Wednesday 23 February 2011

ঘরেবাইরে সঙ্কটে সরকার



জাহেদ চৌধুরী

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তাদের শাসনকালের মধ্যমেয়াদে এসে ঘরেবাইরে প্রচণ্ড সঙ্কটে রয়েছে। দ্রব্যমূল্য ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের দুঃশাসনকালকেও ছাড়িয়ে গেছে। পরিস্থিতি এখন এমনই নাজুক যে সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকারিভাবেই প্রায় সাড়ে ২২ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হবে। আর পরিস্থিতির গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, প্রয়োজনে দেশের সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ রেখে খাদ্যশস্য আমদানি করে হলেও দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তিনি আরও বলেছেন, দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়ে গেছে, যা হওয়ার কথা নয়। শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে একটি মহলের খেলাধুলা রয়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ’৯৬ সালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। খুন ছিনতাই ডাকাতিসহ আইনশৃঙ্খলার অবনতির কথা এখন সরকারিভাবেই স্বীকার করা হচ্ছে। বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং সামনে অপেক্ষা করছে বলে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন, সেচের জন্য গতবারের চেয়ে এবার শহরাঞ্চলে আসন্ন গ্রীষ্মে বেশি লোডশেডিং হবে। রাজধানীতে গ্যাস ও খাবার পানির সঙ্কটকে সরকারি দলের এমপিরাই গত ৫০ বছরের মধ্যে ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেছেন।
মাত্র সোয়া দুই বছর আগে যে মহাজোট
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শতকরা ৮৫ ভাগ আসন পেয়েছিল, তারাই মাত্র ক’দিন আগে দেশব্যাপী পৌরসভা নির্বাচনে অর্ধেক পৌরসভায়ও জিততে পারেনি। দলীয় দুই এমপির মৃত্যুতে সংসদের দুটি আসনের উপনির্বাচনে চ্যালেঞ্জে হেরে গিয়ে একটি আসন খুইয়েছে আওয়ামী লীগ।
কিছুদিন আগে রাজধানী সংলগ্ন রূপগঞ্জে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদিত সেনা আবাসন প্রকল্পে জনগণের জমি ন্যায্য দাম না দিয়ে জোর করে কেনার চেষ্টার প্রতিবাদে গণবিক্ষোভের মুখে ৭টি হেলিকপ্টারে করে সেনাসদস্যদের প্রত্যাহার করে নিয়ে আসতে হয়েছে সরকারকে। অতিসম্প্রতি মুন্সীগঞ্জের আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের প্রকল্প থেকে গণবিক্ষোভের মুখে সরকারকে পিছু হটতে হয়েছে। ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন, মিডিয়া
দলনের সরকারি নীতির বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে প্রতিবাদ এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় তীব্রতর হয়েছে। সম্প্রতি লন্ডন সফরে গিয়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলোর মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ লর্ডস সভার মানবাধিকার বিষয়ক কমিটির প্রধান লর্ড এরিক এল অ্যাভিবুরি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অব্বাস ফয়েজ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের প্রধান ব্রাড অ্যাডামস প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাবলি তুলে ধরে এগুলো বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মিথ্যাচার এক ভয়ানক রোগে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে একাধিকবার বলেছেন, তিনি নবম সংসদ নির্বাচনের আগে কোথাও বলেননি ক্ষমতায় গেলে চালের কেজি ১০ টাকা করবেন। কিন্তু এ নিয়ে মিডিয়ায় সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ উল্লেখ করে পত্রিকার ক্লিপিংস ও টিভি ফুটেজের পরও এ বক্তব্য অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগ যখন ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে, তখন নাকি মোটা চালের কেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি বলছে, ২০০৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মোটা চালের কেজি ২৭ টাকা ছিল। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের খবরে দেখা গেছে, সেদিন দেশের কোনো কোনো এলাকায় মোটা চালের কেজি মাত্র ২৪ টাকা ছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যকে ইতোমধ্যেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার হয়েছে। তাদের কাছে প্রমাণ আছে বলে প্রকাশ্য জনসভায় তারা ঘোষণা দিয়ে সরকারকে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের আহবান জানিয়েছে। বিএনপি নেতারা আরও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ’৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে মোটা চালের কেজি ১০ টাকা ছিল। তাদের ওই শাসনকালে মোটা চাল ২৪ টাকা কেজিতেও দীর্ঘদিন বিকিয়েছে। ’৯৮ সালে ২৪ টাকা কেজিতে মোটা চাল বিক্রির সরকারি রেকর্ডও তাদের হাতে রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য বিএনপিকে দায়ী করে মন্ত্রিসভায় কথা বলেন। ব্রিফিংয়েও একথা বলা হয়। একদিন পর অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি আ হ ম মোস্তফা কামাল (লোটাস কামাল) বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য রাজনৈতিক। বাস্তবের সঙ্গে এর মিল নেই। তিনি শেয়ারবাজার নিয়ে নানা মন্তব্য করেন। গতকাল এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, লোটাস কামাল এসব নিয়ে বলার কে?
মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ বুধবার দলের বনানী কার্যালয়ে দলীয় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস, বিদ্যুত্ ও পানির সঙ্কট, শেয়ারবাজারে অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে জনগণ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়—একথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, সরকারকে অবিলম্বে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। জোটের আরেক শরিক জাসদের হাসানুল হক ইনু গতকাল মন্তব্য করেছেন, আওয়ামী লীগ ফায়দা লোটায় ব্যস্ত। গণতন্ত্র এখনও হুমকির মুখে। এর আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি আওয়ামী লীগকে সতর্ক করে দেয়া চিঠিতে বলেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বিদ্যুত্ সঙ্কট ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিসহ নানাবিধ সঙ্কটে জনমনে হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি মহাজোটের শরিক ১৪ দলের বৈঠকের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, বক্তৃতাবাজি ছাড়া সরকারের কোনো সাফল্য নেই। নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে তারা ক্ষোভ ও হত্যাশা ব্যক্ত করেছেন।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমদ সম্প্রতি সংসদের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে বলেছেন, গত ২ বছরে দেশে কোনো উন্নয়ন হয়নি। দেশের রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা। এ নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রীও স্বীকার করে বলেছেন তার ফান্ড নেই। অর্থমন্ত্রীর কাছে ফান্ড চেয়ে তিনি ফান্ড পাননি। আওয়ামী লীগের সুহৃদ বলে পরিচিত সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে সম্প্রতি মন্তব্য করা হয়েছে, ‘কুশাসন চালিয়ে দিনবদলের স্লোগান বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এর আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান দেশব্যাপী ছাত্রলীগ ও যুবলীগের টেন্ডারবাজি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দখলসহ দেশের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে মন্তব্য করে বলেছিলেন, ‘বাজিকরদের হাতে দেশ চলে গেছে।’
সম্প্রতি ব্রিটেন সফরকালে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের তিনটি মানবাধিকার সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি সংবাদ সংস্থা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে যে খবর প্রচার করেছে, সেটা সত্য নয় বলে সংশ্লিষ্ট দু’জন মানবাধিকার নেতা বিবৃতি দিয়েছেন। তাদের বিবৃতির বরাত দিয়ে বাংলাদেশের পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মানবাধিকার নেতারা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে যে খবর বাসসের বরাত দিয়ে প্রচার করা হয়েছে তা সত্য নয়, মানবাধিকার নেতারা এমন কোনো কথা বলেননি। বরং ওই বৈঠকে তারা প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তিনি বন্ধ করবেন। কিন্তু এখনও তা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না।
কিছুদিন আগেও প্রধানমন্ত্রীকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের টেলিফোনের ভাষ্য নিয়ে সরকারি ব্রিফিংয়ে দেয়া বক্তব্য মার্কিন প্রশাসন থেকে নাকচ করে দেয়া হয়। সরকারি ব্রিফিংয়ের সূত্র ধরে বাংলাদেশের মিডিয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমসহ কয়েকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, এগুলো নিয়ে হিলারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু পরে মার্কিন অ্যাসিসট্যান্ট ও ডেপুটি সেক্রেটারি দুজনের ভাষ্য অনুযায়ী জানা যায়, হিলারি ওই টেলিফোনে মূলত নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের আইনসম্মত নিষ্পত্তির কথা বলেছেন। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে হঠাত্ করেই সরকারের যুদ্ধংদেহী অবস্থান নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের নির্বিচারে বাংলাদেশী হত্যা বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে প্রথমে সরকার কিছু না বললেও মিডিয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ১০ দিনের মাথায় সরকার ভারতীয় দূতকে ডেকে নিয়ে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সরকারকে এ মুহূর্তে বেশ কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। গত বছর জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে পর ভারতের চাহিদা অনুযায়ী ট্রানজিট, বন্দর সুবিধা ভারতকে প্রদান, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদের ভারতের হাতে তুলে দেয়াসহ নানা দাবি বর্তমান সরকার পূরণ করলেও বাংলাদেশের এক নম্বর দাবি অভিন্ন নদী, বিশেষ করে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যাকাণ্ড বন্ধ, ভারতে বাংলাদেশী ৬১ পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার এখনও পায়নি বাংলাদেশ।

No comments:

Post a Comment