Tuesday 28 December 2010

নিত্যপণ্যের মূল্য আকাশ ছুঁয়েছে



সৈয়দ মিজানুর রহমান

রাজধানীর পলাশী মোড় কাঁচাবাজারের খুচরা চাল বিক্রেতা ইসমাইল হোসেন ২০১০ সালের শুরুতে প্রতিকেজি মোটা চাল বিক্রি করতেন ২৭ থেকে ২৮ টাকা দরে। সেসময় ভালো মানের সরু চাল (নাজির ও মিনিকেট) বিক্রি করতেন ৪৫ থেকে ৪৭ টাকায়। তিনি এখন মোটা চাল বিক্রি করছেন ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা এবং সরু চাল ৫২ থেকে ৫৭ টাকা কেজি। তার হিসাবে ২০১০ সালে কেজিপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত। অবশ্য সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদর অনুসন্ধান ও গবেষণা সেল সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সালে এক কেজি চালের দামই ছিল গত এক বছরের বাড়তি দামের সমান। সে সময় ১৬-১৭ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি হয়েছে।
শুধু যে ২০১০ সালে চালের দরই চড়া ছিল তা নয়। টিসিবি নিত্যপ্রয়োজনীয় ৪২টি দ্রব্যের নিয়মিত বাজারমূল্য মনিটরিং করে থাকে। এর মধ্যে ২০১০ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দর বেড়েছে ৩৩টি পণ্যের। বাকি ৯টি পণ্যের একটি পণ্য (লেখার সাদা কাগজ) দামের দিক থেকে বাড়েনি বা কমেওনি (অপরিবর্তিত ছিল)। সামান্য মূল্য কমেছে ৮টি পণ্যের।
নিত্যপণ্যের দাম কারণে-অকারণে বাড়লেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারের অন্য কোনো সংস্থা এ বিষয়ে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। ভোগ্যপণ্যের বাজারে মজুতদার ও মুনাফালোভীদের বিরুদ্ধে আইনেরও কোনো প্রয়োগ হচ্ছে না।
চাল : গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান নিত্যপণ্য মোটা চালের দর ২০১০ সালে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। বছরের শুরুতে মোটা চালের যে দর ছিল, শেষেরদিকে এসে তার সঙ্গে প্রতি কেজিতে আরও ১০-১২ টাকা যোগ হয়ে বর্তমানে প্রতিকেজি মোটা চাল (স্বর্ণা বা চায়না ইরি) বিক্রি হচ্ছে ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা দরে। টিসিবির হিসাবে পয়লা জানুয়ারি থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোটা চালের দর বেড়েছে ৪০ শতাংশ।
২০১০ সালে বছরের প্রথমদিন পয়লা জানুয়ারি রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতিকেজি মোটা চাল খুচরা মূল্যে ২৬ থেকে ২৭ টাকা দরে বিক্রি হয় বলে জানায় টিসিবি। টিসিবির বাজারদর পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, বছরের প্রথমদিন সাধারণ মানের মিনিকেট ও নাজিরশাইল বিক্রি হয় ৩১ থেকে ৪০ টাকা দরে। উত্তম মানের নাজির ও মিনিকেট সেসময় বিক্রি হয়েছে ৩৬ থেকে ৪৫ টাকা দরে। মাঝারি মানের পাইজামের দর বছরের প্রথমদিন ছিল ৩১ থেকে ৩২ টাকা কেজি। বছর শেষে বর্তমানে প্রতিকেজি সাধারণ মানের নাজির ও মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪৪ টাকা দরে এবং মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৩৯ টাকা দরে। এ তথ্য টিসিবির।
২০১০ সালে চালের বাজার অস্থির হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বের করতে পারেনি সরকার। তবে চাল ব্যবসায়ীদের দাবি, পথেঘাটে বেপরোয়া চাঁদাবাজি এবং পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চালের বাজার অস্থির। এছাড়া গত কয়েক বছরে ধানের উত্পাদনও কমে গেছে বলে জানা গেছে।
আটা-ময়দা : বাজারে বর্তমানে এক কেজি খোলা আটার দর (নিম্নমানের) ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা। অবশ্য প্যাকেটজাত আটা ৩৫ থেকে ৩৬ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না। ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪১ টাকা কেজি দরে। আটা-ময়দার চড়া দামের কারণে গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষ এখন খুব একটা রুটি খাচ্ছেন না। এ কারণে বাজারে আটা-ময়দার চাহিদাও কমে গেছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
নারায়ণগঞ্জের আটা-ময়দা মিল মালিক আবদুস সাত্তার আমার দেশকে জানান, তার আটা-ময়দার মিল বছরের অর্ধেক সময়ই এখন বন্ধ থাকে। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আটা-ময়দার চড়া দামের ফলে বাজারে চাহিদা কমে গেছে।
টিসিবি জানিয়েছে, ২০১০ সালের শুরুর দিন বাজারে প্রতিকেজি খোলা আটা বিক্রি হয়েছে ২২ থেকে ২৩ টাকা দরে, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৩ থেকে ৩৪ টাকায়। এক বছরে খোলা আটার দর বেড়েছে কেজিপ্রতি ১১ টাকা। প্যাকেটজাত আটা বছরের শুরুতে বিক্রি হয়েছে ২৪ থেকে ২৬ টাকা কেজি দরে। বর্তমানে প্যাকেটজাত আটার দর ঠেকেছে ৩৪ থেকে ৩৬ টাকায়। বাজারে বর্তমানে প্রতিকেজি ময়দার দর (খোলা) ৩৬ থেকে ৩৭ টাকা। তবে বছরের শুরুতে ময়দা ছিল ৩২ থেকে ৩৩ টাকা।
দফায় দফায় মূল্য নির্ধারণ করেও অস্থির তেলের বাজার : ২০১০ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ভোজ্যতেলের দর কয়েক দফা নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে বাজারদর থেকে অতিরিক্ত দর বেঁধে দিয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষ নেয়ায় বাড়তি দামের চাপ সহ্য করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বাজারে এখন প্রতিলিটার সয়াবিন (খোলা) বিক্রি হচ্ছে ৯৮ থেকে ১০৪ টাকা দরে। টিসিবি জানিয়েছে, গতকালও ভোজ্যতেলের দর লিটারপ্রতি ২ টাকা বেড়ে এখন ৯৬ টাকা দরে খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে। অবশ্য ২০০৬ সালেও সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা দরে।
টিসিবি জানায়, ২০১০ সালের পয়লা জানুয়ারি বাজারে প্রতিলিটার সয়াবিন (লুজ) বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ৮৪ টাকা দরে। সেসময় পামঅয়েলের দর ছিল ৬৩ থেকে ৬৫ টাকা। বর্তমানে পামঅয়েল বিক্রি হচ্ছে ৮৬ থেকে ৮৮ টাকা দরে। পামঅয়েলের দর গত প্রায় ১২ মাসে ৪৮ শতাংশ বেড়েছে বলে টিসিবির বাজারদর তথ্যে তুলে ধরা হয়েছে। এসময় সয়াবিন তেলের দর বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
পেঁয়াজের কেজি ৫০-৫৫ টাকা : বর্তমান সরকারের আমলে দ্রুত লাফিয়ে মূল্য বৃদ্ধির তালিকায় শীর্ষস্থান পেয়েছে পেঁয়াজ। পেঁয়াজের দর গত সাত দিনেই প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে টিসিবি। বর্তমানে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৫৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বছরের প্রথমদিন প্রতিকেজি পেঁয়াজের দর ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। ভারত পেঁয়াজ রফতানিতে সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আগামী ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এটা বলবত্ থাকবে। এ খবরেই বেসামাল হয়ে পড়েছে পেঁয়াজের বাজার।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের পাইকারি পেঁয়াজ বিক্রেতা মহিউদ্দিন জানান, গত ২০ ডিসেম্বর ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণার পর ২১ ডিসেম্বর সকালে পাইকারি বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৪৪ থেকে ৪৫ টাকায়। রাতেই দর বেড়ে হয় ৪৬ থেকে ৫০ টাকা। তিনি বলেন, গতকাল খুচরা বাজারে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৫৫-৫৬ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর শ্যামবাজারের পেঁয়াজ আমদানিকারক হুমায়ন কবির জানান, আগে প্রতিটন পেঁয়াজের জন্য বুকিং দেয়া ছিল ৫৭৫ ডলার। বর্তমানে তা ১ হাজার ২৫০ ডলার হয়েছে। কিন্তু ভারত থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় কোনো পেঁয়াজই আর দেশে আনা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, ভারতের এ ঘোষণায় অনেকেই এখন পেঁয়াজ মজুত করতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, ভারতজুড়ে এখন চলছে পেঁয়াজের আকাল, হু হু করে বাড়ছে দাম। দু’দিনেই কেজিতে পেঁয়াজের দাম ৪০ রুপি থেকে ৬০ রুপিতে উঠেছে। দেশব্যাপী পেঁয়াজের জোগান কমে যাওয়ায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পেঁয়াজ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ভারতে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উত্পাদন হয় অন্ধ্র প্রদেশ, কর্নাটক ও মহারাষ্ট্রে। এর মধ্যে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে পেঁয়াজ সরবরাহ করে অন্ধ্র ও কর্নাটক। কিন্তু এ দুটি রাজ্যে অতিবৃষ্টি হওয়ায় এবার উত্পাদন ব্যাহত হয়েছে।
রসুন ১৮০ টাকা কেজি : টিসিবির তথ্যে জানা গেছে, বছরের শুরুতে রসুনের দর ছিল প্রতিকেজি ৯০ থেকে ১১০ টাকা, বর্তমানে ১৮০ টাকা। হলুদের দর পয়লা জানুয়ারি ১৪০ টাকা ছিল, যা এখন ৩২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আদা ২০১০ সালের পয়লা জানুয়ারিতে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খুচরা বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা দরে। বর্তমানে তা ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছে টিসিবি।
পয়লা জানুয়ারি রাজধানীর মাছের বাজারে প্রতিকেজি রুই মাছ বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা দরে। বর্তমানে রুই ২০০ থেকে ২৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। টিসিবির হিসাবে রুই মাছের দর এ সময়ে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রয়লার মুরগির দর বছরের শুরুতে যেখানে ১২০ থেকে ১২৫ টাকা কেজি ছিল, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা।
চিনির দর আবারও ঊর্ধ্বমুখী : ২০১০ সালের শুরুতেই অস্থির হয়ে ওঠে চিনির বাজার। ২০০৯ সালের পয়লা জানুয়ারি যেখানে এক কেজি চিনির দর ৩১ থেকে ৩৪ টাকা ছিল, সেখানে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ৫৮ থেকে ৫৯ টাকায় গিয়ে ঠেকে। টিসিবি জানিয়েছে, গতকাল আরেক দফা চিনির দর বেড়ে বর্তমানে বাজারে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৫৭ টাকা দরে। তবে কারওয়ান বাজারে গিয়ে জানা গেছে, চিনির দর এখন ৫৯ থেকে ৬০ টাকা কেজি।
আইন আছে প্রয়োগ নেই : ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনসহ নিত্যপণ্যের বাজারে মুনাফাখোরী ও মজুতদারদের ব্যাপারে আইন আছে। তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি কাজী ফারুক গতকাল আমার দেশকে জানান, ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে বলা হয়েছিল, অর্থনৈতিক অপরাধীদের শাস্তি হবে। এ আইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বেশ কিছু কঠোর শাস্তির বিধান রাখা আছে। তবে এর প্রয়োগ এখন পর্যন্ত খুব একটা চোখে পড়ে না। তিনি বলেন, এ আইন ছাড়াও অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তির জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ করা হয়েছে। এ আইনেও অপরাধীদের সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা এবং সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান আছে। এটিরও প্রয়োগ নেই বলে অভিযোগ করেন তিনি

No comments:

Post a Comment