Tuesday 26 April 2011

সরকারকে সাফ জানিয়ে দিল দাতারা : বিচারবহির্ভূত হত্যা দুর্নীতি বন্ধ না হলে সাহায্য নয়









স্টাফ রিপোর্টার
বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পরিচিত দাতা দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা সরকারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সাহায্য পেতে হলে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ, বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। দুনীতি বন্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের ক্ষমতা খর্ব করা চলবে না, দুদকের সংশোধিত আইন বাতিল করতে হবে।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া নিয়ে গতকাল দাতাদের সঙ্গে সরকারের প্রতিনিধিদের পরামর্শ সভায় তাদের এ মতামত উঠে আসে। এসব বিষয়ে পরিকল্পনা দলিলে সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থান ও বক্তব্য থাকা প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন দাতারা। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সভায় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার এ খসড়া উপস্থাপন করা হয়।
এ সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পরিকল্পনামন্ত্রী একে খন্দকার, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এবং উন্নয়ন অংশীদারদের মধ্যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি, ইউএস এইড, ডিএফআইডি, জাইকাসহ বাংলাদেশে নিযুক্ত দাতা দেশ এবং সংস্থার ৪২ জন রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলম খসড়াটি উপস্থাপনের পর পরই এর ওপর দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা তাদের মতামত দেন। খসড়া উপস্থাপনের পর ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত মি. এস ওলিং, বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি এলেন গোল্ডস্টেইন ও এডিবির প্রতিনিধিসহ অন্যরা বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত পরামর্শসভায় দাতাদের পক্ষে বাংলাদেশে সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি উপস্থাপিত খসড়ার নবম অধ্যায়ের সূত্র ধরে বলেন, সরকারকে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজের নিশ্চয়তা দিতে হবে। আদালতের রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার কথা বলেন তিনি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বৈঠকে বলা হয়, একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে, এটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও সুশাসনের অন্তরায়। এসব বিষয়ে সরকারের ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকা দরকার। দুর্নীতি বন্ধে সরকারের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতিও দাবি করেন দাতারা। দুদকের আইন পরিবর্তন করে দুর্বল করায় দাতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। দুদককে শক্তিশালী করা এবং এর আইনে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে সেগুলো বাতিলের পক্ষেও তারা মত দেন। মানবাধিকার কমিশন যাতে স্বাধীন ও সক্রিয় হয়ে কাজ করতে পারে তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় বৈঠকে।
বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধি মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ নিয়ে সরকারের আরও সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দেন। বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও সারের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেয় আইএমএফ।
উন্নয়ন অংশীদাররা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার পরামর্শ দেন। এছাড়া বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো ও সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারা। একই সঙ্গে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা তৈরির প্রতি গুরুত্ব দেয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয় উন্নয়ন অংশীদারদের পক্ষ থেকে।
পক্ষান্তরে এসব সেক্টরে সাহায্য প্রদানের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করার আহ্বান জানান ড. মশিউর রহমান। তিনি উন্নয়ন অংশীদারদের উদ্দেশে বলেন, সাহায্য হিসেবে দেয়া পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য দাতা দেশগুলোর আরও বেশি অর্থ দেয়া প্রয়োজন।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় মোট বাজেটের ৯৬.০৮ শতাংশ আসবে দেশি সম্পদ থেকে। এর সিংহভাগ ব্যয় হবে স্বাস্থ্যসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৩। সর্বশেষ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫.৮।
বৈঠক শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এরই মধ্যে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া নিয়ে বেশকয়েকটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। দাতাদের সঙ্গে আলোচনা করা এ প্রক্রিয়ারই অংশ। এতে দাতাদের কোনো শর্ত বা পরামর্শের ব্যাপার নেই বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, দাতাদের সামনে আগেই খসড়াটির মূল বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা হয়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, দাতারা খসড়াটি দেখে প্রশংসা করেছেন। তবে তারা এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে আঞ্চলিক অসমতা দূর করতে এবং উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে একটি কর্মকৌশল গ্রহণ করা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে কৃষি খাতে আরও বেশি দৃষ্টি দেয়া। দাতার অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি বিনিয়োগের হার ও মান বাড়ানোর বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। এর বাইরে বেসরকারি বিনিয়োগ মোট অভ্যন্তরীণ উত্পাদনের চার শতাংশে নিয়ে যাওয়া এবং জলবায়ু, আঞ্চলিক বাণিজ্যের প্রচার এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগের সুপারিশ করেছে উন্নয়ন সহযোগীরা।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম জানান, মে মাসের ভেতরেই এর খসড়া জাতীয় সংসদে পাঠানো হবে। প্রয়োজনীয় সংশোধন শেষে জুনের মধ্যেই চূড়ান্ত অনুমোদন শেষে এর বাস্তবায়ন শুরু হবে।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদকাল ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত। এ অর্থবছরে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার (জিডিপি) টার্গেট করা হয়েছে ৮ শতাংশ। শিল্প খাতে জাতীয় আয়ের অংশ ২০ দশমিক ৩ ভাগ থেকে বেড়ে ২২ দশমিক ৩ ভাগ হবে। তবে কৃষি খাতে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান ১৯ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ১৬ দশমিক ৬ ভাগে নেমে যাবে। বর্তমান মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে তা ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে ১০ দশমিক ২ মিলিয়ন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ আছে।
এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পাঁচ বছরে ১৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন টাকার প্রয়োজন হবে। এর ৯২ দশমিক ৮ ভাগ সরকারের অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে জোগান দেয়া হবে। বাকি ৭ দশমিক ২ শতাংশ দাতাদের সহযোগিতা থেকে পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে দাতাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দারিদ্র্যবিমোচন কৌশলপত্র (পিআরএসপি) বাস্তবায়ন হচ্ছে। আগামী জুনে এটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। দাতা সংস্থাগুলো চেয়েছিল এই পিআরএসপি আবারও অব্যাহত থাকুক। তাই শুরু থেকেই তারা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিল। শেষ মুহূর্তে দাতাদের অর্থ ছাড় দিতে রাজি করানোর জন্য তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে সরকার।
জানা গেছে, দেশে বিদেশি সাহায্যপ্রবাহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। আগের বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে প্রকৃত সাহায্য এসেছে মাত্র ৩৬ কোটি ডলার বা দুই হাজার ৫২০ কোটি টাকা। সাহায্যের এই পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ে ছাড় করা অর্থের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। গত বছর প্রথম সাত মাসে এর পরিমাণ ছিল ৯৯ কোটি ১১ লাখ ডলার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিশ্বব্যাংক থেকে প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশ বাজেট সহায়তা খাতে ২০ কোটি ডলারের মতো ঋণসহায়তা পেয়ে আসছে। কিন্তু এবার বিশ্বব্যাংক এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা দেয়নি। এ বছর আর সহায়তা দেয়া হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই সরকার সংশোধিত বাজেটে বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ অনেকটাই কাটছাঁট করেছে

No comments:

Post a Comment