Tuesday 31 May 2011

সংবিধান সংশোধন কমিটির নীতিগত সিদ্ধান্ত : এবার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ যাচ্ছে



সংসদ রিপোর্টার
সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকছে না। সংবিধান সংশোধনে বিশেষ কমিটি তাদের সুপারিশে এ বিষয়ে নেতিবাচক প্রস্তাবনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম বিষয়টি ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপে পাওয়া প্রস্তাবনা বিবেচনা করে কমিটির অধিকাংশ সদস্য খসড়া সুপারিশে এটা না রাখার বিষয়ে একমত হয়েছেন। তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর বিধায় কমিটির কয়েকজন সদস্য এক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার ওপর ফেলে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা বিবেচনা করে বিশেষ কমিটি এর আগে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার বিষয়ে একমত হলেও গতকাল অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে এটা নিয়ে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত হয় বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, গতকালের বৈঠকে কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ক (২ক) অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে ‘প্রজাতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মাবলম্বী মানুষ স্ব স্ব ধর্ম পালনে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার পাইবে’ এ ধরনের বক্তব্য সম্বলিত একটি লিখিত প্রস্তাব দেন। খসরু শিরোনামে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ শব্দটি পরিবর্তন করে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’-এর কথা বলেন। কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সদস্য রাশেদ খান মেননও গতকাল পৃথক লিখিত প্রস্তাবনা দেন। অবশ্য রাশেদ খান মেনন দলীয়ভাবেও এর আগে এ ধরনের প্রস্তাব বিশেষ কমিটিকে দিয়েছেন। সদস্যদের এ প্রস্তাবনার পাশাপাশি রাজনীতিক, সাবেক বিচারপতি ও আইনজ্ঞ, পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে কমিটির সংলাপ, ৫ বাম দল, কমিউনিস্ট পার্টি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সঙ্গে মতবিনিময়ের সুপারিশ ও প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। সংলাপে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রধর্ম না রাখার প্রস্তাব এসেছে উল্লেখ করে গতকাল কমিটির একাধিক সদস্য বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনেন। ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম থাকার সুযোগ নেই বলেও কমিটির একাধিক সদস্য মন্তব্য করেন। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের সঙ্গে একমত পোষণ করে রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে ‘স্পর্শকাতর’ উল্লেখ করে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার পক্ষেও মত দেন। পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন আলোচনা করে কমিটির সদস্য ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ এর পরিবর্তে তারা ‘প্রজাতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ/জনগণের ধর্ম ইসলাম’ এমন শব্দগুলো যুক্ত করার সুপারিশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি সুপারিশে হিন্দু, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সমঅধিকারের কথা এবং শিরোনামে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ শব্দের পরিবর্তে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ বা অন্য কোনো বিকল্প শব্দ রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। অবশ্য কমিটি তাদের এ নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করবে। তার পরই এ বিষয়ে তাদের চূড়ান্ত সুপারিশ তৈরি করবে।
প্রসঙ্গত, বর্তমান সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদে রয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে’। আর এ অনুচ্ছেদটির শিরোনাম হচ্ছে ‘রাষ্ট্রধর্ম’। এ বিষয়ে কমিটির সদস্য রাশেদ খান মেনন গতকাল বৈঠকের পর আমার দেশ’র কাছে এক প্রতিক্রিয়ায় সুপারিশে রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ে পরিবর্তন আনার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে গতকাল আলোচনা হয়েছে। কমিটি এ অনুচ্ছেদে ভাষাগত পরিবর্তনের চিন্তা করছে। ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে রাশেদ খান মেনন রাষ্ট্রধর্মের বিপক্ষে বলেও গতকাল আমার দেশকে জানান।
এদিকে গতকালের বৈঠকে কমিটি ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, ১২ অনুচ্ছেদ (চার মূলনীতি) পুনর্জীবিতকরণ, নারী আসন ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০টিতে উন্নীত করা, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণ, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রাখার পাশাপাশি বিচারপতিদের চূড়ান্ত অভিসংশন সংসদের হাতে রাখা, সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণসহ বেশকিছু বিষয়ে তাদের সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে।
কমিটির সুপারিশ অনুসারে সংসদীয় আসন শূন্য হওয়ার বিধান সম্বলিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বর্তমান বিধানের পরিবর্তে কেবলমাত্র অনাস্থা প্রস্তাব, অর্থবিল (বাজেট) ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাজনিত বিষয় ছাড়া অন্য যে কোনো বিষয়ে সংসদ সদস্যরা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন কথা যুক্ত করা হয়েছে।
বিচারপতিদের অভিসংশন বিষয়ে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কার্যক্রম সম্পর্কে বলা হয়েছে, কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তা তদন্তের ভার এই কাউন্সিলের উপরই বর্তাবে। তবে তদন্ত শেষে কাউন্সিলের আর কিছু করার থাকবে না। তাদের দেয়া তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী সংসদই অভিযুক্ত বিচারকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। পরবর্তীতে সংসদের এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করা হবে।
সূত্র জানিয়েছে, কমিটি আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে নির্বাচিত সরকারের অধীনে করা যায় তার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা, শক্তি, জনবল, আর্থিক স্বাধীনতাসহ নির্বাচন কমিশনকে সার্বিক শক্তিশালী করার সুপারিশ করছে। এক্ষেত্রে নির্বাচন চলাকালে নিয়োগ, বদলিসহ যাবতীয় কার্যক্রম কমিশনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এ সময় সরকারের ভূমিকা হবে বর্তমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো। অর্থাত্ ওই সময়ে সরকার রুটিন কাজের বাইরে কিছু করতে পারবে না। কমিটি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সংসদের মাধ্যমে সার্চ কমিটি গঠনসহ কমিশনারের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করার সুপারিশ করবে।
গতকালের বৈঠকে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের আলোকে আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখার সিদ্ধান্ত হলেও কী পদ্ধতিতে এ ব্যবস্থা বহাল রাখা হবে সে বিষয়ে কমিটি কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে কমিটি ৩/৪টি বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাপ করে কমিটি এক্ষেত্রে সিদ্ধান্তে পৌঁছবে বলে সূত্র জানিয়েছে। গতকালের বৈঠকে বিশেষ কমিটি স্বল্পসময়ের মধ্যে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য কমিটির চেয়ারম্যান সাজেদা চৌধুরীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বৈঠকের দিনক্ষণ নির্ধারণের। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর আরেকটি বৈঠক করে কমিটি তাদের চূড়ান্ত সুপারিশ তৈরি করবে

No comments:

Post a Comment