Saturday 16 July 2011

মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে লজ্জাজনক ব্যবসা






কাদের গনি চৌধুরী
মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে চলছে লজ্জাজনক ব্যবসা। গত আড়াই বছর ধরে এ ঘটনা অবাধে ঘটে চললেও তেমন একটা ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে ভুয়া সনদ দিয়ে কেউ চাকরি বাগিয়ে নিচ্ছেন, কেউ বা অতিরিক্ত দুই বছর চাকরি করছেন। আর জাল সনদের তোড়ে মেধাবীরা হচ্ছেন চাকরিবঞ্চিত। জাল মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটের ব্যাপারে কঠোর হওয়ার জন্য গত বছরের ১ নভেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। এতেও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, সরকারের একটি প্রভাবশালী মহল এ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকায় এ নিয়ে বেশি কঠোরতা অবলম্বন করা হয় না।অভিযোগ রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই অনেককেই দেয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সনদ। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কোনো তালিকা, চারটি গেজেট, এমনকি মুক্তিবার্তায়ও নেই—এমন অনেকের নামেই সার্টিফিকেট ইস্যু হচ্ছে। এছাড়া ভুয়া তথ্যও দিয়েছেন অনেকে। তারপরও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা সরাসরি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বাধ্য করছেন এসব সনদপত্র ইস্যুতে। সেই সুযোগে সনদপত্র বাগিয়ে নিয়েছেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা। অবশ্য এজন্য মোটা অংকের অর্থের লেনদেনও হয়েছে।সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স বাড়ানোর আদেশ জারির পর এই সুবিধা গ্রহণ করতেই মূলত ভুয়া সার্টিফিকেটের এই বাণিজ্য শুরু হয়। জাল সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরির বয়স বাড়ানোর অভিয়োগ উঠেছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী শাহাবউদ্দিন, পরিবেশ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আব্দুস সোবহান, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব সুনীল কান্তি বোস-এর মতো শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও। ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব এলপিআর-এ (বর্তমানে পিআরএল) যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে হঠাত্ করে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জমা দেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের আবেদনের সঙ্গে। এ নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর এক পর্যায়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিবের বিপক্ষে পদক্ষেপ নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে তার কাগজপত্রও চেয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কোনো এক অদৃশ্য কারণে সে প্রক্রিয়াও থেমে যায়। মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দেড় হাজার লোক নিয়োগ পেয়েছেন। পুলিশ বাহিনীতে অনেকে চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন। এরই মধ্যে দু’দফায় ৩১ জনের চাকরি গেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োগেও একই অবস্থা হয়েছে।শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন করা এক হাজার ৩৩৮ জনের মধ্যে ১৫২ জনের সনদই ছিল ভুয়া। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগেও ঘটেছে একই ঘটনা। এদিকে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তার অবসরের বয়স দুই বছর বাড়ানোর পর অনেকেই নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে আবেদন করেন। এ রকম আবেদনকারী ২৫ জন পদস্থ কর্মকর্তার সনদ সন্দেহজনক চিহ্নিত করে তদন্ত করা হচ্ছে।ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযোদ্ধার জন্য প্রযোজ্য রাষ্ট্রীয় সুবিধা নেওয়া সাত হাজার জনের সনদও সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর জাল করেও কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর তদন্ত এবং যাচাই-বাছাইয়ে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।গত ৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুক্তিযোদ্ধা চাকরিজীবীদের অবসরের বয়স বাড়ানো-সম্পর্কিত সার-সংক্ষেপ অনুমোদনকালে সনদ যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দেন। সার-সংক্ষেপের একাংশে তিনি উল্লেখ করেন, মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দেড় হাজার লোক নিয়োগ পেয়েছেন। অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োগেও একই অবস্থা হয়েছে।প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা পরিদফতর (এনএসআই) এ নিয়ে তদন্ত এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই শুরু করে। এই প্রক্রিয়া এখনো চলছে। মুক্তিবার্তা এবং বিভিন্ন সময়ে গেজেটে (এ পর্যন্ত চারটি) প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা অনুসরণ করে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধার কোনো তালিকায় নাম না থাকলেও সনদ রয়েছে, এমন ব্যক্তিদের সনদও পরীক্ষা করা হচ্ছে।মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর সূত্র জানায়, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেন এক লাখ ৩০ হাজার প্রার্থী। এদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন করেন এক হাজার ৩৩৮ জন। এদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষাও হয়ে গেছে। কিন্তু যাচাই-বাছাইয়ের কারণে এখনও ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছে না।গোয়েন্দা সংস্থা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং উপজেলা, জেলা ও মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ও জাতীয় মুুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) তদন্ত, যাচাই-বাছাই শেষে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৫২ জনের সনদ সঠিক নয়।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই ১৫২ জনের মধ্যে ২৯ জনের সনদ ভুয়া, ১৩ জনের উপযুক্ত সনদ নেই, ১৮ জনের সনদ যাচাইয়ের উপযুক্ত নয়, ৪১ জনের সনদ গ্রহণযোগ্য নয় এবং ৫১ জনের সনদ নিবন্ধন তালিকাভুক্ত নয়। তবে অপরিচ্ছন্ন থাকায় যে ১৮ জনের সনদ যাচাই সম্ভব হয়নি, তারা আবার কাগজপত্র দাখিল করতে পারবেন। আইন মন্ত্রণালয সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে ভুয়া সনদ দিয়ে ১৯০ জন সাব-রেজিস্ট্রার পদে চাকরি বাগিয়ে দেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পরপরই এদের সাব-রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ করা হয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শারীরিক প্রতিবন্ধী সাবিনা ইয়াছমীনের বয়স ছিল ছয় বছরের কম। তিনি নার্স হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। ওই সময় তিনি ছিলেন মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী। এই তথ্য দিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার পদে চাকরি পেয়েছেন সাবিনা। মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচয় দিয়ে সাবিনার মতো অন্য সবাই এ পদে চাকরি পেয়েছেন। এ নিয়ে দৈনিক আমার দেশে রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচয়ে সাব-রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রতিবেদনেও ভুয়া তথ্য দিয়ে নিয়োগ পাওয়ার ঘটনা ধরা পড়ে।কমিটি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে ২৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দিয়েছে। জানা গেছে, গত বছর ১৯ জুন সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে তদন্ত করে তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার সুপারিশ করা করা। সে অনুযায়ী আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন-২) মজনুল আহসানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ওই বছরের ২২ জুন তদন্ত শুরু করে। কমিটি নিয়োগ-সংক্রান্ত মূল নথি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে। এরপর ৩০ জুন ঢাকা বিভাগের ৪৭ জনের, ১ জুলাই চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ৩২ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়। পর্যায়ক্রমে অন্যদেরও সাক্ষ্য নেয়া হয়। প্রায় এক বছর পর গত মাসে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয়। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (মতামত) সহিদুল করিম ও উপসচিব আবু আহমেদ জমাদ্দার।কমিটি সূত্র জানায়, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচয়ে নিয়োগ পাওয়া ১৯০ সাব-রেজিস্ট্রারের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। বাকি ১৮৯ জনের কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে তাদের বয়স ছিল তিন বছর থেকে ১৯ বছর। এর মধ্যে চারজনের বয়স ছিল তিন বছর, ১৩ জনের বয়স ছিল তিন থেকে পাঁচ বছর, পাঁচ থেকে সাত বছর বয়স ছিল ৩৯ জনের, সাত থেকে আট বছর বয়স ছিল ২১ জনের, আট থেকে ৯ বছর বয়স ছিল ১৮ জনের, ৯ থেকে ১০ বছর বয়স ছিল ১২ জনের, ১০ থেকে ১১ বছর বয়স ছিল ২০ জনের, ১১ থেকে ১২ বছর বয়স ছিল ১১ জনের, ১২ থেকে ১৩ বছর বয়স ছিল ১২ জনের, ১৩ থেকে ১৪ বছর বয়স ছিল ১৩ জনের, ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়স ছিল ১১ জনের এবং ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়স ছিল ১৬ জনের।এদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে তথ্য প্রদানকারী (ইনফরমার) হিসেবে ১৩৪ জন, ক্যাম্প সহকারী হিসেবে ১৫ জন, নার্স সহকারী হিসেবে ১৫ জন, পলিটিক্যাল মোটিভেটর (রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টিকারী) ১০ জন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাতজন, গোয়েন্দা হিসেবে দু’জন এবং ভাণ্ডাররক্ষক হিসেবে কাজ করেছিলেন এমন তথ্য দিয়ে একজনের চাকরি হয়। বাকি তিনজন তাদের দায়িত্বের কথা উল্লেখ করতে পারেননি।তারা ভারতের ১৯টি ক্যাম্প বা শিবিরের অধীন কাজ করেন বলে জানান। সেগুলো হলো বশিরহাট ক্যাম্প, সাহেবগঞ্জ যুবশিবির, টালীখোলা যুবক্যাম্প, খোচাবাড়ী, কাকড়ীপাড়া, নাজিরহাট, চোতাখোলা, চৌধুরীহাট, কল্যাণী মধ্যমগ্রাম, মাঝিরহাট, মানকারচর, কাচিহাটা, আগরতলা, বনগাঁও, দিনহাটা, থোবা, বামনহাট, কুচবিহার, শীলকুচি ও কৃষ্ণনগর।২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে পুলিশে লোক নিয়োগের সময় মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে অনেকে চাকরি পান বলে ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। এরপর তদন্ত করে ২৪ জনের জাল সার্টিফিকেট ধরা পড়ে। তাদের গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে চারজনকে শুক্রবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে এনেছে পুলিশ। বাকি ১৯ জনকে আদালত জেলহাজতে পাঠিয়েছেন। গ্রেফতার হওয়া কনস্টেবলদের বাড়ি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। মামলার এজাহার মোতাবেক সনদ জালিয়াতির সঙ্গে ২৪ জন জড়িত। এদের মধ্যে একজন মহিলা পুলিশ রয়েছেন। তিনি এখনও গ্রেফতার হননি। জালিয়াতির আশ্রয়গ্রহণকারীদের কেউই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান নয়।গ্রেফতারকৃত ২৩ জনকে শুক্রবার দুপুরে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করে তাদের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়। মহানগর হাকিম মিজানুর রহমান শুনানি শেষে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চারজনের প্রত্যেকের একদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া পুলিশ সদস্য শরিফুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, ফিরোজ কবির ও রনি মিয়াকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।এর আগে গাইবান্ধার পুলিশলাইনে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দিয়ে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ১০ জন পুলিশে চাকরি নিতে গিয়ে ধরা পড়েন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র, আইন, বিমান ও পর্যটন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, পরিবেশ, খাদ্যসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগের জন্য আবেদনকারী ২১ হাজার জনের সনদের বিষয়ে যাচাই-বাছাই করছে।মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সারসংক্ষেপে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের নিবন্ধন বইয়ে লিপিবদ্ধ নেই, এমন কিছু ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সই করা মুক্তিযোদ্ধার সনদ চাকরির ক্ষেত্রে সংযুক্ত করেছেন। সারসংক্ষেপে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়, কিছু ব্যক্তি প্রযুক্তি অপপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর জাল করে অবৈধ সুযোগ নিচ্ছেন।সারসংক্ষেপে আরও বলা হয়, তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য কমপক্ষে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। তবে আইনগতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল প্রয়োজন মনে করলে যে কোনো গোয়েন্দা সংস্থা বা প্রশাসনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা-সম্পর্কিত তথ্যাদি যাচাই-বাছাই করতে পারে।সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা সনদ যাচাই সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এ পর্যন্ত দু’দফা তাগিদ দিয়েও জবাব পাওয়া যায়নি।সূত্র জানায়, মুক্তিযোদ্ধার জন্য প্রযোজ্য রাষ্ট্রীয় সুবিধা নেয়া সাত হাজার ব্যক্তি তাদের সনদ নবায়নের আবেদন করেছেন। মুক্তিবার্তা বা চারটি গেজেটের কোনোটিতে তাদের নাম নেই। তাই এগুলো সরকার যাচাই-বাছাই করছে।যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. শাহাবুদ্দিনের মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটটিও ভুয়া। এ ব্যাপারে ব্যাপক সমালোচনা হওয়ার পর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল শাহাবুদ্দিনের মুক্তিযোদ্ধা-সম্পর্কিত তথ্যাদি তদন্ত করতে এনএসআইয়ের কাছে পাঠিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অবসরের বয়স বাড়ানোর জন্য আবেদন করা কর্মকর্তাদের মধ্যে যে ২৫ জনের সনদ সন্দেহের তালিকায় রয়েছে, তিনি তাদের একজন। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল সওজের প্রধান প্রকৌশলীর মোবাইলে কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।অপর যে ২৩ জনের সনদ সন্দেহজনক বলে যাচাইবাছাই চলছে তারা হলেন—পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী; অর্থ মন্ত্রণালয়ের দু’জন ঊর্ধ্বতন মুখ্য কর্মকর্তা, অ্যাপ্রেইজার, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা এক্সাইজ ও ভ্যাট টঙ্গী সার্কেল, একজন ফোরম্যান; ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক (সমন্বয়); প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের চিফ ইনস্ট্রাক্টর; দু’জন সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক; বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী; একজন উপজেলা প্রকৌশলী; একজন সহযোগী অধ্যাপক; একজন প্রধান শিক্ষক; খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের একজন উপপরিচালক; একজন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা; পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের হিসাব সহকারী, পরিবহনচালক; যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পার্সেল সহকারী, বুকিং সহকারী, একজন ওয়েম্যান ও উচ্চমান সহকারী; স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক।তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কেবিনেট সেক্রেটারি ড. আকবর আলি খান আমার দেশকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট জালিয়াতির ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকারের উচিত এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া। তিনি বলেন, এটি নতুন সমস্যা নয়। এর আগেও এটি হয়েছে। কোনো সরকারই কার্যকর কিছু করেনি।নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত বৃহস্পতিবার একজন সচিব আমার দেশকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজ করবে, দেশের মানুষ সেটা কোনোভাবেই প্রত্যাশা করে না। অথচ এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলোই ঘটছে। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে যা হচ্ছে, তাতে সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি কিনা, সেটাই অনেককে নতুন করে ভাবার অবকাশ দিয়েছে। কারণ, শুধু অমুক্তিযোদ্ধাই নয়, এমনকি রাজাকারকেও মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেয়া হয়েছে এই সরকারের আমলে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এ পর্যন্ত জাতীয় তালিকায় প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ দুই হাজার ৫৫৮ জন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা কমান্ড কাউন্সিল নির্বাচন, ২০১০-এর ভোটার তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ৬২ হাজার ৩৫৫ জন, গেজেটে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ৯৯ হাজার ৭৪৫ জন, মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ৫৪ হাজার, ইবিআরসি তালিকায় প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৬৮ হাজার ৯৩ জন, কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকায় প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন।

No comments:

Post a Comment