Sunday 1 January 2012

অর্থনৈতিক মহামন্দার কবলে দেশ








সৈয়দ মিজানুর রহমান

সরকারের তিন বছর যেতে না যেতেই অর্থনৈতিক মহামন্দার কবলে পড়েছে গোটা দেশ। ব্যাংকে চলছে টাকার হাহাকার, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি; দেখা দিয়েছে বৈদেশিক সহায়তা ও ঋণের আকাল, ধস শিল্প উত্পাদনে, নতুন কর্মসংস্থান প্রায় বন্ধ।
মন্দা এতোটাই প্রকট যে, রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যয় নির্বাহ করতে পুরোপুরি ব্যাংক ঋণনির্ভর হয়ে পড়েছে সরকার। অর্থসঙ্কটে সরকার এখন নিজেই ব্যাংকের সব টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এ টাকার প্রায় পুরোটাই খরচ হচ্ছে রাজস্ব বা অনুন্নয়ন খাতে। বন্ধ হয়ে গেছে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। গতি নেই এডিপির।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা অর্থনীতির এই বেহাল দশার জন্য স্থানীয়ভাবে একদিকে সরকারের সম্প্রসারিত রাজস্ব নীতি; অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকুচিত মুদ্রানীতি, দুর্নীতি-অনিয়ম এবং কিছুটা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাকে দায়ী করেছেন। অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অর্থনীতির এই নাজুক দশা স্বীকার করলেও পরিস্থিতি উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ নেই। ফলে দেশের এখন অর্থনীতি এক গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি।
নাজুক ব্যাংকিং খাত : বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার এক বছরের মাথায় দেশের ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা দেখা দেয়। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমিয়ে দেয়। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে চলছে টাকার হাহাকার। ব্যাংকগুলোর সব টাকা সরকার নিয়ে নিচ্ছে। ফলে প্রায় এক বছর ধরে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের বড় ঋণ দেয়া প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো নিজেদের সঙ্কটের মধ্যেই সরকারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ব্যাংকের সব টাকা ধার ও ঋণ হিসেবে দিচ্ছে। চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের ব্যাংক ঋণের প্রাক্কলন ছিল ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। তবে অর্থবছরের পাঁচ মাস যেতে না যেতেই সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ২১ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছর শেষে সরকারের ব্যাংক ঋণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারের বেপরোয়া ব্যাংক ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। কলমানি মার্কেটেও পাওয়া যাচ্ছে না টাকা। চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মাসে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়েছে ২১ হাজার ৩২১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের চাহিদা মেটাতে অর্থায়ন করেছে ১২ হাজার ৮৪১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। বাকি টাকা দিয়েছে তফসিলি ব্যাংক।
ভয়াবহ সঙ্কটে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক : সরকারের ঋণের চাহিদা মেটাতে গিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো চরম অর্থসঙ্কটে পড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক এরই মধ্যে বেসরকারি খাতে তাদের সব ধরনের ঋণ বিতরণ গুটিয়ে নিয়েছে। ব্যাংকটি এতোই তারল্য সঙ্কটে যে, তাদের দৈনন্দিন কাজ চালাতে অন্য ব্যাংক থেকে ধারদেনা করতে হচ্ছে। সরকারের ঋণের চাহিদা মেটাতে গিয়ে সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের অবস্থাও নাজুক। নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকের ওপর; চাপ বাড়ছে কলমানি মার্কেটেও। ব্যাংকিং খাতে তারল্য সঙ্কটের কারণে কলমানি সুদের হার কয়েক মাস ধরেই ২০ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার প্রাক্কলন করেছিল ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা এবং স্বল্পমেয়াদি ঋণ ধরা হয় ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা।
গড় মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটে : স্বাধীনতার পর দেশে গড় মূল্যস্ফীতি কখনও ডাবল ডিজিট (দশ শতাংশের বেশি) অতিক্রম করেনি। এই রেকর্ড ভেঙেছে বর্তমান সরকার। চলতি বছরের (২০১১) মার্চে প্রথমবারের মতো দেশে গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয় ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির রেকর্ড সংগ্রহ ও প্রকাশ করে থাকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। পরিসংখ্যান ব্যুরো সর্বশেষ গত নভেম্বরে যে ডাটা প্রকাশ করেছে তাতেও গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর মার্চ মাস থেকেই টানা ডাবল ডিজিট চলছে গড় মূল্যস্ফীতি। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গভীর হতাশা প্রকাশ করে বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী অনেক কষ্টে আছেন। থমকে গেছে অর্থনীতির অন্যান্য সূচক। জিডি প্রবৃদ্ধিও ৭ শতাংশ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য, দেশে পয়েন্ট টু পয়েন্ট অর্থাত্ আগের বছরের নভেম্বর মাসের তুলনায় ২০১১ সালের নভেম্বরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়ে ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ১০ দশমিক ১৬ শতাংশ। নভেম্বরে গ্রাম অঞ্চলে ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। আর শহরে ১২ দশমিক ১১ শতাংশ। এ সময়ে গ্রামে খাদ্যপণ্যে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এর আগে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশে দাঁড়ায়। যা আগস্টে ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ, জুলাইয়ে ১০ দশমিক ৯৬, জুনে ১০ দশমিক ১৭ শতাংশ, মে মাসে ১০ দশমিক ২০ শতাংশ, এপ্রিলে ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ, মার্চে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ৯ দশমিক ৭৯ এবং জানুয়ারিতে ৯ দশমিক ০৪ শতাংশ।
কমে গেছে রেমিট্যান্স : দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে থাকে। আর রেমিট্যান্সের বেশিরভাগ আয় আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব থেকে। তবে দেশটির সঙ্গে বড় ধরনের কূটনৈতিক দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে গত তিন বছরে। ফলে সৌদি আরবে নতুন করে যেমন জনশক্তি রফতানির দরজা বন্ধ, তেমনি বাংলাদেশীদের কাগজপত্র নবায়নও বন্ধ। ফলে প্রতি মাসেই হাজার হাজার বাংলাদেশী ফিরে আসছে সৌদি আরব থেকে। আর এ কারণে গোটা রেমিট্যান্স আয়ে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের বিপর্যয়। রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি কমে আসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রিজার্ভের ওপর। ২২ মাস পর গত সেপ্টেম্বর মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে ৯ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। এরপর রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারে উঠলেও এখন আবার আশঙ্কাজনক হারে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। গত ১৫ নভেম্বর রিজার্ভ কমে ৯ দশমিক ৬২৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়, যা গত ২৯ নভেম্বরে ৯ দশমিক ২৩৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর নভেম্বরে রেমিট্যান্স আয় হয়েছিল ৯৯৮ মিলিয়ন ডলার। শতাংশের হিসাবে এ বছর নভেম্বরে রেমিট্যান্স আয় কমেছে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে রেমিট্যান্স বাবদ আয় হয়েছে ৪ হাজার ৯২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৪৬ মিলিয়ন ডলার বেশি। অর্থাত্ প্রথম পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স আয়ের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
রিজার্ভ কমছে, বাড়ছে ডলারের দাম : বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ৯৩৫ কোটি ডলার। বিশ্লেষকরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম ও খাদ্য আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে অতিরিক্ত ডলার খরচ করতে হয় সরকারকে। যে হারে আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে হচ্ছে, সে হারে রেমিট্যান্স আসছে না। স্বাভাবিকভাবেই রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বিপরীতে মার্কিন ডলার দুর্বল হয়ে পড়লেও তিন বছরে টাকার ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিপরীত প্রবণতা। গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ১০ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গতকাল ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের দাম ছিল ৮২ টাকা; যেখানে গত বছর ১৩ ডিসেম্বর ডলারের দাম ছিল ৭০ টাকা ৬৪ পয়সা। দাম বেশি হলেও চাহিদা অনুযায়ী পাওয়া যায় না ডলার, ফলে আমদানিকারকরা পড়ছেন বিপাকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলারের দাম বাড়ায় দেশের অর্থনীতির ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে—আমদানি ব্যয় বেড়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষের ঝুঁকি। ডলার সঙ্কটের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেমিট্যান্স আয়ের গতি কমে আসার পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে আসায় রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে ডলারের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
স্থবির উন্নয়ন কর্মকাণ্ড : গত বেশ কয়েক বছর ধরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন স্থবির। অর্থবছরের ৫ মাস পেরিয়ে গেলেও এ পর্যন্ত এডিপির মাত্র ২০ ভাগ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে সরকার। চলতি বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এডিপি বরাদ্দ ৪৬ হাজার টাকা থেকে মাত্র ৯ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। আইএমইডি জানায়, গত অর্থবছরের একই সময়ে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল এ বছরের সমান শতকরা ২০ ভাগ। আর ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাস্তবায়ন হয়েছিল শতকরা ২৩ ভাগ। আর ২০০৮-০৯ অর্থবছরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে প্রকল্প বাস্তবায়নের হার ছিল শতকরা ১৮ ভাগ।
দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থাগুলো বৈদেশিক সহায়তা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও গত অর্থবছরে ৩১ হাজার কোটি টাকার সহায়তা অনাদায়ী থাকে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বৈদেশিক সহায়তা এসেছে মাত্র ৪১ কোটি ৩৮ লাখ মার্কিন ডলার। গত বছরের একই সময়ে বৈদেশিক সহায়তা ছাড় হয়েছিল ৬১ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। এ হিসাবে গত এক বছরের ব্যবধানে অর্থছাড়ের পরিমাণ কমে গেছে ২০ কোটি ৫ লাখ মার্কিন ডলার। শতকরা হিসাবে এক বছরে বৈদেশিক সহায়তা কমেছে ৩৩ ভাগ। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এ সময়ে ১৮৭ কোটি ৪৪ লাখ মার্কিন ডলার ছাড় দেয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল দাতাদের পক্ষ থেকে। এ হিসাবে প্রতিশ্রুতির শতকরা ৭৮ ভাগ বৈদেশিক সহায়তাই অনাদায়ী রয়ে গেছে।
ইআরডি জানিয়েছে, অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে ২৬ কোটি ৪১ লাখ ডলার ঋণ ছাড় করেছে দাতারা। আর অনুদান হিসেবে এসেছে ১৪ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে এ সময়ে ছাড় হয়েছে ৪১ কোটি ৩৮ লাখ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে এ পাঁচ মাসে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে মোট ৪০ কোটি ৯৩ লাখ মার্কিন ডলার, এর মধ্যে আসল ৩২ কোটি ৪০ আর সুদ হচ্ছে ৮ কোটি ৫২ লাখ মার্কিন ডলার। হিসাব কষে দেখা যায় নিট বৈদেশিক অর্থের ছাড় হয়েছে মাত্র ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান মনে করেন, দেশের অর্থনীতিতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। দিন যতই যাচ্ছে এই অস্থিরতা বাড়ছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সরকার যে হারে ভর্তুকি বাড়াচ্ছে এবং রাজস্ব খাতে ব্যয় বাড়াচ্ছে, তাতে দেশে বড় ধরনের আর্থিক বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। এই আশঙ্কা থেকে সরকার সভরেন লোন বা সার্বভৌম ঋণ করতে যাচ্ছে, এটা আরও বিপদ ডেকে আনবে।
এ বিষয়ে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সার্বিক অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় পড়েছে। সরকারের ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। ভর্তুকির মাত্রাও অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। ব্যাংকে চলছে ভয়াবহ তারল্য সঙ্কট। এতে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাও ঋণ পাচ্ছেন না। অন্যদিকে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধিও কমে যাচ্ছে। এসব সমস্যার সব একসঙ্গে যোগ হওয়ায় অর্থনীতি বেকায়দায় পড়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে বৈদেশিক সাহায্যের অবমুক্তিতে পিছিয়ে পড়া।’ তিনি পরামর্শ দেন, বিদেশি সহায়তা ও বৈদেশিক ঋণের যে ১৩ বিলিয়ন ডলার পাইপলাইনে পড়ে রয়েছে, তা কীভাবে ছাড় করা যাবে সে ব্যবস্থা করা দরকার।
ব্যবসায়ী নেতা ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, সরকারের অর্থনীতি দ্বৈতশাসনের কবলে পড়েছে। একদিকে সরকার বলছে, তারা সম্প্রসারিত রাজস্বনীতি বাস্তবায়ন করবে; অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঙ্কুচিত মুদ্রানীতি হাতে নিয়েছে। আর একসঙ্গে এই দুই নীতিই দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিপদ ডেকে এনেছে।
বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার আমার দেশকে বলেন, সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বেশি টাকা নিলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে যাবে—এটাই স্বাভাবিক। আর বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে গেলে দেশে বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন হবে না; বাড়বে না নতুন কর্মসংস্থান।

No comments:

Post a Comment