Friday 13 August 2010

ছয় মাসে ৪৫২ ছাত্র হল ছেড়েছেন



রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল থেকে গত ছয় মাসে ৪৫২ জন সাধারণ ছাত্র হল ছেড়েছেন। ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনে অতিষ্ঠ হয়ে এই শিক্ষার্থীরা তাঁদের নামে বরাদ্দ সিট বাতিল করে চলে যান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শূন্য হওয়া এসব সিট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হলেও এর বিপরীতে আবেদনপত্র জমা পড়ছে কম।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আবদুস সোবহান বলেন, শিক্ষার্থীরা কী কারণে হল ছাড়ছে, তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেওয়া হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলগুলোতে পুলিশ মোতায়েনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদ্য স্থগিত হওয়া কমিটির সভাপতি আওয়াল কবির বলেন, ‘আমার জানামতে, ছাত্রলীগের কোনো নেতা-কর্মী চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নন।’ শিক্ষার্থীদের সিট বাতিল করে চলে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যাঁরা সিট বাতিল করে চলে গেছেন, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া হলে থাকতে ভালো না লাগলে কেউ সিট বাতিল করে চলে যেতেই পারেন। এর জন্য ছাত্রলীগ দায়ী নয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ছয় মাসে বিভিন্ন হলের অন্তত ৪৫২ জন আবাসিক শিক্ষার্থী সিট বাতিল করে চলে যান। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের ওপর শিবিরের হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত শাহ মখদুম (এসএম) হলের ৬৮ জন, সৈয়দ আমীর আলী হলের ৩০, নবাব আবদুল লতিফ হলের ৩৩, শহীদ শামসুজ্জোহা হলের ৪৮, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ৮৪, মাদার বখ্শ হলের ৬৯, জিয়াউর রহমান হলের ৩৭, শহীদ হবিবুর রহমান হলের ৩৮, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক হলের ২৫ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের অন্তত ২০ জন সাধারণ শিক্ষার্থী তাঁদের নামে বরাদ্দ থাকা সিট বাতিল করে হল ছাড়েন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি গঠিত হয়। এর পর থেকেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন ধরনের হুমকিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জিম্মি হয়ে পড়েন। তবে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিরের সংঘর্ষে ছাত্রলীগের কর্মী ফারুক হোসেন নিহত হওয়ার পর শিবিরের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান। এরপর ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে যায়।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে মারধরের পাশাপাশি শিবিরের কর্মী আখ্যা দিয়ে কিংবা ছাত্রলীগের কর্মী ফারুক হত্যায় জড়িত বলে পুলিশে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থীর অভিযোগ, তিনি মাদার বখ্শ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। সম্প্রতি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে তাঁকে মারধর করা হয়। হলে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে সিট বাতিল করে তিনি ক্যাম্পাসের বাইরে একটি বেসরকারি ছাত্রাবাসে থাকছেন।
এস এম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এমন একজনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, হলে থাকার সময় তিনি কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সম্প্রতি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে ‘ছাত্রশিবিরের কর্মী’ আখ্যা দিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা দিতে না পারায় তিনি সিট বাতিল করে হল ছেড়ে দিয়েছেন।
শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের কর্মীরা ভয়ভীতি দেখিয়ে সম্প্রতি তাঁর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নিয়েছে। বাধ্য হয়ে তিনি সিট বাতিল করেছেন।
আরও অনেক শিক্ষার্থী প্রথম আলোর কাছে এ ধরনের অভিযোগ করেছেন। তাঁদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নাম প্রকাশ করা হলো না।
অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী জানান, শিবির ‘ইয়ানত’-এর নামে চাঁদা আদায় করত। আর ছাত্রলীগ বিভিন্ন অজুহাতে চাঁদা আদায় করছে। ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি থেকে সাংবাদিক কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। জিয়াউর রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ও একটি জাতীয় দৈনিকের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন কর্মী সম্প্রতি তাঁর কাছ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা নেন। বিষয়টি হল প্রশাসন ও ছাত্রলীগের নেতাদের জানালেও এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরে সাংবাদিকদের জানালে শেষ পর্যন্ত ওই টাকা ফেরত দেওয়া হয়।
শামসুজ্জোহা হলের আবাসিক ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ইব্রাহিম হোসেনের অভিযোগ, ছাত্রলীগের কিছু কর্মীর চাঁদা দাবিতে তিনি অতিষ্ঠ। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের মিছিল-সমাবেশেও অংশ নেওয়ার জন্য তাঁকে চাপ দেওয়া হয়।
এদিকে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ ও শিবিরের সংঘর্ষের পর বিভিন্ন হলের অনেকের কক্ষ তালাবদ্ধ ছিল। কিছু কক্ষ শিবিরের নেতা-কর্মীর হলেও অধিকাংশই ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের। এসব কক্ষের তালা ভেঙে কম্পিউটার, কাপড়চোপড় ও বইখাতা লুট করা হয়। এসএম হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সেলিম জানান, ছাত্রলীগ-শিবিরের সংঘর্ষের আগে তিনি বাড়ি চলে যান। সংঘর্ষের কয়েক দিন পরে হলে ফিরে দেখেন তাঁর কম্পিউটারসহ অনেক কিছু খোয়া গেছে। পরে জানতে পারেন, একটি ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা তালা ভেঙে এসব নিয়ে গেছেন। বিষয়টি হলের প্রাধ্যক্ষকে জানালে তিনি কোনো ব্যবস্থা নিতে অসহায়তা প্রকাশ করেন।
বিভিন্ন হল সূত্র জানায়, শিক্ষার্থীরা সিট বাতিল করে চলে যাওয়ায় শূন্য সিটগুলো নতুনভাবে বরাদ্দের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এতে শিক্ষার্থীদের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। শামসুজ্জোহা হলে দুই মাস আগে ১২০টি শূন্য সিটের বিপরীতে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। এতে আবেদনপত্র জমা পড়ে মাত্র ৬০টি। সবাইকে সিট দেওয়া হলেও হলে উঠেছেন ৫৪ জন। অন্য হলগুলোতে একই অবস্থা বলে জানা গেছে।
শের-ই-বাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ সুভাষ চন্দ্র শীলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের হল ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি জানান, কয়েকজন শিক্ষার্থী সিট বাতিল করে চলে গেছেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজির কারণে শিক্ষার্থীরা চলে গেছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে হল ছেড়েছেন।’
শামসুজ্জোহা হলের প্রাধ্যক্ষ মর্ত্তুজা খালেদ সাধারণ শিক্ষার্থীদের হল ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত নাকি অন্য কোনো কারণে হল ছেড়েছেন তা ওই শিক্ষার্থীরাই ভালো বলতে পারবেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, শিবিরের সশস্ত্র হামলায় ছাত্রলীগের কর্মী ফারুক নিহত হওয়ার পর ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপতৎপরতার কারণে তা এরই মধ্যে ম্লান হয়ে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য শিক্ষার্থীরা লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতিসহ বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করেন। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের সভাপতি মলয় ভৌমিক বলেন, ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা দুঃখজনক। এটা চলতে থাকলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন পেয়ে মৌলবাদী সংগঠন ছাত্রশিবির লাভবান হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, চাঁদাবাজি কিংবা ভয়ভীতি দেখানো বা লুটপাটের ঘটনার সঙ্গে কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-08-14/news/86325

No comments:

Post a Comment