Saturday 8 January 2011

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ নিয়ে বিশিষ্টজনের প্রতিক্রিয়া : জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি


মাহবুবুর রহমান

সরকারের দুই বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, দুই বছরের মেয়াদে একটি সরকারকে চূড়ান্ত মূল্যায়ন করা ঠিক নয়। তবে এ সময়ে তারা জনগণের মৌলিক চাহিদা-সম্পৃক্ত বিষয়ে কতটুকু সফল, তার মূল্যায়ন করবেন জনগণ। এ সরকারের অনেক উদ্যোগ আছে, অর্জনও আছে। কিন্তু ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঠেকাতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। রাজনৈতিক ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার জাতিকে বিভক্ত করে ফেলেছে। পররাষ্ট্র নীতি পরনির্ভর হয়ে পড়েছে। দুই বছরে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে এসব বিষয়ে ব্যর্থতা স্বীকার করে আগামীতে তা সমাধানের আশ্বাস শুনতে চেয়েছিলেন দেশবাসী। কিন্তু তা না হওয়ায় জাতি হতাশ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ধৈর্য ধরতে বলেছেন, কিন্তু মানুষের ধৈর্যেরও একটি সীমা আছে। এ বিষয়টি অনুধাবন করতে বিশিষ্টজনরা প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের মূল্যায়ন করেছেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ, বিশিষ্ট দার্শনিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, এফবিসিআই’র সাবেক সভাপতি আনিসুল হক, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ধৈর্য ধরতে বলেছেন, দেশবাসী ধৈর্য ধরে আছেন। কিন্তু ধৈর্যেরও একটি সীমা আছে। তিনি তার সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদক্ষেপের কথা বলেছেন। কিন্তু জনগণের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ কী কী তা নির্দিষ্ট করে বলেননি। সরকারের বিষয়ে জনগণের মূল্যায়ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। তা দেখে-বুঝে সরকার পরিচালনা করা উচিত।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ জাতির কাছে হতাশাব্যঞ্জক। তার দুই বছরের শাসনকালে কিছুই যে সাফল্য নেই, তা বলা যাবে না। জনকল্যাণে কিছু উদ্যোগ তার সরকার নিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফলতাও আছে। কিন্তু ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে এমন ইস্যুতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থই বলা যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য এতো বেড়ে গেছে যে, সবকিছুই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। গ্যাস, বিদ্যুত্, পানি সমস্যাও কমেনি। যে উদ্দেশ্য পূরণে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক শক্তির দিকে তাকিয়ে থাকে, তা পুরোপুরি ব্যাহত হয়েছে। আর এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা সন্তোষজনক নয়।
গত দুই বছরে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক ছিল না। গত ২০ বছরের মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে গেল বছর। ২০১০ সালকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বছর বলা যেতে পারে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা বাস্তবতাবিরোধী। কেননা, গত দু’বছরে ২৯৮ জন সাংবাদিক নিগৃহীত হয়েছেন। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ওপর নিপীড়ন ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অর্থনীতির গতিও মন্থর। বিদেশে আমাদের শ্রমিক রফতানি বন্ধ হয়ে গেছে। ২৫টি দেশ থেকে আমাদের শ্রমিকদের যাতায়াতের ব্যবস্থা সুরাহা হয়নি।
গত দুই বছরে জাতি ভয়ঙ্করভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। জাতীয় গতি আজ অবরুদ্ধ। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণ ও অনুগতদের ভিড়ে স্থবির হয়ে পড়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর রিপোর্ট বলেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগ দুর্নীতির শীর্ষে।
পররাষ্ট্রনীতিতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিকে স্বাধীন বলা যায় না। দিন দিন দেশ নির্ভরশীল হতে চলেছে।
জাতীয় সংসদ কার্যকরের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক নয়। বিরোধী দলকে জাতীয় সংসদে টেনে আনার বিষয়ে ইশতেহারে উল্লেখ থাকলেও হয়েছে তার উল্টোটা। সংসদে অসংসদীয় ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে বিরোধী দলকে সংসদের বাইরে রাখা হয়েছে। বিরোধী দল নির্যাতনেও সরকার রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। বহু বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ রাখা হয়েছে।
এসব ব্যর্থতা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীও অবগত বলে আমি মনে করি। আগামী বছরের মধ্যে এসব সমাধান করবেন মর্মে তিনি জাতিকে আশ্বাস দিতে পারতেন। জাতি সমস্যা সমাধানের আশ্বাস শুনতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চার বছর আগে ক্ষমতায় থাকা জোট সরকারকে দোষারোপ করে গেছেন। এটা জনগণকে তৃপ্ত কিংবা আশান্বিত কোনোটিই করেনি।
বিশিষ্ট দার্শনিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ গতানুগতিক। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে রাজনৈতিক ইস্যুগুলোকেই সামনে টেনে আনা হয়েছে। তাদের অনেক অর্জনও আছে। তবে জনগণের যে অর্থনৈতিক সমস্যা, তা তিনি তুলে ধরেননি। আবার সমাধানের কোনো আশ্বাসও দেননি। আমরা জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে প্রত্যাশা করি রাজনীতিকরা চর্বিত চর্বণ যেন না করেন। প্রধানমন্ত্রীকে মনে রাখতে হবে, আমি এখন ক্ষমতায় আছি। জনগণ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের দায়িত্ব। দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতি গণমানুষের প্রতিনিয়ত চিন্তার বিষয়। এ নিয়ে চিন্তা করা সরকারের প্রধান দায়িত্ব। আমি বিরোধী দলের ব্যাপারেও সন্তুষ্ট নই। কেননা, বিরোধী দলের ব্যর্থতা, সংসদে গিয়ে কথা না বলার কারণেই আজ সরকার জনদাবির চেয়ে রাজনৈতিক ইস্যুকে প্রাধান্য দিতে পারছে।
দলে ঐক্য, রাজনৈতিক দলে ঐক্য, জনগণে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সরকারের উদ্যোগ নেয়া দরকার। দেশকে এগিয়ে নিতে চাই—এমনটা প্রমাণ করতে চাইলে তাদের দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে হবে। স্থানীয় সরকার থেকে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে। জনগণের চাহিদা বুঝে কাজ করতে হবে। এসব বিষয় গত দু’বছরে তারা করেনি, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে এ বিষয়গুলোও অনেকক্ষেত্রেই এড়িয়ে গেছেন।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে কিছু মৌলিক বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। বিশেষ করে বিনিয়োগের নেতিবাচক পরিস্থিতি তিনি তুলে ধরেননি। বিনিয়োগের জন্য গ্যাস-বিদ্যুত্সহ অবকাঠামোগত পরিবেশ সরকার যে দিতে পারেনি, তা তিনি এড়িয়ে গেছেন। বরং প্রধানমন্ত্রী গ্যাস-বিদ্যুত্ সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার দায় বিরোধী দলকে দিয়েছেন। পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুত্ উত্পাদনে সরকারের উদ্যোগ আছে, সমন্বিত প্রোগ্রামও এগিয়ে চলছে, তবে তা বিলম্বিত হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সাধারণের কাছে তা যৌক্তিক বলে মনে হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ মূলত গত দু’বছরে তাদের কার্যক্রমের বিবরণ। এ বিষয়টিকে দু’ভাবে দেখা যায়। আন্তর্জাতিকভাবে এ সরকার গত দু’বছরে বেশকিছু সফলতা পেয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তারা সফল। তাদের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে, তা বাস্তবায়নের পর অবশ্য দেখা যাবে আমাদের স্বার্থ কতটা রক্ষা হয়েছে। এরপরও এতটুকু বলা যায়, ভারত-বাংলাদেশের পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝির যে জায়গাটা ছিল, তা নিরসন হয়েছে। আর জাতীয় ইস্যুতে সরকারের ব্যর্থতাই বেশি। যদিও দু্’বছরেই সরকারকে ব্যর্থ বলাটা ঠিক হবে না। জ্বালানি সঙ্কট নিরসনে সরকারের প্রতি জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা সরকার পূরণ করতে পারেনি। তবে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। দু’বছরে সরকারের হিসাব-নিকাশ করতে সময় লেগেছে। মানুষ কিন্তু এসব দেখতে চায় না। তারা দেখতে চায় সমস্যার সমাধান হয়েছে কিনা। সরকারের ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় জায়গাটা হলো সংসদ কার্যকর করতে না পারা। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে গত দু’বছরে দূরত্ব বেড়েছে। বিরোধের জায়গাটা আরও কঠিন রূপ ধারণ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও তা স্পষ্ট হয়েছে। এ বিরোধের জায়গা কমবে বলে জনগণ আশা করেছিল।
এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আনিসুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের ভাষা প্রয়োগই প্রমাণ করে তিনি জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সচেষ্ট। কিন্তু সমস্যা হলো তিনি যে গতিতে এগুতে চান, তার প্রশাসন সে গতিতে চলতে পারছে না। দু’বছরেই একটি সরকারের সফলতা-ব্যর্থতার চূড়ান্ত মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। এখন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়। জনগণ এর কিছুটা ফল পাবে আগামী দু’বছরে।
বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া বলেন, সরকার অনেক ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও এর কিছু উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ সরকারের প্রতি জনগণের যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ করতে পারেনি। নির্বাচনী ইশতেহার দেখে তাদের প্রতি জনগণের আশার জোয়ার এসেছিল। তা এখন ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়েছে। এটা আমাদের জন্য, সাধারণ জনগণের জন্য বেদনাদায়ক। সরকার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারছে না। মানুষ নীরবে কাঁদছে। হাঁপিয়ে উঠছে। সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা গভীরভাবে উপলব্ধি করা দরকার। জনগণের মাঝে সাম্য, মৈত্রীর বন্ধন নষ্ট করেছে। সংবিধান ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। কাঠামোগতভাবে দেশকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে।
এ সরকারের আমলে বিচার ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। সামরিক বাহিনীও আস্থা হারিয়ে ফেলছে। মুক্তবুদ্ধির চর্চা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা প্রাণ খুলে কথা বলতে পারছি না। বলার স্বাধীনতা নেই। লেখার স্বাধীনতা নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে আন্তরিকতা আছে বলে মনে হয়েছে। আবার দুর্বৃত্তায়নও হয়েছে

No comments:

Post a Comment