Tuesday 26 April 2011

লাঠিচার্জে আহত শতাধিক বায়তুল মোকাররম রণক্ষেত্র : পুলিশ-জামায়াত সংঘর্ষ, টিয়ারশেল গুলি ও














স্টাফ রিপোর্টার
মারমুখী পুলিশের অতর্কিত হামলা, বেধড়ক লাঠিচার্জ, বৃষ্টির মতো রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপে গতকাল বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ-মিছিল পণ্ড করতে পুলিশ এ হামলা চালায়। বেপরোয়া পুলিশের নির্মম নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি বায়তুল মোকাররমে নামাজে আসা মুসল্লি ও সাধারণ মানুষ। বুট পায়ে পুলিশ উত্তর গেট দিয়ে মসজিদে ঢুকে মুসল্লিদের নির্বিচারে লাঠিপেটা করে। একই সঙ্গে মসজিদের ভেতরে রায়ট কার থেকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও পানিকামান থেকে রঙিন পানি নিক্ষেপ করা হয়। হামলার পর জামায়াত কর্মীরাও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় আশপাশের এলাকায় আতঙ্কিত মানুষ ছোটাছুটি শুরু করে। বন্ধ হয়ে যায় যানচলাচল ও দোকানপাট। এ ঘটনায় পথচারীসহ শতাধিক জামায়াত কর্মী আহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয় পথচারীসহ অর্ধশতাধিক জামায়াত-শিবির কর্মীকে। শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের নগ্ন হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এদিকে এ হামলার প্রতিবাদে আজ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবে সংগঠনটি।
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ শীর্ষ নেতাদের প্রতি অবিচার, নির্যাতন ও রিমান্ডে নেয়ার প্রতিবাদে এবং তাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল বিকাল সোয়া ৫টায় মুক্তাঙ্গনে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুপুর থেকেই মু্ক্তাঙ্গন, বায়তুল মোকাররম মসজিদসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সংখ্যক পুলিশ রণপ্রস্তুতি নিয়ে অবস্থান নেয়। পল্টন মোড়ে তিনটি পানিকামান, বিশেষ বাহন এপিসি, প্রিজনভ্যান, রায়ট কারসহ দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী আসরের নামাজের পর বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে জামায়াতের মহানগর সেক্রেটারি হামিদুর রহমান আযাদ এমপি, সহকারী সেক্রেটারি নূরুল ইসলাম বুলবুল ও মাওলানা আবদুল হালিমের নেতৃত্বে একটি মিছিল মু্ক্তাঙ্গনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে নেতাকর্মীদের বাকবিতণ্ডা হয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ শুরু করে ছত্রভঙ্গের চেষ্টা করে। তারপরও নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে পল্টন মোড়ের কাছে পৌঁছলে সামনে ও পেছন থেকে পুলিশ তাদের ঘেরাও এবং লাঠিচার্জ শুরু করে।
এ সময় বায়তুল মোকাররমের আশপাশে থাকা কয়েক হাজার জামায়াত কর্মী জড়ো হয়ে রাস্তা দখলে নিয়ে পুলিশকে ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে ব্যাপক সংঘর্ষ বেধে যায়। পুলিশ এ সময় কয়েকশ’ রাউন্ড টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে দৈনিক বাংলা থেকে পল্টন মোড় পর্যন্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। কাঁদানে গ্যাসের কারণে জামায়াত কর্মী ছাড়াও বাসযাত্রী ও পথচারীরা ছোটাছুটি শুরু করে। রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে মহিলাসহ অনেক মানুষ। আশপাশের বিভিন্ন মার্কেট ও বায়তুল মোকাররম মসজিদে আশ্রয় নেন অনেকে। পরে পুলিশ বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর পাশের সিঁড়িতে জুতাপায়ে উঠে মুসল্লিদের ধাওয়া করে এবং তাদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ও রঙিন পানি নিক্ষেপ করে। ফলে জামায়াত-শিবির কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মুসল্লিরাও মসজিদে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। মাগরিবের নামাজের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা বেরিয়ে যান। এ ঘটনায় পথচারী, হকারসহ শতাধিক জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী আহত হন। ভাংচুর হয় ৫-৬টি বাস ও প্রাইভেটকার। ফুটপাতের দোকানপাট লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ঘটনাস্থল ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায় সাধারণ মানুষসহ অর্ধশতাধিক জামায়াত কর্মীকে।
এদিকে প্রায় দু’ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষের পর জামায়াত কর্মীরা রাজপথ ছেড়ে পুরানাপল্টনের মহানগর অফিসের কাছে জড়ো হয়ে সমাবেশে মিলিত হন। এসময় সেখানেও পুলিশ হানা দিয়ে ব্যাপক টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিস ঘেরাও করে রাখে। পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে অফিস চত্বরে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর আমির রফিকুল ইসলাম খানের সভাপতিত্বে এবং সেক্রেটারি এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ এমপির পরিচালনায় সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অধ্যাপক তাসনীম আলম। উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা এটিএম মাসুম, মহানগরী সহকারী সেক্রেটারি নূরুল ইসলাম বুলবুল ও মাওলানা আবদুল হালিম প্রমুখ।
প্রতিবাদ সমাবেশে এটিএম আজহারুল ইসলাম বলেন, জামায়াতের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের হামলা প্রমাণ করে সরকারের পায়ের তলায় মাটি নেই। মূলত সরকার জনগণকে ভয় পায়। কারণ তারা দেশ পরিচালনায় সার্বিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আর নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার জন্যই বিরোধী দলের ওপর দলন-পীড়ন চালাচ্ছে। সরকার পুলিশ বাহিনীকে নিরস্ত্র জনতার ওপর লেলিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে প্রমাণ করেছে আওয়ামী লীগ একটি ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী দল। ইতিহাস সাক্ষী স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের পরিণাম কখনও ভালো হয় না। তাদের লজ্জাজনক পরিণতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, সরকার ক্ষমতার দম্ভে ও পেশিশক্তির জোরে জনগণের আন্দোলন ঠেকানোর অপচেষ্টা করছে। কিন্তু এসব করে জনতার আন্দোলন ঠেকানো যায় না। সরকার জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে রিমান্ডের নামে অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে। তারা আবারও দলীয় প্রসিকিউশনের মাধ্যমে শীর্ষ নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করার জন্য রিমান্ড চেয়েছে। কিন্তু কথিত রিমান্ডের নামে যদি শীর্ষ নেতাদের জীবনকে সঙ্কটাপন্ন করা হয় তাহলে সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য সরকারকেই দায়ী থাকতে হবে। তাদের কিছু হলে এদেশের মানুষ ঘরে বসে তামাশা দেখবে না। তারা সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তুলে সরকারের পতন ঘটিয়ে নেতাদের মুক্তি নিশ্চিত করবে। তিনি বলেন, দেশ পরিচালনায় সরকারের উপর্যুপরি ব্যর্থতা ও জনদুর্ভোগ অবসানের জন্য আন্দোলন শুরু করেছি। জনগণের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। কিন্তু সরকার যদি মনে করে জুলুম-নির্যাতন ও পুলিশ দিয়ে জনগণের এ আন্দোলন বন্ধ করবে তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। মূলত জুলুম-নির্যাতন তাদের পতনকে ত্বরান্বিত করবে।
অধ্যাপক তাসনীম আলম বলেন, সরকার জনতার ওপর পুলিশ লেলিয়ে জনগণের আন্দোলনকে নস্যাত্ করতে চায়। তারা বিনা উস্কানিতে জামায়াতের বিক্ষোভ মিছিলে হামলা চালিয়ে প্রমাণ করেছে, তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, বরং তারা গণতন্ত্রবিরোধী ফ্যাসিবাদী। তাই এই ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে ব্যর্থ সরকারের পতন ঘটিয়ে জনগণের সরকার কায়েম করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে রফিকুল ইসলাম খান বলেন, সরকার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ দিয়ে হামলা চালিয়ে প্রমাণ করেছে, তারা গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাস করে না বরং তারা এখনও একদলীয় বাকশালে বিশ্বাস করে। তাই দেশের মানুষ গণতন্ত্রবিরোধী এই সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তিনি সরকারের পতনের লক্ষ্যে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। প্রসঙ্গত, প্রধান অতিথির বক্তব্য চলাকালে পুলিশ অতর্কিতভাবে সিটি অফিস চত্বরে সমাবেশে হামলা চালায় এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। কিন্তু জনতার উপর্যুপরি প্রতিরোধের মুখে পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়। মাগরিবের নামাজ চলাকালে পুলিশ মুসল্লিদের ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করলেও জনতার প্রতিরোধে তাও ব্যর্থ হয়। এদিকে গতকাল জামায়াতের মিছিলে হামলার ঘটনায় আজ দলের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলন করা হবে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে

No comments:

Post a Comment