Saturday 29 January 2011

শেয়ারবাজারে সূচকে সার্কিট ব্রেকার চালু : লেনদেন বন্ধ : বিক্ষোভ ভাংচুর মতিঝিল রণক্ষেত্র


অর্থনৈতিক রিপোর্টার

পুঁজিবাজারের অস্বাভাবিক উত্থান-পতন ঠেকাতে সূচকের একদিনে হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সীমা (সার্কিট ব্রেকার) আরোপ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। আরোপিত সীমা অনুযায়ী, লেনদেন চলাকালে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক বেড়ে বা কমে ২২৫ পয়েন্ট অতিক্রম করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেশের দুই শেয়ারবাজারের লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে। গতকাল লেনদেন শুরুর আগে সূচকের এ নতুন সার্কিট ব্রেকার আরোপের বিষয়টি কার্যকর হয়। আর প্রথমদিনেই লেনদেন শুরুর মাত্র ১ ঘণ্টা ২৬ মিনিটের মাথায় ডিএসই সাধারণ সূচক আগের দিনের তুলনায় ২২৫ পয়েন্ট কমে সার্কিট ব্রেকারের সীমা অতিক্রম করায় তাত্ক্ষণিকভাবেই লেনদেন বন্ধ হয়ে যায় দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের।
এদিকে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পরই হাজার হাজার সাধারণ বিনিয়োগকারী রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ সমাবেশ ও ভাংচুর চালায়। রাজধানীর মতিঝিলস্থ ডিএসই ভবন এবং এর আশপাশের এলাকাসহ পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় বিনিয়োগকারীরা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে। অব্যাহত দরপতনে পুঁজি হারিয়ে রাস্তায় নেমে আসা বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর, ডিএসই প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করেন। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও নানা সেম্লাগান দেয়।
সূচকের সার্কিট ব্রেকার আরোপের বিষয়ে এসইসির দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কবির ভূইয়া সাংবাদিকদের জানান, কমিশনের বাজার পর্যালোচনা কমিটির বৈঠকে সূচকে সার্কিট ব্রেকার আরোপের সিদ্ধান্ত হয়েছে। মঙ্গলবার লেনদেন বন্ধ করার পর ডিএসই সাধারণ সূচক ২৩৭ পয়েন্টে গিয়ে স্থির হয়েছিল। সে পয়েন্টকে ভিত্তি ধরে তার ( ৫ %) হিসাবে সূচকের ক্ষেত্রে এ সার্কিট ব্রেকার আরোপ করা হয়েছে। সে হিসাবে কোনো লেনদেন দিবসে যদি ডিএসই সাধারণ সূচক একদিনে ২২৫ পয়েন্ট বেড়ে বা কমে যায় তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই দিনের লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে। পরের দিন থেকে আবার লেনদেন শুরু হবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেনও বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, লেনদেন চলাকালে প্রতি ৫ মিনিট পর পর সূচক সমন্বয় করা হয়। এ কারণে কোনো একটি পয়েন্টে সূচকের সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া যায়নি। একবার সমন্বয়ের পর পরের ৫ মিনিটের মধ্যে যাতে বড় ধরনের উত্থান বা পতন ঘটতে না পারে সে জন্য ২৩৭ পয়েন্টকে ভিত্তি ধরা হলেও হ্রাস-বৃদ্ধির পরিমাণ ২২৫ পয়েন্টের বেশি হলেই লেনদেন বন্ধ করে দেয়া হবে। পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এড়াতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই সার্কিট ব্রেকার আরোপ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। আনোয়ারুল কবির ভূইয়া বলেন, একদিনে সূচক ৪০০ থেকে ৫০০ পয়েন্ট পড়ে যাওয়া আবার ১ হাজার পয়েন্ট বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরে আনতে সার্কিট ব্রেকার আরোপ করা হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে সার্কিট ব্রেকার আরোপ করা হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শেয়ারবাজারেও সূচকের এ সার্কিট ব্রেকার রয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, বেশ ক’দিন ধরেই গুজব চলছে বাজার আরও পড়বে। বাজার গুজবনির্ভর হয়ে পড়েছে। সারা বিশ্বজুড়েই পুঁজিবাজারে নানা গুজব থাকে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আমরা আশাবাদী। গতকাল থেকে সূচকের এ সার্কিট ব্রেকার আরোপের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। আর কার্যকরের প্রথমদিনই সার্কিট সীমা অতিক্রম করায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে দিনের লেনদেন।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : বর্তমান বাজার পরিস্থিতির জন্য তারল্য এবং আস্থার সঙ্কটকে প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, সার্কিট ব্রেকার দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। বাজারে তারল্য সঙ্কট ছিল, এখন তা রূপ নিয়েছে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কটে। এ সঙ্কট কাটাতে না পারলে বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে না।
এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আমার দেশকে বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য স্টক মার্কেটে সূচকের ওপর সার্কিট ব্রেকার আরোপ করা হলেও তা কাজ করেনি। বর্তমানে বাজারে অস্থিতিশীলতার জন্য বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাবকে প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনাটা এখন সবচেয়ে জরুরি। ঢাকা বিশ্বদ্যািরয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক সালাহ উদ্দিন আহমেদ খান বলেন, সার্কিট ব্রেকার আরোপ ভালো কোনো সিদ্ধান্ত নয়। এর ফলে বাজার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। বাজারে আস্থার যে সঙ্কট তা কাটাতে হবে।
২ ঘণ্টা পর লেনদেন শুরু : গতকাল দিনের লেনদেন শুরু হয়েছে স্বাভাবিক সময়ের ২ ঘণ্টা পর। ১১টায় দিনের লেনদেন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয় যে, বুধবার লেনদেন ১টা থেকে শুরু হয়ে বেলা ৩টা পর্যন্ত চলবে। মূলত মঙ্গলবারের লেনদেন বন্ধ করাসহ বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সকালে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে এসইসি। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান উপস্থিত ছিলেন। মূলত ওই বৈঠকের কারণে লেনদেনের সময় ২ ঘণ্টা পিছিয়ে দেয়া হয়। বৈঠকে বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা শেষে সূচকের ওপর সার্কিট ব্রেকার আরোপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানা গেছে। আর সূচকের হ্রাস-বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়ার পর বেলা ১ থেকে দিনের লেনদেন শুরু হয়।
লেনদেন বন্ধ : সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপের প্রথম দিনে লেনদেন শুুরুর পর দেড় ঘণ্টার মধ্যেই শেয়ারবাজারে সূচকের নতুন সার্কিট ব্রেকারের সীমা অতিক্রম করায় লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল বেলা ১টার দিকে লেনদেন শুরুর পর ৫ মিনিটের মধ্যে বেশিরভাগ শেয়ারের দরবৃদ্ধি হলে ডিএসই সাধারণ সূচক আগের দিনের চেয়ে ১৬০ পয়েন্টের মতো বেড়ে যায়। কিন্তু এরপরই ব্যাপক হারে কমতে থাকে শেয়ারের দর। ১৫ মিনিট ধরে এ ধারা চলার পর বেলা ১টা ২৫ মিনিটের দিকে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে সূচক। তবে ১৫ মিনিট পর থেকে আবার একটানা দরপতন হতে থাকে। বেলা ২টা ৩০ মিনিটে ডিএসই সাধারণ সূচক হ্রাসের মাত্রা নির্ধারিত সর্বোচ্চসীমা অতিক্রম করে। এ সময় এই সূচক আগের দিনের চেয়ে ২৩১ পয়েন্ট কমে ৬৯০২.৪৮ পয়েন্টে দাঁড়ায়। ফলে ওই অবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে দিনের লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়।
বাজার পরিস্থিতি : গতকাল লেনদেন হওয়া ২৪০টি কোম্পানির মধ্যে ২৩০টিরই দর ব্যাপক মাত্রায় কমেছে। এর বিপরীতে ৭টির দর বেড়েছে এবং ৩টির দর ছিল অপরিবর্তিত। অধিকাংশ শেয়ারের দর ও সূচকে ব্যাপক নেতিবাচক প্রবণতা থাকলেও আর্থিক লেনদেনের মাত্রা ছিল গত কয়েক দিনের তুলনায় বেশি। মাত্র দেড় ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ডিএসইতে বুধবার ৫৩৭ কোটি ৪০ লাখ ৪৭ হাজার টাকার লেনদেন হয়েছে। আগের দিন ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে লেনদেন হয়েছিল ৬০৯ কোটি ৮৬ লাখ ১১ হাজার টাকা।
বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ : লেনদেন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিনিয়োগকারীরা মতিঝিল, দিলকুশা, দৈনিক বাংলা মোড়সহ আশপাশের এলাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ ও ভাঙচুর শুরু করে। তারা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে ইত্তেফাক মোড় থেকে দৈনিক বাংলা মোড় এবং পুরো দিলকুশা এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর সেম্লাগানে উত্তাল হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। এসময় আশপাশের অফিস, দোকানপাটের প্রধান ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়। খণ্ড খণ্ড মিছিলে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ ব্যাংক, এসইসি ও ডিএসই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন। বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারের পতনের প্রতিবাদে হরতালের পক্ষে সেম্লাগান দেয়। ‘হরতাল’, ‘হরতাল’ সেম্লাগানে মতিঝিল এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য প্রধানত অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করেন তারা। এজন্য তারা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগ দাবি করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বেলা আড়াইটার দিকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে লাঠিচার্জ করে বিনিয়োগকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এসময় বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা আরও কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে। এ অবস্থায় বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ শুরু করে।
বেলা সাড়ে ৩টার দিকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ এ এলাকায় বিক্ষোভরত বিনিয়োগকারীদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। এতে পথচারীসহ ৮-১০ জন আহত হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারমুখী অবস্থানের কারণে টিকতে না পেরে বিনিয়োগকারীরা এলাকা থেকে চলে যেতে থাকলে বেলা সাড়ে ৪টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। বিক্ষোভ চলাকালে বিভিন্ন এলাকা থেকে পুলিশ ৭-৮ জনকে আটক করে। অবশ্য সন্ধ্যায় এদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে মতিঝিল থানা সূত্রে জানা গেছে।
বিনিয়োগকারীরা জানান, আমরা শেয়ারবাজারে দরপতনের প্রেক্ষিতে সুষ্ঠু সমাধান চেয়েছিলাম। কিন্তু তা হয়নি। সূচকে সার্কিটব্রেকার আরোপ করে লেনদেন স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক, এসইসির এ বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতা নেই। এজন্য অর্থমন্ত্রী, গভর্নর এবং এসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ করা উচিত। ১:২ হারে ঋণ সুবিধা দেয়ার জন্য মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে বলা হলেও তারা তা মানছে না। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়ার কারণে অনেক বিনিয়োগকারীই ফোর্স সেলের মুখে পড়ছেন। এর ফলে অনেক বিনিয়োগকারীর এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। বাজারে প্রতিদিনই পতন হচ্ছে। আর কত পতন হবে?
মো. জাহেদ নামে এক বিনিয়োগকারী জানান, শেয়ারবাজারে দরপতন হবেই। কিন্তু যেভাবে দরপতন হচ্ছে, তাতে আমরা শুধু পুঁজিই হারাচ্ছি। আমরা এখন শঙ্কিত হয়ে পড়ছি। সোহেল নামে আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজি হারিয়ে রাস্তায় নেমে আসছেন। কিন্তু বাজারের সিন্ডিকেট চক্র পর্দার আড়ালে থেকে বাজারে দরপতন ঘটিয়ে শেয়ার কিনছে। তারা আবার মার্কেটকে টেনে তুলবে। তিনি বলেন, গত কয়েকদিনের দরপতনে অধিকাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজির ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ হারিয়েছেন। ১ লাখ টাকা যদি কেউ বিনিয়োগ করে থাকেন, এখন তা ৩০ হাজারে নেমে এসেছে। মৌলভিত্তিসম্পন্ন শেয়ার ক্রয়ের জন্য বলা হচ্ছে কিন্তু সেগুলোর দামও কমছে। আমরা এখন কোনো কথায় আস্থা রাখতে পারছি না। লিটন সিকদার নামে অপর এক বিনিয়োগকারী বলেন, আমাদের এখন শেয়ার কেনার ক্ষমতা নেই। দাম কমলে শেয়ার কেনার কথা বলা হয়। ১০০ টাকার শেয়ারের দাম ৮০ টাকায় নেমে আসার পর তা কিনেছি। আবার ৭০ টাকায় নামার পরও কিনেছি। এখন তা আরও নেমে ৪০ থেকে ৫০ টাকায় এসেছে। কিন্তু আমরা এখন আর কিনতে পারছি না। আর কত কম দামে শেয়ার কিনব? প্রতিদিনই দাম কমছে। এর ফলে আমরা বাজারের লেনদেন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছি না।
অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক : পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, ড. মশিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার, সদস্য মো. ইয়াসিন আলী, মো. আনিসুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে পুঁজিবাজার পরিস্থিতি ও সঙ্কট উত্তরণে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হলেও সূচকের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ ছাড়া আর কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। তবে বৈঠক থেকে বর্তমান পরিস্থিতি শেয়ারের অতিমূল্যায়ন রোধ ও বাজার থেকে অতিরিক্ত অর্থ স্থানান্তর বন্ধে বুকবিল্ডিং পদ্ধতির কার্যকারিতা স্থগিত রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এছাড়া পুঁজিবাজারে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরির পেছনে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর কারসাজি রয়েছে কিনা—তা খুঁজে বের করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বৈঠকে এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার জানিয়েছেন, পুঁজিবাজারের নেতিবাচক পরিস্থিতি উত্তরণে এসইসি তাদের হাতে থাকা প্রায় সব ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। এখন পুঁজিবাজার সামাল দিতে এসইসির তেমন কিছুই করার নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান বৈঠকে বলেন, পুঁজিবাজারের বর্তমান নেতিবাচক পরিস্থিতি ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু নগদ সহায়তা দিয়ে বেশিদিন এ পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
ডিএসইর ব্রিফিং : বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বিকালে ডিএসইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সতিপতি মৈত্র সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এসময় তিনি সূচকের সার্কিটব্রেকার আরোপের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যাদের হাতে ভালো কোম্পানির শেয়ার আছে, কোনোভাবেই তাদের আতঙ্কে তা বিক্রি করা ঠিক হবে না। বিনিয়োগকারীরা ধৈর্য ধারণ করলে অবশ্যই পুঁজিবাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
এসইসির একের পর এক সিদ্ধান্ত : এদিকে টানা দরপতন ঠেকাতে গত এক মাসের মধ্যে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি। কিন্তু এতেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। ৮ ডিসেম্বর থেকে শেয়ারবাজারে প্রায় টানা দরপতনের ঘটনা ঘটছে। আর এসব দরপতনের পরপরই একের পর এক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে তারা। এ সময়ে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—মার্জিন লোন সুবিধা বৃদ্ধি, একক ব্যক্তির ক্ষেত্রে মার্জিন লোনের সীমারেখা তুলে নেয়া, গ্রামীণফোনের শেয়ারের বিপরীতে নেটিং সুবিধা, মার্জিন সুবিধা অযোগ্য কোম্পানির শেয়ারের বিপরীতে আর্থিক নেটিং সুবিধা চালু, স্পট মার্কেট থেকে সব কোম্পানিকে মূল মার্কেটে ফিরিয়ে নিয়ে আসা, মিউচুয়াল ফান্ডের প্রাইভেট প্লেসমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর সীমা বৃদ্ধি এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সীমা তুলে দেয়া, মার্জিন লোনের ক্ষেত্রে এনএভিভিত্তিক পদ্ধতি স্থগিতসহ আরও বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বলতে গেলে এসইসি মার্কেট নিয়ন্ত্রণের সব ধরনের বিধিমালা প্রত্যাহার এবং সুবিধা বৃদ্ধি করেছে। মঙ্গলবার স্টক ডিলারদের জামানতবিহীন লেনদেনের সীমা তিনগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও বাজারের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। সর্বশেষ গতকাল সূচকের ক্ষেত্রে আরোপ করা হলো সার্কিটব্রেকার।
টানা ৫ দিন দরপতন : এদিকে টানা দরপতনের শিকার হয়েছে শেয়ারবাজার। গতকাল নিয়ে টানা ৫ দিন শেয়ারবাজারের সূচকের পতন হয়েছে। আর এ সময়ে ডিএসই সাধারণ সূচক কমেছে প্রায় ৬০০ পয়েন্ট। গতকাল দিনশেষে ডিএসই সাধারণ মূল্যসূচক কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৯১৩ পয়েন্টে। একই সময়ে বাজার মূলধন কমেছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এবছরের শুরুতে ডিএসই সাধারণ সূচক ছিল ৮ হাজার ৩০৪ পয়েন্টে। অর্থাত্ এ বছরের মাত্র ১৩ লেনদেন দিবসে সূচক কমেছে ১ হাজার ৯১ পয়েন্ট।
‘বুকবিল্ডিং’ পদ্ধতির কার্যকারিতা স্থগিত : শেয়ারের মূল্য নির্ধারণে বহুল আলোচিত ‘বুকবিল্ডিং’ পদ্ধতির কার্যকারিতা আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ পদ্ধতিতে শেয়ারের মূল্য নির্ধারণে বড় ধরনের কারসাজির অভিযোগ রয়েছে। অবশেষে এ পদ্ধতিটি আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দু’একদিনের মধ্যেই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হতে পারে। গতকাল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সরকারি বাসভবনে পুঁজিবাজার বিষয়ক অনুষ্ঠিত বৈঠকে অর্থমন্ত্রী বর্তমান পরিস্থিতিতে বুকবিল্ডিং পদ্ধতি স্থগিত রাখার জন্য এসইসিকে পরামর্শ দেন। এরই প্রেক্ষিতে এসইসি বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সূত্র জানায়, বুকবিল্ডিং পদ্ধতি স্থগিত হলে যেসব কোম্পানি এরই মধ্যে নির্দেশক মূল্য নির্ধারণ করে এসইসিতে আবেদন জমা দিয়েছে, সেসব কোম্পানি চাইলে নির্ধারিত মূল্য (ফিক্সড প্রাইস) পদ্ধতিতে আইপিওর জন্য আবেদন করতে পারবে। অন্যথায় এসব কোম্পানিকে বুকবিল্ডিং পদ্ধতি নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে এরই মধ্যে যে দুটি কোম্পানি বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণের পর আইপিও আবেদন জমা নিয়েছে, সেগুলো লটারির মাধ্যমে শেয়ার বরাদ্দের পর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হবে

No comments:

Post a Comment