Sunday 1 January 2012

সর্বব্যাপী অনিশ্চয়তায় শুরু নতুন বছর ২০১২















ইলিয়াস খান

স্বাগত ২০১২। শুভ ইংরেজি নববর্ষ। বিদায়ী ২০১১ সালের হতাশা, দুঃশাসন, বঞ্চনাকে পেছনে ফেলে ভালো কিছু প্রাপ্তির স্বপ্ন নিয়ে মানুষ শুরু করছে নতুন বছর আজ। সর্বব্যাপী অনিশ্চয়তার মধ্যে নতুন বছরের আগমন।
নতুন প্রত্যাশায় আজ উদিত হয়েছে নতুন বছরের সূর্য। সব ধরনের স্থবিরতা কাটিয়ে নতুন বছর সবার জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ। দেশে ফিরে আসুক শান্তি, সমৃদ্ধি, স্বস্তি, গতিময়তা।
২০১১ সালটি ছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের জন্য গভীর হতাশার। কোনো সুসংবাদ আসেনি ৩৬৫ দিনে। হত্যা, সংঘর্ষ, দুর্ঘটনা, বিরোধী মতের প্রতি দমন-পীড়নসহ নানা দুঃসংবাদের মধ্য দিয়ে কেটেছে দিনগুলো। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি কোথাও কোনো সুখবর ছিল না। বরং নানা দুঃসংবাদ এ সময়ে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে জনমন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার বেদনায় নীল হয়েছে দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠী। এ সময়ে স্থবিরতা গ্রাস করেছে আমাদের অর্থনীতি, বিনিয়োগ, রাজনীতি, সংসদ, প্রশাসন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে। সর্বোপরি আমাদের সার্বিক জনজীবনকে। তারপরও মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখছে নতুন বছর নিয়ে।
বিতর্কিত হলেও একটি নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক শাসনের আকাঙ্ক্ষায় ২০০৯ সালে যে ব্যাপক প্রত্যাশা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার যাত্রা শুরু করেছিল, তিন বছর গড়িয়ে সে প্রত্যাশার খুব কমই পূরণ হয়েছে। কিন্তু নতুন বছরে দেশের মানুষের প্রত্যাশা সব হতাশা, সব গ্লানি কাটিয়ে উঠে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। সচল হবে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংসদ ও প্রশাসন।
বারবার ব্যর্থ হলেও কতগুলো চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে নতুন বছর শুরু করছে মহাজোট সরকার। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। দশ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর অঙ্গীকার করা সরকার চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগাম যেন কোনোভাবেই টেনে ধরতে পারছে না। অস্থিতিশীল বাজারকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। নতুন বছর শুরুর ঠিক তিনদিন আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় এ চ্যালেঞ্জ আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রতিঘরে একজনকে চাকরি দেয়ার বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন দূরের কথা, গত বছরে সার্বিকভাবে কর্মসংস্থানের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিও সম্ভব হবে না। আইনশৃঙ্খলার সার্বিক উন্নয়নসহ ক্রসফায়ারের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করাও সরকারের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর হারও মারাত্মকভাবে কমে গেছে। কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে বরং অনেক শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছে।
গত বছর রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম অস্থিরতা ছিল। ১৯৭২-৭৫ সালের মতো গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে সরকার ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থা চালু করেছে। বিরোধী দলকে মিটিং মিছিল পর্যন্ত করতে দেয়া হচ্ছে না। এ অবস্থায় গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় পড়েছে মানুষ। এ অবস্থার অবসানে নতুন বছরে সংশ্লিষ্টরা সক্রিয় হবেন বলে ব্যাপক প্রত্যাশা রয়েছে জনমনে।
বছর শেষে সরকারের সার্বিক কর্মকাণ্ড নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মন্ত্রীদের নানান বক্তব্য বছরজুড়েই বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সরকার বিভিন্ন মামলা-হামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় জনগণ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন দেখেনি। অর্থনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য দেখতে চায়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায়, দেশের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের ভূমিকার মূল্যায়ন করতে চায়। টিপাইমুখে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী ভারতের বাঁধ নির্মাণ এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন চুক্তি, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, ট্রানজিট, এশিয়ান হাইওয়ের নামে ভারতকে করিডোর প্রদান, সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধসহ বাংলাদেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
প্রশাসনে দফায় দফায় ব্যাপক রদবদল, ওএসডি ও চাকরিচ্যুতির মধ্য দিয়ে যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটা সামাল দিতে না পারলে নতুন বছরেও প্রশাসনিক স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। অবসরে যাওয়া সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের যেভাবে দলীয় বিবেচনায় দু’তিনটি পর্যন্ত প্রমোশন দিয়ে চাকরিতে পুনর্বহাল কিংবা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নতুন করে যে বৈষম্য ও ক্ষোভের জন্ম দেয়া হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে না পারলে সমস্যা থেকেই যাবে। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর দলীয় ক্যাডারদের চাপ কমাতে না পারলে মাঠ পর্যায়েও অবস্থার উন্নতি হবে না। এসব বিষয়ে নজর দিয়ে এগুলোর সুরাহা করাও নতুন বছরে সরকারের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা কিংবা ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার মতো মামলাগুলো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পুনঃতদন্তের নামে মানুষকে হয়রানির পথ সরকার পরিহার করে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা হবে বলে দেশের মানুষের প্রত্যাশা।
সাংবাদিকদের হয়রানি ও নির্যাতনের পথ বেছে নিয়ে সরকার যে সমালোচনার মধ্যে পড়েছে, সেটা থেকে মুক্ত হতে নতুন বছরে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। মিডিয়ার সঙ্গে লড়াই করে অন্যায়ভাবে কণ্ঠরোধের চেষ্টা করে কোনো সরকারই সুবিধা করতে পারেনি। বর্তমান সরকারও পারবে না, ইতিহাসের এই শিক্ষা না নিলে সরকারকে এর খেসারত দিতে হবে বড় আকারে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বিদ্যুতের অব্যাহত লোডশেডিং কিংবা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার না হওয়া এবং সরাসরি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ দেশের মানুষ গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছে। মানুষ রাস্তায় নামতে শুরু করেছে। অবস্থার উন্নতি না হলে সরকারের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় তারা সক্রিয় না হলে এর মাশুল সরকারকে দিতে হবে। নতুন বছরে জনগণের প্রত্যাশা থাকবে। সরকার অন্তত জনগণের কাছে দেয়া তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করুক। স্থবিরতা কেটে গিয়ে দেশ আবার সচল হয়ে উঠুক। গণতন্ত্র পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাক। সচল হয়ে উঠুক সংসদ ও প্রশাসন। উন্নয়ন ও উত্পাদনে নতুন গতি সঞ্চারিত হোক।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়া ছিল জাতির নৈতিকতার ওপর চপেটাঘাত। কিন্তু এর জন্য দায়ী মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে বাদ না দিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সরকারের এ গোঁয়ার্তুমি জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। রাস্তাঘাটের করুণ অবস্থা মানুষের ক্ষোভকে তুঙ্গে নিয়ে গেছে। নতুন বছরে বিভিন্ন ধরনের দুর্ভোগের অবসান চায় মানুষ।
গত এক বছরে সরকার জাতীয় জীবন বিপর্যস্ত করতে নানা অঘটন ঘটিয়েছে। এর অন্যতম সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী সংযোজনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল, শেয়ারবাজার লুটপাট, গুপ্তহত্যা, পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতি, ফালানীসহ বিএসএফ কর্তৃক নিরীহ বাংলাদেশীদের গুলি করে হত্যা, ঢাকা দ্বিখণ্ডিতকরণ, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অপসারণ, বাংলাদেশ থেকে মনমোহনের প্রাপ্তি, আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণ নিয়ে গণবিস্ফোরণ, পুলিশ হেফাজতে অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদের মৃত্যু, সরকারের রোষানলের শিকার হয়ে ২৮৮ দিন জেলে নির্যাতন শেষে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি, মিরসরাই ট্র্যাজেডি, জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর হামলা, খুনিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ইত্যাদি। বছরের শেষ দিকে এসে মহাজোট সরকার যেভাবে তার ফ্যাসিস্ট শাসন উন্মুক্ত করেছে তাতে মানুষের হতাশা আরও বাড়ছে।
তারপরও মানুষ নতুন বছর নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। সুন্দর আগামীর স্বপ্নে তারা বিভোর। কেবল সময়ই বলে দেবে কেমন যাবে তাদের আজ শুরু হওয়া নতুন বছরটি, স্বপ্ন কতটা পূরণ হবে।

No comments:

Post a Comment