Wednesday 23 February 2011

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন : ড. ইউনূসকে রাজনৈতিক হুমকি মনে করেন শেখ হাসিনা


এনা, নিউইয়র্ক

নিউইয়র্ক টাইমসে আবারও ড. ইউনূসকে নিয়ে রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। ২৯ জানুয়ারি প্রকাশিত এ রিপোর্টে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির জনক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বিদ্বেষের বিষয় স্থান পেয়েছে। আবার কোনো সেনাসমর্থিত সরকার অথবা সামরিক সরকার এসে ড. ইউনূসকে তাদের গুরু হিসেবে বিবেচনা করুক—এ ভয়েই শেখ হাসিনা ড. ইউনূসের ইমেজ ধূলিসাত্ করতে চান। নিউইয়র্ক টাইমসকে এ তথ্য জানিয়েছেন শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ হলে তাকেও শেখ হাসিনার রোষানলে পড়তে হবে আশঙ্কায় তিনি নিউইয়র্ক টাইমসকে অনুরোধ জানিয়েছেন তা গোপন রাখতে। ওই কর্মকর্তা টাইমসকে আরও বলেছেন, ১৯৯৬ সালের গোড়ার দিকেই শেখ হাসিনার মনে হয় যে ড. ইউনূসের জনপ্রিয়তা যেভাবে বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে এক সময় তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতে পরিণত হবেন। এ আশঙ্কা থেকেই গ্রামীণ ব্যাংক এবং তার প্রতিষ্ঠাতার স্বাধীনতা সঙ্কুচিত করতে চান। তিনি ব্যাংকের নেতৃত্বে পরিবর্তন দেখতে চান। অবসরপ্রাপ্ত ওই কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, ২০০৬ সালে ড. মুহম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তার প্রতি শেখ হাসিনার হিংসা আরও চরম আকার ধারণ করে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বিভক্ত এবং দুর্বল হয়ে পড়ায় শেখ হাসিনা ড. ইউনূসকে তার বড় একজন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন। তাকে পলিটিক্যাল থ্রেট হিসেবে বিবেচনা করতে থাকেন তিনি।
টাইমসের সংবাদে আরও বলা হয়েছে, সুইজারল্যান্ডের ডেভসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের সম্মেলনে উপস্থিত হতে পারেননি ড. ইউনূস। কারণ, তাকে সে সময় কোর্টে হাজিরা দিতে হয়েছে। গ্রামীণ ড্যানোনের শক্তি দইয়ে ভেজাল করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন জনৈক রাজনীতিক। ওই মামলায় তাকে কোর্টে হাজিরা দিতে হয়।
টাইমসে বলা হয়েছে, ৩৪ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর ব্যাপক তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। নরওয়ে টিভিতে একটি প্রামাণ্যচিত্রে গ্রামীণ ব্যাংককে দেয়া নরওয়ে সরকারের তহবিল অন্য অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরের অভিযোগ প্রকাশ হওয়ার পর ড. ইউনূসের ব্যাপারে অনেকে নানা মন্তব্য করেন। যদিও নরওয়ে সরকার বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, অন্য অ্যাকাউন্টে অর্থ সরানো হলেও তার অপচয় ঘটেনি। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্রঋণের ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মন্তব্য করেন, দারিদ্র্য বিমোচনের নামে গরিবদের রক্ত চোষা হচ্ছে।
টাইমস লিখেছে, ড. ইউনূসের বয়স ৭০ ছুঁয়েছে। এখন তার অবসরে যাওয়ার সময়। তবে এমন কাউকে তিনি সে দায়িত্বে অধিষ্ঠিত করতে চান যার মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানটি টিকে থাকতে পারে। বাস্তবে তেমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।
টাইমসের এ সংবাদদাতা লিডিয়া পলগ্রিন ঢাকায় ড. ইউনূসের অফিসে যান তার সাক্ষাত্কার নিতে। কিন্তু ড. ইউনূস তাতে সম্মত হননি। ড. ইউনূস তাকে বলেছেন, কিছু ভুল তথ্য রয়েছে বিভিন্নজনের মধ্যে। আমি কিছু বলতে চাই না। বললেই তা আমার বিরুদ্ধে যাবে।
টাইমস লিখেছে, গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৩ লাখ সদস্য রয়েছে, যারা প্রতি বছর ১০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিচ্ছেন। এত বিরাটসংখ্যক মানুষের একটি প্রতিষ্ঠান ক্রমেই বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
টাইমস লিখেছে, ক্ষুদ্রঋণের বিশেষজ্ঞরা শঙ্কায় রয়েছেন যে, গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্ব যদি সরকারের হাতে চলে যায় তাহলে সেটি রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে এবং একপর্যায়ে তা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মি. ইউনূস বলেছেন, তিনিও দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চান। তবে তিনি আশা করছেন, দায়িত্ব হস্তান্তরের বিষয়টি খুবই যত্নের সঙ্গে সম্পাদন হতে হবে, যেন ঋণ গ্রহণকারী সদস্য এবং ব্যাংকের কর্মচারীদের মাঝে কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি না হয়। এমন কাউকে দায়িত্ব দেয়া সমীচীন হবে না যার মধ্যে গ্রামীণের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই অথবা আন্তরিকতার সঙ্গে সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী নন। আমি খুব সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ভাবছি।
উল্লেখ্য, নরওয়ে টিভির ডকুমেন্টারি প্রদর্শনের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে এর আগে নিউইয়র্ক টাইমসে একটি সংবাদ এবং ড. ইউনূসের লেখা একটি উপ-সম্পাদকীয় ছাপা হয়। ওয়াশিংটন পোস্ট এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নালেও ড. ইউনূসের ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন টেলিফোন করেছেন শেখ হাসিনাকে। সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. ব্ল্যাক টেক্সাসের একটি ইউনিভার্নিটিতে বক্তৃতার সময় স্টেট ডিপার্টমেন্টের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। এরপরও ড. ইউনূস সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় টাইমসের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দৈনিকে আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হলো বলে বাংলাদেশী-আমেরিকানরা মনে করছেন। ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে ড. মুহম্মদ ইউনূসের সম্পর্ক এবং ক্লিনটন পরিবারের সঙ্গে ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠতার সূত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে তদন্তের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা দেখার বলে পেশাজীবী বাংলাদেশীরা মনে করছেন।
উল্লেখ্য, আমেরিকান মিডিয়ায় প্রকাশিত বিভিন্ন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো মতামত অথবা বাংলাদেশ সরকারের কোনো বক্তব্য এসব মিডিয়ায় প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানা যায়নি

No comments:

Post a Comment