Monday 31 October 2011

দুর্নীতির অভিযোগে চাপের মুখে সরকার



বশীর আহমেদ
দাতা সংস্থা এবং উন্নয়ন সহায়তাদানকারী দেশগুলোর পক্ষ থেকে দুর্নীতির প্রকাশ্য অভিযোগ ওঠায় রীতিমত চাপের মুখে পড়েছে সরকার। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ব্রিটেনের মতো উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর পক্ষ থেকে বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হচ্ছে। সর্বশেষ পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ এবং পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিত ঘোষণা করায় বেকায়দায় পড়েছে সরকার। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো দাতা সংস্থার দুর্নীতির এমন প্রকাশ্য অভিযোগ এর আগে কখনও আসেনি। বিষয়টি নিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, বিদ্যুত্ খাতসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারের সীমাহীন আর্থিক দুর্নীতির ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ তোলা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তা উপেক্ষা করা হয়েছে। যেসব মন্ত্রী ও উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি একজন সম্পাদকও টকশোতে বলেছেন, বিভিন্ন প্রকল্পের কমিশনের টাকা লন্ডন আমেরিকার কোন কোন জায়গায় ভাগ-বাটোয়ারা হয় সে কথাও আমরা জানি।
এখন বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে সরকারকে। শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে দুর্নীতির সনদ নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইন্দ্রাবতী মুলায়নীর সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বৈঠকের সময়ে তাকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতির সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক সব ধরনের সহায়তা স্থগিত রাখবে। বিশ্বব্যাংকের এ পদক্ষেপের কথা যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী নিউজ ওয়ার্ল্ডকে বলেছেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ব্যাপারে সুস্পষ্ট অভিযোগের কথা বলেছে। তারা বলেছে, এ দুর্নীতির ব্যাপারে তাদের কাছে ৭টি প্রমাণপত্র রয়েছে। তবে তারা এগুলো আমাকে দেখায়নি। তদন্ত কমিশনের কাছে এগুলো দেয়া হবে বলে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।
পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এ অভিযোগ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বিবিসিকে বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ দিতে দেরি করছে বিশ্বব্যাংক। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমরা বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তারা বলেছেন, বাংলাদেশে যে দুর্নীতি হচ্ছে তার অভিযোগ আমরা পাচ্ছি। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ দিতে দেরি করলে আমরা অর্থের বিকল্প উত্স খুঁজব। এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর কানাডা পুলিশ কানাডায় অবস্থিত এসএনসি-লাভালিন গ্রুপের একাধিক অফিসে অভিযান চালায়। দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র উদ্ধারের জন্য এ অভিযান চালানো হয়। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতিবিরোধী ইউনিটের অনুরোধেই কানাডা পুলিশ এ অভিযান চালায়। এসএনসি-লাভালিন (ঝঘঈ-খধাধষরহ) পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের পরামর্শক নিউজিল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মনসেল-এইকমের একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি।
পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার কথা। বিশ্বব্যাংকের এ দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করার কথা বলছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বিবিসিকে জানিয়েছেন, বিষয়টি তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং এ দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চেয়ে বিশ্বব্যাংকের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছেন ঢাকায় নিয়োগপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা। গত মাসে সিনেটের ফরেন রিলেশন কমিটিতে শুনানিতে নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এ মন্তব্য বিশেষ অর্থবহ। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের দুর্নীতির বিষয়টি যে এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত—এ মন্তব্য তারই প্রমাণ।
বাংলাদেশের দুর্নীতির বিষয়টি যে এখন সবার জানা, তা পরোক্ষভাবে জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত নতুন ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। গত ৩ তারিখ ঢাকায় তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটিশ হাইকমিশনার বলেন, ব্রিটেন বাংলাদেশকে যে উন্নয়ন সহায়তা দেয় তা ব্রিটিশ জনগণের ট্যাক্সের টাকা। সাধারণ মানুষের এ ট্যাক্সের টাকার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে দেয়া অর্থ কোথায়, কিভাবে ব্যয় করা হচ্ছে তা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মনিটরিং করা হবে।
সরকারের দুর্নীতির কারণেই জলবায়ু তহবিলের কোনো অর্থ পাচ্ছে না বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ১০ বিলিয়ন ডলারের যে তহবিল গঠন করা হয়েছে, সেই তহবিল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ পায়নি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বারবার অনুরোধ করার পরও দাতাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। দাতারা বলছেন, সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাদের প্রশ্ন রয়েছে। কোনো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে জলবায়ু তহবিলের তদারকির দায়িত্ব দিলে অর্থ ছাড় করবে দাতারা। সরকার এ প্রস্তাবে রাজি নয়। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল থেকে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে সরকার।

No comments:

Post a Comment