Wednesday 29 December 2010

গণতন্ত্রের নামে ফ্যাসিজম চলছে : বিশিষ্ট নাগরিকদের অভিমত : ক্রসফায়ার ও রিমান্ডে নির্যাতনে রেকর্ড, গণআন্দোলন না হলে স্বৈরাচার আরও শক্তিশালী হবে



স্টাফ রিপোর্টার
‘বাংলাদেশে আইনের শাসনের বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, রাজনীতিক, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেছেন, দেশে গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী শাসন চলছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও রিমান্ডের নামে নির্যাতনের ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিকে শ্বাসরুদ্ধকর বলে অভিহিত করে তারা বলেন, বিরাজমান অবস্থা থেকে গণতন্ত্র ও দেশবাসীকে মুক্ত করতে সর্বাত্মক গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবাদ ও আন্দোলন না হলে স্বৈরাচার আরও শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। তারা বলেন, বেকারত্ব, অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুত্-গ্যাসের তীব্র সঙ্কটসহ হাজারো সমস্যার সমাধান না করে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও মতের লোকদের দমনে মরিয়া সরকার। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এর উদ্যোগে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে এ গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
টিআইবির বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে মামলা দায়েরের প্রতিবাদ করে বক্তারা বলেন, বিচার বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে টিআইবির রিপোর্টের ব্যাপারে বিভিন্ন পত্রিকাও জরিপ করেছে। তাতে দেখা গেছে, শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ টিআইবির রিপোর্টকে সঠিক বলে মনে করেন। এতেই প্রমাণ হয় টিআইবির রিপোর্ট সঠিক। তারা বলেন, নির্যাতিতদের নিয়ে দেশের প্রতিটি জেলায় গণশুনানির আয়োজন করা হলে দেখা যাবে, সরকারি দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগের দ্বারা কত মানুষ নির্যাতন, নিপীড়ন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। বক্তারা বলেন, দেশের প্রধান তিনটি অঙ্গের মধ্যে নির্বাহী বিভাগ তথা প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। সংসদ রয়েছে অকার্যকর অবস্থায় আর বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা নেই। সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত কেউ আইনের তোয়াক্কা করছেন না। সরকারের অসহিষ্ণু আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, সরকারের পায়ের তলায় মাটি নেই। এজন্যই সরকারের সমালোচনা করা মাত্র তার বিরুদ্ধে হয় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা, না হয় মানহানি মামলা দিয়ে অথবা কোনো অভিযোগ ছাড়াই রিমান্ডে নিয়ে বর্বর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। বর্তমানে দেশে বিরাজমান অবস্থা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেন বক্তারা।
সুজন সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় বক্তব্য রাখেন বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, সাবেক সচিব এনাম আহমেদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না, অধ্যাপক আতাউর রহমান, রুহুল আমিন খান, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, মুসফা আলীম, সাইফুল আজম প্রমুখ। ‘বাংলাদেশে আইনের শাসনের বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক আবু ওবায়দুর রহমান।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার বলতে কিছু নেই। সবদিক বিবেচনা করলে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দেশের পরিস্থিতি এখন খুবই খারাপ। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারাও নির্যাতিত হচ্ছে। চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি সীমা ছাড়িয়েছে। এক অর্থে দেশের মানুষ তার নিজের জীবন নিয়েই শঙ্কিত ও উত্কণ্ঠিত। সুশাসনের আশা এখন দুরাশায় পরিণত হয়েছে। দেশের তিনটি প্রধান অঙ্গের মধ্যে নির্বাহী বিভাগ তথা প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। বিরোধী দলের অনুপস্থিতি আর সরকারের একদলীয় মনোভাবের কারণে সংসদ অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। বিচার বিভাগের ওপরও মানুষের আস্থা আর ভরসা নেই। শাসক দলের নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর সন্ত্রাসীরা এখন একসঙ্গে চলছে। শাসক দলের অন্যায়, অত্যাচার ও নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করছে মানুষ। প্রতিবাদ করতে গেলে ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে’র কথা বলে তা স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ‘মামলা আর রিমান্ড’ বিরোধী মতের লোকদের দমন করার জন্য—এই হচ্ছে সরকারের অস্ত্র। সরকারের এ অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আরও বলেন, প্রতিবাদ না করলে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিজম আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না। স্বৈরশাসকরা আরও শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। আগামী ৮ জানুয়ারি মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করে তিনি বলেন, সরকারের বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে তা রুখে দাঁড়াতে হবে। জনগণের প্রতিরোধ আর প্রতিবাদের কাছে ফ্যাসিজম হার মানতে বাধ্য। আমরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে ’৬২, ’৬৯, ’৭১ ও ’৯০ সালে দেখেছি গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ কীভাবে বিদায় নেয়।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, আইন কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়। এটি হচ্ছে একটি নৈতিক বিষয়। অথচ সরকার বর্তমানে আইনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে পক্ষপাতিত্বমূলকভাবে ব্যবহার করছে। সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সবক্ষেত্রেই আইন লঙ্ঘনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে আইনের শাসনের পরিবর্তে দেশে ব্যক্তি-মতের শাসন চলছে। সরকারি দলের এমপির গাড়িতে তারই আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে লোক নিহত হচ্ছে। অথচ তাকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। অপরদিকে সরকারের অন্যায় কর্মকাণ্ডের মৃদু সমালোচনা করলেই বিরোধী দল ও মতের লোকদের নামে গণ্ডায় গণ্ডায় মামলা দিয়ে আদালতকে ব্যবহার করে দিনের পর দিন রিমান্ডে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা হাজার হাজার। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের এ অবস্থা বর্ণনা করতে গেলে এক দীর্ঘ ইতিহাস হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমরা মূলত একটি অসহ্য ও বিপজ্জনক অবস্থার মধ্যে বসবাস করছি। দেশে আইনের শাসন নেই। চলছে এক ভয়ঙ্কর ফ্যাসিজম। আমরা দিন দিন অসভ্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছি। নারী নেত্রী মোশরেফা মিশুসহ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারের ঘটনা বর্ণনা করে তিনি বলেন, অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে মিশুকে রাত ২টায় পুলিশ গ্রেফতার করে পরে ৩০ দিন রিমান্ড চেয়েছে। এটাকে অসভ্যতা ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। সরকার যাকে খুশি গ্রেফতার করে ১০/১৫ দিন রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠাচ্ছে। আর আদালত বিচার-বিশ্লেষণ না করেই রিমান্ড মঞ্জুর করে নির্যাতনের জন্য পুলিশের হাতে ছেড়ে দিচ্ছে। সরকারি দলের নেতারা নিরীহ মানুষের জমি দখল করছে, রাষ্ট্রের অর্থ লুট করছে, চাঁদাবাজি করছে, মানুষ হত্যা করছে। তাদের ব্যাপারে আইনের প্রয়োগ হতে দেখা যাচ্ছে না। সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের সমালোচনা করলেই আইনকে তাত্ক্ষণিকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার নির্বাচিত হলেই গণতান্ত্রিক হয় না। হিটলারও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন। বর্তমানে দেশে যে ফ্যাসিজম ও স্বৈরতন্ত্র চলছে, তার বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে আমাদের সবাইকে অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেই বেঁচে থাকতে হবে।
অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো সরকার দেশ শাসন করেছে, তারা কেউই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেনি। কেউ গণতন্ত্রের নামে, কেউ সামরিক শাসনের নামে দেশে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছেন। ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত ওই সময়ের শাসন যারা দেখেছেন, তাদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কাকে বলে। ওই শুধু কালো আইনই হয়নি, সংবিধান সংশোধন করে অনেক ত্যাগ আর লক্ষপ্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বহুদলীয় গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করা হয়েছিল। বহু রাজনৈতিক নেতা গুম হয়েছিলেন ওই সময়। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ৪টি সংবাদপত্র রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। বিশেষ বাহিনীর অত্যাচারের কথা মনে করলে মানুষ আজও শিউরে ওঠে। এর ধারাবাহিকতা থেকে পরবর্তী সরকারগুলো বেরিয়ে আসার চেষ্টা খুব একটা করেনি। বর্তমানের অবস্থা আরও শোচনীয়। সরকারি দলের নেতারা প্রকাশ্যে আইন ভঙ্গ করে চলেছেন। সরকারি দলের এমপির গাড়িতে তার ব্যবহার করা অস্ত্রের গুলিতে তারই দলের অপর নেতা নিহত হলেন। এখানে সরকার আইন প্রয়োগ করেনি। সরকারি দলের এক সংসদ সদস্য পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করেছেন। পুলিশ মামলা করার পর এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের অনেকেই একে ভুল বোঝাবুঝি বলে উড়িয়ে দিলেন। অথচ সরকারি দলের আক্রমণের শিকার বিরোধী দলের এমপিকে চিকিত্সাধীন অবস্থায় হাসপাতাল থেকে পুলিশ চ্যাংদোলা করে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সরকার আইনকে বিরোধী দল দমনের জন্য ব্যবহার করছে। দেশের সিংহভাগ মানুষ অবিচারের শিকার।
বিচার বিভাগ নিয়ে টিআইবি প্রকাশিত প্রতিবেদন ও এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরকারের মামলার প্রসঙ্গ তুলে ধরে ড. আসিফ নজরুল আরও বলেন, বিচার বিভাগ যে দুর্নীতিগ্রস্ত তা সরকারই প্রমাণ করে দিচ্ছে। সকালে আদালত ওয়ারেন্ট জারি করে আবার সারাদিন গোপন তত্পরতা ও সরকারের নির্দেশের পর রাতে আদালত বসে তা খারিজ করে দেয়। আদালতকে সরকার তার আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। এ ঘটনাই তার প্রমাণ। টিআইবি প্রকাশিত রিপোর্টের বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকা জরিপ করেছে। তাতে শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ টিআইবির রিপোর্টকে সঠিক বলে মত দিয়েছেন। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়ার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, একজন রাজনীতিবিদকে গ্রেফতারের পর নিত্যনতুন হাস্যকর ঘটনায় মামলা দিয়ে দিনের পর দিন রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। কথায় কথায় রিমান্ডের এ ঘটনা এর আগে কখনোই দেখা যায়নি। গণশুনানির ব্যবস্থা করা হলে দেখা যাবে দেশের কত শতাংশ মানুষ রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, আমরা দিন দিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছি। নির্বাচিত স্বৈরাচারের শাসন সামরিক শাসনের চেয়েও ভয়ঙ্কর। বর্তমানে দেশের মানুষ তা উপলব্ধি করতে পারছে। আইনের শাসন বলতে যা বোঝায়, বর্তমানে দেশে তা সম্পূর্ণই অনুপস্থিত। অনেকে মনে করেন, দেশে এখন নির্বাচিত ফ্যাসিজম চলছে। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে সবাই বসবাস করছি। এ অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। গণতন্ত্রের লেবাসে দেশে এখন অনেকটাই স্বৈরতন্ত্র চলছে। বিচার বিভাগের ওপরও মানুষের কোনো আস্থা নেই। এক বাবার একটি ছেলে খুন হলো। তিনি অপর ছেলেকে হারানোর ভয়ে থানায় মামলাও করতে সাহস পাচ্ছেন না। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা করে তিনি জীবিত থাকতে পারবেন—রাষ্ট্র এ নিরাপত্তাটুকু দিতে পারছে না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে গৌরব অর্জন করেছি, তা আজ হারিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতনের ভয়ে আমরা সাহস করে প্রতিবাদও করতে পারছি না। হয়রানি ও নির্যাতনের ভয় থাকা সত্ত্বেও আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, দেশে বর্তমানে যে আইনবহির্ভূত শাসন চলছে আমি তা মানি না। আমি এ ফ্যাসিজমের অবসান চাই। তিনি বলেন, একজন গার্মেন্ট মালিক একজন শ্রমিককে তিন হাজার টাকা দিতে রাজি হচ্ছেন না। অথচ তিনি এই শ্রমিকদের ঘাম ঝরানো অর্থে প্রতি সেকেন্ডে তিন হাজার টাকা তার আয়েশি জীবন-যাপনের জন্য ব্যয় করছেন। মার্কেটগুলোতে লাখ টাকা দামের লেহেঙ্গা বিক্রি হচ্ছে। নারী নেত্রী মোশরেফা মিশু এর প্রতিবাদ করেছেন বলে তাকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করে হাসপাতালে ফেলে রাখা হয়েছে। অথচ মালিকদের শোষণের কারণে যে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হলো, সেই রক্তচোষা মালিকদের বিরুদ্ধে সরকার একটি কথা পর্যন্ত বলছে না। তিনি বলেন, একজন পুলিশ অফিসারের কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা তার ব্যাজ খুলে নিয়ে হুমকি দিয়ে বলেছে, তোর ব্যাজ খুলে নিলাম। এরপর তোর বাবার ব্যাজও খুলে নেব। সাবধান হয়ে কাজ করিস। আজ সবাই আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। সরকারের এ অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন প্রয়োজন। এ জন্য জনমত গঠন করতে হবে।
বিচারপতি এবাদুল হক চৌধুরী বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। এমপিরা এখন আইন প্রণয়নের পরিবর্তে রাস্তাঘাট, স্থানীয় প্রশাসন আর সরকারি বরাদ্দ নিয়ে বেশি উত্সাহী। গণতন্ত্রের জন্য এটা শুভ লক্ষণ নয়।
এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, দেশে আমরা এক অঘোষিত ফ্যাসিজম দেখতে পাচ্ছি। আইনের শাসন তো দূরের কথা, সরকার প্রতি পদে আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করে চলেছে। সরকারের বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিবাদ ও আন্দোলন হতে হবে। তা না হলে দেশে ফ্যাসিজম আরও শক্তিশালী হবে। গণতন্ত্র ও বহুমতের ধারাবাহিকতা হারিয়ে যাবে। তিনি বলেন, রিমান্ডের নামে বর্তমানে যে আলামত চলছে তা শুভ নয়। আমার জীবনেও এ ধরনের রিমান্ডের কথা শুনিনি। দেশে অবসরপ্রাপ্ত হাজার হাজার ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। যারা তাদের গোটা চাকরি জীবনে একটিও রিমান্ড মঞ্জুর করেননি। কেউ কেউ সারা জীবনে দু’একটি রিমান্ড মঞ্জুর করলেও তার আগে মামলার নথি, এজাহার, পুলিশের বক্তব্য, আসামির বক্তব্য যাচাই-বাছাই করে দেখতেন। বর্তমানে পুলিশ যেনতেন মামলায় রিমান্ড চেয়ে বসল, আর ম্যাজিস্ট্রেট পরীক্ষা-নিরীক্ষা এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুনানি ছাড়াই রিমান্ড মঞ্জুর করছেন। একটি সুস্থ সমাজের জন্য এগুলো কোনো অবস্থায় মেনে নেয়া যায় না। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের ব্যাপারে একটি নীতিমালা করা দরকার।
এনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকার সমস্যা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিদ্যুত্ ও গ্যাস সঙ্কটের তীব্রতা, সীমান্তে নির্বিচারে বাংলাদেশীদের ওপর বিএসএফের হত্যাযজ্ঞ, সরকারি দলের দখলবাজি আর টেন্ডারবাজিসহ হাজার হাজার সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ। ইচ্ছা থাকলেও এ সমস্যা নিয়ে কথা বলা যায় না। সরকার মনে কষ্ট পেলে একটি মামলা দিয়েই রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন শুরু করে দেবে। কেননা মন্ত্রীরা এখন নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের দিকে না তাকিয়ে সবাই গ্রেফতারের বিষয়ে উত্সাহী। মন্ত্রীরাই আগে বলেন কাকে কখন গ্রেফতার করতে হবে। কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলেই সরকার হয়তো ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজে পাবে। তখন আর রেহাই পাওয়া যাবে না। মূলত সরকার দেশের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানে কাজ না করে বিরোধী দল ও মতের মানুষদের দমনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। এজন্য সমস্যার পাহাড় তৈরি হচ্ছে। আর সবকিছুর জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করা হচ্ছে। দেশের মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
মাহমুদুর রহমান মান্না বিচারকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, একসময় উচ্চ আদালতের বিচারকরাই সামরিক শাসনকে বৈধ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আবার এখন দেখছি সেই উচ্চ আদালতের বিচারকরাই সামরিক শাসনকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন। ভবিষ্যতে হয়তো আবার অন্যরকমও দেখব। সরকারের সামনে দিন দিন অনেক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। জনগণ ভোট দিয়ে এ সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে দেশের জন্য কাজ করতে। এটা অস্বীকার কোনো সুযোগ নেই যে, দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত, গ্যাস ও বিদ্যুত্ সঙ্কট বাড়ছে, বেকার সমস্যা প্রকট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সীমান্তে মানুষ খুন হচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রীদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের বিচার ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো কাজ নেই। এ বিষয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে ৪-৫ জন মন্ত্রীর মধ্যে এখন প্রতিযোগিতা চলছে। কেউ কেউ বিচারের সময়সীমাও বেঁধে দিচ্ছেন। কাকে কখন গ্রেফতার করা হবে, মন্ত্রীরা তা আগে বলে দিচ্ছেন। এতে ট্রাইব্যুনালের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এসব প্রশ্ন এড়াতে আইনকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেয়া উচিত। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হোক—এটা সবারই প্রত্যাশা। আমরা কেউ চাই না যে দেশটা ফ্যাসিজমের দিকে ধাবিত হোক।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, গত এক বছরে ২২৭ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বর্তমানে গুপ্তহত্যার ঘটনাও উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় ৫৩ জন আসামি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থেকে মারা গেছেন। সরকার রাজনৈতিক স্বার্থে একের পর এক কালো প্রণয়ন করছে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন এখন পর্যন্ত কেউই বাতিল করেনি। ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও ১৬৭ ধারায় রিমান্ডের নামে নির্যাতন বন্ধের জন্য হাইকোর্ট ফৌজদারি কার্যবিধির এ দুটি ধারা সংশোধনের নির্দেশ দিলেও আজ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় নিজেদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নিলেও বিরোধী দলেরগুলো প্রত্যাহার হয়নি। অথচ জরুরি অবস্থার সময় প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার না করে তাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে এ প্রবন্ধে। একই সঙ্গে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করে জনগণের সামনে নিজেদের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে

No comments:

Post a Comment