Wednesday 21 December 2011

সরকারের একগুঁয়েমিতে সহিংসতার পথে রাজনীতি : ঢাকায় বিএনপির ১২০ জন রিমান্ডে, সারাদেশে দুই ডজন মামলা













মাহাবুবুর রহমান
রাজনীতি আবারও সহিংস হয়ে উঠেছে। বিরোধী দলের কর্মসূচিতে অব্যাহত বাধা, গণগ্রেফতার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়িতে সারাদেশে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সর্বাত্মক আক্রমণে র্যাব-পুলিশ ও মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে সরকার। রাজপথে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে কোনো কর্মসূচিই নির্বিঘ্নে করতে দেয়া হচ্ছে না। কর্মসূচিতে চলছে অব্যাহত বাধা ও হামলা। রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করতে চলছে মামলা, গ্রেফতার ও নির্যাতন। পুরনো ঘটনায় সারাদেশে ২৬ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার পর এবার রোববারের সহিংসতায় প্রায় দু’ডজন মামলায় কমপক্ষে ১৫ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। গণগ্রেফতারে পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে পুলিশ-র্যাব ও সরকারি দল রাজপথ দখলে রাখছে। বিএনপিকে রাজপথে নামতে দেয়া হচ্ছে না। চলছে চোরাগোপ্তা হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ। রাজপথে বিস্ফোরিত হচ্ছে বোমা ও ককটেল। বিএনপির কর্মসূচি ঠেকাতে সরকারের তত্পরতায় গত দু’দিন রাজধানীতে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়। হরতালের মতোই র্যাব-পুলিশ ও সরকারি দলের নেতাকর্মীরা ছিল সক্রিয়। বিএনপি অফিসে ব্যারিকেড দিয়ে অঘোষিত ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ। নেতাকর্মীদের প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। কোথাও মিছিল করতে দেয়া হচ্ছে না। পুলিশ-র্যাবের ঘেরাওয়ের মধ্যে গতকাল নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে দলটি। সমাবেশ থেকে আগামীকাল ঢাকায় গণমিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। পুলিশ-র্যাবের তত্পরতার মধ্যেই নয়াপল্টন এলাকায় চারটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। ভীতিকর পরিস্থিতিতে কর্মব্যস্ত মানুষ রাস্তায় বেরুলেও সবার মধ্যে ছিল আতঙ্ক। যানজটের ঢাকার অধিকাংশ সড়ক ছিল ফাঁকা।
রোববার মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনাকে ঘিরে সংঘটিত সহিংসতায় জরুরি আইনে চারটিসহ ঢাকায় ১২টি মামলা করা হয়েছে। এতে বিএনপির সাংগঠনিক শক্তির ভিত্তি হিসেবে পরিচিত বেশকিছু নেতাসহ ১০ হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় গ্রেফতার ১২০ জনকে তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এছাড়া সিলেটে সাত মামলায় দেড় হাজার এবং রাজশাহীতে দু্রত বিচার আইনের এক মামলায় ৪০ জনকে আসামি করা হয়েছে। রাজশাহীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ৬ জনকে দণ্ড দেয়া হয়েছে।
রোববার রাত থেকে বিএনপি ও অঙ্গদলের নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় তল্লাশি চলছে। সারাদেশে পুলিশ বাহিনী ব্যস্ত রয়েছে বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার অভিযানে। বিএনপি নেতাকর্মীরা বাড়ি ছেড়ে আত্মীয়স্বজন ও অজ্ঞাত স্থানে থাকছেন। অনেকে মোবাইল বন্ধ করে বিকল্প সিম ব্যবহার করছেন। ঢাকায় আত্মীয়-স্বজনের বাসা থেকেই নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন কর্মীরা। চট্টগ্রামে মামলা ও গ্রেফতার অভিযান না চললেও সরকারি নিপীড়নের বিরুদ্ধে গত দু’দিন রাজপথে ছিলেন নেতাকর্মীরা। তারা দু’দিন অব্যাহত প্রতিবাদ সমাবেশে করেছেন নগরীতে। রাজশাহী মহানগর যুবদল সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে গ্রেফতার করার প্রতিবাদে গতকাল থানা ঘেরাও করেন নেতাকর্মীরা। এসময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। পুলিশের লাঠিচার্জে ২০ নেতাকর্মী আহত হন। ১২ জনকে আটক করা হয়। সিলেটে গত রোববার এক বাসযাত্রীর মৃত্যুসহ বিক্ষিপ্ত সহিংসতার ঘটনায় চার থানায় সাতটি মামলা করেছে পুলিশ। এতে বিএনপি ও ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ ১২০ নেতাকর্মীসহ দেড় সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া গতকাল দেশের বিভিন্ন জেলা ও থানা শহরে সহিংসতার অভিযোগে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
গত রোববার বিএনপি আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পুলিশের বাধাকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারাদেশে সহিংসতায় দু’জন মারা যান। অনুষ্ঠানটি বাধাগ্রস্ত করতে পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে বিএনপির মিছিল জমায়েতে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের ক্যাডারবাহিনী। এতে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘাতে ঢাকা নগরীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সারাদেশে বিক্ষোভ ও গাড়িভাংচুর করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনায় বাধা ও নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে বিএনপি গতকাল দেশব্যাপী প্রতিবাদ মিছিল কর্মসূচি ঘোষণা করে। পূর্বঘোষিত বিজয় শোভাযাত্রার কর্মসূচিকে প্রতিবাদ সমাবেশ হিসেবে ঘোষণা দেয় দলটি। সে অনুযায়ী দেশে কয়েকটি জেলা শহরে প্রতিবাদ মিছিল বের হলেও ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ নগরী ও জেলায় পুলিশ বিএনপি-নেতাকর্মীদের রাস্তায়ই নামতে দেয়নি।
নয়াপল্টনের আশপাশ এলাকায় হরতালের আবহ : কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তিন স্তরের পুলিশি বেষ্টনী ও র্যাবের মহড়ায় গতকাল পূর্বঘোষিত বিজয় শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ মিছিল করতে পারেনি বিএনপি। দলটির কর্মসূচি ঠেকাতে পুলিশ-র্যাবের তত্পরতায় হরতালের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নয়াপল্টন, কাকরাইল, বিজয়নগর, পুরানাপল্টন ও ফকিরাপুল এলাকায় র্যাব-৩-এর দশটি গাড়ির সারিবদ্ধ মহড়ায় দুপুর ১২টা থেকেই আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পৌনে ১২টায় নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে মাইক স্থাপন করলে তাও পুলিশ কেড়ে নেয়। ১টায় বিএনপি কার্যালয় ঘিরে ফেলে পুলিশ। এ সময় রায়টকার, সাঁজোয়া যান, পানির গাড়িসহ বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও র্যাব সদস্য বিএনপি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। নাইটিঙ্গেল মোড়, ফকিরাপুল মোড় এবং নয়াপল্টনের রাস্তার প্রতিটি গলির মুখে পুলিশি প্রহরা ও তল্লাশি বসানো হয়। অনেক সাংবাদিককে পরিচয়পত্র দেখানোর পর ঢুকতে দেয়া হয়। পুলিশি তল্লাশিতে পথচারী নারী-পুরুষরা হয়রানির শিকার হন।
এদিকে বেলা সাড়ে ১১টা থেকেই বিএনপি ও অঙ্গদলের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসতে থাকেন। বিক্ষিপ্তভাবে হাতেগোনা কিছু নেতাকর্মী ১২টার মধ্যে কার্যালয়ে প্রবেশ করলেও ১টার পর কাউকে আশপাশে ভিড়তে দেয়নি পুলিশ। জাতীয় প্রেস ক্লাব, নয়াপল্টন, কাকরাইল, শান্তিনগর ও ফকিরাপুলের বিভিন্ন ভবনে বিএনপি নেতাকর্মীরা অবস্থান নিলেও পুলিশ-র্যাবের মহড়ায় তারা বেরুতে পারেননি। পল্টন থানার দুই সাব ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে পুলিশের দুটি দল ঘুরে ঘুরে আশপাশে ভিড় করা মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
পুলিশ বেষ্টনী পেরিয়ে ১২টার দিকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক কার্যালয়ে আসেন। নেতাকর্মীদের উপস্থিতি কম থাকায় নির্ধারিত সময় বেলা আড়াইটায় মিছিল বের করার চেষ্টাও করেনি বিএনপি। বেলা ২টা ৩৫ মিনিটে সাবেক এমপি শাহীনা খান ও রহিমা খন্দকারসহ চারজন মহিলা কর্মী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করেন। পুলিশ আটকে দিলে শাহীনা খান বলেন, ‘আমাদের অফিসে আমরা ঢুকব। আপনারা আটকাচ্ছেন কেন?’ পুলিশ নিশ্চুপ থাকলে তিনি জানতে চান, ‘আপনারা কী ১৪৪ ধারা জারি করেছেন?’ তখন একজন কনস্টেবল বলেন, ‘উপরের নির্দেশ আছে’। পুলিশের সঙ্গে বচসা চলতে থাকলে পৌনে ৩টায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা ও ছাত্রদল নেত্রী সেলিনা সুলতানা নিশিতার নেতৃত্বে ২০/২৫ জন মহিলা কর্মী জড়ো হন। তারা দলীয় কার্যালয়ের গেটে পুলিশ ব্যারিকেডকে ঘিরেই দাঁড়িয়ে থাকেন। ২টা ৫০ মিনিটে পল্টন থানার ওসির নির্দেশে তাদের কার্যালয়ের ভেতরে ঢোকার সুযোগ দেয়া হয়। বেলা ৩টার দিকে হোটেল ’৭১-এর সামনে হঠাত্ দু’টি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। কে বা কারা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তা কেউ বলতে পারেনি।
পুলিশি বেরিকেড সম্পর্কে এডিসি মোল্লা জাহাঙ্গীরের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘রোববার ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তারা সহিংসতা চালিয়েছে। এজন্য তাদের বিক্ষোভ মিছিলের অনুমতি নেই। একসঙ্গে বেশি লোক জড়ো হলে সহিংসতা ঘটাতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ডিএমপি কমিশনারের মৌখিক অনুমতির ভিত্তিতে স্বল্প পরিসরে সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে।’
ঢাকায় ১২ মামলায় আসামি দশ হাজার : রাজধানীতে বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের কাজে বাধা, অগ্নিসংযোগ ও বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগে ১২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে চারটি মামলা রয়েছে দ্রুত বিচার আইনে। এসব মামলায় বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতাসহ অজ্ঞাতনামা ১০ সহাস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এতে ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব আব্দুস সালাম, যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নিরব, সিনিয়র সহসভাপতি আবদুস সালাম আজাদ, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল, সাধারণ সম্পাদক সরাফতুল্লাহ সফু ও ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলিম, যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুল হক রয়েলসহ বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি হিসেবে পরিচিত অনেক নেতাকর্মীর নাম রয়েছে।
বিভিন্ন থানায় গ্রেফতার হওয়া ১২০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল ১৬ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। শাহবাগ, রমনা, পল্টন, মতিঝিল, তেজগাঁও এবং বাড্ডা থানায় দায়েরকৃত মামলাগুলোর ৯টির বাদী পুলিশ। অন্যদিকে বোমা বিস্ফোরণে নিহত আরিফুজ্জামান আরিফের পিতা জয়নাল আবেদিন বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
আমাদের সিলেট অফিস জানায়, সিলেটে রোববারের সহিংস ঘটনায় চার থানায় ৭টি মামলা করা হয়েছে। এতে দেড় হাজারের বেশি লোককে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে বিএনপি ও ছাত্রদলের ১২০ জনের মতো নেতাকর্মীর নাম রয়েছে। পুলিশকে লাঞ্ছিত করার মামলায় তিনশ’ থেকে চারশ’ জনকে আসামি করা হয়েছে।
দক্ষিণ সুরমায় বাসযাত্রী পুড়ে মরার ঘটনায় একটি হত্যা মামলা, বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় একটি এবং পুলিশকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে একটি মামলা করা হয়েছে। তবে পুলিশ মামলার আসামিদের গতকাল পর্যন্ত নাম প্রকাশ করেনি। ইকবাল, আফজাল হোসেন, নিজাম ও সাব্বিরকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। শাহপরান থানায় যানবাহন ভাংচুরের ঘটনায় ছাত্রদল নেতা দিনারসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত আরও ১১-১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। জালালাবাদ থানায় ছাত্রদল নেতা কাজী মেরাজ, মাহবুব চৌধুরীসহ ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে গাড়ি ভাংচুর মামলার আসামি করা হয়েছে।
কোতোয়ালি থানায় ২টি পুলিশ এসল্ট মামলা করা হলেও পুলিশ অভিযুক্তদের নাম জানাতে পারেনি।
দক্ষিণ সুরমার চণ্ডিপুল এলাকায় সিলেট থেকে হবিগঞ্জগামী একটি যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১ জন বাসযাত্রী পুড়ে মারা যান। এছাড়া নগরীর সোবাহানিঘাট, মেন্দিবাগ, কুমারপাড়া ও সুবিদবাজার, চৌহাট্টা ও পাঠানটুলা এলাকায় আরও ১৫-২০টি গাড়ি ভাংচুরের ঘটনা ঘটে
রাজশাহী অফিস জানায়, গতকাল রাজশাহী মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে গ্রেফতার করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নগরীতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিএনপি কর্মীরা থানা ঘেরাও করলে পুলিশ আরও ১১ জনকে গ্রেফতার করে।
সকাল সোয়া ১০টায় মহানগর বিএনপি কার্যালয়ের সামনে থেকে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে আটক করে পুলিশ। পরে তার মুক্তির দাবিতে দুপুরে নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার সামনে বিক্ষোভ করায় আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটানোর অভিযোগে পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। এ সময় মহিলাকর্মীসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে। সেখান থেকে ৬ নেতাকর্মীকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে অর্থদণ্ড দেয়া হয়। এ ঘটনায় নগরজুড়ে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। বিভিন্ন পয়েন্টে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
খুলনা অফিস জানায়, রোববার গভীররাতে নগরীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিএনপি নেতা সাবেক কাউন্সিলর হাসিবুল হক বাবলা, জামায়াতের নায়েবে আমির মাস্টার শফিকুল আলম, জেলা কৃষক দল সভাপতি নুরুল হুদা খান বাবুসহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। এছাড়া আরও শতাধিক নেতাকর্মীর বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা রাতভর অভিযান চালায়।
বিকালে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশে বিএনপি নেতারা বলেন, বিজয়ের এ মহান মাসে মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্ট দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকার ঢাকায় সারাদেশ থেকে সংবর্ধনায় যোগ দিতে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের লাঠিপেটা করেছে। ন্যক্কারজনক এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে যুবদল নেতা নিহত হয়েছেন। আহত ও গ্রেফতার হয়েছেন সহস্রাধিক। এ ঘটনায় মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে দলীয় নেতাকর্মীদের।
মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু এমপির সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন মনিরুজ্জামান মনি, শফিকুল আলম মনা, সাহারুজ্জামান মোর্ত্তজা, কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম, সৈয়দা নার্গিস আলী, এসএম মোর্শেদ আলম, শেখ মোশারফ হোসেন, মীর কায়সেদ আলী প্রমুখ।
এদিকে রোববার রাতে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া বিএনপির নেতাকর্মীরা হলেন ২৩নং ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুল হক বাবলা, সাধারণ সম্পাদক নাসির খান, জেলা কৃষক দল সভাপতি নুরুল হুদা খান বাবু, খালিশপুর থানার ৯নং ওয়ার্ড কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আবদুর রউফ, ১২নং ওয়ার্ড কমিটির সহ-সভাপতি মো. জামালউদ্দিন, সোনাডাঙ্গা থানার ১৮নং ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি হাফিজুর রহমান মনি, মাসুদ হোসেন ও মো. মনিরুজ্জামান। তবে গতকাল সোমবার বিকালে তাদের আদালতে পাঠানো হলে প্রত্যেকে জামিন লাভ করেন। জামিন লাভের পর সন্ধ্যায় দলীয় কার্যালয়ে এলে তাদের সংবর্ধনা দেয়া হয়। তাদের পক্ষে আদালতে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট মাসুদ হোসেন রনি, অ্যাডভোকেট গোলাম মাওলা, অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান খান, অ্যাডভোকেট একেএম শহিদুল আলম, অ্যাডভোকেট তৌহিদুর রহমান চৌধুরী তুষার, অ্যাডভোকেট মহসিন মোল্লা প্রমুখ।
এছাড়া পুলিশ জামায়াত ও শিবিরের যেসব নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে তারা হলেন নগরীর দিলখোলা রোডের একটি মেস থেকে ছাত্রশিবিরের কমার্স কলেজ সেক্রেটারি ইমরান হোসেন, সিদ্দিকুর রহমান, রাজা আহমেদ, আলমগীর হোসেন ও আসাদুজ্জামান, খালিশপুর থানা এলাকা থেকে মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমির মাস্টার শফিকুল আলম ও মো. আলাউদ্দিন, দৌলতপুর থানা এলাকা থেকে শিবির নেতা আবুল বাশার, রিয়াজুল ইসলাম, আকবর হোসেন, আবদুল্লাহ মনি, সোহাগ হোসেন, ফারুক হাসান মামুন, রোহানুল আলম, শফিকুল ইসলাম নয়ন ও মো. আল আমিনকে গ্রেফতার করে এবং খানজাহান আলী থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে জামায়াত নেতা নাসিরউদ্দিন গাজী, এসএম কামাল ও ওলিয়ার রহমানকে গ্রেফতার করে।
বরিশাল অফিস জানায়, রোববার ঢাকাসহ সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশ ও সরকারি দলের হামলার প্রতিবাদে জেলা ও মহানগর বিএনপির উদ্যোগে নগরীর অশ্বিনী কুমার টাউন হল প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান শাহীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বিএনপি নেতারা বক্তৃতা করেন।
রংপুর প্রতিনিধি জানায়, পুলিশি বেষ্টনীতে গতকাল দিনব্যাপী রংপুর জেলা বিএনপির কার্যালয় ঘেরাও ছিল। পরে বিকাল সাড়ে ৪টায় নগরীর গ্রান্ড হোটেল মোড়ের দলীয় কার্যালয় থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে জাহাজ কোম্পানির দিকে আসতে থাকলে পুলিশ সালেক পাম্পের সামনে বেরিকেড দিয়ে বাধা দেয়। পুলিশের বাধায় নেতাকর্মীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায়। সেখানেই প্রতিবাদ সমাবেশ করে জেলা বিএনপির নেতারা। এ সময় বক্তব্য রাখেন রংপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু, শহিদুল ইসলাম মিজু, মামুনুর রশিদ মামুন, সুলতান আলম বুলবুল প্রমুখ।
যশোর অফিস জানায়, সোমবার সকালে যশোর শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে জেলা বিএনপি। সকাল থেকেই বিপুলসংখ্যক পুলিশ জেলা বিএনপির কার্যালয় ঘিরে রাখে। তবে পুলিশ অ্যাকশনে যায়নি।
সকাল ১১টার মধ্যে জেলা বিএনপি কার্যালয়ে উপস্থিত হয় দলটির নেতাকর্মীরা। এসময় সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল হুদার সভাপতিত্বে এতে বক্তৃতা করেন সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইসহাক, দেলোয়ার হোসেন খোকন প্রমুখ। সভা শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে দলীয় কার্যালয়ে এসে শেষ হয়।
আমাদের উজিরপুর প্রতিনিধি জানায়, গতকাল বাসায় তল্লাশি চালিয়ে উজিরপুর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি সাহাবুদ্দিন আকন, ছাত্রদল নেতা সবুর হাওলাদার, এনামুল মীর্জা ও লাবিদ হাওলাদারকে পুলিশ গ্রেফতার করে।

No comments:

Post a Comment