Tuesday 26 April 2011

নির্বাহী কমিটির সভায় খালেদা জিয়া : মধ্যবর্তী নির্বাচনে সরকারকে বাধ্য করতে আন্দোলনের ঘোষণা














বাছির জামাল ও মাহাবুবুর রহমান

মধ্যবর্তী নির্বাচনে সরকারকে বাধ্য করতে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী এ সরকারকে আর ক্ষমতায় রাখা যাবে না। সরকারকে হঠাতে লংমার্চ, রোডমার্চ এবং জেলায় জেলায় গণমিছিলসহ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়ার কথা তিনি ঘোষণা করেন।
গতকাল রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে অনুষ্ঠিত দলের নির্বাহী কমিটির সমাপনী বক্তব্যে তিনি এ ঘোষণা দেন। এর আগে নির্বাহী কমিটির রুদ্ধদ্বার সভায় নির্বাহী কমিটির সম্পাদক, সদস্য ও জেলা সভাপতিসহ প্রায় অর্ধশতাধিক নেতার বক্তব্য শোনেন তিনি। নেতাদের বক্তব্যের পর রাত পৌনে ৯টার দিকে বেগম জিয়া তার সমাপনী বক্তব্য শুরু করেন।
বেগম খালেদা জিয়া বলেন, মধ্যবর্তী নির্বাচন এখন জনগণের দাবি। এ নির্বাচন আদায়ে সরকারকে বাধ্য করা হবে। তিনি বলেন, নির্বাচনে কারচুপির কৌশল হিসেবেই সরকার ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি চালু করতে চাচ্ছে। এ পদ্ধতি আমরা মানি না। বিএনপি ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি করতে দেবে না। সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলে টালবাহানা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ পদ্ধতি অবশ্যই বহাল থাকতে হবে। তবে বর্তমান প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করার যে পরিকল্পনা নিয়েছে বিএনপি তা মেনে নেবে না। কারণ তিনি দলীয় লোক। নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে বেগম জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশন দলীয়করণ করার যে পরিকল্পনা নিয়েছে বিএনপি তা প্রতিরোধ করবে। দলের সাংগঠনিক অবস্থা সম্পর্কে বেগম জিয়া বলেন, বিএনপিতে এর কথায়, ওর কথায় কমিটি নয়। সবাইকে নিয়ে কমিটি করা হবে। পকেট কমিটি আর সহ্য করা হবে না। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আমি জেলায় জেলায় যাব। সংশ্লিষ্ট জেলা কমিটি কর্মসূচি আশানুরূপ পালন করতে না পারলে সেই জেলা কমিটি তাত্ক্ষণিকভাবে ভেঙে দেয়া হবে। তিনি দলে নতুন প্রজন্মকে গুরুত্ব দেয়ার কথাও উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে তিনি নির্বাহী কমিটিতে কারা সক্রিয় ও কারা নিষ্ক্রিয় তাদের তালিকা তৈরির জন্য ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে দায়িত্ব দিয়ে বলেন, এর আলোকে প্রয়োজনে নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠন করা হতে পারে।
নির্বাহী কমিটির সভায় উপস্থিত সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, খালেদা জিয়া দলকে শক্তিশালী করার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি নির্বাহী কমিটির নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সবক্ষেত্রেই ব্যর্থ। এজন্য তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জনগণ আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিতে তাদের ষড়যন্ত্র রুখতে হলে সংগঠনকে শক্তিশালী করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। কারণ জনগণের ভোটকে রক্ষা করতে হলে শক্তিশালী সংগঠন অবশ্যই প্রয়োজন।
খালেদা জিয়া এজন্য নিজেদের মধ্যে দলাদলি, চক্রান্ত, ল্যাংমারা ইত্যাদি বাদ দিয়ে এক হয়ে দলকে শক্তিশালী করায় মনোনিবেশ করতে নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি পৌর নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বলেন, আপনারাই বলেছেন, সংগঠন শক্তিশালী বলে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনায় দল ভালো করেছে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলে বরিশাল অঞ্চলে দল ভালো করতে পারেনি। প্রার্থীকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দলকে শক্তিহীন করলে কোনো লাভ হবে না।
২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির পঞ্চম কাউন্সিল অধিবেশনের পর ৩৮৬ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। ২০১০ সালের ৩১ জুলাই নতুন নির্বাহী কমিটির প্রথম সভা হয়। এটি হচ্ছে দ্বিতীয় সভা।
রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় নির্বাহী কমিটির এ সভা শুরু হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বেগম খালেদা জিয়া। প্রথমে উদ্বোধনী পর্ব হয়। এতে খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বক্তব্য রাখেন। এর আগে লন্ডনে চিকিত্সাধীন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বাণী পড়ে শোনানো হয়। বাণীটি পাঠ করেন বিরোধীদলীয় নেতার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল।
পরে দুপুর সাড়ে ১২টায় শুরু হয় রুদ্ধদ্বার সভা। মহানগর নাট্যমঞ্চ মিলনায়তনে নির্বাহী সভার মূল মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গনি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এমপি, তরিকুল ইসলাম, এম কে আনোয়ার এমপি, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার এমপি, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আসম হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
১৯ সদস্যের মধ্যে তারেক রহমান লন্ডনে চিকিত্সাধীন এবং সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কারাগারে থাকায় সভায় উপস্থিত হতে পারেননি। এছাড়াও এম. শামসুল ইসলাম, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান এবং গয়েশ্বর চন্দ্র রায় অনুপস্থিত ছিলেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান জানান, তিনি অসুস্থ। সবেমাত্র হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। এজন্য নির্বাহী কমিটির সভায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় এম. শামসুল ইসলাম ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। সভায় উপস্থিত ছিলেন নির্বাহী কমিটির ৩৮৬ জন সদস্য ছাড়াও সহ-সভাপতি, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টাসহ কাউন্সিলর ও ৭৪ জেলা কমিটির সভাপতিরা। কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে নির্বাহী সভার উদ্বোধনী পর্বের সূচনা হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন দলের প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক।
পরে দলের মহাসচিব মরহুম খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার লে. জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলী, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আলহাজ কমরউদ্দিন আহমেদ, সাবেক হুইপ জাহেদ আলী চৌধুরী, সাবেক কোষাধ্যক্ষ শাহ আলম, চট্টগ্রাম মহানগরের সিনিয়র সহ-সভাপতি দস্তগীর চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা কফিল উদ্দিন মাহমুদ, মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী, শিল্পী কলিম শরাফী, শাহ আবদুল করিম, সাহিত্যিক আবদুল মান্নান সৈয়দ, চিত্রপরিচালক শিবলী সাদিক, আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী ও লুত্ফুল হাই সাচ্চু, ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট কোরাজন একুইনো, হলিউডের অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেইলর, সাংবাদিক অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক পথিক সাহাসহ গত ৯ মাসে মারা যাওয়া দলীয় নেতাকর্মী, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে একটি শোকপ্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। শোক প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। পরে মরহুম নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়।
বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া নির্বাহী কমিটির সমাপনী বক্তব্যে দলের প্রতিটি নেতাকর্মীকে গণমাধ্যমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সরকারের ব্যর্থতা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। কারণ, বর্তমান গণমাধ্যমের অধিকাংশই সরকারি দলের তোয়াজে ব্যস্ত। এজন্য জনগণ প্রকৃত সংবাদ পাচ্ছে না। জনগণকে সরকারের প্রতিটি ব্যর্থতার কথা জানাতে হবে। তাহলে আমরা যে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তুলেছি, তাতে জনগণ অংশ নেবে।
তিনি দ্রব্যমূল্য, পানি, গ্যাস সঙ্কটসহ বিভিন্ন সঙ্কট নিরসনে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতার কথা নিজেদের জেনে জনগণকে জানানোরও নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি সরকারের নিষ্পেষণে অতিষ্ঠ জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্যও নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। সঙ্কট উত্তরণে জনগণকে ভরসা দিতে হবে। সরকারি দল ও প্রশাসনের নির্যাতনের জবাব দিতে হবে সংগঠনকে শক্তিশালী করে, মাঠে কর্মসূচি পালন করে। নিজেদের মধ্যে দলাদলি থাকলে কখনোই শক্তিশালী হওয়া যায় না।
খালেদা জিয়া কে ত্যাগী আর কে বেঈমান—সবকিছু বিবেচনা করেই কমিটি দেয়া বলে জানিয়ে বলেন, তবে তা হতে হবে শক্তিশালী ও আন্দোলনের জন্য উপযুক্ত। যারা পদ পেয়েও দলে নিষ্ক্রিয়, কাজ না করে শুধু ঘোরাঘুরি করছেন, তারা কাজ করুন। এ প্রসঙ্গে তিনি নির্বাহী কমিটিতে কারা সক্রিয় ও কারা নিষ্ক্রিয় তাদের তালিকা তৈরির জন্য ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে দায়িত্ব দেন। এ তালিকা অনুযায়ীই কেউ কমিটিতে থাকবে কেউ বাদ যাবে উল্লেখ করে বলেন, যারা বাদ যাবেন তারা যেন মন খারাপ না করেন। আর যারা থাকবেন তারা নিজ যোগ্যতা বলেই টিকেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, এই অংশকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন হতে দেয়া হবে না। সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা হবে।
এর আগে সকালে উদ্বোধনী বক্তব্যে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচানোর লড়াইয়ের দায়িত্ব পড়েছে বিএনপির ওপর। আজ দেশ ও জনগণ বিপন্ন। বর্তমান সরকারের অপশাসন, অযোগ্যতা, ব্যর্থতা ও নিপীড়নে জনগণ ক্ষুব্ধ ও পরিবর্তনের প্রত্যাশায় অধীর। তাদের সংগঠিত করে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা বিএনপির আছে। তাই জনগণের এই দুঃসময়ে আমাদের আরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নিজেদের মধ্যকার বিভেদ ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়া তার উদ্বোধনী বক্তব্যে সরকারের অপশাসন ও নানা ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেন। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা, শেয়ারবাজার বিদ্যুত্-গ্যাস-পানি সঙ্কটে জনগণের চরম দুর্ভোগের চিত্র বর্ণনা করে তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণ দিশেহারা। ১০ টাকায় চাল ও বিনামূল্যে সার দেয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা সরকারি দল আজ অস্বীকার করছে। ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার মতো চটকদার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা বেকার জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করেছে। দেশ-বিদেশে শ্রমিক চাকরি হারাচ্ছেন। বিনিয়োগ নেই বলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। ২০০৬ সালের ১৭ টাকার কেজির চাল এখন ৪০ টাকার ওপরে। একই অবস্থা ডাল, তেল, মাছ ও মাংসে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও সাংঘাতিক অবনতি ঘটেছে বলে উল্লেখ করে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, দেশের সীমান্ত আজ অরক্ষিত। ফেলানীর লাশ সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকে। তাঁবেদার সরকার এ ঘটনার প্রতিবাদ করারও সাহস পায় না। নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ সরকার গদি রক্ষার জন্য সব অন্যায় মেনে নিতে পারে। কিন্তু যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনকারী এদেশের জনগণ কারও আগ্রাসনের কাছে নতিস্বীকারে রাজি নয়। দেশের জনগণ বর্তমান সরকারের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ। তারা ক্রোধে ফুঁসছে। কাজেই জনস্বার্থে গৃহীত সব কর্মসূচিতে আমরা জনগণকে পাশে পাব।
খালেদা জিয়া আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, যত দিন যাবে, আন্দোলন ও বিজয়ের মূলশক্তি হবে দলের সাংগঠনিক ঐক্য এবং জনগণের সমর্থন। আমরা যত বেশি ও দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হতে পারব, ততই আমাদের প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়বে। এজন্য দলের ঐক্য ও সংহতি জোরদার করার তাগিদ দেন চেয়ারপার্সন।
দীর্ঘ বক্তব্যে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে প্রতিবেশী দেশ ও কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে যারা লাভবান হয়েছে, তাদের আগামীতে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। একই সঙ্গে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদেরও আগামীতে বিচার করার কথা বলেন তিনি।
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। সরকারবিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও হয়রানি করে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুপ্ত হত্যা ও মানুষ গুম করার মতো নৃশংসতা।
নোবেল পুরস্কারবিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর সরকারের প্রতিহিংসার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। খালেদা জিয়া বলেন, এখন আর শুধু প্রতিবাদ করলে চলবে না, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে সব অন্যায়, অবিচার ও নিপীড়নের।
খালেদা জিয়া বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুত্, গ্যাস, পানির অভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গ্রীষ্মকাল শুরু হতে না হতেই যে ভয়াবহ লোডশেডিং শুরু হয়েছে, তাতে আগামী মাসগুলোতে পরিস্থিতি কেমন হবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে কলকারখানা ঠিকমত চলছে না। উত্পাদনের জন্য প্রস্তুত শত শত শিল্প উত্পাদনে যেতে পারছে না। এসবের বেশিরভাগই আমাদের আমলে শুরু হয়েছিল। বিনিয়োগকারীরা প্রতিদিন লোকসান গুনছেন। যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। এই ঢাকা শহরে হাজার হাজার ফ্ল্যাট বাড়ি বসবাসের জন্য প্রস্তুত হওয়া সত্ত্বেও গ্যাস-বিদ্যুত্ সংযোগ না পাওয়ায় শূন্য পড়ে আছে। বিনিয়োগকারী ও যারা এসব ফ্ল্যাট কিনেছেন তারা সবাই নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। অথচ ২০০৬ সালে তো এমন অবস্থা ছিল না।
খালেদা জিয়া তার সরকারের আমলের বিদ্যুত্ পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিনিয়ত মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করে বলেন, আমাদের আমলে নাকি এক মেগাওয়াট বিদ্যুত্ও উত্পাদন করা হয়নি। অথচ বর্তমান সরকারের বিভিন্ন প্রকাশনায়ই স্বীকার করা হয়েছে যে, বিগত জোট সরকারের আমলে ১২৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই হিসেবে শুধু বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড ও তার আওতাধীন কোম্পানিগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে আমাদের সরকারের আমলে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড এবং আরপিসিএলের মাধ্যমে আরও আড়াইশ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছিল। এছাড়াও ১২৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছিল, যার অধিকাংশ অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিয়েছে। এর বাইরেও ২৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের ব্যবস্থা আমরা করে এসেছিলাম।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার এবং তাদের আন্দোলনের ফসল অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেসব বাস্তবায়ন না করে রেন্টাল বিদ্যুত্ উত্পাদনের ব্যবস্থা নিয়েছে। এতে কিছু ব্যক্তি লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জাতীয় অর্থনীতি ও দেশের জনগণ। আমাদের সরকারের আমলে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুত্ উত্পাদন ও সঞ্চালন ব্যয় ছিল ২ টাকা ৩০ পয়সা মাত্র এবং বছরে এই খাতে ভর্তুকি দেয়া হতো ৫-৬শ’ কোটি টাকা। অথচ বর্তমানে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুত্ উত্পাদন ও সঞ্চালনে ব্যয় হচ্ছে ৪ টাকা ৬৮ পয়সা এবং গত অর্থবছরে বিদ্যুত্ খাতে ভর্তুকি দিতে হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এই সরকারের আমলে বিদ্যুতের দাম দুই দফা বাড়ানোর পরও এ বছর ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ে জনগণের কোনো কল্যাণ হয়নি। লোডশেডিং বেড়েই চলেছে। শিল্প-বাণিজ্য-কৃষি কোনো খাতেই অতিরিক্ত কিংবা কম দামে বিদ্যুত্ দেয়া হচ্ছে না। তাহলে লাভবান হলো কারা?
তিনি বলেন, এতদিন পর সরকার গ্যাসকূপ খননের কথা বলছে। এরই মধ্যে নতুন গ্যাস সংযোগ না দেয়ার সরকারি ঘোষণা এসেছে। জনগণকে অনেক বেশি দামে এলপিজি কিনতে হলে তাদের প্রকৃত উপার্জন কমে যাবে। অর্থাত্ জনগণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেখানে গ্যাস নেই, সেখানে গ্যাস দেয়ার সরকারি প্রতিশ্রুতি ভাঁওতা বলেই প্রমাণিত হচ্ছে।
পানি সঙ্কট সমাধানেরও কোনো লক্ষণ নেই, উদ্যোগও নেই। খাল, বিল, নদী, নালা সরকারি দল দখল করে এমন সব প্রতিষ্ঠান গড়ছে যাতে পানি দূষণ বাড়ছে।
তিনি বলেন, গঙ্গার পানি সরবরাহ ক্রমাগত কমতে থাকায় নদীপথ সঙ্কুচিত হওয়ার পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে, নদীপৃষ্ঠ উঁচু হওয়ায় বন্যার প্রকোপ বাড়ছে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চল মরূকরণ দ্রুততর হচ্ছে। এ ব্যাপারেও দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার কোনো সরকারি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরসহ আশুগঞ্জ নৌবন্দর প্রতিবেশী দেশকে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হলো, কিন্তু বিনিময়ে কঠিন শর্তে ও বেশি সুদে কিছু অর্থ ঋণ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। এমনকি তিনবিঘা করিডোর সমস্যারও সমাধান হয়নি। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টিকেও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
বিরোধীদলীয় নেতা কারা নির্যাতিত আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের কথা উল্লেখ করে বলেন, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে নির্যাতনের পাশাপাশি সত্য কথা বলার জন্য আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করেছে এ সরকার।
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান সরকারের হাত থেকে জনগণকে রক্ষায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য সরকারকে অবশ্যই পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে।
তিনি আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, এমন একজন নির্ভীক সম্পাদক ও কলামিস্টের ওপর সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতন দেশবাসী তথা সারাবিশ্বের নজর কেড়েছে।
নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সংগঠন এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৪৩টি পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি হয়েছে। ১০টি বাকি রয়েছে। আশা করি আগামী এক মাসের মধ্যে সবগুলো জেলা কমিটি করা সম্ভব হবে। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব জানান, দলের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অচিরেই শুরু হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিএনপির ওয়েবসাইট উদ্বোধন করেন খালেদা জিয়া। ওয়েবসাইটের ঠিকানা : www.bangladeshnationalistparty-bnp.org
জনগণের সংগ্রামে দেশের বর্তমান দুঃসময় কেটে যাবে—তারেক রহমান : জনগণের সংগ্রামে দেশের বর্তমান দুঃসময় কেটে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন লন্ডনে চিকিত্সাধীন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গতকাল দলের নির্বাহী কমিটির পূর্ণাঙ্গ সভায় পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তারেক রহমান বলেন, আমি দূর থেকে আপনাদের কঠিন সংগ্রামের কথা ভেবে আলোড়িত ও আন্দোলিত হই। আমি সাহসে উদ্দীপ্ত হয়ে ভাবি, এই দুঃসময় কেটে যাবে বীর জনগণের দুর্জয় সংগ্রামে।
এক পৃষ্ঠার লিখিত বাণীটি পাঠ করে শোনান খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান। এ সময় পুরো সভাস্থলে ছিল পিনপতন নীরবতা। ২০০৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উচ্চতর আদালত থেকে জামিন নিয়ে লন্ডনে চিকিত্সার জন্য যান তারেক রহমান। ওই বছরের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে যৌথ বাহিনী গ্রেফতার করে।
বাণীতে তারেক রহমান বলেছেন, জনগণের দুর্জয় সংগ্রামে নতুন সূর্যোদয়ের প্রত্যাশায় আমরা সবাই গভীর অমানিশার প্রহর যাপন করছি। সংগ্রামের প্রস্তুতি ও পথনির্দেশনায় এ সভা সফল হোক।
যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক কমরউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বিবৃতিতে তারেক রহমান বলেন, লন্ডনে তিনি আমার পরম সুহৃদ ছিলেন। অকস্মাত্ তার এই মৃত্যু আমার কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এবং স্বজন হারানোর বেদনার মতো।
তিনি নির্বাহী কমিটির সদস্যদের প্রতি সালাম ও শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, আপনারা যখন এই সভায় মিলিত হয়েছেন, আমি তখন অনেক দূরে বিদেশ বিভূঁইয়ে চিকিত্সাধীন রয়েছি।
তারেক রহমান নির্বাহী কমিটির সফলতা কামনা করেন।

No comments:

Post a Comment