Wednesday 28 July 2010

সংবিধান এবং সরকারের গোপন এজেন্ডা

শা হ আ হ ম দ রে জা
সংবিধান সংশোধনের জন্য সরকারের নেয়া উদ্যোগ আস্থার পরিবর্তে জনগণের মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি করেছে। এর প্রথম কারণ সংবিধানসম্মত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরাসরি জাতীয় সংসদের মাধ্যমে পা না বাড়িয়ে ক্ষমতাসীনরা আদালতের একটি বিতর্কিত রায়কে অবলম্বন করেছেন, অজুহাত বানিয়েছেন। রায়টির নানাদিক নিয়ে এরই মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে পুনরাবৃত্তিতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। শুধু এটুকু স্মরণ করাই যথেষ্ট যে, এটা যে মামলার রায় সে মামলার আবেদনে পঞ্চম সংশোধনী কোনো বিষয় ছিল না। মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল পুরনো ঢাকার মুন সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে। এরই সূত্র ধরে ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট দেয়া রায়ে হাইকোর্টের বেঞ্চ পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগ উঠেছে প্রথম থেকে। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, বিচারপতি খায়রুল হক ও বিচারপতি ফজলে কবির আসলে নিজেদের এখতিয়ারের সীমা অতিক্রম করে রায়টি দিয়েছেন। এটা অনেকটা জুতা সেলাই করতে গিয়ে চণ্ডি পাঠ করার মতো ব্যাপার। দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদ জড়িত রয়েছে বলে একটি সিনেমা হলের মালিকানাসংক্রান্ত মামলার রায় দিতে গিয়ে পঞ্চম সংশোধনীর মতো রাষ্ট্রীয় বা সংবিধানের কোনো বিষয়কে টেনে আনা সমীচীন মনে করেননি আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, সংশোধনীসহ সংবিধানসংক্রান্ত সব বিষয়ে এখতিয়ার রয়েছে কেবল জাতীয় সংসদের। এ প্রসঙ্গে সাবেক বিচারপতি টিএইচ খানের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। একই মামলার লিভ টু আপিলের শুনানিতে অংশ নিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, পঞ্চম সংশোধনী দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদে পাস হয়েছিল। সেটা বাতিল বা সংশোধন করার এখতিয়ারও একমাত্র সংসদেরই, কোনো বিচারপতির নয়। টিএইচ খান আরো বলেছেন, সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ হাইকোর্ট বিভাগকে কিছু ক্ষমতা দিয়েছে সত্য, কিন্তু তাই বলে সংসদে পাস হওয়া কোনো সংশোধনী বাতিলের ক্ষমতা দেয়নি।
সাবেক বিচারপতি টিএইচ খানের যুক্তি ও বক্তব্যের পর্যালোচনায় পরিষ্কার হয়েছে, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করার মতো কার্যক্রমের এখতিয়ার সংবিধান শুধু জাতীয় সংসদকেই দিয়েছে। সংবিধান কীভাবে সংশোধন করতে হবে সে কথাও সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে। প্রয়োজন পড়লে কোনো বিচারপতি বড়জোর এর ব্যাখ্যা দিতে পারেন, কিন্তু নিজেই পঞ্চম সংশোধনীর মতো কোনো ‘অ্যাক্ট অব পার্লামেন্ট’কে বাতিল করতে পারেন না। এ সম্পর্কিত উদাহরণের সংখ্যাও কম নয়। অতীতে বিভিন্ন সময়ে প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি এফকেএমএন মুনীম, বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন এবং বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী সামরিক ফরমানের বৈধতা দিয়ে গেছেন। তারা সামরিক শাসনকে বাতিল না করে অনুমোদন দিয়েছেন। সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধস্তন আদালত হিসেবে হাইকোর্টের জন্য সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনা নেয়া ও মেনে চলা বাধ্যতামূলক। ফলে সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়ার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার এবং পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করার এখতিয়ার হাইকোর্টের কোনো বিচারপতির থাকতে পারে না। কারণ, সুপ্রিমকোর্টের পূর্ববর্তী প্রধান বিচারপতিরা এর বৈধতা দিয়ে গেছেন।
অন্যদিকে এ রায়কে কেন্দ্র করেই আওয়ামী লীগ সরকার তত্পর হয়ে উঠেছে। সরকার জাতীয় সংসদকে থানা-পুলিশের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। ক্ষমতাসীনরা এমনভাবেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন যেন থানা-পুলিশের মতো জাতীয় সংসদের জন্যও আদালতের রায় কার্যকর করা বাধ্যতামূলক! যেন ঠিক এ মুহূর্তে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল না করা হলে মহাভারত একেবারে অশুদ্ধ হয়ে যাবে! সংশয় বেড়ে যাওয়ার অন্য একটি কারণ হলো, ক্ষমতাসীনরা শুধু পঞ্চম সংশোধনীই বাতিল করতে চাচ্ছেন না, রায়টিকে অজুহাত বানিয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানও পুনর্বহাল করতে চাচ্ছেন—যদিও রায়ে তেমন কোনো নির্দেশনা নেই। এ জন্য তারা সংবিধান সংশোধন করতে উঠে-পড়ে লেগেছেন। কিন্তু এ প্রক্রিয়াতেও ক্ষমতাসীনরা নিজেদের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে মানুষের মনে আস্থা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে সংসদীয় কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করা দরকার। ‘সর্বদলীয়’ কমিটির ঘোষণা দিলেও সরকার প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে পর্যন্ত কমিটিতে রাখেনি। বিএনপির মাত্র একজন সদস্যের নাম চেয়ে বেগম খালেদা জিয়ার কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন সরকারি দলের চিফ হুইপ। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কার্যপ্রণালী বিধি অনুসারে চিফ হুইপ বিরোধী দলের নেত্রীকে এ ধরনের চিঠি লিখতে পারেন না। পারেন সংসদ নেত্রী তথা প্রধানমন্ত্রী কিংবা তার অনুপস্থিতিতে উপসংসদ নেত্রী সাজেদা চৌধুরী। বিষয়টি ক্ষমতাসীনদের না জানার কথা নয়। তা সত্ত্বেও চিফ হুইপকে দিয়ে চিঠি পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো, বিএনপি যাতে ক্ষুব্ধ হয়, কোনো সদস্যের নাম না পাঠায় এবং সংসদীয় কমিটিকে বর্জন ও প্রত্যাখ্যান করে। তেমন অবস্থায় সরকার জনগণকে বলতে পারবে, তারা বিরোধী দলকেও কমিটিতে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু বিরোধী দলই আসেনি! ক্ষমতাসীনরা একে কৌশল হিসেবে চমত্কার মনে করতে চাইলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা আসলে খুবই কাঁচা খেলা। অমন খেলার উদ্দেশ্য কিশোর-কিশোরীরাও বুঝতে পারে।
অন্য একটি কারণেও সরকারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়েছে। ‘সর্বদলীয়’ নামের সংসদীয় কমিটিতে জামায়াতে ইসলামী, বিজেপি ও এলডিপির কাউকে রাখা হয়নি। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে যে রাখা হবে না সে ঘোষণা ক্ষমতাসীনরা প্রথম থেকেই দিয়ে এসেছেন। এ ব্যাপারে বিগত কয়েক দিনে বিশেষ করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে খুবই সোচ্চার দেখা গেছে। টিভির টকশোসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মিস্টার সেনগুপ্ত পুনরাবৃত্তি করে বলেছেন, জামায়াতকে ‘রাখার প্রশ্নই ওঠে না’। অন্যদিকে সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে, এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার ক্ষমতাসীনদের রয়েছে কি না। কারণ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির পর জামায়াত বাংলাদেশের চতুর্থ জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। ১৯৮৬ সাল থেকে প্রতিটি সংসদে জামায়াত প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। বর্তমান সংসদেও দলটির প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। শুধু তাই নয়, ‘ডিজিটাল’ নির্বাচনে হারিয়ে দেয়া হলেও প্রতি আসনে গড়ে ৮৬ হাজার ৫৪৬টি করে ৩৮ আসনে জামায়াত পেয়েছিল ৩২ লাখ ৮৮ হাজার ৭৮২ ভোট। এর সঙ্গে রয়েছেন বাকি ২৬১ আসনে জামায়াতের ভোটাররা—যারা বিএনপিসহ চারদলীয় জোট প্রার্থীদের ভোট দিয়েছিলেন। সবচেয়ে রক্ষণশীল হিসেবে প্রতি আসনে যদি ১০ হাজার করে ধরেও ৩৮ আসনে প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে যোগ করা হয় তাহলে দেখা যাবে, দেশে জামায়াতের ভোটার রয়েছেন অন্তত ৫৮ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮২ জন। জামানত বাজেয়াপ্ত না হওয়াসহ সামগ্রিক অর্জনের ক্ষেত্রেও জামায়াত ছিল যথেষ্ট সম্মানজনক অবস্থানে। আওয়ামী লীগ চারটি আসনে এবং জাতীয় পার্টি ১২টি আসনে জামানত হারিয়েছে। ১৫৫৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ৯৩২ জনের অর্থাত্ ৬০ শতাংশেরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। কিন্তু জামায়াতের একজন ছাড়া কারো জামানত বাজেয়াপ্ত হয়নি। যার বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তিনিও ৩২ হাজার ৫২৭ ভোট পেয়েছিলেন। সুতরাং গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান থাকলে জামায়াতকে সংসদীয় কমিটিতে ‘রাখার প্রশ্নই ওঠে না’ ধরনের মন্তব্য করার সুযোগ থাকতে পারে না। ‘সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল’ দলগুলোর সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হলে সে কমিটিতে জামায়াতের এমপিদের রাখতে হবে। এটাই গণতন্ত্রের নির্দেশনা। অন্যদিকে বাদ তো দেয়া হয়েছেই, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে দিয়ে একথা পর্যন্ত বলানো হয়েছে যে, কমিটিতে জামায়াতকে ‘রাখার প্রশ্নই ওঠে না’। প্রশ্ন কেন উঠবে না—সে প্রশ্নই বরং জোরেশোরে উঠেছে। কারণ, সরকার এমন দু-একজনকেও কমিটিতে রেখেছে, যারা নিজেদের দলের নাম নিয়ে নির্বাচন করার সাহস পর্যন্ত পাননি। জিতেছেন আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা নিয়ে।
১৯৭২ সালের সংবিধান পুনর্বহাল করার আড়ালে সরকারের গোপন কয়েকটি এজেন্ডা রয়েছে বলে প্রচারণার ফলেও জনমনে ভীতি ও সংশয় ছড়িয়ে পড়েছে। এসব বিষয়ে খোলামেলাভাবেই জানিয়ে চলেছেন ক্ষমতাসীনরা। তারা বলেছেন, সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল বাতিল করা হবে। ক্ষমতাসীনরা অবশ্য ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন। যেমন বিভিন্ন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কিছু ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় ছাড়া বর্তমান সংবিধানকে সম্পূর্ণরূপে ১৯৭২-এর অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়া হবে। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ ও রাষ্ট্রধর্ম প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়গুলোর মধ্যে প্রধান। কথার মারপ্যাঁচে প্রধানমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছেন, ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনর্বহাল করা হলেও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বাদ দেয়া হবে না। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হাইকোর্টের রায় অনুসারে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বহাল থাকার কথা নয়। সরকার রাষ্ট্রধর্ম-সংক্রান্ত বিধানও বাতিল করে দেবে। একই সঙ্গে ধর্মভিত্তিক দল বাতিল করার পাশাপাশি সংবিধানে এমন আরো অনেক পরিবর্তনও সরকার করবে—যেগুলো বিশেষ করে মুসলিম জনগণের চিন্তা, বিশ্বাস ও স্বার্থের পরিপন্থী। প্রধানমন্ত্রী শুধু নন, অন্য মন্ত্রী ও নেতারাও বিভিন্ন সময়ে সরকারের এসব উদ্দেশ্য পরিষ্কার করেছেন। যেমন—সর্বশেষ উপলক্ষে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ থাকবে না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও সমপ্রতি বেশ কিছু উপলক্ষে স্পষ্টভাষায় জানান দিয়েছেন। তিনি আবার নাম ধরে বলেছেন, ১৯৭২-এর সংবিধান পুনর্বহাল করা হলে জামায়াতে ইসলামীর মতো ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতি করার সুযোগ থাকবে না। এসব বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেশপ্রেমিকরা সঠিকভাবেই আশঙ্কা করছেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার আড়ালে সরকার আসলে ইসলামী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে এমন কিছু বিষয়, যেগুলোর মীমাংসা না করে সংবিধান সংশোধন করার চেষ্টা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যেমন—১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যেতে চাইলে সরকারকে প্রথমেই ঘোষণা দিয়ে স্বীকার করতে হবে, তাদের নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ও অন্যায় করেছিলেন। জনগণকে এ কথাও জানাতে হবে যে, ১৯৭২ সালের সংবিধানও ‘অক্ষত’ ছিল না। বরং মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সংবিধানকে চার-চারবার ‘কাটাছেঁড়া’ এবং প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় ‘ক্ষতবিক্ষত’ করা হয়েছিল। ‘কাটাছেঁড়া’ এবং ‘ক্ষতবিক্ষত’ করার কাজটুকু করেছিলেন স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রবর্তন করেছিলেন এবং এই আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগ করে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন চালিয়েছিলেন। এর পরপর তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ভারতের হাতে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেরুবাড়ি তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু আদায় করতে পারেননি তিনবিঘা করিডর। পাশাপাশি রয়েছে চতুর্থ সংশোধনী—যার মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তন করা এবং বাকশালের একদলীয় শাসন চাপানো হয়েছিল। সমগ্র এই প্রক্রিয়া ও কর্মকাণ্ডের একমাত্র নির্দেশদাতা, নিয়ন্ত্রক ও লাভবান ব্যক্তি ছিলেন শেখ মুজিব। ‘জাতীয় প্লাটফর্ম’ হিসেবে ‘সাময়িক কালের’ জন্য বাকশাল গঠন করা হয়েছিল—এ ধরনের যুক্তি দেয়া হলেও তেমন কোনো কথা চতুর্থ সংশোধনীর কোথাও কিংবা বাকশালের গঠনতন্ত্রে ছিল না। গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারা-উপধারা বরং এ কথাই প্রমাণ করেছে যে, রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের প্রশ্নাতীত একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য নিয়েই বাকশাল গঠন করা হয়েছিল। তিনি এমন একজন চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন, যাকে নির্বাচিত করার কোনো প্রক্রিয়া বা বিধানেরই উল্লেখ ছিল না বাকশালের গঠনতন্ত্রে বা সংবিধানে। অর্থাত্ পরোক্ষভাবে এ কথাই ঘোষণা করা হয়েছিল যে, শেখ মুজিব আজীবন বাকশালের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকবেন।
১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে চাইলে মাঝখানে প্রবর্তিত বাকশাল ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকারকে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে। স্বীকার করতে হবে, শেখ মুজিব বহুদলীয় গণতন্ত্র হত্যা করেছিলেন। সরকারকে সেই সঙ্গে বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করতে হবে এবং ভারতের দখল থেকে বেরুবাড়ি ফেরত আনতে হবে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ ও উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দিয়ে তারা সংবিধানের এখানে কিছু ওখানে কিছু পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন। তা ছাড়া এ ধরনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোয় জনমত যাচাই এবং গণভোট অনুষ্ঠান করাও গণতন্ত্রে একটি অবশ্যপালনীয় কর্তব্য— যেমনটি দ্বাদশ সংশোধনী পাস করার পর করেছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে শেখ মুজিব প্রবর্তিত রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি বাতিল করে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন উপলক্ষে সংসদে সংবিধানের সংশোধনী সর্বসম্মতিক্রমে পাস করা সত্ত্বেও এ প্রশ্নে গণভোট আয়োজন করা হয়েছিল। অন্যদিকে বাকশাল গঠন ও চতুর্থ সংশোধনী পাস করার সময় শেখ মুজিব যেমন গণতন্ত্রসম্মত চিন্তাটুকু করেননি, তেমনি বর্তমান পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও করছেন না। গণভোট দূরে থাকুক, সরকার এমনকি বিরোধী দলগুলোকে পর্যন্ত সংসদীয় কমিটিতে নেয়নি। এ জন্যই জনগণের সমর্থন ও গ্রহণযোগ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারের সফলতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সরকারের উচিত সংবিধান সংশোধনের সমগ্র প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলগুলোকে সঙ্গে রাখা। দেশের সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞদেরও সম্পৃক্ত করা দরকার। কারণ, সংবিধান পুতুল খেলার মতো বিষয় নয়।
লেখক : সাংবাদিক
ই মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
http://amardeshonline.com/pages/details/2010/07/23/35828%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8

No comments:

Post a Comment