Wednesday 29 December 2010

দুই হাজার পয়েন্ট দিয়ে হাজার কোটি টাকার মাদক ঢুকছে দেশে : ঝুলে আছে ৩২ হাজার মামলা

মুস্তফা নঈম ও সোহাগ কুমার বিশ্বাস, চট্টগ্রাম

ভারত-মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তের প্রায় ২ হাজার পয়েন্ট দিয়ে বছরে হাজার কোটি টাকার মাদক ঢুকছে বাংলাদেশে। বিজিবির বরাত দিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ৫১২টি পয়েন্ট দিয়ে মাদক প্রবেশ করার কথা স্বীকার করেছে। এছাড়া ভারতে সীমান্তের কাছাকাছি শতাধিক ফেনসিডিল কারখানা বন্ধের বিজিবির (সাবেক বিডিআর) অনুরোধে নয় মাসেও সাড়া দেয়নি বিএসএফ। এদিকে সারাদেশে র্যাব, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ প্রশাসনিক বিভিন্ন দফতরে ৩২ হাজারেরও বেশি মাদকদ্রব্য আইনে মামলা রয়েছে, যার কোনো কূলকিনারা হয়নি।
ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি সংস্থার এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, প্রতিবছর শুধু ভারত থেকে চোরাইপথে ৩৪৭ কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের মাদক দেশে আসছে। জাতিসংঘের একটি জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৯ লাখ নারীসহ ৬৫ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ১ লাখেরও বেশি মানুষ। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাবে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৪৬ লাখ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীরা বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার মাদক বাংলাদেশে আমদানি করছে। প্রতিবছর শুধু ভারত থেকে চোরাইপথে আসা বিপুল পরিমাণ মাদক দেশে আসছে। যার মাত্র ১০ শতাংশ পুলিশ ও র্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে।
গত মার্চ মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে বৃহত্তর যশোর সীমান্তের ৫২টি ও উত্তরাঞ্চলের ৬টি জেলার ৭২ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৭০টি ফেনসিডিল ও ১০টি হেরোইন প্রস্তুত ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার তালিকা করে বিএসএফের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে এবং বিডিআরের পক্ষ থেকে কারখানাগুলো বন্ধ করার জন্য বিএসএফকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু এর ৯ মাস অতিবাহিত হলেও বিএসএফের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ দফতর সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য এলাকার ভারত-মিয়ানমারসংলগ্ন ৭১০ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৩৬৫ কিলোমিটারই অরক্ষিত। রাঙামাটির সাজেক থেকে খাগড়াছড়ির নারাইছড়ি পর্যন্ত ১১৩ কিলোমিটার, রাঙামাটির আন্ধারমানিক থেকে বান্দরবানের মদক পর্যন্ত ১৩১ কিলোমিটার, মদক থেকে লেম্বুছড়ি ১২১ কিলোমিটার সীমান্তে কোনো বিজিবি বা অন্য কোনো বাহিনীর ক্যাম্প নেই।
কুমিল্লা জেলার ৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রক্ষায় বিজিবির মাত্র ১৫টি বিওপি রয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা, আখাউড়া ও সদর উপজেলার ৮০ কিলোমিটার সীমান্তের অর্ধশতাধিক স্পট দিয়ে ভারতীয় মাদক বাংলাদেশে ঢুকছে।
দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলায় বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকায় বিডিআরের চিহ্নিত ৯৯টি রুটসহ প্রায় ৩ শতাধিক রুট দিয়ে মাদক আসছে। বিপরীতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ৪টি জেলায়ও প্রায় ২শ’ পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। অভ্যন্তরের রুটগুলো হলো সাতক্ষীরা জেলায় ২৬টি, যশোর জেলায় ২১টি, ঝিনাইদহে ২২টি, চুয়াডাঙ্গায় ৬টি, মেহেরপুরে ২২টি এবং কুষ্টিয়া জেলায় ২টি রুট রয়েছে। এসব রুটে প্রতিনিয়ত ভারতীয় মাদক দেশে ঢুকছে। ভারত থেকে সব থেকে বেশি মাদক আসে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে। কারণ বেনাপোল থেকে ভারতের কলকাতার সীমান্ত মাত্র ৮০ কিলোমিটার। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভালো। এছাড়া প্রতিদিন ভারতীয় বিভিন্ন পণ্যের প্রায় ৫শ’ ট্রাক বেনাপোলে আসে। এসব গাড়ির বিভিন্ন মালামালের সঙ্গে অবাধে মাদকও আসছে। যে কোনো জিনিসের উপরে কার্বন পেপার দিয়ে মুড়িয়ে দিলে স্কানিং মেশিনে ধরা পড়ে না। যার কারণে ট্রাকভর্তি বিভিন্ন ধরনের মালের সঙ্গে মাদকের চালান আসছে অবাধে।
নাটোরের লালপুর থেকে নওগাঁর ধামুইরহাট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩শ’ কি.মি. সীমান্ত এলাকায় ২৭টি রুটে এ ফেনসিডিল ও হেরোইন পাচার হয়ে আসছে। সাতক্ষীরার ১৩৮ কিলোমিটার সীমান্ত এখন মাদক ব্যবসায়ীদের দখলে। জেলার সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার ভোমরা স্থলবন্দরসহ অন্তত ১৭৫টি পয়েন্ট দিয়ে অবাধে মাদকদ্রব্য ঢুকছে দেশে। শেরপুরের অন্তত ১৮টি পয়েন্টসহ ভোগাই, মহারশি, চেল্লাখালী সোমেশ্বরী সীমান্ত নদী দিয়ে ভারতীয় মাদক আসছে।
উত্তরাঞ্চলের মাদক পাচারের বিস্ময়কর তথ্য মিলেছে। ৭২ কিলোমিটার ভারতীয় সীমান্তের জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার চেঁচড়া, দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার হাড়িপুকুর, ঘাসুরিয়া, বিরামপুর উপজেলার কাটলাসহ প্রায় ২২০টি পয়েন্ট দিয়ে অবাধে মাদকের চালান দেশে ঢুকছে। বিপরীতে কাঁসা, পিতল, তামা, দস্তা, মূল্যবান ধাতব মুদ্রা, সোনা, শার্ট-প্যান্ট পিস, টাঙ্গাইল শাড়ি, জামদানি শাড়ি প্রভৃতি মূল্যবান দেশীয় সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া স্বাধীনতার পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের চালু মিলকারখানার মূল্যবান যন্ত্রপাতি খুলে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তপথে পাচার হচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া আদমজি জুটমিলের যন্ত্রাংশও উরাঞ্চলের এসব সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
দেশের আকাশ ও সমুদ্রপথও মাদক ব্যবসায়ীদের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। চলতি বছরে বিমানবন্দরে বেশ কয়েকটি চালন ধরা পরার পর আকাশপথে মাদক পাচারের বিষয়টি সামনে চলে আসে। বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে ২০ কেজি কিটামিন পাউডারসহ (নেশার উপকরণ) তামিলনাড়ুর এক ব্যক্তিকে কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা গ্রেফতার করে। গত ১৩ মার্চ বিমানবন্দরে সাড়ে তিন কেজি হেরোইনসহ এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর পরপরই বিমানবন্দরের দোতলায় বহির্গমনে নাইজেরিয়ান নাগরিক আফোলয়েনের লাগেজ তল্লাশি করে কাস্টমস কর্মকর্তারা ৫ কেজি ৮০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করে।
১৮৫৭ সালে প্রণীত হয় মাদকদ্রব্য আইন। তখন এই আইন আফিম আইন নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে এই আইনে বেশকিছু ধারা সংযোজিত হয়। এসব আইন একত্র করে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন নামে পূর্ণাঙ্গ আইন পাস হয়। এই আইনের আওতায় বিভিন্ন সংস্থার হাতে সারাদেশে অন্তত ৩২ হাজার মামলা ঝুলে আছে। যার কোনো কূলকিনারা হয়নি।

No comments:

Post a Comment