Monday 5 December 2011

সুপ্রিমকোর্ট বার সভাপতির অফিসে তুলকালাম : ভাসানী জিয়া ওসমানীর ছবি নামিয়ে ভাংচুর আওয়ামী আইনজীবীদের


স্টাফ রিপোর্টার

ছবি টাঙানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পুলিশ পাহারায় সুপ্রিমকোর্ট বার সমিতির সভাপতির কক্ষের দরজা ভেঙে হামলা চালিয়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছবি ভাংচুর করেছেন সরকারদলীয় আইনজীবীরা। এ সময় বাধা দিতে গেলে বিএনপি সমর্থক দুই আইনজীবীর ওপর হামলা চালিয়ে আহত করা হয়েছে। হামলাকারীরা সভাপতির কক্ষে ভাংচুর চালান। এতে দরজা-জানালাসহ কক্ষের বিভিন্ন আসবাবপত্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তছনছ করা হয় কক্ষের বিভিন্ন জিনিসপত্র। এ সময় হামলাকারীরা সুপ্রিমকোর্ট বার সভাপতিসহ বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের খুঁজতে থাকেন এবং অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। প্রায় আধাঘণ্টাব্যাপী তাণ্ডবে পুরো সুপ্রিমকোর্ট এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ তাণ্ডবে অংশ নেয়া আইনজীবীদের বেশিরভাগই ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। ভাংচুর সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, কারা ভাংচুর করেছে আমি জানি না। তবে সমিতির সভাপতির দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। সভাপতির এমন কিছু করা উচিত হবে না যাতে উত্তেজনা তৈরি হয়। অন্যদিকে আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট এবিএম রফিকুল হক তালুকদার রাজা বলেন, সরকার সমর্থক আইনজীবীরা সভাপতির কক্ষ তছনছ করেছেন। সভাপতি-সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ঘটনার জন্য আওয়ামী সমর্থক আইনজীবী এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের কিছু কর্মকর্তাকে দায়ী করে এর শাস্তি দাবি করেন সাধারণ আইনজীবীরা। তবে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় ও সুপ্রিমকোর্ট ইউনিটের কোনো নেতাকে তখন দেখা যায়নি এবং প্রতিক্রিয়া নেয়ার জন্যও কাউকে পাওয়া যায়নি।
গতকাল পৌনে ১টার দিকে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে সভাপতির কক্ষে স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও জেনারেল ওসমানীর ছবি টাঙানো হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির বিপরীত পাশে টাঙানো হয় এ তিন নেতার ছবি। এ সময় আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি গত ১৭ নভেম্বর সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত নেয় স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা রাখায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও জেনারেল এমএজি ওসমানীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের ছবি সভাপতি-সম্পাদকের কক্ষে টাঙানো হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ছবি টাঙিয়েছি।
ছবি টাঙানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বেলা পৌনে ২টার দিকে সভাপতির কক্ষের সামনে একদল আওয়ামী সমর্থক আইনজীবী উপস্থিত হন। একে একে সেখানে হাজির হন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু, একরামুল হক টুটুল, মনিরুজ্জামান রুবেল, মো. সেলিম, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এমএ কামরুল হাসান খান আসলামসহ প্রায় ২৫ জন আইন কর্মকর্তা। আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। তখন বিএনপি সমর্থক একদল আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের অফিসের সামনে হরতালের পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন। অন্যদিকে সভাপতির অফিসের সামনে থাকা আওয়ামী সমর্থক আইনজীবীরা হরতালবিরোধী পাল্টা স্লোগান দেন। প্রায় ১৫ মিনিটব্যাপী মিছিল পাল্টা মিছিলের একপর্যায়ে আওয়ামী সমর্থক আইনজীবীরা সভাপতির কক্ষে জোর করে ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু দরজা তালাবদ্ধ থাকায় তারা ঢুকতে পারছিলেন না। আওয়ামী সমর্থক আইনজীবীদের একজন পাশে থাকা পুলিশের এক কর্মকর্তাকে বলেন, আপনি এখন এসেছেন, ওসিকে বলেছিলাম এখানে ফোর্স নিয়ে আরও আগে আসতে। তিনি দেরি করলেন কেন? সব কয়টারে বুঝাবো এবার। পুলিশ কর্মকর্তা জবাবে বলেন, আমরা আছি। আপনার উত্তেজিত হওয়ার দরকার নেই। আইনজীবী বলেন, আমরা সভাপতির কক্ষ থেকে জিয়ার ছবি নামাব, এখানে থাইকেন। পরে ওই আইনজীবী একদল পুলিশ সঙ্গে নিয়ে সভাপতির কক্ষের পেছনের দরজার দিকে যান। সমিতির সভাপতি তখন কক্ষে ছিলেন না। সমিতির সহ-সভাপতি জগলুল হায়দার আফ্রিক এ সময় সরকারি আইনজীবীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। সামনের দিকের দরজা ভাঙতে ব্যর্থ হয়ে তারা কক্ষের পেছনের দিকের দরজায় যান। পেছনের দরজা ভেঙে তারা সভাপতির কক্ষে প্রবেশ করেন। আওয়ামী আইনজীবীরা দরজা ভেঙে সভাপতির কক্ষে প্রবেশ করেই অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়ে জিয়াউর রহমানসহ তিন নেতার ছবি নামিয়ে আনেন। এ সময় মাসুদ রানা ও মানিকসহ কয়েকজন বিএনপি সমর্থক আইনজীবী বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে তাদের কিল-ঘুষি মারেন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা। স্টিলের মই দিয়েও তাদের পেটানো হয়। সেখানে বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতিতেই তাদের ওপর চলে কিল-ঘুষিসহ মারধর। পুলিশ আওয়ামী আইনজীবীদের সহায়তায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। বিএনপির স্বল্পসংখ্যক আইনজীবী সেখানে টিকতে না পেরে সমিতির দক্ষিণ হলে গিয়ে অবস্থান নেন।
বেলা পৌনে ৩টায় সুপ্রিমকোর্টের দক্ষিণ হলে তাত্ক্ষণিক এক প্রতিবাদ সভায় সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট এবিএম রফিকুল হক তালুকদার বলেন, সরকার সমর্থক আইনজীবীরা সভাপতির কক্ষ তছনছ করেছেন। সভাপতি-সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ঘটনার জন্য আওয়ামী সমর্থক আইনজীবী এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের কিছু কর্মকর্তাকে দায়ী করে এর শাস্তি দাবি করা হয়। প্রতিবাদ সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন অ্যাডভোকেট আবদুস শহিদ, অ্যাডভোকেট আইয়ুব আলী, ড. আরিফা জেসমিন, অ্যাডভোকেট পারভীন জেসমিন প্রমুখ। তখন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সিনিয়র কোনো নেতাকে দেখা যায়নি। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতা হিসেবে যারা সুপ্রিমকোর্ট অঙ্গনে নিজেদের দাবি করেন, তারা কেউ তখন উপস্থিত ছিলেন না। বরং যারা পেছনের সারিতে থাকেন, তাদেরই প্রতিবাদ ও সমাবেশ করতে দেখা গেছে।
অপরদিকে সমিতির উত্তর হলে সভা করেন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা। জগলুল হায়দার আফ্রিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি নুরুল ইসলাম সুজন, মোতাহার হোসেন সাজু, আসলামসহ আরও অনেকে। সভায় মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, প্রতিবাদের জন্যই আমরা বিচ্ছিন্ন আইনজীবীদের একত্র করেছি। তারা সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতিতে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়ে ইস্যু তৈরি করতে চান। ভবিষ্যতে এ ছবি টাঙানো হলে হাত ভেঙে দেয়া হবে। নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, সুপ্রিমকোর্টের একটি ঐতিহ্য আছে। আইনজীবীরা রাজপথের পাশাপাশি সুপ্রিমকোর্টেও তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। সভাপতি-সম্পাদক রাজনৈতিক চিন্তা থেকেই তাদের কক্ষে এসব ছবি টাঙিয়েছেন। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীর ছবি সুপ্রিমকোর্টে টাঙাতে দেয়া হবে না। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের আরও বলেন, সাধারণ আইনজীবীরা শুরু থেকেই ছবি টাঙানোর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ছবি টাঙানো হয়েছে। ভাংচুর ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত কি-না জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখবে। অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে আমারও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সমিতি ভবনে কী হয়েছে তা দেখার দায়িত্ব আমার নয়। তবে আইনজীবী সমিতির সভাপতি বারকে বিভক্ত করেছেন। এমনকি তিনি যুদ্ধাপরাধীদেরও পক্ষাবলম্বন করছেন।
গত ১৭ নভেম্বর সমিতির এক সাধারণ সভায় সভাপতি ও সম্পাদকের কক্ষে ভাসানী, ওসমানী ও জিয়ার ছবি টাঙানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা এর আগেও কয়েকদফা বিক্ষোভ করেছিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তখন বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর পাশে আর কারও ছবি টাঙানো হবে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অন্যদিকে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, সংবিধানের কোথায়ও এ ধরনের কথা লেখা নেই।
গতকাল রাতে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমার দেশ-কে জানান, এ ন্যক্কারজনক ঘটনা আওয়ামী লীগেরই মানায়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছবিকে অবমাননা করা মানে দেশের স্বাধীনতাকে অবমাননা করা। তিনি বলেন, আজ বেলা সোয়া ১টায় সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাবে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি।

No comments:

Post a Comment