Monday 11 July 2011

হরতালে ব্যাপক সহিংসতা : ইসলামী দলগুলোর আড়াই হাজার কর্মী আহত : গ্রেফতার দেড় হাজার










স্টাফ রিপোর্টার
ইসলামী ও সমমনা দলগুলোর ৩০ ঘণ্টা হরতালের প্রথমদিনে গতকাল ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। মারমুখী পুলিশ-র্যাবের সঙ্গে সরকারি দলের ক্যাডাররাও হরতাল সমর্থকদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালিয়েছে। পিকেটারদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে কাঁচপুর, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে হরতাল সমর্থকরা। কাঁচপুর ব্রিজ থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত পুরো এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, গুলি ও লাঠিচার্জে আড়াই হাজারেরও অধিক হরতাল সমর্থক আহত হন। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা নেজাম উদ্দিন, সম্মিলিত উলামা-মাশায়েখ পরিষদের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সাংগঠনিক সম্পাদক হুমায়ুন কবীরসহ সারাদেশ থেকে পুলিশ দেড় হাজারের অধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। ফতুল্লায় হরতাল সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজিসহ ১২ পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন। রাজপথে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে অর্ধশতাধিক হরতাল সমর্থককে দণ্ড দেয়া হয়।
এদিকে হরতাল ঠেকাতে ইসলামী দলগুলোর কার্যালয়ে ঢুকে পুলিশ তাণ্ডব চালায়। অবরুদ্ধ করে রাখে দলগুলোর সারাদেশের কার্যালয়। ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীরা কার্যালয়ের মুখে অবস্থান নিয়ে ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ জিকির করেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় পুলিশ অবরুদ্ধ করে রাখে। হাজার হাজার পুলিশের ব্যাপক রণপ্রস্তুতির মুখে রাজধানীতে দাঁড়াতেই পারেনি ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীরা। কয়েক দফা মিছিল বের করলে তা পুলিশি হামলায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। হরতালে রাজধানীসহ পুরো দেশ অচল হয়ে পড়ে। ঢাকায় কিছু লোকাল বাস ও রিকশা চলাচল করলেও দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। সরকারি অফিস খোলা থাকলেও উপস্থিতি ছিল কম। দূরপাল্লার কোনো বাস ছাড়েনি। চট্টগ্রামে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয় হরতাল সমর্থকরা। বরিশালে রাস্তায় গাছ ফেলে সড়ক অবরোধ করা হয়। সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপনের প্রতিবাদ এবং ইসলামবিরোধী শিক্ষানীতি, কোরআনবিরোধী নারীনীতি বাতিলসহ বিভিন্ন দাবিতে ইসলামী ও সমমনা ১২টি দল গতকাল সকাল ৬টা থেকে লাগাতার ৩০ ঘণ্টার হরতাল পালন করছে। আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত তারা হরতাল কর্মসূচি পালন করবে। একই দাবিতে পৃথকভাবে গতকাল সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ইসলামী ও সমমনা দলগুলোর ডাকা ৩০ ঘণ্টার এ হরতালে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামীসহ চারদলীয় জোট। হরতাল আহ্বানকারী ১২টি দল হলো—বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন, সম্মিলিত উলামা-মাশায়েখ পরিষদ, জাগপা, ইসলামিক পার্টি, মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ ন্যাপ, ন্যাপ ভাসানী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও এনডিপি। পরে এতে আরও সমর্থন দিয়ে সক্রিয় অংশ নেয় আরও ৯টি ধর্মীয় সংগঠন। সেগুলো হচ্ছে—আইম্মা পরিষদ, ইসলাহুল মুসলিমিন, জাতীয় ফতোয়া বোর্ড, নাস্তিক মুরতাদ প্রতিরোধ জাতীয় কমিটি, সচেতন যুবসমাজ, আহকামে শরিয়াহ হেফাজত কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় ওলামা পরিষদ, জাতীয় তাফসির পরিষদ ও জমিয়তুল মুফাসসিরিন।গতকালের হরতালে ঢাকায় বড় ধরনের পিকেটিং না হলেও নারায়ণগঞ্জে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ ক্যাডার ও পুলিশের সঙ্গে হরতাল সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। হরতালের প্রথম দিনে গতকাল ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। সংঘর্ষে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও পুলিশের আরও ১০ সদস্যসহ শতাধিক হরতাল সমর্থক আহত হয়। সিদ্ধিরগঞ্জে সংঘর্ষের সময় পুলিশ ও সরকারি দলের ক্যাডাররা গুলি চালালে তোফায়েল নামের এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়। হরতাল সমর্থকদের অভিযোগ, পুলিশের প্রকাশ্য ছত্রছায়ায় এলাকার সরকারদলীয় চিহ্নিত সন্ত্রাসী নূর হোসেন বাহিনীর ক্যাডাররা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে। পুলিশ ফতুলা থেকে ৮ জন ও সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে। সকালে ফতুলায় পুলিশের দুটি অস্ত্র লুট করা হলেও দুপুরে তা উদ্ধার করা হয়। ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জে সংঘর্ষের সময় পিকেটাররা বেশ কিছু যানবাহন ভাংচুর ও সড়কে টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেয়।গতকাল সকাল ৬টা থেকে হরতাল সমর্থকরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। এতে চরমোনাই পীর সমর্থিত ইসলামী আন্দোলন এবং হরতাল আহ্বানকারী ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটিসহ ১২টি দলের কয়েক হাজার নেতাকর্মী অংশ নেন। তারা কাঁচপুর সেতুর পূর্বদিকে অবস্থান নিয়ে সড়কে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ ও অবরোধ সৃষ্টি করে। সমাবেশ শেষে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে হরতাল সমর্থকরা চিটাগাং রোডের দিকে অগ্রসর হয়। এদিকে চিটাগাং রোড এলাকায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকশ’ নেতাকর্মী হরতালবিরোধী মিছিল বের করে। পৌনে ৯টার দিকে ইসলামিক দলগুলোর মিছিল চিটাগাং রোডে পৌঁছলে হরতালবিরোধী মিছিলের মুখোমুখি হয়। এ সময় দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। হরতাল সমর্থনকারীদের ধাওয়ায় যুবলীগ, ছাত্রলীগ ক্যাডাররা পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় সরকারদলীয় চিহ্নিত সন্ত্রাসী নূর হোসেন বাহিনীর শতাধিক ক্যাডার মিছিল বের করে হরতাল সমর্থকদের ওপর হামলা চালায়। সামনে লাঠি, ধারালো অস্ত্রসহ সরকারদলীয় ক্যাডার আর পেছন থেকে কয়েকশ’ পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করলে হরতাল সমর্থকরা পিছু হটে। হামলার তোপে টিকতে না পেরে তারা সড়ক ছেড়ে আশপাশ এলাকায় আশ্রয় নেয়। সেখানে গিয়েও তাদের ওপর হামলা চালাতে থাকে ক্যাডাররা।শ্রমিক লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা চালায়। টিনশেড ঘরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও লাঠির আঘাতের শব্দে শিশু-নারীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। পুরুষ সদস্যরা বাইরে বের হলে দাড়ি-টুপিধারীদের ওপর হামলা চালায় সশস্ত্র ক্যাডাররা। ঝোপঝাড়, ঘর, অলিগলি থেকে দাড়ি-টুপিধারীদের ধরে এনে গণপিটুনি দেয় তারা। ২৮ অক্টোবরের মতো একজনের ওপর ১০-১২ জন মিলে হামলা চালানো হয়। রক্তাক্ত মাদরাসা ছাত্র ও শিক্ষকদের পুলিশ ও র্যাবের হাতে তুলে দেয় সরকারি দলের ক্যাডাররা। পুলিশ ও সরকারি দলের ক্যাডাররা এলোপাতাড়ি গুলি চালালে তোফায়েল (২২) নামের এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুল আলম মোল্লা জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। সংঘর্ষের সময়ে পুলিশ ১০ রাউন্ড টিয়ারশেল ও ২০ রাউন্ড রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। পিকেটারদের অবস্থানের কারণে ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকে।ফতুল্লার পঞ্চবটিতে অবরোধ : গতকাল ভোর সাড়ে ৫টায় সহস্রাধিক হরতাল সমর্থক নারায়াণগঞ্জের পঞ্চবটি মোড়ে অবস্থান নেয়। তাদের বেশিরভাগের হাতে ছিল লাঠি এবং সবাই ছিল পাঞ্জাবি-পায়জামা টুপি ও পাগড়ি পরিহিত। তারা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-পাগলা সড়ক ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ সড়কের কয়েকটি স্থানে টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা কয়েকটি যানবাহন ভাংচুর করে। সকাল সাড়ে ৬টায় পঞ্চবটিতে হরতাল সমর্থকরা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইদুর রহমানসহ ১২ পুলিশ সদস্যকে অবরুদ্ধ করে রাখে এবং তাদের মারধর করে। এতে সাইদুরসহ ১৩ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়। অবরুদ্ধ পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে হরতাল সমর্থকদের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পুলিশ শতাধিক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে। কয়েক দফা লাঠিচার্জ করে। হরতাল সমর্থকরা ৮-১০টি গাড়ি ভাংচুর করে। সংঘর্ষ চলাকালে এএসআই আনোয়ারের পিস্তল এবং ফতুল্লা থানার ওসির বডিগার্ড কনস্টেবল কবিরের শর্টগান লুট হয়।ফতুল্লা মডেল থানার ওসি আইনুল হক জানান, অস্ত্র লুটের পর দুপুর ১২টায় পঞ্চবটি মোড়ে একটি চায়ের দোকানের টিনের চালার ওপর পরিত্যক্ত অবস্থায় শর্টগানটি উদ্ধার করা হয়। দুপুর পৌনে ১টায় ফতুল্লা মডেল থানার অদূরে লালপুর এলাকায় আবুল হোসেন সরকারের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সাগরকে গ্রেফতার ও পিস্তলটি উদ্ধার করে পুলিশ। সে আবুল হোসেন সরকারের বাড়ির ভাড়াটিয়া আনসার আলীর ছেলে। সংঘর্ষ চলাকালে পিকেটারদের হামলায় পুলিশের ১৩ সদস্য আহত হয়। আহতরা হলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান, এসআই মিজান ও মনির হোসেন, সহকারী এএসআই আনোয়ার হোসেন, হাবিলদার শফিকুর রহমান, কনস্টেবল তরিকুল, ডালিম, রাজিব, কবির হোসেন, ওয়াজেদ, শামীমুল হক, সেলিম, আজম। আহতদের মধ্যে সাইদুর রহমান, কবির হোসেন ও আনোয়ারকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে চিকিত্সা দেয়া হয়েছে। জেলা পুলিশ সুপার শেখ নাজমুল আলম জানান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইদুর রহমানসহ ১৩ পুলিশ আহত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।হরতাল সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ ১২ পুলিশ আহত হওয়ার ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি আগামী ৩ দিনের মধ্যে তাদের রিপোর্ট পেশ করবে। পুলিশ সুপার শেখ নাজমুল আলম জানান, স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটি ঘটনার সময় কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কর্তব্য পালনে অবহেলা ছিল কি-না তাও খতিয়ে দেখবে। এদিকে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে ঘটনার সময় ফতুল্লা মডেল থানার ওসি আইনুল হক প্রাণ বাঁচাতে ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়েন। ওই সময়ে তার সিনিয়র পুলিশ অফিসারসহ অন্যদের পিকেটাররা প্রকাশ্যে লাঠিপেটা করলেও ওসি ঘটনাস্থল থেকে দৌড়ে পালাতে থাকেন। এক পর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের অবরুদ্ধ রেখে ও তাদের বেধড়ক পিটিয়ে আহত করে পিকেটাররা। বিষয়টি আইনুল হক অস্বীকার করে বলেন, তিনিও পিকেটারদের হামলায় আহত হয়েছেন। ১২ দলের মিছিলে হামলা ১০ নেতা আটক : সকাল সোয়া ৬টায় পুরানা পল্টনে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস কার্যালয়ের সামনে থেকে ১২ দলের নেতাকর্মীরা হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাতে অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় ১২ দলের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা আবদুর রব ইউসুফিসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। পুলিশ বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা নেজামউদ্দিন, মহাসচিব হুমায়ুন কবির, সম্মিলিত উলামা মাশায়েখ পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক ড. খলিলুর রহমান মাদানী, জাতীয় উলামা পরিষদের সভাপতি দ্বীন মোহাম্মদ কাসেমী, ১২ দল নেতা হাফেজ শামসুল আলম, শামীম, দেলোয়ার হোসেন, আবু সাঈদ, নজরুল ইসলাম, ওয়ালী উল্লাহসহ ১০ জনকে আটক করে। আটকের সময় পুলিশ ড. খলিলুর রহমান মাদানীকে লাঠিচার্জ ও তার পাঞ্জাবি খুলে নেয় এবং টুপি ফেলে দেয়। খেলাফত মজলিসের অফিসে ঢুকেও নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। সকাল ৭টায় অফিসে আসার পথে পল্টন মোড়ে খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা আহমদুল্লাহ আশরাফকে টানা-হেঁচড়া করে পুলিশ। এছাড়া সকালে লালবাগে ১২ দলের নেতারা মিছিল বের করলে পুলিশ তাতে হামলা চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় দুই জনকে আটক করে তারা। মত্স্য ভবনের কাছে একটি মিছিল বের করলে পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেয়। যাত্রাবাড়ীতে মিছিলে হামলা ও অনেককে গ্রেফতার করে পুলিশ। বাদ ফজর শাহবাগ এলাকায় মিছিল করে ১২ দলের কর্মীরা। সারাদেশে হরতালের সমর্থনে মিছিলে পুলিশ হামলা চালায় এবং বিভিন্ন স্থান থেকে ৫ শতাধিক নেতকর্মীকে আটক করে বলে দলটি অভিযোগ করেছে। দুই শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। ইসলামী আন্দোলনের মিছিলে লাঠিচার্জ : সকালে সাড়ে ৬টায় রাজধানীর পুরানা পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ধাওয়া ও লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় দলের মহানগর সভাপতি অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিনসহ অনেক নেতা রাস্তায় পড়ে যান। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ দলের দক্ষিণখান থানা সভাপতি ফরিদ উদ্দিনসহ ৪ জনকে আটক করে। পরে দলের নেতাকর্মীরা দলীয় অফিসের গেটে অবস্থান নিয়ে হরতালের সমর্থনে স্লোগান দিতে থাকে। সকাল সাড়ে ৯টায় অফিসের সামনের গলিতে বেশকিছু কর্মী জড়ো হলে র্যাব ও পুলিশ তাদের ধাওয়া করে। এ সময় ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন ঢাকা মহানগরের সাবেক সভাপতি ওমর ফারুকসহ ৯ জনকে আটক করে পুলিশ। পরে পুলিশ ও র্যাব দফায় দফায় অভিযান চালিয়ে পুরানা পল্টন এলাকা থেকে ইসলামী আন্দোলের অন্তত ১০ কর্মীকে আটক করে। ব্যাপক পুলিশি বেষ্টনীর মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা দলীয় কার্যালয়ের গেটে অবস্থান নিয়ে দিনভর বিক্ষোভ করতে থাকে। বেশ কয়েকবার তাদের সরিয়ে দিয়ে গেট আটকানোর চেষ্টা করে পুলিশ। এ সময় দলের মহানগর সভাপতি হেমায়েত উদ্দিন ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বেলায়েত হোসেনসহ নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি হয়।এদিকে ভোর পৌনে ৬টায় যাত্রাবাড়ী থানার কুতুবখালি মাদরাসার সামনে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করলে পুলিশ তাদের ধাওয়া করে। এ সময় হরতাল সমর্থকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। সেখান থেকে পুলিশ ৪ জনকে আটক করে। যাত্রাবাড়ীর সানারপাড় মোড় থেকে সকাল ৭টায় হরতাল সমর্থনকারী সন্দেহে ৩ জনকে আটক করে পুলিশ। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ইসলামী আন্দোলনের ২ শতাধিক নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এ সময় পুলিশের হামলায় অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয় বলে দলটি দাবি করেছে।ইসলামী আন্দোলন ও ১২ দলের অফিস অবরুদ্ধ : হরতালকে কেন্দ্র করে শনিবার রাত থেকেই পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলন ও ১২ দল তথা বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস কার্যালয়ের আশপাশে ব্যাপক সংখ্যক পুলিশ ও র্যাব মোতায়েত করা হয়। গতকাল ভোর থেকে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। সারাদিনই র্যাব-পুলিশ কর্তৃক অবরুদ্ধ ছিল দলীয় কার্যালয়। এ সময় বাইরে থেকে কোনো নেতাকর্মীকে অফিসে ঢুকতে এমনকি অফিসের রাস্তায় বের হতে দেয়া হচ্ছিল না। বেলা ৪টায় ১২ দলের নেতা ও খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা আহমদুল্লাহ আশরাফ, মহাসচিব জাফরুল্লাহ খানসহ কয়েক নেতাকে মজলিস অফিসে ঢুকতে বাধা দেয় পুলিশ। এ সময় বেশ কিছুক্ষণ তারা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবরুদ্ধ : ইসলামী ও সমমনা ১২ দলের হরতালে পূর্ণ সমর্থন দেয়ায় গতকাল সকাল থেকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখে পুলিশ। পুলিশি বেষ্টনি ও কিছু সাংবাদিক ছাড়া কার্যালয়ের সামনে কাউকে দেখা যায়নি। সকাল সোয়া ৯টায় অফিস সহকারীরা মেইন গেট খুললেও পরে পুলিশের নির্দেশে তা বন্ধ করে রাখে। তবে ৩০ ঘণ্টার লাগাতার হরতাল জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করছে বলে গতকাল দুপুরের দিকে ফোনে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। রাত সাড়ে ৮টায় চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে হরতালে পুলিশি হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। নয়া পল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে ভোর ৫টা থেকেই বিপুলসংখ্যক পুলিশ অবস্থান নেয়। মেইন গেটে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। দুপাশে পুলিশের রায়টকার ও জলকামান এনে রাখা হয়েছে। আল্লাহর ওপর আস্থা না থাকলে ঈমান থাকে না- চরমোনাই পীর: হরতাল পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বিকালে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ইসলামী আন্দোলনের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, সরকার দেশের বিরাজমান নানা সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে ইসলাম ধ্বংসের কাজ করছে। আল্লাহর ওপর আস্থা না থাকলে ঈমান থাকে না। কিন্তু সরকার সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা স্থাপন করেছে। এর প্রতিবাদ না করলে মুসলমানিত্ব থাকে না বিধায় ঈমানি দাবিতে আমরা বাধ্য হয়ে হরতাল ডেকেছি। এটা কোনো সরকার পতন বা কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য নয়। কিন্তু শান্তিপূর্ণ হরতালে সরকার তার ক্যাডার ও নিরাপত্তারক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে নিরীহ লোকদের ওপর যে বর্বর হামলা এবং মামলা করেছে তা অসভ্য যুগকেও ছাড়িয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করে ঈমানি চেতনার প্রকাশ করেছে। এ হরতালে প্রমাণিত হয়েছে যে, জনগণ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রত্যাখ্যান করেছে।তিনি গতকালের হরতালে নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশি হামলা-নির্যাতন ও গ্রেফতারের পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, ঢাকা মহানগরীতে দুই শতাধিকসহ সারাদেশে ১ হাজার ২৫৩ জন নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। আর সারাদেশে ৩৭২ জন গুরুতরসহ আহত হয়েছে ২ হাজার ৫৭১ জন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে খুলনায় ১৫১ জন, বরিশালে ৪৭, চট্টগ্রামে ৩০০, নরসিংদীতে ৭০, নোয়াখালীতে ৫৫, চাঁদপুরে ২৫ জন রয়েছে। চরমোনাই পীর অবিলম্বে আটক নেতাকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি এবং সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা পুনর্বহাল করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান। অন্যথায় লাগাতার কর্মসূচি দেয়া হবে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, অত্যাচার নির্যাতন করে অতীতে কেউ টিকে থাকতে পারেনি, বর্তমান সরকারও টিকতে পারবে না। তিনি দাবি আদায়ে ৪ দিনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এর মধ্যে রয়েছে- ১২ জুলাই চট্টগ্রামে, ১৩ জুলাই ঢাকায়, ১৪ জুলাই দেশব্যাপী সমাবেশ ও মিছিল এবং ১৫ জুলাই ঢাকার মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ ও গণমিছিল। এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে কুনুতে নাজেলা পড়ার আহ্বান জানান তিনি। নির্যাতন সয়ে মাঠেই থাকব- ১২ দল : ৩০ ঘণ্টার হরতালের প্রথমদিনের পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ১২ দল। এতে ১২ দলের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা আবদুুর রব ইউসুফি বলেন, আমরা ঈমানি দাবিতে শান্তিপূর্ণ হরতাল আহ্বান করছি। কিন্তু সরকার এতে নানাভাবে বাধা দিয়ে পরিবেশ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছে। হরতালে আমাদের নিরস্ত্র নিরীহ জনশক্তি রাস্তায় বের হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। সকালে দলীয় অফিস থেকে নেতাকর্মীরা বের হলেই পুলিশি ব্যারিকেডে পড়ে। গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে মিছিল করতে চাইলেই পুলিশ আমাদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ ও নেতাদের লাঞ্ছিত করে। এ সময় ১০ জনকে আটক করে পুলিশ। নির্যাতন সহ্য করে রাজপথে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন তিনি। এছাড়া পঞ্চবটি ও কাঁচপুরে নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট, টিয়ারশেল নিক্ষেপে এবং দলীয় ক্যাাডারদের হামলায় অসংখ্য নেতাকর্মী আহত হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে মিছিলে পুলিশের হামলায় ৫ শতাধিক গ্রেফতার ও ২ শতাধিক আহত হয়েছে। এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের এ আচরণে আমরা কঠোর থেকে কঠোরতর হতে বাধ্য হব। তিনি অবিলম্বে আটক নেতাদের মুক্তি দাবি করেন। এছাড়া তিনি আজ ১২টা পর্যন্ত হরতাল চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। হরতাল শেষে আজ দুপুরে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কর্মসূচি দেয়া হবে বলেও জানান তিনি। ২৩ শিবির কর্মী গ্রেফতার : শনিবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ২৩ শিবির নেতাকর্মীকে আটক করে পুলিশ। সংগঠনের শাখা কার্যালয়ে ‘ফলচক্র’ বিষয়ক প্রোগ্রাম চলাকালে পুলিশ আকস্মিক অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে বলে জানা গেছে। এদিকে এ গ্রেফতারের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা। এক যৌথ বিবৃতিতে শিবির সভাপতি ডা. মো. ফখরুদ্দিন মানিক, সেক্রেটারি জেনারেল মো. দেলাওয়ার হোসেন ও ঢাকা মহানগরী পশ্চিমের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, গতকাল সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ফলচক্র অনুষ্ঠান চলা অবস্থায় শিবির নেতাকর্মীদের ন্যক্কারজনকভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা অবিলম্বে আটককৃতদের মুক্তি দাবি করেন।নারায়ণগঞ্জ শহর : ইসলামী দলগুলোর হরতালে নারায়ণগঞ্জ শহরে কোনো পিকেটিং হয়নি। সকাল থেকেই শহরের ডিআইটি জামে মসজিদে কঠোর অবস্থান নেয় পুলিশ। শহরের দেওভোগ এলাকা থেকে পিকেটাররা কয়েক দফা মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। হরতালে বিএনপি সমর্থন দিলেও নারায়ণগঞ্জের কোথাও বিএনপি কিংবা এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের দেখা যায়নি। জেলা বিএনপি অফিস ছিল বন্ধ। শহরের মার্কেট, বিপণী বিতান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সকাল থেকে বন্ধ ছিল। যান চলাচল ছিল খুবই কম। শহরের বিভিন্ন স্থানে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও আর্মড পুলিশ মোতায়েন ছিল ।ফতুল্লার ওসিকে ডিআইজির ভর্ত্সনা : ফতুল্লার পঞ্চবটিতে পুলিশের সঙ্গে পিকেটারদের সংঘর্ষের ঘটনার পর দুপুরে ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি আসাদুজ্জামান। তিনি সকালের ঘটনার জন্য ফতুল্লা থানার ওসি আইনুল হককে ভর্ত্সনা করেন বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র। ডিআইজি ফতল্লায় গত কয়েক মাস ধরে চলা রাজনৈতিক খুনাখুনি, চুরি, ডাকাতি, মানুষ গুমের ঘটনায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে ওসিকে কঠোর ভাষায় ভর্ত্সনা করেন। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেজন্য তত্পর হওয়ার নির্দেশ দেন



http://www.amardeshonline.com/pages/details/2011/07/11/92303

No comments:

Post a Comment