Friday 5 August 2011

আওয়ামী লীগ ভারতের কাছ থেকে ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে’ : ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন সত্য বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা








জাকির হোসেন
আওয়ামী লীগ ভারতের কাছ থেকে ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে— যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট-এর চলতি সংখ্যায় প্রকাশিত এ প্রতিবেদনকে সত্য বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। এছাড়াও পত্রিকাটি ভারতকে কোরিডোর দেয়া হলে বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে বলে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, তার সঙ্গেও একমত প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলেছেন, বিগত সাধারণ নির্বাচনের আগে শোনা যাচ্ছিল আ’লীগ ভারতের কাছ থেকে প্রচুর টাকা পেয়েছে। এ নিয়ে ওই সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে নানা রকম আলোচনা এবং সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী পত্রিকা এ ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় বিষয়টি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হলো। তারা বলেন, ইকোনমিস্ট একটি প্রভাবশালী পত্রিকা। বিশ্বজুড়ে ম্যাগাজিনটি সোজাসাপ্টা কথা বলার জন্য পরিচিত। পত্রিকাটি অনেক অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে। এর আগে পত্রিকাটি বাংলাদেশ বিষয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কিন্তু সেসব ব্যাপারে সরকারকে তেমন বিব্রতহতে দেখা যায়নি। কিন্তু এবার সরকার বিব্রত বোধ করেছে এবং প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা আরও বলেন, ভারতকে কোরিডোর দেয়া হলে বাংলাদেশ ভারতের বিভিন্ন বিচ্ছন্নতাবাদী গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। কারণ, ভারত তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছন্নতাবাদীদের দমন করতে বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ওই সব অঞ্চলে অস্ত্র সরবরাহ করবে। এতে করে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকা রক্ষিত হয়ে যাবে। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে এটাকে রক্ষা করা যাবে না। ফলে ওই এলাকার বিচ্ছন্নতাবাদীরা বাংলাদেশের মধ্যে প্রবেশ করবে। যা বাংলাদেশের জাতীয় নিরপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি। গতকাল দৈনিক আমার দেশকে দেয়া পৃথক প্রতিক্রিয়ায় তারা এসব কথা বলেন। দ্য ইকোনমিস্ট-এর ৩০ জুলাই সংখ্যার এক প্রতিবেদনে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে কিছু নেতিবাচক বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিচক্ষণতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রতিবেদনে দ্য ইকোনমিস্ট বলেছে, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করার সময় ‘ব্যাগভর্তি ভারতীয় টাকা’ এবং উপদেশ পেয়েছে। একই সঙ্গে পত্রিকাটি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা পেলে তা সামরিক কাজে ব্যবহার করতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশ ভারতের বিদ্রোহীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে। সাময়িকীটির মতে, শেখ হাসিনা ক্রমশ স্বৈরাচারী হয়ে উঠছেন এবং ২০১৩ সালের নির্বাচনে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া ক্ষমতায় চলেও আসতে পারেন। দ্য ইকোনমিস্টের-এ প্রতিবেদন বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, বিগত সাধারণ নির্বাচনের সময় এ কথাটি শোনা যাচ্ছিল এবং বিভিন্ন মহলে এনিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। ইকোনমিস্টের রিপোর্টের ভিত্তিতে বিষয়টি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হলো। তিনি বলেন, এই সরকার ভরতের সঙ্গে যে সব চুক্তি করছে এগুলো যে জাতীয় স্বার্থবিরোধী তা আমরা বরাবরই বলে আসছি। বিশেষ করে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার বিষয়টি আমাদের স্বাধীনতা এবং সর্বভৌমত্বের ওপর একটি বড় আঘাত। তিনি আরও বলেন, যদি ভারতকে ট্রানজিট বা কোরিডোর দেয়া হয়, তাহলে ভারত এর মাধ্যমে তাদের অভ্যন্তরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে অস্ত্র পরিবহন করবে। ফলে বাংলাদেশ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আওয়ামী লীগ ভারতের কাছ থেকে প্রচুর টাকা পেয়েছে, এটা নির্বাচনের পর শোনা যাচ্ছিল। দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত হওয়ার পর এটাকে এখন সত্যি বলেই মনে হচ্ছে। বিষয়টি আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। প্রখ্যাত রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তক, বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার বলেন, গত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ভারতের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে, এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে কানাঘুষা ও আলোচনা শুনতাম। এখন তথ্য আকারে দ্য ইকোনমিস্ট এটা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা একটি নতুন উপাদান। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবান জানানো হয়নি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো প্রতিবাদে কোনো যুক্তি তুলে ধরা হয়নি এবং এর বিপরীতে সরকারের কাছে কোনো প্রমাণ আছে কিনা তাও জানানো হয়নি। তিনি আরও বলেন, ভারতকে করিডোর দেয়া হলে তারা তাদের অভ্যন্তরে স্বাধীনতাকামীদের দমনে বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে অস্ত্র পরিবহন করবে, এটা আমরা বরাবরই বলে আসছি। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমাদের চিন্তার একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলল বলে আমি মনে করি। তিনি আরও বলেন, ইকোনমিস্ট এর আগে এ অঞ্চল বিষয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এখন তাদের ভারতবিরোধী অবস্থানের একটি কারণ এটা হতে পরে যে, তারা হয়তো বুঝতে পেরেছে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনায় নানাভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এখানে একটি গণবিক্ষোভের সৃষ্টি হতে পরে। এ কারণে তারা এখন এ ধরনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। আমার কাছে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি খোলা চোখে দেখছি যে, বিগত সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বর্তমান মহাজোট সরকার ভারতের সহায়ক একের পর এক চুক্তি করছে। এসব চুক্তি সম্পর্কে জনগণকে বিস্তারিত কিছু জানানো হচ্ছে না। এ প্রেক্ষিতে দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব বিষয়ে আমরা চিন্তিত। ভারতকে করিডোর দেয়া বিষয়ে তিনি বলেন, আমি বরাবরই বলে আসছি এটা ট্রানজিট নয়— কোরিডোর। এটা দেয়া হলে ভারত শুধু এর মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রই পরিবহন করবে না, এটাকে তারা সামরিক কোরিডোর বা স্ট্র্যাটেজিক কোরিডোর হিসেবে ব্যবহার করবে। ভারতের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ দমনে তারা এই কোরিডোরকে ব্যবহার করবে। ফলে বাংলাদেশ এর মাধ্যমে ভারতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে এবং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহফুজ উল্লাহ বলেন, ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। ঘটনাপরম্পরা বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি সত্যি বলে প্রতিভাত হবে। তিনি বলেন, ইকোনমিস্ট অনেক অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রতিবেদন করে থাকে। এর আগেও পত্রিকাটি বাংলাদেশকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কিন্তু তখন সরকারকে এতো বিব্রত বোধ করতে দেখা যায়নি। এ প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার বিব্রতবোধ করেছে এবং প্রতিবাদ জানিয়েছে। তিনি আরও বলেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন না করে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়। এ ধরনের সম্পর্ক স্থায়ী এবং কার্যকরী হয় না। কারণ, কোনো দলের সরকারই চিরস্থায়ী নয়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে দলীয় সরকারের পরিবর্তন হয়। তিনি বলেন, ভারতকে আমরা ট্রানজিট নাকি কোরিডোর দিচ্ছি এ বিষয়টি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। মূলত ভারতকে আমরা কোরিডোর দিচ্ছি। এর মাধ্যমে ভারত তাদের উত্তর-পূর্ব এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে অস্ত্র সরবরাহ করবে। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্ব এলাকার সীমান্ত রক্ষিত হয়ে যাবে। কাঁটাতারের বেড়ার মাধ্যমে এটাকে আর রক্ষা করা যাবে না। এতে করে ভারতের ওই অঞ্চলের বিভিন্ন ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশের মধ্যে ঢুকে যাবে

No comments:

Post a Comment