Sunday 27 March 2011

শেয়ারবাজারে সূচক পতনের রেকর্ড

জাহেদ চৌধুরী ও কাওসার আলম

শেয়ারবাজারে সাম্প্রতিক সূচক পতনের ধস ও মহাধসের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড হয়েছে গতকাল। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসসি) সাধারণ সূচক গতকাল নেমে এসেছে ৫ হাজার ৪শ’ ৬৩ দশমিক ৩৫ পয়েন্টে। এর আগে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সূচক সর্বনিম্ন ৫ হাজার ৫শ’ ৭৯ দশমিক ৫০ পয়েন্টে নেমে এসেছিল। তারও আগে গত ২০ জানুয়ারি যখন সূচক ৬ হাজার ৩শ’ ২৬ দশমিক ৩৪ পয়েন্টে নেমে আসে তখন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আন্দোলনের মুখে অর্থমন্ত্রী বাজার ধসের কথা স্বীকার করে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ট্রেডিং বন্ধ রেখে বেশ কিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সরকারি সব পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়েছে। গত ৫ ডিসেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসসি) বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭১ কোটি টাকা, সেখানে গতকাল পর্যন্ত মূলধন ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৮৪ কোটি কমে গেছে। গতকাল ডিএসসি’র মূলধন দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। ৫ ডিসেম্বরে একদিনে লেনদেন হয়েছিল ৩ হাজার ২৪৯ কোটি টাকার শেয়ার। সেখানে গতকাল লেনদেন হয়েছে মাত্র ৫০১ কোটি টাকার শেয়ার। দেখা যাচ্ছে ৫ ডিসেম্বরের তুলনায় লেনদেন হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৮৫ শতাংশ।
চরম আস্থাহীনতা ও তারল্য সঙ্কটের কারণে শেয়ারবাজারে এই ধস অব্যাহত রয়েছে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। গত ৫ ডিসেম্বর যেদিন সূচক ৮ হাজার ৯১৮ দশমিক ৫১ পয়েন্টে পৌঁছেছিল সেদিনের তুলনায় গতকাল পর্যন্ত সূচকের পতন হয়েছে ৩৯ শতাংশ। মাত্র ৫৫ ট্রেডিং বা কর্যদিবসে সূচকের এই পতন বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে কিছু ব্যাংকসহ বেশ ক’টি কোম্পানির শেয়ারের দাম অর্ধেক কিংবা তারও বেশি নিচে নেমে এসেছে। অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, বিশেষ করে যারা ৬ মাস আগে অতিমূল্যায়িত শেয়ারবাজারে প্রবেশ করেছেন তারা ভালো কোম্পানির ও ভালো মৌলভিত্তির শেয়ার কিনেও ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মূলধন হারিয়েছেন। তুলনামূলকভাবে বেশি মূল্যায়িত শেয়ার কিনে গতকাল পর্যন্ত ৭০ শতাংশ পুঁজি হারানোর নজিরও আছে।
৫৫ শতাংশ পর্যন্ত স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণার পর ইস্টার্ন ব্যাংক কিংবা ওয়ান ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দামও ভয়াবহভাবে পড়ে গেছে। একইভাবে ৯৫ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা ও রেকর্ড ডেট পার হওয়ার পর ন্যাশন্যাল ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৫ ডিসেম্বরের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশে এসে দাঁড়িয়েছে। সিএমসি কামালের শেয়ারের দাম প্রায় ৮৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
তারল্য সঙ্কট এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার কারণে বাজারে বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এ অবস্থায় তারল্য সঙ্কট এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে না পারলে বাজার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে—অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের এমন বক্তব্যের কোনো প্রতিফলন নেই বাজারে। বরং অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার পর বাজারে একের পর এক দরপতনের ঘটনা ঘটছে। অর্থমন্ত্রীর কোনো ঘোষণাতেই বিনিয়োগকারীরা আর আস্থা রাখতে পারছেন না। বরং অর্থমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি আ হ ম মোস্তফা কামাল শেয়ারবাজার সূচক সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার পয়েন্টে নেমে এলে বাজার স্থিতিশীল হবে বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন—বিনিয়োগকারীরা সেটিই আশঙ্কা করছেন। ফলে বিনিয়োগকারীরা তাদের আর্থিক ক্ষতি কমাতে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে বাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়লেও ক্রেতা না থাকাতে বড় ধরনের দরপতন হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ লোকসান সত্ত্বেও সব শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অনেকেই। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো মার্জিন লোন না বাড়িয়ে বরং ফোর্স সেলের পথ বেছে নিয়েছে।
তবে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা বাজারের ওপর কোনোভাবেই আস্থা রাখতে পারছেন না। বাজারের সূচক আরও কমে যাবে—এ ধরনের আশঙ্কা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। ফলে বিনিয়োগকারীরা তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। অপরদিকে শেয়ারের দর কমতে কমতে ক্রয়ানুকূল অবস্থায় চলে এলেও বিনিয়োগকারীদের হাতে টাকা না থাকায় তারা শেয়ার কিনতে পারছেন না। আবার শেয়ারের দর আরও কমে যাবে—এ কারণেও বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ক্রয় করছেন না।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী রবীন্দ্র চন্দ্র রায় পূবালী ব্যাংকের ব্রোকারেজ হাউসে ট্রেড করেন। গত জুলাইতে তিনি বিও অ্যাকাউন্ট খুলে পেনশনের টাকাসহ বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা নিয়ে শেয়ারবাজারে ব্যবসা শুরু করেন। মাস তিনেক অবস্থা ভালো থাকলেও এখন তার অর্ধেকেরও বেশি পুঁজি নেই। নিজের কেনা শেয়ারের তালিকা ও মূল্য চার্ট (পোর্টফোলিও) দেখিয়ে বললেন, তালিকা দেখলেই যে কেউ বুঝতে পারবেন আমাদের অর্ধেকেরও বেশি পুঁজি কিভাবে চলে গেছে। শাহ আলম সোহাগ মর্ডান সিকিউরিটিজে শেয়ার কেনাবেনা করেন। শেয়ারের দরপতনের তালিকা দেখিয়ে বললেন, গত ৫ ডিসেম্বর সূচকের সর্বোচ্চ অবস্থানের দিনে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক শেয়ারের দাম ছিল ৮১৯ টাকা। ২০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণার পরও রেকর্ড ডেট শেষে গতকাল দাম কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩২৯ টাকা ৭৫ পয়সা। ৩৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা সত্ত্বেও ঢাকা ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৮১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে কমে ৫৬ টাকা ৯০ পয়সায়, ২০ শতাংশ স্টক ও ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড ঘোষণার পরও ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ার ১ হাজার ৮ টাকা থেকে কমে ৫১০ টাকায় গতকাল বিক্রি হয়েছে। ৩০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড ঘোষণার পরও ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ২ হাজার ৫শ’ ৫ টাকা দামের শেয়ার গতকাল বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১শ’ ৯৩ টাকা ৫০ পয়সা দামে। ৬৬৯ টাকা দামের সাউথইস্ট ব্যাংকের শেয়ার ২০ শতাংশ স্টক ও ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড ঘোষণার পরও গতকাল বিক্রি হয়েছে ৩৬৪ টাকা ২৫ পয়সা। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ৬৭৫ টাকা দামের শেয়ার ২২ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড দেয়ার পরও গতকাল বিক্রি হয়েছে ৩৪২ টাকা ৫০ পয়সায়। প্রাইম ব্যাংকের ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা দামের শেয়ার ৩৫ শতাংশ স্টক ও ৫ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয়ার পরও গতকাল বিক্রি হয়েছে ৫৪ টাকা ৫০ পয়সায়।
পূবালী ব্যাংকে ট্রেড করেন গৃহিনী আয়েশা সিদ্দিকী। মৃত স্বামীর পেনশনের টাকা আর আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করে প্রায় ১০ লাখ টাকার মতো বিনিয়োগ ছিল। গড়ে এই বিনিয়োগের বছরের আয় থেকে সংসার চলে যেত। প্রায় তিন বছর থেকে ভালই দিন কাটছিল তার। কিন্তু সাম্প্রতিক দরপতনে এখন লাভের টাকা তো গেছেই উপরন্তু মূলধন নিয়ে তিনি এখন শঙ্কায়।
২ বছর আগে মুজিবুর চৌধুরীর বিনিয়োগ ছিল ৩ লাখ টাকা। বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছিল। সব টাকাই মার্কেটে বিনিয়োগ করেছিলেন। তিনি বললেন, শেয়ারবাজারের এ ধস কল্পনা করা যায় না। ৫ ডিসেম্বরের তুলনায় গতকাল পর্যন্ত আল আরাফাহ ব্যাংক ৭১ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৪০ টাকা ৭০ পয়সায়, উত্তরা ব্যাংকের শেয়ারের দাম ১৮৬ টাকা ৯০ পয়সা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৯৭ টাকায়।
ছাইফুল ইসলাম নামে এক বিনিয়োগকারী জানান, বাজারে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। সরকার শেয়ার কিনবে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু আদৌ সরকার শেয়ার কিনবে বলে মনে হচ্ছে না। এদিকে বাজারে দরপতনে আমাদের অবস্থা খুবই করুণ। আমাদের হাতে কোনো পুঁজি নেই। সূচক সাড়ে ৪ হাজারে নেমে যাবে বলে বাজারে গুজব রয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আরও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। বাজারে অব্যাহত দরপতন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বক্তব্য নেই। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। আমরা পুঁজি হারিয়ে ফেলছি। আমাদের বলার মতো কোনো ভাষা নেই। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী তাদের সবর্স্ব হারিয়ে ফেলছেন কিন্তু এ নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
এদিকে শেয়ার ক্রয়ে সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবিকে এরই মধ্যে তিন দফায় ৬০০ কোটি টাকা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এ টাকা শেয়ারবাজারের তারল্য সঙ্কট কাটাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। অবশ্য শেয়ারবাজারের পতনরোধে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংক সোনালী, রূপালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংককে অর্থমন্ত্রণালয় থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করছে না। শেয়ারবাজারের বর্তমান তারল্য সঙ্কট কাটাতে বড় ধরনের ফান্ড প্রয়োজন বলে বিশ্লেষকরা জানান। তারা বলেন, ছোট ফান্ড দিয়ে বাজারের তারল্য সঙ্কট মেটানো যাবে না। বরং এ টাকার অপচয় ঘটবে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ারমূল্য; ৫ ডিসেম্বরের সঙ্গে গতকালের তুলনামূলক চিত্র : ৫ ডিসেম্বর ন্যাশনাল ব্যাংকের ১০ টাকার শেয়ারের দাম ছিল ১৭৬ টাকা। মাঝখানে এটা প্রায় ২শ’ টাকায় উঠেছিল। ৯৫ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা এবং রেকর্ড ডেট শেষে গতকালের বাজারে এই শেয়ারের দাম ছিল মাত্র ৬৬ টাকা ৩০ পয়সা। ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৫ ডিসেম্বর ছিল ১ হাজার ১শ’ ৯৬ টাকা। সম্প্রতি প্রতি ১০০ শেয়ারধারীকে ৫৫টি শেয়ার বোনাস অর্থাত্ ৫৫ ভাগ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণার পরও গতকাল শেয়ারের দাম কমে দাঁড়িয়েছে ৭৪৬ টাকা ৫০ পয়সা। ইস্টার্ন ব্যাংকের শেয়ারের দাম ছিল ১৩৮ টাকা। বাজারের সঙ্গে এর দামও ওঠানামা করে। সম্প্রতি ব্যাংকটি ৫৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে। গতকাল এর দাম দাঁড়িয়েছে ৮৬ টাকা ৩০ পয়সা। আগামীকাল ব্যাংকটির ডিভিডেন্ড রেকর্ডের ডেট। প্রথম বিএসআরএস মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ারের দাম ছিল ১৮৯০ টাকা। গতকাল এই শেয়ার বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২শ’ ৩৫ টাকায়। বেক্সিমকোর শেয়ার ছিল ৩২৭ টাকা, গতকাল দাঁড়ায় ২৪২ টাকা ৮০ পয়সায়। ইস্টার্ন হাউজিংয়ের দাম ছিল ১৮১০ টাকা। গতকাল বিক্রি হয়েছে ৬৪৮ টাকা ৫০ পয়সায়। গ্রামীণফোন (জিপি) শেয়ারপ্রতি নগদ সাড়ে ৮ টাকা লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। জিপির শেয়ারের দাম ২৩৪ টাকা থেকে কমে ১৪৯ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। বেক্সটেক্সের শেয়ার ৮৪ টাকা থেকে ৫৩ টাকা ৪০ পয়সায়, আরএকে সিরামিকসের দাম ১৯৫ টাকা থেকে ৯২ টাকা ৭০ পয়সা, শাইনপুকুর সিরামিকস ১১৬ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ৭২ টাকা ৬০ পয়সা, এএমসি (প্রাণ) ২ হাজার থেকে ১ হাজার ১শ’ ৫২ টাকা, তিতাস গ্যাসের শেয়ার ১ হাজার ৪০ থেকে কমে ৬৭৮ টাকা ৭৫ পয়সায় গতকাল বিক্রি হয়েছে।
সরকারদলীয় এমপি লোটাস কামালের মালিকানাধীন বস্ত্রখাতের প্রতিষ্ঠান সিএমসি কামালের শেয়ারের দাম ৫ ডিসেম্বর ছিল ২৯৭ টাকা ৮০ পয়সা। কমতে কমতে সেই শেয়ারের দাম গতকাল এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪৫ টাকা ৯০ পয়সায়। অভিযোগ উঠেছে, পরিকল্পিতভাবে অতিমূল্যায়ন করে কোম্পানিটি এরই মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রায় ৯১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। মন্ত্রী ফারুক খানের পারিবারিক মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ায় ও খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (কেপিসিএল)। সামিট পাওয়ারের শেয়ারের দাম ১৪৯ টাকা থেকে কমে গতকাল ৯৭ টাকা ৭০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ডিরেক্ট লিস্টিংয়ের মাধ্যমে অতি মূল্যায়িত হয়ে বাজারে আসা কেপিসিএলের দাম ১২৪ টাকা ৫০ পয়সা থেকে নেমে ৭৮ টাকা ৫০ পয়সা হয়েছে।
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে না : পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সরকারের দিক থেকে একের পর এক পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়া হলেও এর অধিকাংশই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অর্থমন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা সত্ত্বেও বাজারে চাহিদা বাড়াতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ প্রতিষ্ঠান কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও শেয়ারবাজার থেকে অর্জিত মুনাফা পুনরায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের উদ্যোগ নিতে পারছে না। অন্যদিকে এক মাস পার হলেও মার্জিন ঋণের নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শেষ করতে পারেনি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। একইভাবে ফোর্স সেল বন্ধে অর্থমন্ত্রী স্পষ্ট ঘোষণা দিলেও লিখিত আদেশ না থাকায় কোনো কোনো মার্চেন্ট ব্যাংক আগের মতোই এ ধরনের প্রবণতা অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ২৪ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে ধারাবাহিক দরপতন সামাল দিতে বাজারে শেয়ারের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মার্চেন্ট ব্যাংকসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় করতে বলা হয়। অর্থমন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে পুঁজিবাজার থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিমাণ মুনাফা করেছে তার একাংশ পুনরায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য বলা হয়। পাশাপাশি মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোও তাদের মুনাফার অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া পুঁজিবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে নমনীয় নীতি অনুসরণ করতে বলা হয়। প্রজ্ঞাপনে মার্জিন ঋণের ক্ষেত্রে এসইসির পক্ষ থেকে দীর্ঘমেয়াদি নীতি ঘোষণার কথা বলা হয়।
সরকারের এসব ঘোষণায় তাত্ক্ষণিকভাবে শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তৈরি হয়। কিন্তু বাজারে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলতে সক্ষম কোনো পদক্ষেপই বাস্তবায়ন না হওয়ায় কয়েক দিনের মধ্যেই বড় দরপতনের ধারায় ফিরে যায় পুঁজিবাজার।
রাষ্ট্রীয় পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে ফের বিনিয়োগের নির্দেশ : শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে গতকাল ফের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আইসিবি এবং সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে শেয়ারবাজারে যত বেশি সম্ভব বিনিয়োগের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরকারের নির্দেশ পাওয়ার পর গতকাল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বমোট প্রায় ৫০ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে। এর আগে ১৫ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেয়ার কেনার নির্দেশ দিয়েছিল অর্থমন্ত্রণালয়।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের বক্তব্য : রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সঙ্কটের কারণে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে কার্যকরভাবে বিনিয়োগ করতে পারছে না। বিভিন্ন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক সরকারি ব্যাংক থেকে নামমাত্র সুদে রেপোর মাধ্যমে কলমানি নিয়ে শেয়ার মার্কেটে খাটিয়েছে বেশি লাভের আশায়। কিন্তু এভাবে ব্যাংকগুলোর সম্পদের চেয়ে বেশি পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করে ফেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমন্বয় নির্দেশ জারির পরই তারল্য সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। প্রায় একই সময়ে সরকারি ব্যাংক রেপোর মাধ্যমে টাকা সরবরাহে কড়াকড়ি আরোপ করে, যার প্রভাব পড়ে শেয়ার মার্কেটে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসএলআর ও সিআরআর বৃদ্ধি করায় অনেক ব্যাংকই তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সিআরআর ও এসএলআর আগের হারে নিয়ে যাওয়া দরকার। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী তাত্ক্ষণিকভাবে বিনিয়োগের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারে বড় আকারের বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। চলতি বছর চার ব্যাংক মিলে পুঁজিবাজারে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে। তবে মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা এবং তারল্য প্রবাহের ওপর এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে। জানা গেছে, শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সবগুলো রাষ্ট্রীয় ব্যাংকই নিজেদের মতো করে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক বিনিয়োগ করতে পারবে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংক বিনিয়োগ করতে পারবে ২ হাজার কোটি এবং রূপালী ব্যাংকের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলো মুনাফার অংশ বিনিয়োগ করতে পারছে না : ২০১০ সালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজার থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে মুনাফার এই অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মুনাফার টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ঘোষণা কার্যকর করতে পারছে না বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত মুনাফার অর্থ শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে লভ্যাংশ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও ওই টাকা পুঁজিবাজারে পুনঃবিনিয়োগের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী আমানতের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ নেই। ফলে পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত মুনাফা কোন প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ করা হবে—সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পুঁজিবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে নমনীয় নীতি অনুসরণ করতে বলা হলেও এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
ফোর্স সেলে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা : মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউস থেকে মার্জিন ঋণ নিয়ে শেয়ার কিনে বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছেন প্রায় ১২ লাখ বিনিয়োগকারী। ধারাবাহিক পতনের কারণে অধিকাংশ শেয়ারের মূল্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এ মুহূর্তে শেয়ার বিক্রি করলে বিনিয়োগকারীদের নিজস্ব মূলধনের প্রায় পুরোটা মার্জিন ঋণ পরিশোধ করতেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু শেয়ারের দর ব্যাপক হারে কমে যাওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান বাধ্যতামূলক বিক্রির (ফোর্স সেল) মাধ্যমে ঋণ আদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এরই মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অনেক গ্রাহকের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে বলেও জানা গেছে।
তবে মার্চেন্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা ফোর্স সেলের বিষয়টি অস্বীকার করছেন। তারা কোনো ফোর্স সেল করছেন না বলে জানান। একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা কোনো ধরনের ফোর্স সেল করছি না। এ ধরনের কোনো অভিযোগ কেউ করতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো তাদের মূলধনের বড় অংশই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক দরপতনের কারণে তারা এখন বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তারপরও বাজারের স্বার্থে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করছে। তিনি আরও জানান, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো তাদের মূলধনের মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নিজস্ব পোর্ট ফলিওতে বিনিয়োগ করে থাকে। বাকি ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে থাকে। ফলে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়ানোর খুব একটা সুযোগ নেই। বাজারে তারল্যপ্রবাহ বাড়াতে হলে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যাংকগুলো যদি বিনিয়োগে এগিয়ে আসে, তাহলে বাজারের তারল্য সঙ্কট কাটবে। তিনি আরও বলেন, বাজারে তারল্য সঙ্কটের চেয়ে বড় হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট। প্রতিদিনই শেয়ারের দর কমতে থাকলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট না হওয়ার কোনো কারণও থাকে না। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দেয়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আস্থা সঙ্কট তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাজার বিশেষজ্ঞদের অভিমত : বাজারে দরপতনের বিষয়ে এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা ভালো-মন্দ সব শেয়ারই ছেড়ে দিচ্ছেন। এতে তারা অপরিপকস্ফতার পরিচয় দিচ্ছেন। তাদের উচিত যেগুলো ভালো শেয়ার, মৌলভিত্তির দিক থেকে ভালো—সেসব শেয়ার ধরে রাখা। বাজারে এখন অনেক কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ানুকূল অবস্থায় রয়েছে। এসব কোম্পানির শেয়ার কেনার জন্য বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ খান বলেন, বাজারে যেভাবে দরপতন হচ্ছে, এটি অব্যাহত থাকলে অনেক বিনিয়োগকারী বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়ে বাজার থেকে শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে যাবেন। আর যদি এ অবস্থা থেকে বাজারকে উত্তরণে পদক্ষেপ নেয়ার চিন্তা-ভাবনা করা না হয়, তাহলে সরকারকে বড় ধরনের ফান্ড নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সামান্য কয়েকশ’ কোটি টাকা দিয়ে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না বরং যে টাকা দেয়া হবে—তা কোনো কাজে লাগবে না। তিনি বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বাজারকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল জোগান দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন। তিনি বলেন, এ ফান্ড দিয়ে মৌলভিত্তিসম্পন্ন এবং ১৫-এর নিচে ‘মূল্য—আয় অনুপাতের’ (পিই রেশিও) কোম্পানির শেয়ার কিনলে বাজারে চাহিদা তৈরি হবে। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। পরে এ ফান্ডটিকে মিউচুয়াল ফান্ডে রূপান্তরিত করলে সরকারও লাভবান হবে এবং বাজারের স্থিতিশীলতাও ফিরে আসবে।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রেসিডেন্ট ফখর উদ্দিন আলী আহমদ বলেন, বাজার এখন খুবই দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা খুব সামান্য পরিমাণে শেয়ার কিনছে। বাজারে বিক্রেতা বেশি কিন্তু ক্রেতা কম। বিক্রেতা বেশি থাকার কারণে শেয়ারের দর কমছে। তিনি বাজারে তীব্র তারল্য সঙ্কট রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, তারল্য সঙ্কটের কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে। তারল্য সঙ্কট কাটাতে পারলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা স্বাভাবিকভাবেই ফিরে আসবে

No comments:

Post a Comment