Sunday 27 March 2011

১/১১’র সময় ডিজিএফআইর নির্যাতনের তদন্ত চাই : জলিল

স্টাফ রিপোর্টার

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের এবারের মন্ত্রিসভায় হ্যাভিওয়েট রাজনীতিক নেই মন্তব্য করে দলটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আবদুল জলিল বলেছেন, বর্তমান মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যকেই জনগণ ভালোভাবে চেনে না। জনগণের সঙ্গে তাদের তেমন কোনো সংশ্রব নেই। মন্ত্রিসভায় রদবদল হওয়া দরকার বলেও সাবেক এই মন্ত্রী মনে করেন।
গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মিট দ্য প্রেসে আবদুল জলিল দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে সঙ্কট দেখা দিয়েছে উল্লেখ করে আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দখল করে নিয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাবে তারা সংসদকে রাজনীতি বিবর্জিত করে তুলেছে। গ্যাস-বিদ্যুত্সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে ব্যবসায়ীদের পরামর্শ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আবদুল জলিল বলেন, ব্যবসায়ীদের ধমক দিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। ব্যবসায়ীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে।
জরুরি অবস্থার সরকার প্রসঙ্গে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ডিজিএফআই ক্ষমতার বাইরে থেকেও রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, পেশাজীবী, ব্যবসায়ীদের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে এর জন্য সংসদীয় কমিটি গঠন করে তদন্ত হওয়া উচিত। ভবিষ্যত্ গণতন্ত্র এগিয়ে নেয়ার জন্য এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। এ নিয়ে আগে একবার কথা বলে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছি। আবার বলতে গেলে দল থেকে বের হতে হবে।
এর আগে আবদুল জলিল বিব্রতকর কোনো প্রশ্ন না করতে উপস্থিত সাংবাদিকদের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, লন্ডনে আমার একটি বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করে দলের ভেতরে এবং বাইরে আমার রাজনৈতিক ইমেজ ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। সে কারণে অভিমান, ক্ষোভ বা দুঃখ থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলি না। তবে আমি স্পষ্টবাদী। মনের ভেতরে যখন যা আসে তা বলে দেই।
রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব আসছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, কী করে নেতৃত্ব তৈরি হবে। ২০ বছর ধরে ডাকসুর নির্বাচন নেই। আগে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। এতে করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব উঠে আসত। আজকে নেতা কারা হচ্ছে? এই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, দুর্নীতি ও অসত্ উপায়ে অর্জিত টাকার মালিকরা সাবেক ‘সংসদ সদস্য’ লেখার জন্য রাজনীতিতে আসছেন। তারা সমাজে রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্য নির্বাচনে বিপুল অর্থ খরচ করে জয়লাভ করেন। পরে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এ কারণে সর্বত্রই রাজনীতিতে দুরবস্থা চলছে, নেতৃত্বে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। রাজনীতিতে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের কিছু ব্যর্থতার কারণে ‘লিডারশিপ’ তৈরি হচ্ছে না। এ দীনতা কাটিয়ে উঠতে সমাজের সর্বস্তরে নাড়া দেয়া দরকার। সংসদ এবং সংসদের বাইরে থেকে এ আওয়াজ তুলতে হবে।
আবদুল জলিল আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আজও সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সরকার দুই বছরে অনেকটা পথ এগিয়েছে। তবে চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে পারেনি।
সংসদে প্রাণ নেই দাবি করে তিনি বলেন, বিরোধী দল সংসদে না গেলেও সংসদ প্রাণবন্ত হতে পারে। সংসদে প্রাণ সঞ্চার করতে হলে সংসদ সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দিতে হবে। তাদের কথা বলার অধিকার দিতে হবে। আমরা আশা করি, বিরোধী দল সংসদে যাবে। তারা সংসদে গেলে মানুষের অনেক সমস্যার সমাধান হবে।
১৪ দল তথা মহাজোটের সমন্বয়হীনতা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে জোটের সাবেক সমন্বয়ক আবদুল জলিল বলেন, যথাযথ উদ্যোগের অভাবে ১৪ দলে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মহাজোটের নির্বাচনী মহাবিজয়ের পেছনে তাদের অবদান অনেক বেশি। ১৪ দল হঠাত্ করে হয়নি। একটি আস্থা-বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে এ আদর্শিক জোট গড়ে উঠেছে। তিনি বলেন, আমরা যখন মহাজোট করি, তখন ছোট-বড় বলে কোনো রাজনৈতিক দলকে গণ্য করিনি। আমরা মনে করেছিলাম গণতন্ত্রের জন্য সবার ভূমিকা সমান। আজকে ১৪ দলে শরিকদের মূল্যায়নের অভাব রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সরকারে মহাজোটের অংশীদারিত্ব আছে। তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে। শরিক দলের অনেক নেতাই বলছেন, তাদের মূল্যায়ন করা হয় না, খোঁজ-খবরও নেয়া হয় না। তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও দুঃখবোধ রয়েছে। এটা ঘুচাতে হবে। ১৪ দলকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে, সম্মান দিতে হবে। তবেই আবার এই আদর্শিক জোট উজ্জীবিত হবে।
দুই বছরে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন সম্পর্কিত অপর এক প্রশ্নোত্তরে আবদুল জলিল বলেন, আওয়ামী লীগ অবশ্যই নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। এ ক্ষেত্রে দলীয় কর্মকাণ্ড অনেক কম স্বীকার করে তিনি বলেন, দল এবং সরকার একসঙ্গে তত্পর হলে, সমন্বয় করা হলে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব।
সরকারের ব্যর্থতা-সফলতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার দুই বছরে ব্যর্থ হয়েছে তা বলব না। তবে পুরোপুরি সফলতার অভাব রয়েছে। কৃষি, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের সচল পদচারণা রয়েছে। বিদ্যুত্-গ্যাসের সমস্যা এখনও সমাধান করতে পারেনি। তবে এ সঙ্কট কাটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে সরকার। চেষ্টা সত্ত্বেও সামাজিক-রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যার কারণে এসব সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব হয়নি।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রসঙ্গে প্রশ্নোত্তরে সাবেক এই বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রীকে নিয়ে আমি কোনো সমালোচনা করব না। তবে তিনি বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। মন্ত্রণালয় এককভাবে কাজ করছে। এসব বিষয়ে দলীয়ভাবে আলোচনা করা উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। একত্রিতভাবে আলোচনা করলে এসব ক্ষেত্রে সুফল আসত। বাণিজ্যমন্ত্রীর প্রতি ইঙ্গিত করে আবদুল জলিল বলেন, এ মন্ত্রণালয় যিনি পরিচালনা করছেন, তার দলগত সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রচেষ্টা নেই।
বাণিজ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় আবদুল জলিল নিয়মিতই ব্যবসায়ীদের পরামর্শ নিতেন উল্লেখ করে বলেন, শুধু এফবিসিআইর সঙ্গে নয়, ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসায়ীর সঙ্গেও আলোচনায় বসতে হবে। আমি ও তোফায়েল আহমেদ যখন বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলাম, তখন ছোট ছোট ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের সহযোগিতা ও পরামর্শ চাইতাম। সাংবাদিকদেরও পরামর্শ নিতাম। এখন তা না করে ধমক দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, একজনের সিদ্ধান্ত সবসময় সঠিক হয় না। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে সবার পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ও বর্তমান মহাজোট সরকারের মধ্যে গুণগত পার্থক্য কী—সাংবাদিকরা এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে আবদুল জলিল বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর যখন একটা সরকার গঠন করা হয়, তখন দলীয়প্রধান মন্ত্রিসভা নির্বাচন করেন। কোথাও কোথাও দলের পরামর্শ নেয়া হয়। আমাদের দেশে দলের পরামর্শ নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয় না। তিনি বলেন, আমাদের দলে অনেক অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ রয়েছেন। এটা ভেবে এবার প্রধানমন্ত্রী দলের নতুন মুখ ও প্রজন্মকে মন্ত্রিসভায় নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন। কারণ আমরা তো আর চিরদিন থাকব না।
মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন প্রয়োজন মনে করেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে একটা নড়াচড়া হওয়া দরকার।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে সাংবাদিকদের একাধিক প্রশ্নের জবাবে আবদুল জলিল বলেন, এখন কাগজ খুললে ঢাকায় ৩/৪টা খুনের খবর দেখতে পাই। অন্য সময়ে যে এটা হয়নি তা নয়। আগেও এর থেকে বেশি হয়েছে। তিনি বলেন, এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে, অষ্টম শ্রেণীর কনস্টেবল নিয়োগ দিলে চলবে না। দেশে অনেক শিক্ষিত বেকার রয়েছে। শিক্ষিত বেকার যুবকদের এ পদে নিতে হবে।
ডিআরইউর সভপতি মোস্তাক হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন

No comments:

Post a Comment