবসায়ী আজগরকে হত্যা করে লাশ ১৫ টুকরা করে সন্ত্রাসীরা। ২৭ অক্টোবর ব্রহ্মণবাড়িয়ায় সন্ত্রাসীদের হামলায় সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান ও হোসেন মিয়া মারা যান। এছাড়াও লালমনিরহাটে বিএনপি নেতা ও ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম, বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবু, নাটোরে কলেজ শিক্ষক মিজানুর রহমান, রূপগঞ্জে জামাল উদ্দিন, কুষ্টিয়া-১ আসনের আওয়ামী লীগদলীয় এমপি আফাজউদ্দিন আহম্মেদের বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণে তিনজন নিহত হন। অন্যদিকে ২০০৯ সালের উল্লেখযোগ্য খুনের মধ্যে যাত্রাবাড়ীতে মা ও তার দুই মেয়ে, ফকিরাপুল বাজারের সামনে ৩২নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সালাউদ্দিন সুমন, মতিঝিলে মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক, সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মী আসাদুজ্জামান, মিরপুরে একটি পেট্রল পাম্পের হিসাবরক্ষককে গুলি করে পৌনে ৮ লাখ টাকা ছিনতাই, বাড্ডায় ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেনের শ্বশুর মোবারক আলী, খিলগাঁও আইডিয়াল সিটি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল চন্দন চক্রবর্তী ওরফে সাজ্জাদ হোসেন, ধলপুরে অ্যাডভোকেট শামসুল হক রিন্টুকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়।
টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ পুলিশ : মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি ও ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে হানাহানিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অশান্ত হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগের সশস্ত্র মহড়া, অস্ত্রবাজির ঘটনা ছিল ওপেন সিক্রেট। ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতা ও ক্যাডার ব্যাপক টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির দায়ে অভিযুক্ত হয়। একপর্যায়ে এদের কর্মকাণ্ড এত মাত্রা ছাড়িয়ে যায় যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক ছিন্ন করার মৌখিক ঘোষণা দেন। মূল দলের সাধারণ সম্পাদক বারবার হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। তাতেও টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি বন্ধ থাকেনি। প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও তা ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, টেন্ডারবাজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কিছু লোক জড়িত। দিনাজপুরের টেন্ডার নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রথম সারির কয়েকজন ঠিকাদার পুলিশের কাছে এই অভিযোগ করেন। একপর্যায়ে পুলিশের তখনকার আইজি টেন্ডারবাজি নিয়ে উত্কণ্ঠা প্রকাশ করেন। পুলিশ সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলন করে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, যেসব এলাকায় টেন্ডারবাজি ঘটছে, সেসব স্থানে পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট এসপি ও ওসির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি দলের ক্যাডারদের ব্যাপারে শক্তভাবে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় টেন্ডাবাজদের ব্যাপারে পুলিশও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। টেন্ডারবাজিতে জড়িতদের ছাড় দেয়া হবে না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের এমন হুঙ্কারেও সরকারি দলের ক্যাডারদের বেপরোয়া টেন্ডারবাজি ঠেকাতে প্রশাসনও ব্যর্থ হয়।

No comments:

Post a Comment