Tuesday 12 July 2011

ঠুনকো অজুহাতে সরকারি কর্মকর্তারা চাকরি হারাচ্ছেন








কাদের গনি চৌধুরী
কথায় কথায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমানের সমালোচনা, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করা এবং ভিন্নমত পোষণের কারণে বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি হারাতে হচ্ছে। ভিন্নমতের যারা চাকরিতে টিকে আছেন তাদেরও প্রতিনিয়ত সইতে হচ্ছে নানা গঞ্জনা। পূর্বশত্রুতার জের ধরে শেখ মুজিব বা শেখ হাসিনার সমালোচনা করা হয়েছে, এমন মিথ্যা তথ্যের ওপর ভর করেও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের কোনো কোনো কর্মকর্তাকে। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সরকারের সময় ৩২ ক্যাডার কর্মকর্তা চাকরি হারিয়েছেন। এদের মধ্যে একজন সচিব রয়েছেন। চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিতে হয়েছে সাবেক কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়াসহ আরও কয়েকজনকে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর শতাধিক কর্মচারীর চাকরি গেছে এসময়।সরকারের সর্বশেষ রোষানলের শিকার হয়েছেন বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী সমন্বয় পরিষদের মহাসচিব মো. সালেউদ্দিন সেলিম। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী সমন্বয় পরিষদের কার্যালয় দখলের বিরুদ্ধে কথা বলায় গত ৩ জুলাই তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এর আগে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয় শরীয়তপুর সরকারি কলেজে। সেখানে যোগদানও করেন তিনি। এরপর কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে আবার কাজে যোগদান করতে গেলে তাকে আর যোগদান করতে দেয়া হয়নি। বলা হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তাকে যোগদানের অনুমতি প্রদানে নিষেধ রয়েছে। উপায়ান্তর না দেখে তিনি প্রিন্সিপালের কাছে ছুটির আবেদন করেন। একটানা ৩৭ বছর সরকারি চাকরি করেছেন এ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। এক মাস পরই তার পিআরএলে যাওয়ার কথা। শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত চাকরিজীবনের একেবারে শেষ মুহূর্তে তাকে চাকরিচ্যুত করা হলো। এর ফলে পেনশন ভাতা থেকেও বঞ্চিত হলেন তিনি। জানা যায়, ২০০৩ সালে বিজয় দিবস উপলক্ষে বন মিনিস্ট্রিয়াল কর্মচারী সমিতির একটি সংকলনে তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে সম্বোধন করে একটি বাণী দিয়েছিলেন। এটাকে ইস্যু করে শিক্ষা অফিসার মু. আবুল কাসেম ডিজির পক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন মহলে চিঠি দেন। তখন প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে সালেউদ্দিন সেলিমকে চাকরিচ্যুত করার নির্দেশ দেয়া হয় বলে সংগঠনটি দাবি করেছে। তবে তার চাকরিচ্যুতির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন অননুমোদিতভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার কারণে তাকে বিধি মোতাবেক চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, যেহেতু সালেউদ্দিন সেলিম ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল থেকে কর্তব্য কাজে অননুমোদিতভাবে অনুপস্থিত থেকে অত্যন্ত সুকৌশলে বাংলাদেশ সচিবালয়সহ দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থেকে সরকারি কাজে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যেহেতু তার বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্ট স্যুয়োমোটো রুল ১১/২০১০ ইস্যু হয় এবং রুলের শুনানি শেষে মহামান্য হাইকোর্ট সালেউদ্দিন সেলিমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান/তদন্ত করে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রায় প্রদান করেন এবং মহামান্য হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী তদন্ত করে কর্মকর্তা মো. সালেউদ্দিন সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। যেহেতু তিনি ১৫ মাস কর্মস্থলে অননুমোদিতভাবে অনুপস্থিত রয়েছেন এবং তার কর্মকাণ্ড সরকারি চাকরিবিধির পরিপন্থী, যা সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ ১৯৭৯-এর ৩ (এ), (বি) এবং (সি) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেহেতু মো. সালেউদ্দিন সেলিমকে সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ ১৯৭৯-এর ৪ (এ) ধারা অনুযায়ী তার কর্তব্য-কাজে অননুমোদিত অনুপস্থিতিসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল করে শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনাসহ মহামান্য হাইকোর্টের স্যুয়োমোটো রুলের রায় অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তাকে ৪ এপ্রিল, ২০১০ থেকে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো।জানা যায়, ২০০৩ সালে বিজয় দিবস উপলক্ষে বন মিনিস্ট্রিয়াল কর্মচারী সমিতির একটি সংকলনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে সম্বোধন করে একটি বাণী দেয়ায় তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার স্যুয়োমোটো রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ। এর আগে শেখ মুজিব ও তার পরিবারকে হেয় করে কবিতা লেখার অভিযোগে তথ্য সচিব আ ত ম ফজলুল করিমকে (আবু করিম) বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আ ত ম ফজলুল করিমই (আবু করিম) প্রথম শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা যাকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে চাকরি থেকে বের করে দেয়া হয়।আদেশে বলা হয়, ‘চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় তাকে অবসরে পাঠানো হলো।’২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব পদ থেকে আ ত ম ফজলুল করিমকে তথ্য সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়।শেখ মুজিবকে ‘আলু বোখরা’ উপাধি দিয়ে কবিতা লেখার অভিযোগ এনে তথ্য সচিবের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন আওয়ামী ওলামা লীগের সভাপতি মাওলানা মো. ইলিয়াস হোসেন বিন হেলালী। আলু বোখারা একটি সুস্বাদু আফগান ফলের নাম। এ ঘটনার পরপরই তার বিসিএস অফিসার (সহকারী সচিব) মেয়েকেও চাকরি ছাড়তে হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগের ওপর ভর করে আরকাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. শাহাব উদ্দিন খানকে ২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট চাকরিচ্যুত করা হয়। তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অভিযোগ করেন, শেখ মুজিবুর রহমানের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জাতীয় শোকদিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিতব্য প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে তিনি বাধা প্রদান করেছেন। এ অভিযোগ পাওয়ার পর আর দেরি না করে তাকে সাময়িকভাবে চাকরিচ্যুত করে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। ১২.১১.২০০৯ তারিখে তিনি ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশ নিয়ে বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি এ ধরনের কোনো কাজই করেননি। কিন্তু তার বক্তব্য মন্ত্রণালয় গ্রহণ না করে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫-এর ৭(২)(সি) উপবিধি অনুসারে ২০০৯ সালের ২৩ নভেম্বর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব আবদুল ওয়াহাব খানকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। তদন্ত কমিটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দেন, আরকাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. শাহাব উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। আরকাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদফতরের নতুন পরিচালকও জানান যে, শাহাব উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগটি সত্য নয়। অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে এক বছর পর আবার তার চাকরি ফিরিয়ে দেয়া হয়। খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, ভারপ্রাপ্ত পরিচালক তার পদটি আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য এ কৌশল নিয়েছিল। উপ-পরিচালক মো. শাহাব উদ্দিন খান তাকে সরিয়ে পরিচালক হতে পারেন এমন আশঙ্কা থেকে তিনি এ ধরনের হীনমন্যতার পরিচয় দেন বলে জানা যায়। এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকারের আমলে ৩০ জন বিসিএস অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পিএস শামসুল আলম (আইডি-৪১৩২), মোহাম্মদ মহসিন (আইডি-১৩৫১), মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন (আইডি-১১১৩),আহসান উল করিম (আইডি-৭১৯৯), আবুল মোসাদ্দেক আজাদ (আইডি-১৮৭৯), মো. আজিজুল ফারুক (আইডি-১৬০৯), আলাউদ্দিন আহমদ চৌধুরী (আইডি-৫৩০৮), নন্দিতা দত্ত (আইডি-৬৩৬৮), মোহাম্মদ বাহারূল ইসলাম (আইডি-৩৩৭৪), কামরুন নাহান বেগম (আইডি-৪৬১১), একেএম আবদুুল্লাহ আল রেজা (আইডি-১৬২৩২), ইশরাত শবনম (আইডি-১৬২১৭), নিশাত সুলতানা (আইডি-১৬১২৪), জান্নাত ফাতেমা (আইডি-১৬২০৫), মোহাম্মদ মিল্লাত হোসাইন (আইডি-১৬৪৫৬), মো. শাহাদাত হোসেন (আইডি-১৬১৪৩), নাসরিন সুলতানা রোজি (আইডি-১৫৮৯৯), ইফফাত ইয়াসমিন মান্নান (আইডি-১৬২৫০) সোহায়েল আহমেদ মোতাহির চৌধুরী (আইডি-৪১৬৫), অঞ্জন কুমার চাকমা (আইডি-৪০৭৫), আঞ্জুমুন আরা বেগম (আইডি-৩৬৯০), আজিজুল আলম শাহ (আইডি-৬৬৪১), ইফতেখারুল আমিন (আইডি-১৬০৭২), আবদুল্লাহ আল ইমরান খান (আইডি-১৫৭৭৫), রিয়াদ মাহমুদ (আইডি-১৫২৪৫), রোজারিনা ওমর (আইডি-১৫৬২০) ও নূশেরা তাজরিন (আইডি-১৫০৩৮)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৭ কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়

No comments:

Post a Comment