Friday 7 January 2011

দুঃশাসনের দুই বছর



জাহেদ চৌধুরী

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দুই বছর পূর্ণ হলো আজ। বিরোধী মতকে দলন ও প্রতিবেশীদের স্বার্থরক্ষায় সরকার এ দু’বছরে সাফল্য দেখালেও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধানে তারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
নির্বাচনের আগে মহাজোট ১০ টাকা কেজির চাল, দ্রব্যমূল্য সহনশীল রাখা, সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার, কৃষকদের বিনামূল্যে সার, প্রতি পরিবারে একজনের চাকরি, সবার জন্য বাসস্থানসহ নানা স্বপ্ন দেখিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা ও লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নয়ন, সুশাসনসহ দিনবদলের স্লোগান দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলেও দু’বছরের মাথায় মানুষ আশাহত হয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের কথা বলে ও দলের পুরনো নেতাদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞ অপরিচিতদের মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়ে চমক দেখিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু বাস্তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চরম ব্যর্থতা, অসহনীয় লোডশেডিং, লাগামহীন দলীয়করণ, সুশাসনের অভাব, দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তারে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে।
নির্বাচনী অঙ্গীকার পালনে সরকারের ব্যর্থতা চরমভাবে ফুটে ওঠেছে। ভারতের সঙ্গে বিতর্কিত চুক্তি, বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে পরোক্ষ সমর্থন জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে রক্তপাত, ছাত্রলীগ ও যুবলীগসহ সরকারদলীয় ক্যাডারদের চাঁদাবাজি ও টেন্ডার সন্ত্রাস, সরকারি কর্মকর্তাদের গায়ে শাসক দলীয় দুর্বৃত্তদের হাত দেয়ার ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। গার্মেন্টসহ শিল্পাঞ্চলে বিশৃঙ্খলা ছিল দু’বছর জুড়ে আলোচিত। রাজধানীতে দুর্বিষহ যানজটসহ জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী নানা পদক্ষেপ সরকারের ব্যর্থতার পাল্লাকে প্রকট করে তুলেছে গত দু’বছরে। মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব দেয়ার প্রতিশ্রুতি গত দুই বছরেও বাস্তবায়ন করেনি মহাজোট সরকার। এরই মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সর্বশেষ বিচার বিভাগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে তার ৩৮ বছরের পুরনো বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার নাম বিমানবন্দর থেকে মুছে ফেলা কিংবা যুদ্ধপারাধীদের বিচারের নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের রিমান্ডে নির্যাতনে যত তত্পর ছিল জনস্বার্থ বিষয়ে সরকারের সে রকম তত্পরতা চোখে পড়েনি।
বিরোধী দলের নেতাদের রিমান্ডে নির্যাতন, গণমাধ্যমের ওপর আঘাত ও আমার দেশ পত্রিকা, চ্যানেল ওয়ান বন্ধসহ মিডিয়া দলন, সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড, ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকারের লঙ্ঘন, হত্যা-গুম, সীমান্তে প্রতিনিয়ত বিএসএফের হাতে বাংলাদেশীদের হত্যা ঠেকাতে ব্যর্থতা, ইভটিজিং বৃদ্ধি, দু’বছরে মাত্র তিন হরতালের মুখোমুখি হয়েও হরতাল কর্মসূচিতে অংশ নেয়া নারীদের রাজপথে শ্লীলতাহানির ঘটনা মানুষকে হতাশ করেছে।
গত দু’বছরে সরকার পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন ধরে রাখতে সক্ষম হলেও মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। শ্রমবাজারেও এর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিরোধী দলবিহীন জাতীয় সংসদ এরই মধ্যে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ফাঁসিতে ঝোলানো ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুকে সরকার নিজেদের বড় সাফল্য হিসেবে দেখছে। গত দু’বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেড়েছে। শেয়ারবাজারে সূচকের ঊর্ধ্বগতি দীর্ঘদিন থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের রাস্তায় বসিয়ে দিয়েছে। হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টের রায় নিয়ে সংসদকে পাশ কাটিয়ে সংবিধান সংশোধন করে ফেলাকেও সরকার তাদের বড় সাফল্য হিসেবে দেখছে। শিক্ষা ও কৃষি ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের পারফরমেন্স নিয়ে খোদ সরকারের ভেতরেই প্রশ্ন রয়েছে। এরই মধ্যে মহাজোট সরকার বিচার বিভাগে বিতর্কিত পছন্দসই লোকদের নিয়োগ ও সুপারসিডের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। প্রশাসনে নিরঙ্কুশ দলীয়করণের মাধ্যমে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকার। দুর্নীতি রোধের শ্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় এসে দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতাকেই খর্ব করেছে বর্তমান সরকার। প্রথম বছরের তুলনায় দ্বিতীয় বছরে বিরুদ্ধ মতের প্রতি সরকারের অসহিষ্ণু মনোভাব প্রকট হয়েছে। একদলীয় বাকশালের আদর্শ আওয়ামী লীগ পুরোপুরি ত্যাগ করেনি এ কথা দলের যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ হানিফ প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের কথা বলে ক্ষমতায় এলেও সরকারের কাজে কিংবা শাসক দলের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে এর কোন প্রতিফলন নেই। অশালীন কথার্বাতা ও মিথ্যাচার ভর করেছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকের ওপর।
বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, নাগালের বাইরে দ্রবমূল্য : ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি বর্তমান সরকার যেদিন ক্ষমতায় আসে সেদিন মোটা চালের কেজি ছিল ২৪ থেকে ২৭ টাকা। সেই চালের কেজি এখন ৩৮ থেকে ৪০ টাকায় পৌঁছেছে। এভাবে আটা, তেল, পেঁয়াজ, হলুদ, মরিচসহ প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম এখন গত বিএনপি আমলের দ্বিগুণেরও বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনগুণও হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক আমলে চালসহ নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল, সে রেকর্ডগুলোও এরই মধ্যে ভেঙে ফেলেছে মহাজোট সরকার।
দেশজ উত্পাদন বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে ভারতমুখী অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে সরকার। এতে দেশের কৃষকরা উত্পাদনে দিন দিন নিরুত্সাহী হচ্ছেন। সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, বিএনপি আমলে যেখানে মসুর ডালের কেজি ছিল ৪৫ থেকে ৬০ টাকা। আওয়ামী সরকারের আমলে তা এখন দাঁড়িয়েছে ১০৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ টাকায়। খোলা সয়াবিন তেলের দামও বেড়েই চলছে। ৪৮ টাকার সয়াবিন এখন ১০০ টাকা লিটার। পেঁয়াজের কেজি পৌঁছেছে ৫৫-৬০ টাকায়। চিনির কেজি ৬০ টাকা। বাজার মনিটরিংয়ে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এভাবে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দামই আকাশছোঁয়া।
লোডশেডিং বেড়েছে, গ্যাস উত্পাদন কমেছে : বিদ্যুত্ সমস্যার সমাধানের কথা বলে সরকার ক্ষমতায় এলেও দিনে ১৮ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের রেকর্ড হয়েছে বিদায়ী বছরে। লোডশেডিং ঠেকাতে ঘড়ির কাঁটার পরিবর্তন করেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়নি। দিনে প্রতি দু’ঘণ্টা পরপর এক ঘণ্টা বিদ্যুত্ থাকবে বলে সরকারের দেয়া ঘোষণা প্রমাণ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরকারিভাবেই ১৬ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হয়েছে। গ্রামের অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ। কোনো কোনো জেলা ও উপজেলা শহরে এমনও সময় গেছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৪ ঘণ্টাও বিদ্যুত্ থাকেনি।
তত্ত্বাবধায়ক আমলে যেখানে ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুত্ উত্পাদিত হয়েছে সেখানে বর্তমানে গড়ে বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। ফলে লোডশেডিং অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। গ্যাস উত্পাদনও বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। গ্যাস সঙ্কট তীব্র রূপ নিলে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম নতুন গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গ্যাসের অভাবে শিল্প-কারখানায় উত্পাদনে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। দেশে বিদ্যুতের উত্পাদনে ধস নেমেছে। চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৩ হাজার ২৮৩ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়েছে গত ১ ডিসেম্বর বুধবার। পরদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পিকআওয়ারে বিদ্যুত্ উত্পাদিত হয়েছে ৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট, যা প্রায় ৪ বছর আগে ২০০৭ সালের গোড়ার দিকের গড় বিদ্যুত্ উত্পাদনের চেয়েও কম। ২০০৬ ও ২০০৭ সালে প্রতিদিন পিক আওয়ারে বিদ্যুতের গড় উত্পাদন ছিল ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। ৪ বছরে বিদ্যুতের চাহিদা যেখানে দেড় হাজার মেগাওয়াটের অধিক বেড়েছে, সেখানে বিদ্যুত্ উত্পাদনে এ ভয়াবহ ধস নামায় ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়েছে মোটা দাগে। কুইক রেন্টালের নামে বিনা টেন্ডারে দলীয় লোকজনকে উচ্চদরে বিদ্যুেকন্দ্রের কাজ দেয়ার পরও উত্পাদন পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে অবনতি ঘটে চলেছে। শীতের কারণে গ্রাহকরা গরমের কষ্ট থেকে রেহাই পেলেও বিদ্যুতের ব্যাপক লোডশেডিংয়ে শিল্প-কারখানায় উত্পাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে ফাইনাল পরীক্ষার্থীদের পড়ালেখা হচ্ছে বিঘ্নিত। বিদ্যুিনর্ভর সব খাতেই সৃষ্টি হচ্ছে অচলাবস্থা।
গুপ্তহত্যা ও ক্রসফায়ার : গুপ্তহত্যা ও ক্রসফায়ারসহ বিচারবহির্ভূত সব ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলেও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী আগের বছরের তুলনায় গত বছরে ক্রসফায়ারের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার হলেও ক্রসফায়ার বন্ধ হচ্ছে না। সর্বশেষ উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যেও ক্রসফায়ারে র্যাবের জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করে র্যাবকে ডেথ স্কোয়াড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাদের ক্রসফায়ারের নামে পরিকল্পিত হত্যা করা হচ্ছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১১ মাসে ১৪৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে এ সরকার। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলছেন, দেশে ক্রসফায়ারের কোনো ঘটনা ঘটছে না। ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে সুয়োমোটো রুল ইস্যু করা হয়েছে। রুল ইস্যু করার পরও ক্রসফায়ার অব্যাহত থাকায় হাইকোর্ট বিভাগ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সিরাজ শিকদার হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শেখ মুজিবের আমলে ক্রসফায়ার শুরু হয়েছিল। এদিকে ঢাকার প্রভাবশালী ওয়ার্ড কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমসহ বিরোধী দলের অনেকেই সাম্প্রতিক সময়ে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন।
প্রতিবেশী দেশের স্বার্থরক্ষা, পরনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি : প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বছরের শুরুতেই জানুয়ারি মাসে ভারত সফরে গিয়ে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট দু’টিসহ তিনটি চুক্তি ও ৫০ দফা সমঝোতা স্মারক সই করে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি করার অভিযোগ আনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। সংসদে এসব চুক্তি প্রকাশের দাবি জানান। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী আজও এসব চুক্তি প্রকাশ করা হয়নি। চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের আলোকে ভারতে ট্রানজিট ও করিডোর দেয়ার আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে লাভবান হওয়ার কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত নামমাত্র ফি দিয়েই ভারত সড়ক, রেল ও নৌ ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করেছে বলে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছিল বছরজুড়েই। এছাড়া ভারত থেকে উচ্চ সুদে ও কঠিন শর্তে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ ভারতের ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করতেই ব্যয় হবে নিশ্চিত হওয়ার পর সুধীসমাজে এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ধরে রাখতে সক্ষম হলেও গত দু’বছরে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ফলে মুসলিম দেশে শ্রমবাজার হারিয়েছে সরকার। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন হলেও এ সম্পর্ক একতরফা ভারতের স্বার্থে কাজে লাগছে বলে মনে করেন ওয়াকিবহাল মহল। প্রতিবেশী একটি দেশ যা চায়, তা বাস্তবায়নই যেন সরকারের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরনির্ভর পররাষ্ট্রনীতির কারণে এ দেশ কোনো কোনো বৃহত্ শক্তিরও প্রতিপক্ষ হতে শুরু করেছে।
সমুদ্রসীমা বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রাধান্য না দেয়া, সমুদ্রবক্ষে ৮০ ভাগ গ্যাস রফতানির সুবিধা রেখে তিনটি ব্লক বহুজাতিক কোম্পানিকে ইজারা দেয়াসহ নানা ইস্যুতে সরকার প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে। টিপাইমুখ ইস্যুতে যেখানে সিলেটসহ সারাদেশের মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে, সেখানে সরকার আধিপত্যবাদের দালালিপনায় ব্যস্ত রয়েছে। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে ভারতীয় বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগের প্রস্তাবের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে ভূলুণ্ঠিত করার উদ্যোগকেও সরকার ইতিবাচকভাবে দেখছে।
দুর্নীতির বিস্তার : ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান আরও এক ধাপ নিচে নেমেছে। আগের চেয়ে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। টিআইবির সাম্প্রতিক এক জরিপে বলা হয়েছে, সেবাখাতের মধ্যে দেশের বিচার বিভাগ সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত। ৮৮ শতাংশ খানা এ খাতের দুর্নীতির শিকার। শুনানি দ্রুত করানো কিংবা শুনানির তারিখ পেছানো, মামলার রায়কে প্রভাবিত করা, ডকুমেন্ট উত্তোলন বা গায়েব করতে ঘুষ বা বিধিবহির্ভূত অর্থ দিতে হয়েছে তাদের। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগের দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার ছিল ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ খানা। সে হিসাবে এ খাতে দুর্নীতির হার বেড়েছে প্রায় ৮৫ শতাংশ। এরপরই রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও ভূমি প্রশাসন। গতকাল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত ‘সেবাখাতের দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ-২০১০’-এ এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের ৮৪ দশমিক ২ শতাংশ খানাকে সেবা নিতে গিয়ে কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছে। দুর্নীতির কারণে বছরে প্রায় ৯ হাজার ৫৯১ দশমিক ৬ কোটি টাকা ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ প্রদান করতে হয়েছে। সেবাখাতের মধ্যে ঘুষ আদায়ের শীর্ষে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এরপর ভূমি প্রশাসন ও বিচার বিভাগ। ২০০৭ সালের তুলনায় ২০১০ সালে বিচার বিভাগ, ভূমি প্রশাসন ও বিদ্যুত্খাতে দুর্নীতি ও হয়রানি বৃদ্ধি পেলেও পুলিশ, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে কমেছে। তবে ২০০৭ সালের তুলনায় ২০১০ সালে সার্বিকভাবে দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা বেড়েছে বলে জরিপে তথ্য প্রকাশ করা হয়।
জরিপ প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, এটি দুর্নীতির সার্বিক চিত্র নয়, এর ব্যাপকতা আরও অনেক বেশি।
বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার অঙ্গীকার করে সরকার ক্ষমতায় এলেও গত বছরে দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) যে কয়টি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দুর্নীতি আগের চেয়ে বেড়েছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
নির্যাতনের শিকার মিডিয়া : দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দেয়া, চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করা, টেলিভিশনের টক-শো বন্ধ করে দেয়াসহ গণমাধ্যমের ওপর আঘাত ছিল সরকারের দ্বিতীয় বছরে আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম। আমার দেশ পত্রিকার জনপ্রিয় সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে পত্রিকা কার্যালয় থেকে বিনা ওয়ারেন্টে গত ১ জুন রাতে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। ১২ দিনের রিমান্ডে নিয়ে বিবস্ত্র করে তার ওপর চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। বাংলাদেশের ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং জ্বালানী উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর ঘুষ গ্রহণের অভিযোগের তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ করায় আমার দেশ ও এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সরকারের রোষানলে পড়েন। একে একে তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় ২৬টি মামলা দেয়া হয়। গ্রেফতারের পর আরও মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি ও নির্যাতন অব্যাহত রাখা হয়েছে। এখন তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অর্ধশত। এরই মধ্যে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে একটি প্রতিবেদনের জন্য আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ৬ মাসের দণ্ড ও এক লাখা টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সঙ্গে আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি অলিউল্লাহ নোমানকে এক মাসের দণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অথচ আদালত অবমাননা আইনে সর্বোচ্চ জরিমানা হলো ২ হাজার টাকা। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ সরাসরি ট্রায়ালকোর্ট হিসেবে বিচার করে এ দণ্ড ও জরিমানা দেয়। দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এটি একটি ব্যতিক্রমী দণ্ড ও জরিমানা। রায় দেয়ার পর সাড়ে চার মাস পার হয়ে গেলেও লিখিত রায় এখনও দেয়নি আদালত। লিখিত রায় ছাড়াই দণ্ড ভোগ করছেন সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। প্রতিবেদন দণ্ড ভোগ করে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তারপরও রায়ের কপি চূড়ান্ত হয়নি।
অকার্যকর জাতীয় সংসদ : দিনবদলের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় বসা বর্তমান সরকার এক বছরে জাতীয় সংসদকেও কার্যকর করতে পারেনি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের নির্বাচনী ওয়াদায় বিরোধী দলকে ডেপুটি স্পিকার এবং সংখ্যা অনুপাতে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান করার অঙ্গীকার করলেও তা বাস্তবায়ন করেনি। সংসদের সামনের সারিতে বিরোধী দলের আসন কেড়ে নিয়ে সংসদের বাইরে ঠেলে দেয়া হয়েছে বিএনপিকে। জাতীয় সংসদে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ই আলোচনা হচ্ছে না। একদলীয় সংসদ চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অতিসম্প্রতি সুপ্রিমকোর্টের ফুল কোর্ট রেফারেন্সেও সংসদ সার্বভৌম নয় বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ : রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বর্তমান সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে তার সেনানিবাসের বৈধ বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে। ক্ষমতায় আসার পর পর মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের নোটিশ দেয়া হয়। হাইকোর্ট ঘুরিয়ে বিষয়টি যখন সুপ্রিমকোর্টে বিবেচনাধীন ছিল তখনই গত ১৩ নভেম্বর ভোর থেকে জবরদস্তিমূলকভাবে খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। বাড়ি থেকে বের হয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে গুলশানের অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া জানান, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে অমানবিকভাবে টেনে-হিঁচড়ে এক কাপড়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। বাড়িছাড়া করার সময় পরিবারের সদস্যদের গায়ে হাত দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে বলেও জানান তিনি। ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী জরুরি সরকারের সময় যেভাবে গ্রেফতার করা হয়েছিল, ঠিক একই কায়দায় মইনুল রোডের বাড়িতে হানা দিয়ে, গেট ও দরজা ভেঙে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় খালেদা জিয়াকে। সাব-কবলার মাধ্যমে চিরস্থায়ীভাবে লিজ দেয়া সুদীর্ঘ ৩৮ বছরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি দখল করে নেয়া হলো। ১২ নভেম্বর রাত থেকেই বাড়িটি ঘেরাও করে রাখে সরকারি বাহিনী। আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় ওই বাড়ির কর্মচারীসহ অন্য বাসিন্দাদের। আপিল বিভাগে মামলা বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় বেগম জিয়াকে হয়রানি না করার জন্য প্রধান বিচারপতির নির্দেশনাও আমলে নেয়নি সরকার। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে আইনজীবীরা মইনুল রোডে যেতে চাইলে তাদের ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে দেয়া হয়নি।
মামলাবাজ সরকার : একদিকে বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে কথায় কথায় মামলা দায়ের হলেও রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বাতিলের নামে খুন, ডাকাতি, রাহাজানি মামলার আসামিদের ছেড়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে সরকারের দ্বিতীয় বছরটিতে। ১৯ জন ফাঁসির আসামিকে আপিল শুনানির আগেই রাষ্ট্রপতির ক্ষমার নামে কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়ার ঘটনা বছরের শেষদিকে বেশ সমালোচিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সমালোচনা করায় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, বিএনপি নেতা শাহ মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক প্রধানমন্ত্রীপুত্রের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন নিয়ে বক্তব্য দেয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলায় মামলা হয়েছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শওকত মাহমুদ সরকারের সমালোচনা করায় ৫ জেলায় মামলা দিয়েছে শাসক দলের লোকরা।
মামলা দেয়া, মামলা তুলে নেয়া কিংবা পুনর্তদন্তের মাধ্যমে মামলায় ভিন্নমতের লোকদের জড়িয়ে দেয়া, নিজেদের লোকদের নাম বাদ দেয়া—এসব বিষয়ে বছরজুড়েই সরকার তত্পর ছিল।
বিভিন্ন মামলা পুনর্তদন্তের নামে ভিন্নমতের লোকদের জড়িয়ে দেয়া, নতুন করে মামলা দায়ের, নিজেদের মামলাগুলোর রায় দ্রুত নিষ্পত্তি করে খালাস পাওয়া, প্রশাসনিক নির্দেশে নিজেদের হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া, স্বাধীন সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে ডজন ডজন মামলা দিয়ে সম্পাদক ও সাংবাদিকদের হয়রানি করার জন্য সরকারের তত্পরতা সমালোচিত হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের মামলা নিয়ে সরকার কাজের চেয়ে বেশি শোরগোল বাধিয়ে প্রমাণ করেছে, বিচারের চেয়ে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়াতেই তারা বেশি আগ্রহী। যদিও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ও বিএনপির সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। সরকারের মামলাবাজি থেকে রেহাই পাননি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের সাবেক দুই প্রধানসহ অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারাও।
প্রধানমন্ত্রীর ১১টিসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দুই হাজারেরও বেশি মামলা প্রত্যাহার চূড়ান্ত করা হলেও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীর কোনো মামলাই প্রত্যাহার করা হয়নি বরং নতুন করে খালেদা জিয়ার নামে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে নানা অজুহাতে নতুন মামলা দেয়া হয়েছে। বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে পুরনো মামলায় দ্রুত চার্জশিট দেয়া হয়েছে আদালতে। পুনর্তদন্তের নামে অনেক পুরনো মামলা নতুন করে শুরু করেছে সরকার।
বিচার বিভাগে বিতর্কিতদের নিয়োগ ও প্রশাসনে নগ্ন দলীয়করণ : বর্তমান সরকারের আমলে বিচার বিভাগে খুনের আসামি, সুপ্রিমকোর্টে ভাংচুরকারি ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। হাইকোর্টে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৭ বিচারপতির অধিকাংশের তৃতীয় শ্রেণী থাকায় এ নিয়েও মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এছাড়া নানা কারণে বিচার বিভাগ সমালোচনার মুখে পড়ে। দুই সিনিয়র বিচাপতিকে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ এবং সর্বশেষ টিআইবি’র অনুসন্ধানে বিচার বিভাগ বিশেষ করে সর্বোচ্চ আদালত সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিচার বিভাগ নিয়ে বিতর্ক নতুন মাত্রা পায়। এর আগে ‘চেম্বার মানেই সরকারের পক্ষে স্ট্রে’ শিরোনামে সত্য প্রতিবেদন লেখায় আমার দেশ সম্পাদকের ছয় মাসের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ড ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
এদিকে সচিবালয় থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও থানা পর্যন্ত সর্বত্র আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের শরিক দলের সমর্থকদের প্রশাসনে বসানো হয়েছে। শত শত সরকারি কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখা হয়েছে। চাকরিচ্যুত করা হয়েছে অনেককে। বেসামরিক প্রশাসনের মতো সামরিক প্রশাসনেও ব্যাপক চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। বেসামরিক প্রশাসনে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশনায় অফিশিয়ালি দলীয় সমর্থকদের তালিকা করে তাদের পদায়ন করা হয়েছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি), বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), সবকয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িতদের বসানো হয়েছে। বিশেষ করে যুবলীগের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ এবং আন্তর্জাতিক সম্পাদক প্রফেসর ড. এমরান কবির চৌধুরীকে পিএসসির সদস্য পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান দুটিতে নগ্ন দলীয়করণ জাতিকে হতবাক করেছে।
অনিয়ন্ত্রিত যুবলীগ, ছাত্রলীগ : বর্তমান সরকারের প্রথম দুই বছরে আলোচিত ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানে নিজেদের মধ্যে এবং অন্য সংগঠনের সঙ্গে হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ে সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিতে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ে এ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন সময় চাপাতি, কিরিচ, হকিস্টিকসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগের এক গ্রুপকে অপর গ্রুপের ওপর হামলা করতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু। ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ মেধাবী ছাত্র আবু বকরকে প্রাণ দিতে হয়েছে। রাজশাহীতে ছাত্রলীগের হাতে মারা গেছেন ছাত্রমৈত্রীর এক নেতা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এভাবে প্রতিনিয়তই দেশের কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও মারামারির ঘটনা ঘটতে থাকায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং ছাত্রলীগের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। দলের একাধিক নেতা প্রকাশ্যেই ছাত্রলীগের সমালোচনা করেছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছাত্রলীগের মধ্যে ছাত্রশিবির ঢুকে হানাহানির ঘটনা ঘটাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন।
প্রথম বছরের মতো দ্বিতীয় বছরেও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সরকার সমালোচিত হয়। সর্বশেষ গত মঙ্গলবারও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে বরিশালে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপে সংঘর্ষ হয়েছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মেয়াদে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ছাত্রলীগ, যুবলীগের দায়িত্ব আওয়ামী লীগ নেবে না বলে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে মন্তব্য করা হয়। বিভিন্ন অপকর্মের জন্য ছাত্রলীগ ও যুবলীগের প্রায় দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে স্থায়ী এবং সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু পরিস্থিতি বদল হয়নি।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর পাবনায় স্বাস্থ্য অধিদফতরে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে পরীক্ষা ভণ্ডুলের পাশাপাশি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করে। এর জের ধরে পাবনার ডিসি-এসপিসহ জেলা প্রশাসনের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, পাবনার এই ঘটনার ইন্ধনদাতা ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স। এরপর ৮ অক্টোবর নাটোরে বিএনপির একটি মিছিলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালালে নাটোরের বনপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নুর বাবু নিহত হন। ভিডিও ফুটেজে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা চিহ্নিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
ইভটিজিং : নারী, শিশু হত্যা, খুন, শ্লীলতাহানি, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, এসিড সন্ত্রাসের পাশাপাশি নতুন উপদ্রব হিসেবে দেখা দেয় ইভটিজিং। সাম্প্রতিক সময়ে ইভটিজিং নামের যৌন নিপীড়ন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কিশোরী ও তরুণীরা জীবনও দিচ্ছে। সারাদেশে ইভটিজিংবিরোধী সভা-সমাবেশের পরও বন্ধ থাকেনি এ যৌন হয়রানির অপরাধ। এ পর্যন্ত ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে একডজন তরুণী আত্মাহুতি দিয়েছে। ইভটিজিংয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে অনেককে দণ্ড দেয়া হলেও থেমে থাকেনি ইভটিজিং।
বিদেশে শ্রমবাজারে ধস : সরকারের দুর্বল কূটনীতির কারণে বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার এরই মধ্যে স্থায়ীভাবে বন্ধ হতে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি মিডিয়ায় বলেন, সহসাই তারা বাংলাদেশী শ্রমিক নেয়ার অনুমতি দেবে না। এদিকে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার সৌদি আরব, কুয়েত, ব্রুনাই, ওমান, মরিশাশে ২০০৯ সালে কোনো বাংলাদেশী শ্রমিক নেয়া হয়নি। শ্রমিক নেয়ার পুরো প্রক্রিয়াই বন্ধ রয়েছে। ২০১০ সালের ২০ এপ্রিল সৌদি প্রবাসী পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কার শ্রমিকদের আকামা পরিবর্তনের সুযোগ দেয়া হলেও বাংলাদেশী শ্রমিকদের তা দেয়া হয়নি। এতে আকামাজনিত সমস্যার কারণে লক্ষাধিক শ্রমিক সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। বিদেশে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ থাকার কারণে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৮৫ শতাংশ ব্যবসায়ীর কোনো কাজ নেই। অনেকে কর্মী ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি লাইসেন্স নবায়ন করতে পারেনি। এ বিষয়ে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার নির্বাহী কমিটির সদস্য ফোরকান উদ্দিন গত ২৬ ডিসেম্বর বলেন, ব্যবসায় মন্দা চলছে। এখন ৮৫ শতাংশ ব্যবসায়ী বেকার।
বিনিয়োগ নেই : দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ শূন্যের কোঠায় এবং রফতানিতে ধস, কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাস পেয়েছে কয়েকগুণ। গ্যাস ও বিদ্যুত্ সরবরাহ না থাকায় চলমান সহস্রাধিক শিল্প অচল হতে বসেছে। গত দুই বছরে তিন শতাধিক গার্মেন্ট বন্ধ হয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুত্ সরবরাহের আশ্বাস না পাওয়ায় দেশি-বিদেশি কোনো উদ্যোক্তা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। বরং ব্যবসা গুটিয়ে নিতে শুরু করেছেন অনেকে। দেশীয় ব্যাংকে রয়েছে ৪০ হাজার কোটি অলস টাকা। কিন্তু বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। চাঁদাবাজি, গ্যাস-বিদ্যুত্ সঙ্কট ও নিরাপত্তাহীনতা এক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে আছে।
শেয়ারবাজারে পতন : রেকর্ড লেনদেন ও সূচকের বড় ধরনের উত্থান-পতনে বছর পার করেছে দেশের শেয়ারবাজার। নতুন নতুন বিনিয়োগকারীর আগমনে শেয়ারবাজারে একদিকে বেড়েছে লেনদেন, অন্যদিকে একই সমান্তরালে বেড়েছে ঝুঁকি। পর্যাপ্ত শেয়ার সরবরাহ না থাকার কারণে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দরই বেড়ে যায় কয়েকগুণ। অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ে শেয়ারবাজার। বছরের শুরু থেকেই ক্রমান্বয়ে এ ঝুঁকির পরিমাণ বাড়তে থাকে। অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে বাজার নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। পরিণতিতে বছর শেষে ভয়াবহ দরপতন হয়েছে শেয়ারবাজারে। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধসের যে দুঃসহ স্মৃতি, তাকেও হার মানিয়েছে এবারের দরপতন। এ দরপতনের কারণে সূচক, মূলধন, লেনদেনের সব রেকর্ড ম্লান হয়ে গেছে। রেকর্ড দরপতনের কারণে হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব হয়েছে। ফলে তাদের বিক্ষোভ, সমাবেশ, মিছিলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজপথ। সর্বশেষ গতকালও পর পর তৃতীয় দিনের মত শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতন হয়েছে। বিক্ষোভ ভাঙচুর হয়েছে রাজপথে। সরকার দু’বছরের মাথায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ারবাজার এখন এক আতঙ্কের নাম।
নাম বদলের হিড়িক : আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে আওয়ামীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এক্ষেত্রে সরকার আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানীর নাম পরিবর্তন করতেও দ্বিধা করেনি। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নামে নির্মিত ‘ভাসানী নভোথিয়েটার’-এর নাম বদলে এখন শেখ মুজিবুর রহমানের নাম দেয়া হয়েছে। চীনের অর্থায়নে নির্মিত চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নামকরণ করা হয়েছে। স্বাধীনতার মহান ঘোষক ও মুক্তিযুদ্ধে ‘জেড ফোর্স’-এর প্রধান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নাম নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ নেয় সরকার। ক্ষমতা গ্রহণের দ্বিতীয় মাসেই তারা চারদলীয় জোট সরকারের সময় প্রতিষ্ঠিত বেগম খালেদা জিয়া মেডিকেল কলেজের নাম পরিবর্তন করে ফেলে। জাতীয় স্টেডিয়াম, সিলেট বিমানবন্দর, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও মেহেরপুরের মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্সে স্বাধীনতা স্তম্ভ থেকে রাতের আঁধারে শহীদ জিয়ার ম্যুরাল ভেঙে ফেলা হয়। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম মুছে ফেলতে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে মন্ত্রিপরিষদে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
উপদেষ্টানির্ভর প্রশাসন ও এমপিদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড : গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দক্ষ রাজনীতিকরা সরকারের নেতৃত্ব দেবেন এটাই নিয়ম। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে দক্ষ রাজনীতিকের বদলে দুর্নীতিবাজ টেকনোক্র্যাটদের উপেদষ্টা বানিয়ে প্রশাসন চালানোর পদক্ষেপ নেয়। এখনও অনেক মন্ত্রী জানেনই না কীভাবে তার মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম চলছে। উপদেষ্টারাই হয়ে বসেছেন সর্বেসর্বা। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভি, সংস্থাপন উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডাক্তার সৈয়দ মোদাচ্ছেরকে নিয়ে স্বয়ং সরকারি দলেই চলছে ব্যাপক অসন্তোষ ও কানাঘুষা।
সরকারের মন্ত্রিসভা চমক লাগানোর মতো কোনো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেনি দুই বছরে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির বেপরোয়া আচরণের চরম মূল্য গোটা দলকে দিতে হয়েছিল পরবর্তী নির্বাচনে। ওই ঘটনা থেকে এবার দলটি শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। এছাড়া গত বছর পাবনা ও নাটোরের সহিংস ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলকে বিপাকে পড়তে হয়।
গত দুই বছরে বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য যেসব সংসদ সদস্যের নাম বারবার উচ্চারিত হয়েছে তাদের মধ্যে আছেন ভোলা-৩ আসনের এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, পটুয়াখালী-৩ আসনের গোলাম মাওলা রনি, কক্সবাজার-৪-এর আবদুর রহমান বদি, চট্টগ্রাম-১০ আসনের এম আবদুল লতিফ, ঢাকা-১৬ আসনের ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা, ময়মনসিংহ-১০ আসনের গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, যশোর-১-এর শেখ আফিল উদ্দিন, পাবনা-৫ আসনের গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স ও বরিশাল-২ আসনের সরকারদলীয় এমপি মনিরুল ইসলাম মনি।
গত বছরের ১৩ আগস্ট নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের লাইসেন্স করা পিস্তলের গুলিতে রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার যুবলীগ নেতা ইব্রাহিম আহমেদের মৃত্যু নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অভিযোগ ওঠে, শাওনের গুলিতেই ইব্রাহিম খুন হন। তবে এরপর যুবলীগ তাদের নেতা শাওনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকারও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। গত বছরের জুনে আশুলিয়া বাজারসংলগ্ন সেতুর কাছে কর্তব্য পালনের সময় ইলিয়াস মোল্লা সাভারের ট্রাফিক সার্জেন্ট মো. শরীফুল ইসলামকে মারধর করেন। যুবদল নেতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা নেয়ায় শার্শা থানার ওসিকে মারধর করেন আফিল উদ্দিন। নিজ এলাকায় বিভিন্ন কারণে বারবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন আবদুর রহমান বদি ও গোলাম মাওলা রনি। ভূমি দখল, স্থানীয় নেতাকর্মীদের পেটানো, সরকারি জমিতে অবৈধ স্থাপনা, পুলিশ কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে দু’জনের বিরুদ্ধে। আবদুল লতিফ বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের আধিপত্য নিয়ে লড়াইয়ে বিতর্কিত হয়েছেন। পাশাপাশি দুই বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি সারাহ বেগম কবরী এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের মধ্যে বিবাদ লেগেই ছিল। বরিশাল-২ আসনের সরকারদলীয় এমপি মনিরুল ইসলাম মনি গত সোমবার বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীকে প্রহার করে সর্বশেষ আলোচনায় আসেন।
বিডিআর বিদ্রোহ : সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার চরম ব্যর্থতায় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদর দফতরে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতার কারণে এ ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন সৈনিক প্রাণ হারান। এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী দুটি বাহিনীকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। এ ঘটনায় সরকারের একাধিক সংসদ সদস্য, প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তদন্তে পাওয়া গেলেও হয়রানির শিকার হয়েছেন বিরোধী দলের এক এমপিসহ অনেকে। ঘটনাকে ভিন্নখাতে নিতে বিরোধীদলীয় রাজনীতিক ও দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীদের হয়রানি করা হয়।
হত্যাকাণ্ড ও বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয় কয়েক হাজার জওয়ানকে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফের করুণার ওপর নির্ভর করছে আমাদের সীমান্ত নিরাপত্তা। এমনকি স্বাধীনতার ৩৮ বছরেও বিএসএফ সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ড অতিক্রম করতে যেখানে সাহস পায়নি, সেসব জায়গায় বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে প্রবেশ করে বিভিন্ন নির্মাণ কাজেও বাধা দেয়। বিডিআর দুর্বল হওয়ার ফলে এই সাহস পায় বিএসএফ।
গত বছর বিভিন্ন স্থানে বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত অনেক সদস্যের বিচার হয়েছে। গতকাল থেকে সাধারণ কোর্টে শুরু হয়েছে পিলখানা হত্যাযঞ্জের বিচার। এরই মধ্যে বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে বিজিবি করা হয়েছে। তাদের পোশাকও পরিবর্তন করা হয়েছে

No comments:

Post a Comment