Wednesday 29 December 2010

ভারতের কাজেই ঋণের বিলিয়ন ডলার



বশীর আহমেদ

ভারতের ঋণের টাকা ব্যয় হবে ভারতেরই প্রকল্পে। বহুল আলোচিত ভারতের এক্সিম ব্যাংকের একশ’ কোটি সমপরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত প্রকল্পের জন্যই কেবল ব্যয় করতে পারবে বাংলাদেশ। চুক্তি স্বাক্ষরের পর নতুন এই শর্তের কথা বাংলাদেশকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৮৫ ভাগ পণ্য ও সেবা ভারত থেকেই আনতে হবে। বাকি ১৫ ভাগ পণ্য ও সেবা ভারতীয় ঠিকাদারদের পরামর্শ অনুযায়ী কিনতে হবে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, প্রকল্প অনুমোদন করবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এটি একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। আর এই ধরনের স্বার্থে সাধারণভাবে বাংলাদেশের কোনো লাভ হবে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণ চুক্তির শর্তের বাইরে নতুন নতুন শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে একপ্রকার জিম্মি করে ফেলছে ভারত। ভারতের ঋণের টাকা দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো ক্ষমতাই বাংলাদেশের হাতে থাকছে না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ভারতেরই। এই ঋণের আওতায় এরই মধ্যে যে ১৪টি প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার চূড়ান্ত করেছে তা ভারতের জন্য নৌ, সড়ক এবং রেল ট্রানজিট কার্যকর করার জন্য সহায়ক হবে। কর্মকর্তারা আরও জানান, বাংলাদেশের কোনো আপত্তিই আমলে নিতে চাইছে না ভারত। উল্লেখ্য, চলতি বছর জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ভারতের এই ঋণ সহায়তা বলে তখন ফলাও করে প্রচার করা হয়। গত ৭ আগস্ট ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির উপস্থিতিতে ঢাকায় এই এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশের পক্ষে ইআরডি সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভূইয়া এবং ভারতের পক্ষে সেদেশের এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিসিএ রঙ্গনাধন চুক্তিতে সই করেন। চুক্তিতে স্বাক্ষরের পর গত মাসে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক নাদিম পাঞ্জেতানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরে আসেন। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তারা। ওই বৈঠকে ঋণের বিভিন্ন শর্তের কথা তুলে ধরেন এক্সিম ব্যাংকের কর্মকর্তারা। বৈঠকে নাদিম পাঞ্জেতান সাফ জানিয়ে দেন, প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে হবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমোদন না করলে কোনো প্রকল্পের জন্য অর্থ ছাড় করবে না এক্সিম ব্যাংক। এছাড়া ঋণের টাকায় কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তার মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কী ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে তাও ভারত সরকারকে নিয়মিতভাবে জানাতে হবে।
উল্লেখ্য, স্বাক্ষরিত ঋণ চুক্তিতে এই ধরনের কোনো শর্ত ছিল না। নতুন করে এই শর্তারোপ করা হয়েছে। এক্সিম ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের জন্য ৮৫ ভাগ পণ্য ও সেবা ভারত থেকেই কিনতে হবে। এই ক্রয়ের ক্ষেত্রে যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশ নেবে সেগুলোও ভারতীয়। বাকি যে ১৫ ভাগ পণ্য বাইরে থেকে বাংলাদেশ কিনতে পারবে তা ঠিক করে দেবে ভারতীয় ঠিকাদাররা। প্রয়োজনে ভারত তৃতীয় কোনো দেশ থেকে আমদানি করে পরে তা আবার বাংলাদেশে রফতানি করবে।
সেতুসহ অন্যান্য নির্মাণ কাজের জন্য ইট, বালু, সিমেন্ট, রড সবকিছুই ভারত থেকে কিনতে হবে বলে এক্সিম ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়ে গেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের জন্য ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন, ভারতীয় পণ্যের নিম্নমানসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হলে নাদিম পাঞ্জেতান বাংলাদেশের কোনো আপত্তি আমলে না নিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেন এসব শর্ত মেনেই বাংলাদেশকে ঋণ নিতে।
উল্লেখ্য, ঋণ চুক্তি অনুযায়ী এক বিলিয়ন ডলারের জন্য বছরে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে সুদ দেয়ার পাশাপাশি শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ হারে কমিটমেন্ট ফি দিতে হবে।
বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রীতিমত ক্ষুব্ধ এসব অযৌক্তিক শর্তের জন্য। তারা বলেছেন, এই ঋণের আওতায় রেলের বগি ও ইঞ্জিন কেনার কথা রয়েছে। রেলের ইঞ্জিন ও বগি কিনতে ১৮ থেকে ২৪ মাস সময় লাগে। এক্ষেত্রে পণ্য কেনার আগেই কমিটমেন্ট ফি গুনতে হবে বাংলাদেশকে। এছাড়া বিএসটিআই’র সামর্থ্য বাড়াতে ঋণের আওতায় ভারত থেকে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি কেনার কথা বলা হয়েছে। ভারতীয় এসব যন্ত্রপাতি এতই নিম্নমানের যে ভারত নিজেই এসব যন্ত্রপাতি জার্মানি থেকে সংগ্রহ করে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হলে এক্সিম ব্যাংকের কর্মকর্তারা ঋণের শর্তের কথাই বলেন।
ভারতের নতুন শর্ত এবং এই ঋণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. আকবর আলি খান গতকাল আমার দেশকে বলেন, শর্ত অনুযায়ী ভারতের ঋণের টাকা দিয়ে ভারতেরই পণ্য এবং সেবা আমাদের কিনতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়েও যদি ভারতে দাম বেশি ধরা হয়, আমাদের তা মেনে নিতে হবে। তিনি বলেন, এক্সিম ব্যাংকের ঋণ দিয়ে সাধারণত আমাদের কোনো লাভ হয় না। তাই অতীতে আমরা এই ধরনের ঋণ কখনও নেইনি। প্রকল্প গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের এখতিয়ার বাংলাদেশেরই। এক্সিম ব্যাংক এখানে পরমার্শ দিতে পারে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকল্প অনুমোদন করবে, এটা নতুন এবং অস্বাভাবিক ঘটনা

No comments:

Post a Comment